অনুগল্প

অনুগল্প ১৮-বছর

১৮-বছর

লেখক : অলোক কুমার দত্ত

প্রায় আঠেরো বছর আগের এক ঘটনা। বাসুদেবপুর গ্রামে বসবাস করতো দুই পরিবার। দুই পরিবারে খুবই খাতির, খুবই মিলমিশ। এক পরিবারের ছেলের নাম বাবলা, আরেক পরিবারের ছেলের নাম চিন্টু। সম্পর্কে ওরা জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাই। অর্থাৎ দুই কিশোর, দুজনেই ক্লাস সিক্সে পড়ে। প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যায় স্কুল থেকে ফিরে একসাথে খেলাধূলা করে। একেবারে হরিহর আত্মা। চিন্টুর মাথায় ঝাঁক্ড়া চুল। বাবা শিবের থানে মানত্ করা। অর্থাৎ মানত্ পূরণ হলে বাবার ম¨িরে গিয়ে চুল দিয়ে আসবে। মাঝে মাঝে চিন্টু পাঞ্জাবিদের মতন ঝুঁটি বাঁধে; দেখতে খারাপ লাগে না। বাব্লা আবার খুবই চালাক, খুবই বুদ্ধি ধরে। চট্ করে কোনো পাগ্লামি করে না। বাব্লার মধ্যে আবার পুথিগত বিদ্যা থেকে কারিগরি বিদ্যার ঝোঁক বেশি। অর্থাৎ হাতেকলমে কাজ সাংঘাতিক, এমনকি ইলেক্ট্রিকের কাজেও বাব্লা সিদ্ধহস্ত। এদিকে পাড়াতেই আরেক ব্রাহ্মণ পরিবারের বসবাস। চ্যাটার্জী পরিবার। পেশায় যজমানি করা চ্যাটার্জী পরিবারের প্রধানের কাজ। সেই পরিবারের এক ছেলে---নাম অপূর্ব চ্যাটার্জী। অপূর্বরা খুবই গরিব। নুন্ আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা।

অপূর্ব বাসে হকারি করে অর্থাৎ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে লজেন্স্ ও চানাচুর বিক্রি করে দৈনিক। অপূর্বর পৈতের সূত্রেই হোক্ অথবা চিন্টুর মানতের সূত্রেই হোক্---চিন্টুর মা অপূর্ব এর ‘‘ভিক্ষা-মা।’’ ভিক্ষা মা হিসেবেই গণ্য হতে লাগলো দুই পরিবারের সখ্যতা। অপূর্ব এর বয়স ১৮ বছর। টগবগ্ করে ফুট্ছে রক্ত। এই বয়স মানে না কোনো বাধা, মানে না কোনো কুসংস্কার, মানে না কোনো বিধি নিষেধ। শুধু প্রতিবাদ, সংগ্রাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। মানে না কোনো জাতপাত। আঠারো বছর বয়স শুধুই ন্যায়ের পক্ষে। এক কালী পূজোর রাতের ঘটনা। দীপাবলী উপলক্ষ্যে সবাই বাজি ফাটাচ্ছে। তুবড়ি, দোদমা, চক্লেট বোম, রকেট্ বাজি চিন্টু করেছে কি-যে কালী পটকাগুলো ফাটেনি সেই গুলো জড়ো করে একটা বড় ধুনুচিতে রাখে ও পড়ে মাথা নীচু করে নীভু আগুনে ফুঁ দিতে থাকে। অমনি হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে চিন্টুর মুখমণ্ডল ও লম্বা-লম্বা চুল। সে যাত্রায় কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যায় চিন্টু। ডাক্তার-চিকিৎসার মাধ্যমে সে যাত্রায় বাঁচে কিন্তু পুরোপুরি নিরাময় হতে বেশ সময় লাগলো। অর্থাৎ চিন্টু পুনর্জীবন লাভ করলো। বাব্লার কিন্তুù এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি কারণ ও অতি চালাক। কথায় বলে অতি চালাকেরও গলায় দড়ি হয়। একদিন বাব্লা স্কুল থেকে ফেরার পথে কুল গাছে ভর্তি পাকা কুল হয়ে আছে দেখে আর লোভ সামলাতে পারলো না। বাব্লা ঢিল মেরে কুল পারতে শুরু করলো। এক ব্যাগ্ কুল জোগাড়ও করে ফেলল। অবশেষে লাস্ট্ ঢিলটা যখন মারলো তখন গাছে বেঁধে থাকা একটা আধ্লা ইট বাব্লার মাথায় এসে পড়লো। বাব্লার মাথা ফেটে রক্ত বেরোতে লাগলো। বাড়ি ফিরে ডাক্তার ডেকে স্টিচ্ করতে হয়েছিল বাব্লার। এইভাবেই চলছিল বাব্লা আর চিন্টুর স্কুলজীবন। অবশেষে একদিন দুজনে চান করতে গিয়েছিল গ্রামেরই এক পুকুরে। বাস রাস্তার ধারে বিশাল গভীর পুকুর ‘‘লাইনের-পুকুর’’ নামে খ্যাত। বাব্লা আর চিন্টু দুজনের কেউই সাঁতার জানতো না। দুজনেই পুকুরে নামলো চান করতে বাব্লা একটু কাছে আর চিন্টু একটু ভিতরে চান করছে। বাব্লা লক্ষ করলো চিন্টু একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে পুকুরের গভীরে। চিন্টু প্রাণপণ চেষ্টা করছে বাঁচার, হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে কিন্তু, কিছুই করতে পারছে না কারণ ও সাঁতার জানতো না। এই দেখে বাব্লা জল থেকে উঠে বাড়ি ফিরে আসলো কিন্তু, কাউকেই কিছু জানায়নি। চিন্টুর ডুবে যাওয়ার খবর কেউ জানতো না। কিন্তু, কথায় বলে রাখে হরি মারে কে? চিন্টু যখন ডুবে যাচ্ছিল ঠিক্ তখনই ‘‘লাইনের পুকুরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল সেই ১৮-বছরের যুবক অপূর্ব। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাসে হকারি করতে অর্থাৎ চানাচুর-লজেন্স বেচতে অপূর্ব লক্ষ করলো এক কিশোর জলে ডুবে যাচ্ছে ও জলে বুড়বুড়ি কাটছে। একটুখানি হাতের ডগা দেখা যাচ্ছে। তক্ষুণি সেই ১৮-বছরের যুবক কোনো কিছু আগ-পাশ না ভেবে, কাঁধের ব্যাগ ছুড়ে ফেলে জলে ঝাঁপ দিলো ও কোনোরকমে চিন্টুর ঝুঁটি ধরে উপরে তুলে নিয়ে এলো। চিন্টুকে উপুড় করে শুইয়ে পেটে চাপ দিয়ে প্রচুর জল বের করতে লাগলো। জল বের করতে করতে অপূর্ব হাঁপিয়ে উঠছিল। অবশেষে চিন্টু পুনুর্জীবন লাভ করলো এক ১৮-বছরের যুবকের হাত ধরে। নিমেষের মধ্যে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে। কিন্তু, এখনকার মতন এত টি.ভি. চ্যানেল ছিলো না সেই সময়ে ১৮-বছর আগে। খবরটা সীমাবদ্ধ রয়েই গেল গ্রামের মধ্যে। কিন্তু, ১৮-বছরের দুঃসাহস সর্বব্যাপী। সর্বকালীন, মানে না কোনো ভেদাভেদ, জাতপাতের ঊzর্ধ্বে, ধর্ম-বর্ণ-রঙের ঊর্ধ্বে। আঠারো তুমি দীর্ঘজীবী হও-সবার মাঝে। ভিক্ষা মায়ের ছেলে-ভিক্ষা ভাইরূপে দেখা দিলো; আঠারো বছর আগে---আঠারোর হাত ধরে! চিন্টুকে জলে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে অসীম সাহসিকতার পুরস্কারের আয়োজন করা হয়েছিল স্থানীয় এক ক্লাব পল্লীমঙ্গল সমিতির পরিচালনায়। এলাকার উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওই পুরস্কার তুলে দেন ১৮-বছরের যুবক অপূর্ব চ্যাটার্জীর হাতে। তিনি বলেন---সবার উপরে মানুষ সত্য-তাহার উপরে নাই। মানুষ-মানুষের জন্যে এবং মনুষ্যত্বই মানবিকতার প্রধান পরিচয় হওয়া উচিত। আঠারোর জয়গানে এগিয়ে এসেছিল লোকাল থানার ও.সি. ও অন্যান্য পুলিশ আধিকারিকরা এবং তৎসহ পঞ্চায়েত প্রধান ও অন্যান্য পঞ্চায়েত সদস্য-সদস্যাগণ। প্রত্যেকের বক্তব্যেই ফুটে ওঠে আঠারোর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও ন্যায়ের পক্ষে আপসহীন সংগ্রামের কথা। অর্থাৎ জন্ম হউক্ যথা-তথা কর্ম হউক ভালো। এইভাবে দরিদ্র পরিবারের মানবিক অপূর্ব চ্যাটার্জী আঠারো বছর আগে এক অপূর্ব নিদর্শন স্থাপন করেছিলো যা আজও লোকমুখে স্মৃতিমেদুর!

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.