প্রবন্ধ

প্রবন্ধ বিনোদ বিহারী চৌধুরী

বিনোদ বিহারী চৌধুরী

লেখক : তীর্থ মিত্র

আট বছরের এক বালকের ইচ্ছা হল, মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথে দেখা করার৷ সংবাদ গেল মাস্টারদার কাছে৷ মনে হয় তিনি হয়ত স্থির করেছিলেন আট বছরের বালকের সাহস পরীক্ষা করে দেখবেন, তাই তিনি বালকটিকে সময় দিলেন রাত্রি আটটায় শ্মশানে৷

আমি আপনাদের যে সময়কার কথা বলছি যে সময়ে যেতে গেলে আমাদের একশো বছরেরও বেশি সময় পিছিয়ে যেতে হবে৷ বৈদ্যুতিক চুল্লিতো ছিলই না৷ কোনো আলো থাকত না রাত্রিতে সেখানে৷ শ্মশান রাত্রিতে জনমানবশূন্য, অন্ধকারময়৷ নিজেকে নিজে চিনতে পারা যেত না সেই অন্ধকারে৷ সাধারণ মানুষ রাত্রিতে একা সেখানে যাবার সাহস করত না৷ মাস্টারদার মনে হয়েছিল নিতান্ত বালক হয়ত রাত্রিতে আসতে ভয় পাবে তাই নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুঘণ্টা পরে সেখানে উপস্থিত হন৷ গিয়ে আশ্চর্য হয়ে যান যখন দেখেন বালকটি একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে৷ হয়ত ভেবেছিলেন ছেলেটা সাহসী তো বটেই কিন্তু কতটা সাহসী সেটা একবার দেখা দরকার তাই নিঃশব্দে পিছন থেকে কাঁধে আচমকা হাত রেখে বলেছিলেন ‘‘কিবে বিনোদ ভয় পেলি?’’

বালকটির নির্ভীক জবাব ছিল ‘‘আমি ভয় পাই না মাস্টারদা৷’’

‘‘তুই কতক্ষণ দাঁড়িয়ে?’’ আবার প্রশ্ণ করেছিলেন তিনি৷

‘‘আপনি সে সময় আসবেন বলেছিলেন সে সময় থেকেই৷’’

‘‘এতক্ষণ ধরে রয়েছিস একবারও তোর মনে হয়নি, আমি আসব না৷’’

‘‘আমি জানতাম আপনি আসবেন৷’’

‘‘তুই কি চাস আমার কাছে?’’ জানতে চান মাস্টারদা৷

‘‘আমি আপনার শিষ্য হবো?’’

মাস্টারদা বয়সের কথা বলে বোঝাতে চেয়েছিলেন সেই বালককে কিন্তু যে বোঝার নয় তাকে বোঝাতে গিয়ে শেষে হাল ছেড়ে দেন তিনি৷ হাতে খড়ি হয় সেই বালকের স্বদেশি কর্মকাণ্ডে৷

যে বালকের আট বছর বয়সের ঘটনা বললাম, তিনিই আমাদের এ পর্যায়ের স্মরণীয় বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী৷ যাঁর জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার অন্তর্গত, উত্তরভূর্ষি গ্রামে৷ বাবার নাম স্বর্গীয় কামিনী কুমার চৌধুরী, মায়ের নাম স্বর্গীয় বামা চৌধুরী৷ পিতা ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী৷ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি৷ বিনোদবাবু জানতেন পিতার সামাজিক অবস্থানের কথা কিন্তু যেখানে দেখেন বদ্ধ জন্মভূমি, শৃঙ্খলে বাধা দেশ মা তখন তিনি স্থির থাকতে পারেননি৷ নিজের লক্ষ্যস্থির করেন আর সিদ্ধান্ত নেয় দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করতে হবে৷ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চলতে থাকলেই দলে যোগদান করতে সময় লাগে ১৯২৭ সালে যুগান্তর দলের সদস্য হন৷ স্বদেশী কার্যকলাপের সাথে সাথে পড়াশোনাও চালাতে থাকেন ১৯২৯ সালে চট্টগ্রামের, ফটিকছড়ির রাঙামাটিয়া বোর্ড সুকল থেকে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন ও বৃত্তিলাভ করেন৷

স্বদেশি কার্যকলাপের জন্য বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার, মধুসূদন দত্ত, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস-এর মতো মহান বিপ্লবীদের৷ অবশেষে তার জীবনে এসে উপস্থিত হয় অন্যতম ঐতিহাসিক দিন ১৮ এপ্রিল ১৯৩০, যেদিন মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগারের দখল নিয়েছিলেন৷ বারিদবাবু ছিলেন মাস্টারদার সেই অভিযানের অন্যতম সৈনিক৷ সেই অভিযানের শেষে মাস্টারদার নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়, সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি৷ ২১ এপ্রিল ১৯৩০ জালালাবাদ পাহাড়ে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে যে সশস্ত্র সংগ্রাম হয় সেই সংগ্রামের অন্যতম সৈনিক ছিলেন বারিদবাবু৷ তার গুলিতে অসংখ্য ইংরেজ সৈন্যের মৃত্যু হয়৷ নিজেও আহত হন মারাত্মক ভাবে গুলিগালার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়৷ প্রথমে অন্যান্য সতীর্থরা মনে করেছিলেন তিনি বেঁচে নেই কিন্তু দেখেন যখন প্রাণের অস্তিত্ব আছে নিয়ে আসেন কাঁধে করে৷ যাতে ধরা না পরে যান, সেই সময় ব্রিটিশ সরকার তার নামে হুলিয়া জারি করে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে পারলে ৫০০ টাকা পুরস্কার৷ এর জন্য তিন বছর আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে৷ কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি, ধরা পড়ে যান দীর্ঘ পাঁচ বছরের কারাবাস হয়৷ এই পাঁচ বছর কেটেছে চট্টগ্রাম জেল, কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল, দেউলী ডিনোটেশন ক্যাম্প ও বহরমপুর জেলে৷ এই কারাবাসে থাকার সময়ই ১৯৩৪ সালে আই.এ. প্রথম বিভাগে ও ১৯৩৬ সালে বি.এ. ডিস্টিংশন নিয়ে পাস করেন৷ তখন তিনি দেউলী ডিনোটেশন ক্যাম্পে বন্দী৷ শেষে ১৯৩৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ইংরেজিতে এম.এ. পাস করেন৷ তখন তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী৷ অবশেষে ১৯৩৯ সালে ছাড়া পান ও চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন ও চট্টগ্রাম জেলার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ দায়িত্ব পেলেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেননি গৃহবন্দী থাকার জন্য৷ গৃহবন্দী থেকে মুক্তি পেয়ে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বদেশি কার্যকলাপে আবারও ধরা পড়েন তখন ১৯৪১ সাল বন্দী থাকেন দীর্ঘ চার বছর ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত৷ চার বছর কাটে চট্টগ্রাম জেলে, হিজলী বন্দী শিবিরে, ঢাকা জেলে, দ্বিতীয়বার কারাবরণের সময় আইনের প্রথম ও দ্বিতীয় শিক্ষা সম্পন্ন করেন৷ অবশেষে দেশভাগ হয়ে আসে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা৷ দেশভাগ হলেও নিজের জন্মস্থান চট্টগ্রাম ফিরে তিনি আসেননি, সেখানেই কাটিয়েছেন জীবনের বাকিটা সময়৷ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থেকেছেন বাকি জীবন৷ পরিশেষে ১০ এপ্রিল ২০১৩-তে চট্টগ্রামেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বারিদবাবু৷ স্বাধীনতা যুদ্ধের এই মহান বিপ্লবীকে আমরা সশদ্ধ প্রণাম

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.