প্রবন্ধ রক্তকরবীর নন্দিনী — মানবতার প্রতীক
'রক্তকরবী' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রূপক সাংকেতিক নাটক'গুলোর অন্যতম। ইংরেজিতে যাকে বলে 'Divine Essence'। একবাক্যে বললে "The analogy of being in God and in Creatures"। আবার রূপক সাংকেতিক নাটকের ইংরেজি অর্থ হয় "Allegorical Drama"। বাংলায় ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, এটি এমন এক ধরণের নাটক যার কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র প্রভৃতি উপলক্ষ্য মাত্র কিন্তু মূল লক্ষ্য হচ্ছে এর অন্তর্নিহিত ভাব বা তত্ত্ব। এককথায় কাহিনীর সমান্তরাল গৃঢ় ভাবার্থকে ব্যক্ত করা। এই পর্যায়ে 'রক্তকরবী' ছাড়াও তাঁর রচিত নাটকগুলো হল 'ডাকঘর', 'শারদোৎসব', 'রাজা', 'অচলায়তন', 'ফাল্গুনী', 'মুক্তধারা' ও 'তাসের দেশ' ইত্যাদি।
শিলং শৈলবাসে থাকাকালীন ১৯২৩ (বাংলা ১৩৩o) সালে রবীন্দ্রনাথ এই নাটকটা রচনা করেন 'যক্ষপুরী' নামে। ১৯২৪ (বাংলা ১৩৩১) সালে প্রবাসী পত্রিকায় যখন প্রকাশিত হয় তখন রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের নাম বদল করে রাখেন 'রক্তকরবী'। ১৯২৬ (বাংলা ১৩৩৩) সালে এই নাটক প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্র সমালোচকের মতে 'রক্তকরবী' রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক "রূপক সাংকেতিক নাটক"। 'রক্তকরবী' রবীন্দ্রনাথের পরিণত মানসের নাট্যপ্রয়াস। তাঁর এই নাটকের সংলাপও কাব্যময়-গদ্যে নির্মিত, গানের খুব একটা আধিক্য নেই। নাটকের বিষয়বস্তুতে জড়বাদী যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রণা প্রকট হয়েছে। সমালোচক শিশিরকুমার দাশের ভাষায় -- "মানুষের প্রবল লোভ কিভাবে জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্র ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিণত করেছে এবং তার বিরূদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের প্রতিফলন ঘটে এই নাটকে।"
জাগতিক জীবনকে জয় করার প্রবল বাসনায় যক্ষপুরীর মকররাজ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ব্যবহার করে, পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে ধনরত্ন (সোনা) সংগ্রহ করে তার সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছেন। তার সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শক্তি, দম্ভও বৃদ্ধি পেয়েছে। মকররাজের এই বস্তুবাদী জাগতিক সম্পদ সংগ্রহের খেলায় সমগ্র রাজ্যই যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। সামগ্রিক অর্থে তার রাজ্যে মানবিকতা, মানবকল্যাণ ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমবোধ লোপ পেয়েছে। মকররাজ এই মূর্তিমান দৈত্য-জীবনে সম্পদ সংগ্রহ ও তা রক্ষা করার প্রয়াসে এই চরম পরিণতিতে জীবনের নিরানন্দ ও ক্লান্তিকর কারাগার থেকে অবশেষে মুক্তি কামনা করে। রাজার এই অবরূদ্ধ বাস্তববৃত্তে বন্দী জীবনে মুক্তির অবিরল স্রোতধারা, প্রেম ও ভালোবাসার শাশ্বত বাণী নিয়ে নাট্যকাহিনীতে প্রবেশ করে মানবী নন্দিনী।
"ভালোবাসি ভালোবাসি --
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি...।"
( রাগ : খাম্বাজ, তাল : দাদরা, পর্যায় : প্রেম, রচনাকাল : ১৩৩১ বঙ্গাব্দ/১৯২৪ খৃষ্টাব্দ)
পয়সার যেমন এপিঠ-ওপিঠ থাকে, তেমনি 'রক্তকরবী'র মানবী নন্দিনীর মনের জোর যদি রঞ্জন হয় তাহলে নন্দিনীকে জীবনে বাঁচার এবং প্রেম ও ভালোবাসার শাশ্বত বাণী শিখিয়েছে বিশুপাগল তার গানের সামান্যতম ডালি নিয়ে।
"পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে,
আয় আয় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,
মরি হায় হায় হায়...।"
নন্দিনী রাজকে বলে -- দেখছ না, পৌষের রোদ্দুর পাকা ধানের লাবণ্য আকাশে মেলে দিচ্ছে?
"হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে
দিগবধূরা ধানের ক্ষেতে --
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে,
মরি, হায় হায় হায়...।"
নন্দিনী আবারও রাজাকে বলে -- তুমিও বেরিয়ে এসো রাজা, তোমাকে মাঠে নিয়ে যাই।
"মাঠের বাঁশি শুনে শুনে
আকাশ খুশি হ'ল।
ঘরেতে আজ কে রবে গো,
খোলো খোলো দুয়ার খোলো...।"
(রাগ : বিভাস-বাউল, তাল : দাদরা, পর্যায় : প্রকৃতি)।
রাজা নন্দিনীকে জিজ্ঞাসা করেন -- আমি মাঠে যাব? কোন্ কাজে লাগব।
নন্দিনী তখন রাজাকে বলে -- "মাঠের কাজ তোমার যক্ষপুরীর কাজের চেয়ে অনেক সহজ।
সোনার পিন্ড কি তোমার ঐ হাতের আশ্চর্য ছন্দে সাড়া দেয়, যেমন সাড়া দিতে পারে ধানের ক্ষেত।"
প্রকৃতি কন্যা নন্দিনী কত সহজে যক্ষপুরীর ধন আগলে বসে থাকা রাজাকে কথাটা বলতে পারে।
পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসী মানসিকতার নগ্ন রূপটাকে রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে দেখিয়েছেন, তা এক বাক্যে সকল সমালোচকই স্বীকার করেছেন। এক প্রেমহীন পুরুষের (রাজার চরিত্র) জীবনে এক নারীর (নন্দিনী) উপস্থিতিতে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে শাশ্বত প্রেমের উপলব্ধিতে উত্তরণই যেন 'রক্তকরবী' নাটকের মূল অবলম্বন
।
নাটকের শুরুতে নন্দিনীর একটা প্রতীক্ষা --
"আজ রঞ্জন আসবে।"
আর পাঠককূল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, এই বুঝি সম্পদের প্রাচুর্যপূর্ণ কারাগারের অন্তরাল থেকে রাজা বাইরে বেরিয়ে আসবে। দুটো প্রতীক্ষার দুটো প্রতিক্রিয়া আশ্চর্য বন্ধনে সংবেশিত হয়েছে। দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজা অন্ধকারের আবরণ ভেঙে প্রাচুর্যে ভরা কারাগার থেকে যখন বাইরে আবির্ভূত হবেন তখন কী হবে, কী দেখবে পাঠককূল? এই ভাবনার থেকে আরো বেশি আনন্দ, আরো বেশি মাধুর্যের আশ্বাস -- যান্ত্রিক জাগতিক মানব জীবনে প্রেম, ভালোবাসার শাশ্বত বাণী নিয়ে বাইরে আসছে নন্দিনীর 'রঞ্জন'। নন্দিনীর জীবনের ত্যাগের ধর্ম, ভালোবাসার দান রাজাকে ভুল বুঝতে ও যথার্থ প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। ছকবাঁধা জীবনের অভ্যাসের বৃত্তাবদ্ধ আবহমন্ডলের প্রতিক্রিয়াই এই প্রতীক্ষার জন্ম দেয় এবং বৃত্তের বাইরে এসে মুক্তির স্নান করে। তাইতো বিশুপাগলের মতো লোক নন্দিনীকে বলে -- যক্ষপুরীতে ঢুকে অবধি এতকাল মনে হত, জীবন হতে আমার আকাশখানা হারিয়ে ফেলেছি, মনে হত, এখানকার টুকরো মানুষদের সঙ্গে আমাকে এক ঢেঁকিতে কুটে একটা পিন্ড পাকিয়ে তুলেছে। তার মধ্যে ফাঁক নেই। এমন সময় তুমি এসে আমার মুখের দিকে এমন করে চাইলে, আমি বুঝতে পারলুম আমার মধ্যে এখনো আলো দেখা যাচ্ছে।
নন্দিনী বললে -- পাগলভাই, এই বন্ধ গড়ের ভিতরে কেবল তোমার-আমার মাঝখানটাতেই একখানা আকাশ বেঁচে আছে। বাকি আর সব বোজা।
বিশুপাগল বলে -- সেই আকাশ আছে বলেই তোমাকে গান শোনাতে পারি --
"তোমায় গান শোনাব তাই তো
আমায় জাগিয়ে রাখ
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক'
ওগো দুখজাগানিয়া...।"
(রাগ : পিলু, তাল :কাহারবা, পর্যায় : প্রেম)
নন্দিনী শুধায় -- বিশুপাগল, তুমি আমাকে বলছ 'দুখজাগানিয়া'?
বিশুপাগল বলে -- তুমি আমার সমুদ্রের অগম পারের দূতী। যেদিন এলে যক্ষপুরীতে, আমার হৃদয়ে লোনা জলের হাওয়া এসে ধাক্কা দিলে।
অন্যদিকে রাজাকে মানসিক উত্তরণে, তাকে ভ্রান্ত প্রেমভাবনা থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছে 'নন্দিনী'। বারে বারে রাজা নন্দিনীকে ফিরিয়ে দিলেও নন্দিনীর কথা রাজাকে শুনতে হয়েছে। নন্দিনীর কাছ থেকে বিশুপাগল জানতে পারে যে, কেমন করে রাজা নন্দিনীকে পাশে বসিয়ে শিশুর মতো কৌতূহল নিয়ে তার আর রঞ্জনের ভালোবাসার গল্প শুনেছেন। শুধু তাই নয়, নন্দিনী যখন জানিয়েছে রঞ্জনের জন্য সে তার প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে, তখন রাজার রীতিমত বিস্ময় জেগেছে। ভালোবাসার জন্য যে প্রাণ পযর্ন্ত দেওয়া যায়, রাজার বস্তুসর্বস্ব মন বিশ্বাসই করতে পারেনি। তিনি দিনের পর দিন কেবলই মরা শক্তির সাধনা করেছেন, কিন্তু ভালোবাসার মধ্যেও যে এত শক্তি থাকতে পারে তা মকররাজ ভাবতে পারেননি।
যে হৃদয় ধর্মকে, যে যৌবনকে রাজা ভুলে থেকেছেন। রঞ্জনের মধ্যে সেই হৃদয়, সেই যৌবনের জাদুশক্তি আছে। তাই অলক্ষ্যে থেকেও রঞ্জন নন্দিনীর হৃদয়কে, ভালোবাসাকে জয় করতে পেরেছে কিন্তু রাজা প্রবল ক্ষমতার মালিক হয়েও নন্দিনীর হৃদয় ছুঁতে পারেননি। তাইতো নন্দিনীর ত্যাগের শক্তিতে দীক্ষিত শাশ্বত ভালোবাসার পরিচয় রাজার মানসিক চিন্তার উত্তরণ ঘটিয়েছেন। তাই মকররাজ অবশেষে চেয়েছিলেন নন্দিনী আর রঞ্জনের মিলন ঘটাতে। যে যৌবনকে তিনি উপেক্ষা করেছেন, রঞ্জনের মধ্যে তিনি সেই যৌবনের জাদুশক্তি প্রত্যক্ষ করেন, তাই নন্দিনীর নিষ্কলঙ্ক প্রেম আর রঞ্জনের সেই যৌবনের জাদুশক্তিকে মিলিয়ে দিয়ে তিনি নিজ জীবনের অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস তিনিই প্রকারান্তরে রঞ্জনের হত্যাকারী হয়ে সেই স্বপ্নের সম্ভাবনাকে ধুলিসাৎ করে ট্র্যাজিক হিরো হয়ে গেলেন।
রাজা দিনের পর দিন শুধু শক্তির সাধনাই করে গেছেন, যৌবনকে ছুঁতে পারেননি। নন্দিনী তাই বার বার চেয়েছে রাজাকে তার জালের আবরণ থেকে, প্রাণহীন শক্তির সাধনা থেকে মুক্ত করে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে। নন্দিনী একলা রাজার যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করতে পারত। তাই সে বিশুপাগলকে বলেছে --
"ও যেন হাজার বছরের বটগাছ, আমি যেন ছোট্ট পাখি। ওর ডালের একটা ডগায় কখনো যদি একটু দোল খেয়ে যাই নিশ্চয় ওর মজ্জার মধ্যে খুশি লাগে। ঐ একলা প্রাণকে সেই খুশিটুকু দিতে ইচ্ছা করে।"
নন্দিনীকেও রাজা একবার বলেছিলেন --
"আমার অনবকাশের উজান ঠেলে তোমাকে ঘরে আনতে চাই নে। যে দিন পালের হাওয়ায় তুমি অনায়াসে আসবে সেই দিন আগমনীর লগ্ন আসবে। সেই হাওয়া যদি ঝড়ের হয় সেও ভালো। এখন সময় হয়নি।"
আজ সেই সময় এসেছে। রঞ্জনকে হত্যা করে রাজার পরিণতি ট্র্যাজিক হলেও, সেই যৌবনকে আজ ছুঁতে পেরেছেন। আজ তাই নন্দিনীর সঙ্গে রাজার কোন বিরোধ নেই। যৌবনের নতুন ধর্মে দীক্ষিত রাজা আজ তাই জালের আবরণ ছিন্ন করে নিজের শক্তির বিরুদ্ধে নিজেই লড়াইয়ে নেমেছেন এবং সেই লড়াইয়ে আর তিনি একা নন। নন্দিনীই তার পাশে দাঁড়িয়েছে। তাই রাজার ট্র্যাজেডির মধ্যে কোথাও যেন একটা সান্তনার সুর আছে, হাহাকার নেই। বেদনা নেই, আছে প্রাপ্তি।
সমাপ্ত
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.