গল্প

গল্প জগন্নাথের ফুলবাগান

জগন্নাথের ফুলবাগান

লেখক : সংঘমিত্রা রায়

" ওরে আমি দেখলে পা ভাইঙ্গা ফালাইমু ! এতো বড় হইছে বাপের কষ্ট বুঝে না কি পুলার জন্ম দিছো হৈম। ওর লাইগা আমার মান ইজ্জত সব গেল । "

" মান ইজ্জত যাওনের কি আছে । ছেলেটা এমন কি বড় হইছে কাম করব । আর কাম করে নাই দেইখ্যা জগা আমার পুলা । আর বাকিরা কাম করে হের লাইগা তারা তোমার পুলা।"

" তর্ক কইরো না যাও তোমার পুলারে লইয়া আমার বাড়ি থাইকা চইলা যাও ।"

" এতো কথা শুনাইও না দেখবা একদিন ঠিক চইলা যামু ।"

" তাই যাও ।"



সবাই যখন বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকে তখনই হৈমবতী খেতে দেয় জগন্নাথকে। এখন ছেলেরা মাঠে কাজ করতে গেছে আর বৌমারা পুকুরে কাজ করছে । তাই সুযোগ বুঝে জগন্নাথকে খেতে ডাকল হৈমবতী। সেই কাল রাতে খেয়েছিল এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে সবার খাওয়া শেষ তবু ও পেটে কিছু পড়েনি জগন্নাথের। সারাদিন কোথায় ছিল কে জানে ! খড়ের ঘরের পাশে ওকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চুপিচুপি খেতে ডাকলেন হৈমবতী। জগন্নাথ এসেই খেতে শুরু করে দিল। খুব ক্ষিদে পেয়েছে দেখলেই বোঝা যায় ।

" তাড়াতাড়ি খাইয়া নে বাপ্ , কেউ আইয়া পড়লে কথা শুনাইব তোরে। আমার ঔসব শুনতে ভাল লাগে না ।"

" শোনাক কথা ! আমার ঔসব কথায় কিছু হয় না । একটু পুঁটিমাছের পাতুড়ি দেও না। খুব ভালো লাগছে খাইতে ।"

"তোর তো শরীরের চামড়া গণ্ডারের মতোন ! তাই কিছু গায়ে লাগে না । কিন্তু আমি তো মা তাই সকলে যখন তোকে যখন অকর্মণ্য কইয়া গাল দেয় আমার খুব কষ্ট হয় রে জগা !বয়স তো কম হইল না এখন কোন কামে লাইগা পড়। তাইলে কেউ আর কথা শোনাইব না ।"

" করুম মা কাম ! তুমি চিন্তা কইরো না !

একদিন দেখবা সবাইরে তাক লাগাইয়া দিমু !"

"হেই দিন কবে আইবো ভগবান জানে ! হয়তো আমি মইরা গেলে তুই কামে লাগবি ততদিনে হগলের কথা শুনতে শুনতে আমি এমনিতেই শেষ হইয়া যামু ।" " এমন কথা কইও না মা আমি তোমারে মরতে দিমু না দেখবা আমি একদিন তোমার চোখের জল মুইছা দিমু । "

জগন্নাথ ওরফে জগা হৈমবতী আর বলরাম দাসের ছোট ছেলে । নয়নপুর গ্রামের একজন চাষী বলরাম দাস । নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ ওরা । বলরামের পাঁচ ছেলে, জগন্নাথ সবার ছোট । বাকিরা সবাই চাষবাস করে , নিজের কিছু জমি আছে তাতে সারাবছর চাষবাস করে যখন চাষবাস থাকে না অন্যত্র কাজ করে , মাছ ধরে মোটকথায় কেউ বসে নেই সবাই কিছু না কিছু রোজগার করছে । তিনজন বিবাহিত ওদের ছেলেমেয়ে আছে সবাই এখনো একসঙ্গেই থাকে । সংসার বেশ বড় । প্রতিবছর বন্যা, খরা, পোকায় অনেক ফসল নষ্ট হয় । এরপর চাষবাস করে যা আয় হয় তাতেই কোন রকমে ওদের সংসার চলে , আর যে যা পারে তাই করে । তবে এতো লোক বেশ কষ্টেই চলে ওদের । ছোটছেলে জগন্নাথ একেবারে অকর্মণ্য। প্রাইমারী স্কুল অবধি পড়াশোনা করেছে। এরপর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় । প্রথম প্রথম কেউ কিছু বলেনি কিন্তু এরপর থেকেই সবার একই কথা জগন্নাথ যেন চাষবাসে হাত লাগায় । কিন্তু এতো বলার পরও জগন্নাথ সংসারের কোন কাজ করে না। ওর বয়স এখন একুশ বছর । বলরাম ওকে খাবার দিতে বারণ করে দিয়েছে । অন্য ছেলেরা ও বলেছে জগন্নাথ যদি জমিতে কাজ করতে না যায় তাহলে ওকে খেতে দেওয়া যেন না হয় । কিন্তু হৈমবতী তো মা তাই দিনে একবেলা হলেও সবার চোখের আড়ালে ওকে খেতে দেয়। কখনও নিজের ভাগ থেকেই কিছু খাবার জগন্নাথকে দেয় । এরজন্য তাকে ও অনেক কথা শুনতে হয়।

ক্ষুধার্ত জগন্নাথ খুব তাড়াতাড়ি খেতে লাগল। হৈমবতীর সব কথা তার কানে ঢুকছে না । খাওয়া প্রায় শেষ বলরাম হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন । এরমধ্যে কেউ তাকে খবরটা দিয়ে দিয়েছে।

" একি হৈম ! তুমি ওরে কেন খাইতে দিলা।কাইল থাইকা আমি তোমার ভাত বন্ধ করুম। নইলে তোমাগো শিক্ষা হইব না ।"

" আমার লাইগা মারে কষ্ট দিও না বাবা । ঠিক আছে কাইল থাইকা আমি আর খাইতে আইমু না।"

" কি কছ্ জগা না খাইয়া থাকতে পারবি । তার চাইতে কামে লাইগা পড় তাইলে কেউ কিছু কইতে পারব না । হগলের মুখে ঝামা ঘইসা দে। " - হৈমবতী বলল ।

" ও নাকি কাম করব ।কি ছেলের জন্ম দিলা হৈম ঘরের খাইয়া বনের মোষ তাড়ায়। এই জগা তুই ঔ বাঁজা জমিতে সারাদিন মাটি কাটিস কেন?" " ফুলের গাছ লাগামু তাই !"

" কি ফুলের গাছ লাগাইবি ! যে জায়গায় একটু ঘাসও ভালোমতোন উঠে না , একটা গাছ হয় না ঔখানে নাকি উনি ফুলের গাছ লাগাইবেন। আর ফুলের গাছ লাগাইয়া কি হইব , কিভাবে পেটের ভাত জোগাড় হইব সেই চিন্তা কর। এইরকম চললে আমি তোমাগো দুজনেরই বাড়ি থাইকা তাড়াইয়া দিমু । কথাডা মনে রাইখো।"

বলরাম গটগট করে চলে যান। পিছনে এসে ওর দুই বৌমা এসে দাড়িয়েছিল । তারাও নানান কথা বলতে থাকে , ফোড়ন কাটতে থাকে । হৈমবতী , জগন্নাথকে নানা কথা শুনায় হৈমবতী কিছু বলতে পারেন না তার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে জগন্নাথের জন্য ।

বলরামের দুই বিঘার মতো জমি আছে ওখানে কোন চাষবাস হয় না ।সারা জমিতে ছোট ছোট পাথর রয়েছে । জমিটা একটু উঁচু , সবাই ওটাকে বাঁজাজমি বলে। জগন্নাথ ওখানে মাটি খুঁড়ে পাথর বের করে । এতে বেশ কিছুদিন লেগে যায় । এরপর ওখানে কয়েক রকমের গাঁদা ফুলের গাছ লাগাতে থাকে । পাশে কয়েক ধরনের গোলাপ ফুলের গাছ ও লাগিয়েছে । তারপর রোজ সকাল থেকে বিকেল অবধি ঔ গাছগুলোর পিছনে লেগে থাকে । গাছে জল দেয় , সারা মাঠ খুঁজে গোবর এনে গাছগুলোর গোড়ায় দেয়।

জগন্নাথের বাড়ির লোকজন , গ্রামের লোকেরা ওকে পাগল বলছে ।" জগা পাগল হইয়া গেছে নইলে এই বাঁজা জমিতে কেউ গাছ লাগায়। যে জমিতে কোনদিন কিছু হয় নাই। সেইখানে নাকি ও ফুলচাষ করব।"

" আর ফুল চাষ কইরা কি হইব পেট ভরব না। ঔ অকর্মণ্য পুলার দ্বারা জীবনে কিছু হইব না । "

" বাপ যতদিন বাইচা আছে ততদিন খাইব।এরপর ভাইরা ওরে বাড়ি থাইকা বাইর কইরা দিব।"

এরকম অনেক কথা সারা গ্রামে উড়ে বেড়ায়। বলরাম বাড়িতে এসে রাগে গজগজ করে আর হৈমবতীর উপর সব রাগ ঝাড়ে।কিন্তু জগন্নাথের কোন হেলদোল নেই এসব কথায়। সে গাছগুলোর পরিচর্যা করেই চলেছে কারও কথা শুনছে না । যদিও দিনে একবার তার খাবার জোটে হৈমবতীর দয়ায়। হৈমবতী নিজের খাবারের অর্ধেক ওকে খেতে দেয়।

কিন্তু কথায় আছে পরিশ্রম বিফলে যায় না । জগন্নাথের বাগান একসময় গাঁদা ফুলে ভরে উঠল। কি সুন্দর লাগছে ! যে জমিতে কোনদিন কিছু হয়নি সেখানে এতো সুন্দর ফুল ফুটেছে দেখে সবাই অবাক । একি করে সম্ভব ! বাঁজা জমিতে গাছ হল কি করে । হৈমবতী খুব খুশি। কিন্তু বলরাম বলল ," এতো ফুল দিয়া আমাগোর কি হইব ! ফুল দিয়া তো আর ভাতের জোগাড় হইব না । "

" হইব বাবা ফুল দিয়াই আমি ভাতের জোগাড় করুম । "

" হেইডা কি রকম? "

" দেখ কি কইরা হয়।"

জগন্নাথ অনেক গাঁদা ফুল নিয়ে কলকাতায় যায় আর ওসব বিক্রি করে ভালো দাম পায়। হয়তো ওর মাথায় এতদিন তাই খেলছিল ।এরপর থেকে প্রায়ই নিয়ে যেতে থাকে আর ভালো দাম পায়। এখন আর ওকে কে !

গাঁদা ফুল বিক্রি করে বেশ কিছু আয় হয় জগন্নাথের । সংসারে টাকা দিল তাই এখন আর কেউ ওকে খাবারের খোঁটা দেয় না আর অকর্মণ্য ও বলে না । জগন্নাথ এরপর ফুলের নার্সারি থেকে ডালিয়া, গোলাপ, চন্দ্র মল্লিকা, রজনীগন্ধা আরও নানা ধরনের ফুল এনে তার বাগানে লাগায়। দিনরাত ওগুলোর পরিচর্যা করে । ধীরে ধীরে ওর ফুলের বাগান নানা ধরনের ফুলে ভরে উঠে । দেখতে খুব সুন্দর লাগছে । এখন আর কেউ ওকে অকর্মণ্য বলে না ।বরং বাঁজা জমিতে ফুল চাষ করে আয় করছে দেখে অনেকে নূতন কিছু করার প্রেরণা পায়। জগন্নাথ ওর বাগানের সব ফুল বিক্রি করে ভালো আয় করছে । বলতে গেলে বলরামের পরিবারে এখন জগন্নাথের আয় এখন বেশী । হৈমবতী খুব খুশি । কে যে কোন কাজ দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে তা কেউ বলতে পারে না । সময় চলে যায় জগন্নাথ ধীরে ধীরে ওর ফুল বাগানের দৌলতে সুন্দর বাড়ি , গাড়ি সব করেছে । এখন সবাই ওকে ভালোবাসে । হৈমবতী, বলরাম ওকে বিয়ে দিয়েছে জগন্নাথ এখন বড় ফুল ব্যবসায়ী। বাবা , মাকে খুব যত্ন করে জগন্নাথ !

সমাপ্ত ।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.