প্রবন্ধ

প্রবন্ধ অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ

অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ

লেখক : উৎপল সেনগুপ্ত

সত্তর দশকের উত্তাল সময়ের ইতিকথা লিখতে বসেছি৷ সেইসময় এপার বাংলার বারুদের গল্পে এপারও বিষাক্ত৷ তখনকার ছেলে ছোকরারা সত্তর দশককে মুক্তির দশক বলতে চাইছে৷ তৎকালীন পূর্ব বাংলাও মুক্তি চাইছে জল্লাদ পাকিস্তানিদের হাত থেকে৷ ফলে তাজা রক্ত ঝরছে চারদিকে৷ আমরা কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক ‘অমৃত’ (সাপ্তাহিক) পত্রিকার অফিসে যুগ্মসম্পাদক কবি মণীন্দ্র রায়ের সঙ্গে রাজনীতির আলোচনা করছি৷ বিষয়টা ছিল ‘এদেশ ও রাজনীতি’৷ সময়টা ১৯৭৫৷ আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি কয়েকদিন আগেও ‘জরুরি অবস্থা জারি করেছেন৷ তিনি রাতারাতি সংবাদপত্রের ওপর কুঠারাঘাত করলেন৷ কন্ঠরোধ হল সারা দেশের সাংবাদিকদের৷ লেখনী স্তব্ধ হল৷ বহু সাংবাদিকদের জেলে ভরা হলো৷ নিপীড়ন চলল তাঁদের ওপর৷ গণতন্ত্র বলে বস্তুটিকে ভূলুন্ঠিত করা হল৷ এই বিষময় পরিবেশে আমরা সবাই শঙ্কিত হলাম৷ তখন কবি মণীন্দ্র রায় আমাকে ডেকে বললেন, ‘উৎপল, তোমার ওপর একটা দায়িত্ব ন্যস্ত করছি, অন্নদাবাবুর কাছে গিয়ে এই মুহূর্তে একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া৷ গণতন্ত্রের এই বিপদে ওনার মতো চিন্তাবিদের মতামত খুবই প্রাসঙ্গিক আমাদের পত্রিকার জন্য৷ উনি বয়োঃজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদও বটে৷

মণিদার কথা উপেক্ষা করতে পারলাম না৷ কালবিলম্ব না করে পরেরদিন সকাল সাড়ে নটায় অন্নদাবাবুর যোধপুর পার্কের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম৷ তাঁকে আমি ‘কাকাবাবু’ বলে ডাকতাম৷ ওঁনার স্ত্রী আইরিশ মহিলা ছিলেন৷ তাঁকে ডাকতাম ‘কাকিমা’ বলে৷ পরিষ্কার বাংলায় কথা বলতেন৷ ওঁনার নাম লীনা রায়৷ যদিও অন্নদাবাবু ছদ্মনামে লিখতেন লীলাময় রায় নামে৷

বাড়ির কলিংবেল টিপতেই দরজা খুললেন শ্বেতশুভ্রা লাল পাড়ের শাড়ি পরিহিতা ‘কাকিমা’, কপালে লাল টিপ৷ ‘নমস্কার’ বলে অভিবাদন জানালেন৷ জিজ্ঞাসা করলেন ‘কী ব্যাপার’ উৎপল, এত সকালে! শরীর ঠিক্‌ আছে তো? উনি এইমাত্র ‘মর্নিং ওয়াক’ করে ফিরলেন৷ টুমি ভিতরে এসো৷’
কাকিমা হাঁক পেড়ে বললেন---কোথায় তুমি! শোন, উৎপল এয়েছে৷ কাকাবাবু ভিতর থেকে বললেন, ‘ওঁকে বসতে বলো৷’
কাকিমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হট খাবে না কোল্ড?’ বললাম, চা খাব৷ আমাদের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে আমার কোনো আবদার কখনও তাঁরা ফেরাননি৷ কিছুক্ষণ পরেই কাকাবাবু আমার সামনে এসে বসলেন৷ হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়ির খবর ভালো তো! বাবা কেমন আছেন? বাবার (সরলানন্দ সেন) ‘ঢাকার চিঠি’ বইটা বেরোল৷ উল্লেখ্য বাবার এই গ্রন্থটির দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছে অন্নদাবাবু৷ বললাম কলকাতার পুথিপত্র প্রকাশনা সংস্থা বইটি বার করবে বলেছে৷ ‘বা বা খুবই আনন্দের বিষয়৷ আতজকালতো ভালো বইয়ের প্রকাশক পাওয়া দুষ্কর৷’

প্রথমেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম আজকের ‘গণতন্ত্র কোন পথে! দেশে জরুরি অবস্থা বলবৎ হয়েছে সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আমার প্রশ্ণ৷ উনি সেদিন অনেক প্রশ্ণেরই মতামত দিলেন, একেবারে খোলাখুলি স্বাধীনভাবে৷

আলোচনার মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে অন্নদাবাবুর ব্যক্তিগত পরিচয় একটু দেওয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করছি৷ ত্রিশ চল্লিশ দশকের সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায় নিঃসন্দেহে একজন বিদগ্দ সাহিত্যিক৷ তিনি সরাসরি কথা বলতে ভালোবাসতেন৷ তা রাজনীতি হোক বা সাহিত্য হোক, স্পষ্ট বক্তা খুব একটা মিশুকে স্বভাবের ছিলেন না৷ কদাচিৎ কোনো আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকতেন৷ তিনি একাধারে কবি-ছড়াকার-প্রবন্ধকার- ঔপন্যাসিক হিসেবে সর্বজনবিদিত৷ মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর সাহিত্যক্ষেত্রে পদার্পণ৷ তদানীন্তন প্রবাসী পত্রিকায় তাঁর সাহিত্যে হাতেখড়ি৷ সাহিত্যের মহান দিকপাল রুশ সাহিত্যিক টলস্টয়ের একটি গল্পকে অনুবাদ করে সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশ করলেও তাঁর তখনকার পুস্তকের সংখ্যা সত্তর ছাড়িয়েছে৷ সেইসময় তাঁর বয়সও ছিল সত্তর৷

‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় ‘বীরবল’ ও রবীন্দ্রনাথের নানা লেখা পড়ে তিনি আকৃষ্ট হন এবং তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগায় সাহিত্যক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করতে৷ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আই-সি-এস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস)৷ চাকরি ও সাহিত্য একসঙ্গে চলতে পারে না, এই ভেবেই তিনি ১৯৫১ সালে আই-সি-এস পদ থেকে ইস্তফা দেন৷ এরপরই সাহিত্যসেবায় আত্মনিয়োগ করেন৷ তাঁর শিক্ষাকাল কেটেছে কটকে৷ কারণ তাঁর বাবা নিমাইচন্দ্র রায় ছিলেন *কানাল-এর সরকারি কর্মী৷ সেই অর্থে তিনি প্রবাসী বাঙালি৷ কটকের র* কলেজে পড়াশুনা করার পর স্নাতক হন পাটনা কলেজ থেকে৷ ওড়িয়া ভাষায়ও তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল৷ চাকরিজীবনে নিয়মিত সাঁতার ও টেনিস খেলে কাটিয়েছেন৷

যোধপুর পার্কের ছোট বাড়িতে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল৷ ১৯৭৫-এর নভেম্বর মাসে৷ জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর আমি একটু উত্তেজিত ছিলাম৷ কারণ সেই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেছিলেন৷ রুদ্ধ হয়েছিল বাক স্বাধীনতা৷ যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী৷ আমাকে দেখেই অন্নদাবাবু বললেন, ‘কী ব্যাপার তোমার, এত উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন? বললাম, এখন থেকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না কিংবা লেখাও যাবে না৷ তাহলে আমাদের গণতন্ত্র এগোবে কোন পথে?

এখনও স্মরণে আছে তিনি মৃদু হেসে তখন বলেছিলেন, ‘উৎপল, এসব নিয়ে ভেবো না৷ আমাদের মতো মূর্খের দেশে গণতন্ত্র চলে না৷ এখানে গণতন্ত্র হচ্ছে প্রহসন৷ আমাদের দেশে গণতন্ত্র শাসক শ্রেণির৷ এরা তলায় তলায় স্বৈরাতন্ত্রকে বিশ্বাস করে৷ একদল যাবে আর একদল সেই পথই অনুসরণ করবে৷ শুধু টেকনিকটা আলাদা৷ মূল উদ্দেশ্য ভোটে জেতা৷
জনগণের অধিক মঙ্গলের জন্য কিছুই করবে না৷ যে দেশে এত দুর্নীতি ও মিথ্যাচার সেদেশে গণতন্ত্র অচিরেই ভেঙে পড়বে৷ ১৯৬২ সালে ভারত চিন সংঘর্ষের সময় সম্পাদকীয় লেখার জন্য তোমাদের কাগজের সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়কে কিরকম হেনস্থা হতে হল৷ আগে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে খবরের কাগজের মালিকদের স্বাধীনতা বোঝাত৷ গণতন্ত্রকে কুঠারাঘাত করতে পিছপা হতো না৷ এখন গণতান্ত্রিক অধিকারের একচেটিয়া মালিক হলো শাসকগোষ্ঠী৷ তাঁদের অঙ্গুলি হেলনে সবাইকে চলতে হবে, নচেৎ সাধারণ মানুষ বা বুদ্ধিজীবীরা খচাং হয়ে যাবে৷ সংবাদপত্রগুলো ক্রমশ হচ্ছে বাণিজ্যিকমুখী৷ ফলে শাসকশ্রেণির ঔদ্ধত্য বাড়ছে দিন দিন৷ আবার বলছি আমাদের দেশের গণতন্ত্রে পচন ধরেছে৷ সময় একটু নেবে, তবে আগামি পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই এর পতন অবশ্যম্ভাবী৷ এতে সমালোচক বা চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে৷ এখনই দেখ না, কত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকদের জেলবন্দী করা হয়েছে৷ এই জরুরিকালীন ব্যবস্থায় ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া৷ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে গ্রামে-গঞ্জে-মফঃস্বলে৷ আর একটা বিপদে পড়ব আমরা, ধর্মান্ধতা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে৷ এখন অল্পবিস্তর হলেও পরবর্তী সময়ে এটা ভয়ঙ্কর রূপ নেবে৷ এই ধর্মান্ধতা গণতন্ত্রকে গ্রাস করবে৷ গণতন্ত্রের আড়ালে ফ্যাসিস্ট কায়দায় শাসন চলবে৷ আমাকে হয়ত দেখতে হবে না, তবে তোমরা দেখবে৷ আমায় তখন স্মরণ কর৷

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ত্রিশ চল্লিশ দশকের সাহিত্য আপনি দেখেছেন! সেদিক থেকে সত্তর দশকে সাহিত্যের গুণগত উৎকৃষ্টতা কি বেড়েছে? না হ্রাস পেয়েছে? আপনার কী মনে হয়?’
কাকাবাবুর মতো একথা ঠিক যে, ত্রিশ চল্লিশের দশকের চেয়ে সত্তর দশকের সাহিত্যচর্চার পরিধি অনেক বেড়েছে, লেখকের সংখ্যাও যেমনি বেড়েছে, তেমনি বইয়ের সংখ্যাও৷ পাঠকও বেড়েছে৷ মুদ্রণ শিল্পের বিপ্লব ঘটেছে৷ দুর্ভাগ্যবশত মূল সাহিত্যের স্বাদ বা উৎকর্ষ সেভাবে বাড়েনি৷ কোনো কোনো সাহিত্যিক বছরে ৬/৭টি করে উপন্যাস লিখছেন৷ কিন্তু স্বাদ কোথায়? অনেকটা লেখা হল মুরগির ডিমের মতো৷ মাসে ত্রিশটি ডিম দেয় লেগইন মুরগি---কোনোটাই সুস্বাদু নয়৷ অপরদিকে দেশি মুরগি মাসে ১৫টি ডিম দেয়৷ কী সুস্বাদু৷ এর কারণ বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা৷ আজকের অর্থনৈতিক সঙ্কটের আবর্তে পড়ে লেখকদের বেশি লিখতে হচ্ছে৷ এটা হচেছ পুরোপুরি জীবিকার তাগিদে৷ ফলে লেখার ধাঁচে ক্রমশ কমার্শিয়াল ভাব এসে গেছে৷ চল্লিশ দশকে এটা ছিল না৷ এভাবে চলতে থাকলে সাহিত্যের গুণগত উৎকৃষ্টতা কমবে বইকি বাড়বে না৷

এইসময় সাহিত্য অশ্লীলতায় ভুগছে বলে পাঠকরা শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন---কেউবা আবার এটিকে বাহবা দিচ্ছেন, আপনি কী বলবেন এটাকে? সাহিত্য হলো একটা সময়কার সামাজিক প্রতিচ্ছবি৷ সেটার সার্থক রূপায়ণ হলো সাহিত্যিকের পরম ধর্ম এবং সমাজের নানা চারিত্রকে জীবন্তরূপ দেওয়া নির্ভর করে সাহিত্যিকের ওপর৷ জীবনে চলার পথে অনেক বাস্তবচিত্র আমরা সমাজজীবনে প্রত্যক্ষ করি৷ মনের মধ্যে ভেসে ওঠে অনেক নগ্ণ ছবির জীবন্তরূপ, চরিত্রের খাতিরে সেসব লিখতেই হয়৷ মহাভারতেও এরকম অনেক চরিত্র আছে৷ এটা নির্ভর করে পরিবেশনের ওপর৷ সেটাকে অশ্লীলতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করতে পারি না৷ সেতো প্লেটো নিজেই হোমারের সাহিত্যকীর্তিকে অশ্লীল আখ্যা দিয়েছিলেন, তা বলে হোমারের সাহিত্যকর্ম কি অশ্লীলতার দায়ে দুষ্ট! মোটেই নয়৷ আমাদের দেশে মহাকবি কালিদাসের লেখায়ও এমন অনেক অশ্লীলতা পাওয়া যাবে৷ সাহিত্যে অশ্লীল বলে কিছু নেই৷

পরের প্রসঙ্গ হলো ছড়া নিয়ে৷ বললাম, আমাদের ছেলেবেলায় আপনার বিখ্যাত ছড়া ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর ওপর রাগ করে, তোমরা যেসব ধেড়ে খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো, তার বেলা’৷ এটা এখনও অমর হয়ে আছে৷ প্রসিদ্ধ ছড়াকার হিসেবে আপনার নাম সর্বজনবিদিত৷ কিন্তু আজকের সাহিত্যে ছড়া সেভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না কেন?

হাসতে হাসতে তিনি উত্তর দিলেন, ‘শোন, তুমি ঠিকই বলেছ৷ ছড়া লিখতে আমি মজা পাই, এখনও সময় পেলে তা লিখে ফেলি৷ আসলে ছড়ার মূল উৎপত্তি হলো গ্রামাঞ্চল থেকে৷ গ্রামের বিভিন্ন লোকগাঁথা থেকেই ছড়ার জন্ম ও জনপ্রিয়তা৷ আস্তে আস্তে শহরাঞ্চলে তা প্রভাব বিস্তার করে এবং নিজস্ব একটা ঢং বা আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে৷ এরপর বর্তমান কিছু কবি এটাকে নবরূপে নব আঙ্গিকে সাজাচ্ছেন৷ সেটা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা কেউ ভাবছে না৷ ছড়া জনপ্রিয়তা হারানোর অন্যতম কারণ, ছড়ার মধ্যে কৃত্রিমতার ছাপ এসে গেছে৷

এখন আর তা দেখা যাচ্ছে কই! ছড়ার মধ্যে যুক্তাক্ষর বর্জন হচ্ছে না৷ ফলে ছড়া ক্রমশ গুণগত মান থেকে পিছু হটছে৷’
আজকের শিশু সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
অন্নদাশঙ্কর : আমাদের দেশে শিশু সাহিত্যের বিকাশ কোনোদিনই বিরাটাকারে ছিল বলে আমার মনে হয় না৷ কেবল ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিদেশ থেকে শিশুদের উপযোগী সাহিত্য এদেশে আমদানি হতো৷ বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত দেশ থেকে৷ এরপর মনে হয় এদেশে শিশুদের উপযোগী সাহিত্য সৃষ্টি করার প্রবণতা দেখা দেয়৷ পরবর্তী সময়ে দেখা যায় ত্রৈলোক্যনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় ও সুখলতা রাও ও আরও কয়েকজন বাংলার শিশু সাহিত্যকে কিছুটা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন৷ কিন্তু বর্তমানে এর গতি আবার শ্লথ বলে মনে হচ্ছে৷ এর কারণ আজকের শিশুসাহিত্যিকরা শিশুদের মানসিকতা সম্পর্কে একেবারেই সচেতন নন৷ ফলে সাহিত্য হচ্ছে বটে, কিন্তু শিশুদের উপযোগী সাহিত্য কটা হচেছ৷ বাজারে কিছু সাহিত্যিক আছেন, যাঁরা কোনোদিন শিশুসাহিত্যের চর্চা করেননি---তাঁরাই এখন নিজেদের মতো শিশুসাহিত্য করার চেষ্টা করছেন৷ তাহলে তো শিশু সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির সম্ভাবনা উবে যাবে, তা বলাই বাহুল্য৷

আমার আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে উনি কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, আজ অনেক হয়েছে, এবার কেটে পড়ো৷’
বললাম কাকাবাবু, আর দু একটা কথা বলেই কেটে পড়ব৷
জবাবে বললেন, ‘আমার স্নানের সময় হয়ে গেছে৷’
আমি নাছোড়বান্দা৷
আপনার কোন গ্রন্থ সবচেয়ে দীর্ঘাকৃতি এবং তা লিখতে কতদিন সময় লেগেছিল এবং কোন বইটি আপনার বিতর্কিত হয়েছে?

অন্নদাবাবু : আমার সবচেয়ে বড় গ্রন্থ হলো ‘সত্যাসত্য’ এটি ছয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়৷ ছটি উপন্যাস নিয়ে এটি সংকলিত৷ এর মধ্যে আছে ‘যার যেথা দেশ’ ‘অজ্ঞাতবাস’৷ ‘কলঙ্ক’, ‘অতীত’, ‘দুঃখমোচন’, ‘মর্ত্যে, স্বর্গ, ও অপসারণ৷’ ‘কলঙ্ক’ অতীতকে ঘিরে সেইসময় খুবই বিতর্কের সৃষ্টি হয়৷ এটিকে অনেকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন৷ অংশের সকলের এই অভিযোগ খণ্ডিত হয়৷ দীর্ঘাকৃতি এই বইটি ১৯৩০ সালে লিখতে শুরু করি, শেষ হয় ১৯৪২ সালে৷ এতে স্থান পেয়েছে তৎকালীন রাজনীতি-সমাজনীতি, বলা যায় একটা যুগের প্রচছন্ন ছবি৷ এই গ্রন্থ শেষ হওয়ার পর ১৯৫৫-৫৬ সালে ‘রত্ন ও শ্রীমতী’৷ উপন্যাসটি দুই খণ্ডে বেরোয়৷ কিন্তু এটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমি কয়েকজনের বিরাগভাজন হই৷ আমাকে কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়৷ আমার লেখার কাজে বিঘ্ন ঘটে৷ এটার আর একটি খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়৷ পরে ১৯৫৫ সালে আবার এর তৃতীয় খণ্ড লেখার কাজে হাত দিই৷ বই আকারে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে৷

‘আজকের সমাজের একজন সাহিত্যিকের আদর্শ ও দায়িত্ব কী হতে পারে!’
‘সাহিত্যিক হিসেবে একজনের দায়িত্ব ও আদর্শ অবশ্যই থাকা উচিত৷ আদর্শের কথাটা অবশ্য মুখেই বলা হয়৷ বাস্তবজীবনে কেউ যদি মেনে চলতেন, তাহলে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি অন্যরূপ হতে পারত৷ আর দায়িত্ব কথা বলাটা অর্থহীন৷ সমাজের প্রতি সাহিত্যেকের যে দায়িত্ব আছে, তা যদি প্রকাশের সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে দায়িত্ব কথাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে৷

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.