উপন্যাস

উপন্যাস হারিয়ে যাওয়া জন্মভূমি

হারিয়ে যাওয়া জন্মভূমি

লেখক : ভগীরথ মিশ্র

প্রথম ভাগ

সদ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. সুকোমল সেনের  সম্বর্ধনা সভায়  ওঁকে নিয়ে বলতে গিয়ে গোয়ালপাড়া পুরসভার পৌরপিতা বঙ্কুবিহারী সেনডেকা সহসা মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন।
শহরের পৌরপিতা হিসেবে, স্বাগত-ভাষণ দেবার কালে, উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে তিনি এইভাবেই ড. সেনের পরিচয় ঘটিয়ে দেন।
আবেগে গদ্গদ হয়ে যারপরনাই গলা কাঁপিয়ে বলতে থাকেন, বন্ধুগণ, আজ আমাদের এক বিশেষ সৌভাগ্যের দিন। সৌভাগ্যের দিন এই কারণে যে, আজকের এই মহতী সভায় যে বিশ্ববন্দিত মানুষটি মঞ্চ আলোকিত করে বসে রয়েছেন, তিনি এই গোয়ালপাড়া জেলারই সন্তান। এই জেলার লখীপুর গ্রামই তাঁর  জন্মভূমি। শৈশবের বেশ কয়েক বছর তিনি ওই গ্রামেই কাটিয়েছেন। ওই গ্রামের আলো-হাওয়া সারা অঙ্গে মেখেছেন। ওই গ্রামেরই অন্ন-জলে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ওই গ্রামেই সমবয়েসিদের সঙ্গে খেলে বেড়িয়েছেন … গ্রামের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে বেড়িয়েছেন… গ্রামসংলগ্ন নদীতে সাঁতার কেটেছেন…। লখীপুর গ্রামের  সেই শিশুটি আজ রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে, একজন আন্তর্জাতিক মানুষ হয়ে উঠেছেন,এ গর্ব রাখবার জায়গা নেই আমাদের। আজ আমরা অবলীলায় বলতে পারি, ড. সুকোমল সেন আজ কেবল একজন ভারতীয় নন, তিনি আজ বিশ্বনাগরিক। সারা বিশ্বের প্রতিটি কোণেই তাঁর জন্য মর্যাদার আসনটি পাতা রয়েছে। আজকে আমাদের পরম সোভাগ্যের দিন এই কারণে যে, এমন একজন মানুষ আজ এই মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন। গোয়ালপাড়া পুরসভা’র পৌরপিতা হিসেবে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, ড. সেনের মতো মানুষের পদধূলি পেয়ে আজ গোয়ালপাড়া’র মাটি পবিত্র হল…।

    মূল্যবান আন্তর্জাতিক পুরস্কারটা পাওয়ার পর  ড. সুকোমল সেনের চাহিদা তখন গোটা দেশ জুড়ে। দেশের সব রাজ্যের বিদগ্ধ মানুষজনদের মধ্যে তাঁকে সম্বর্ধনা জানানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছে। বলা যায়, ওই নিয়ে রাজ্যগুলির মধ্যে রীতিমতো কমপেটিশন শুরু হয়েছে। ফলত, সম্বর্ধনার ব্যাপারটা চূড়ান্ত করা তো পরের কথা, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করাটাই দুষ্কর ছিল। ওই পরিস্থিতিতে গোয়ালপাড়ার পৌরপিতা বঙ্কুবিহারী  সেনডেকা যখন সবাইকে টপকে ড. সেনকে গোয়ালপাড়ায় এনে ফেললেন, দলের হাইকম্যান্ডের কাছে রাতারাতি তাঁর এইসান টি-আর-পি বেড়ে গেল, যা দেখে তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী তথা স্থানীয় এমএলএ মাখন মহান্তির রাতের ঘুম ছুটে যায়-যায় অবস্থা !  

  বঙ্কুবিহারী তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে এইমাত্র ড. সেনের জন্মভূমি-গ্রামের নাম এবং তাঁর শৈশবের দিনগুলি সম্পর্কে যেসব তথ্য পরিবেশন করলেন, সেগুলো সংগ্রহ করবার পেছনে অবশ্য গোয়ালপাড়া শহরের তরুণ যুবক রাজীব ফুকনের ভূমিকা অনেকখানি।

গোয়ালপাড়া হাইস্কুলের মাষ্টার রাজীব। ইংরেজীর মাষ্টার বটে, কিন্তু দুনিয়ার হরেক বিষয়ে তার অগাধ জানকারি। নিজের স্কুলে একটা কুইজ ক্লাবও গড়েছে সে। আর, জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে লুপ্তপ্রায় ইতিহাস ও সংস্কৃতি’র সন্ধান করে বেড়ায়। বঙ্কুবিহারীর খুবই ঘনিষ্ঠজন রাজীব। সেই সুবাদে, সুকোমল সেন গোয়ালপাড়ায় আসছেন শুনে সে-ই একদিন বঙ্কুবিহারীকে দিয়েছিল ওই কোটি টাকা মূল্যের তথ্যটি, কিনা, মানুষটি তো এই জেলারই লোক।
তাই শুনে বিষম চমক খেয়ে বঙ্কুবিহারী শুধিয়েছিলেন, সে কি !! তুমি জানলে কোত্থেকে?

---জানতে হয় দাদা। মুচকি হেসে বলেছিল রাজীব, যদিও কবি লিখে গিয়েছেন, ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি...’ , কিন্তু তাও কিছু কিছু বিষয় তো জানতেই হয় দাদা। তাবাদে, ওই আমলে বিশ্বকবি’র পক্ষে হয়তো-বা খুব বেশি জানা-টানা সম্ভব ছিল না, কিন্তু আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে বিপুলা পৃথিবীর প্রায় সবটুকুই তো মানুষের নখের ডগায় চলে এসেছে।

সে যাই হোক, সেদিন ওই তথ্যটি দেওয়ার জন্য রাজীবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিল বঙ্কুবিহারীর মন। ছোকরা ভাগ্যিস দিয়েছিল তথ্যটা! তাই তো আজকের সভায় অবলীলায় তথ্যটা উগরে দিতে পেরে উপস্থিত শ্রোতাকুলকে চমকে দেওয়া গেল, কিনা, বিশ্বনন্দিত এই মানুষটি গোয়ালপাড়া জেলাতেই জন্মেছেন !! এবং রাজীব ফুকনের কল্যাণে নির্দিষ্টভাবে ওঁর জন্মভূমি-গ্রামটার নামও বলে দেওয়া গেল !

বঙ্কুবিহারীর বক্তৃতা শুনে এই মুহূর্তে উপস্থিত শ্রোতৃকুল স্পষ্টতই যারপরনাই চমৎকৃত। বাস্তবিক, এমন উজ্জ্বল একটি তথ্য জানা ছিল না সভার অধিকাংশের। কাজেই,বঙ্কুবিহারী আচমকা এমন একটি তথ্য প্রকাশ করায় খুশি হয়ে মঞ্চেই তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন দলের জেলা-সভাপতি তথা এই অনুষ্ঠানের সভাপতি রামগতি বড়ুয়া।  আর,তাই দেখে সভার অপর বক্তা, মাখন মোহান্তি, যিনি এই জেলারই মানুষ এবং দুনিয়ার তাবৎ  ব্যাপারে বঙ্কুবিহারীর চেয়ে অধিক ওয়াকিবহাল বলে সদা-সর্বদা দাবি করেন হাইকম্যান্ডের কাছে, তিনি যারপরনাই ভাবনায় পড়ে যান,মূলত দুটো কারণে।

এক, এই বঙ্কুবিহারী লোকটা,---মাখন মহান্তি’র বিবেচনায়--- সব ব্যাপারেই যারপরনাই ‘অঘা’। অথচ, আজকের সভায় ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে নেমে একেবারে প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে ফেলল লোকটা ! আর, এই জেলার মানুষ হয়েও , এবং দলের হাইকম্যান্ডের কাছে চিরটাকাল নিজেকে এই জেলার একমাত্র বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তি হিসেবে জাহির করেও, ঠিক সময়ে তিনিই বঙ্কু’র গুগ্‌লি বলেই ডাহা আউট হয়ে গেলেন ! এবং তাও খোদ হাইকম্যান্ডেরই সামনেই !
আর দুই, আজকের ঘটনায় বঙ্কুবিহারী নামের মাথামোটা লোকটা হাইকম্যান্ডের সামনে যে-পরিমাণ মাইলেজ পেয়ে গেল, সেটাও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে, মাখন মহান্তি’র একটি দুর্ভাবনার কারণ হয়ে রইল। কারণ, শত্রুকে মাইলেজ দেবার ব্যাপারে মাখন মহান্তি চিরটাকালই দুর্যোধনপন্থী। সেই পন্থা অনুসারে, এক মাইল তো দূরের কথা, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’---এই হল মাখন মহান্তি’র চিরকেলে নীতি। এতকাল বাদে অনেকেই অবশ্য দুর্যোধনের এই মনোভাবটিকে বালখিল্যসুলভ মনে করেন এই যুক্তিতে যে, পাঁচটামাত্র গ্রাম বৈ তো নয়, দিয়ে দিলেই কিস্যা ফুরিয়ে যেত। এত বড় সাম্রাজ্যের থেকে মাত্র পাঁচখানা গ্রাম চলে যাওয়াটা তো সমুদ্রের থেকে কয়েক গণ্ডূষ জল চলে যাবার সামিল। অথচ তাতে করে গোটা কৌরব-বংশটা বেঁচে যেত। গোঁয়ার দুর্যোধন সেটাই বুঝল না ! লাভটা হল কি? বংশে বাতি দেবার কেউ রইল না। মাথামোটা আর কারে কয় !

কিন্তু দুর্যোধনের নীতিটা যে ষোলআনা’র জায়গায় আঠারোআনা সঠিক ছিল, সে-ব্যাপারে মাখন মহান্তি’র মনে তিলমাত্র সংশয় নেই। দুর্যোধনের মতো তিনিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, শত্রুকে সূচ্যগ্র পরিমাণ জমি দিলেই ওই সূচ্যগ্র-পরিমাণ জমি দু’দিন বাদে ফাল-পরিমাণ হয়, এবং কালক্রমে ওই ফাল্‌টি যে আয়তনে বাড়তে বাড়তে শেষ অবধি কোথায় গিয়ে থামে, তা খোদায় মালুম। বাস্তবিক, প্রাণীটার নাম মানুষ তো, তাই, একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকবার মতো ঠাঁই দিলে সে অচিরেই ওখানে দুটি পা’ রাখবার মতো ঠাঁই করে নেবেই। তারপর ক্রমে ক্রমে সে ওখানে বসতে চাইবে,…তারপর শুতে চাইবে,…তারপর ওখানেই ঘরকন্না পাততে চাইবে…!

অথচ আজকের সভায় তো সেটাই ঘটল। চিরটাকাল যাকে মাখন মহান্তি সূঁচ-প্রমাণ জমিও ছাড়তে নারাজ, সেই কিনা কীসব আগডুম-বাগডুম তথ্য পরিবেশন করে এভাবে মাইলেজ পেয়ে গেল ! এর ফল কতদূর অবধি গড়াবে কে জানে !
   মঞ্চের একপ্রান্তে বসে এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের হাতখানা ক্রমাগত কামড়াতে থাকেন মাখন মোহান্তি, এটাই ভেবে যে, এই জেলায় তাঁর দলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তথা আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি রামগতি বড়ুয়াকে তিনিই বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ডেকে এনেছিলেন, কেবল ওই মওকায় নিজের মাইলেজটা কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে নেবার জন্য। অথচ বিচ্ছিরি ঘটনাটা ঘটল সেই জেলা-সভাপতি’র সামনেই। ফলে, বাড়তি মাইলেজ পাওয়া দূরের কথা, বঙ্কুবিহারী  সেনডেকার একটিমাত্র গুগ্‌লি বলে এযাত্রা তিনি পুরোপুরি কুপোকাত। আরো ভয়ের ব্যাপার হল, জেলা-সভাপতির মারফৎ আজকের ঘটনাটা কোনোগতিকে রাজ্য-সভাপতি’র কানে গেলেই চিত্তির ! সব মিলিয়ে বঙ্কুবিহারী’র দেওয়া আজকের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সূঁচটি তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ফাল হয়ে দেখা দেবে কিনা এই মুহূর্তে সেই ভাবনা একেবারে কাবু করে ফেলে মাখন মহান্তিকে।

    বঙ্কুবিহারীর দেওয়া তথ্যটা যে গোটা সভার রঙটাই অতখানি বদলে দেবে,সেটা বুঝি কেউ ভাবতেই পারেনি। এমনকী, খোদ বঙ্কুবিহারীও নয়। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটল। অর্থনীতি’র জাঁদরেল অধ্যাপক হিসেবে যে-সুকোমল সেন প্রতিটি সভায় এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশ নিয়েই মূল্যবান বক্তৃতা দিতেই অভ্যস্ত, সেই তিনিই তাঁর গোটা বক্তৃতা জুড়ে খালি শৈশবের স্মৃতিচারণ, আর ছেড়ে যাওয়া জন্মভূমির জন্য হাহাকার করে গেলেন !

সম্বর্ধনার জবাবে অনেকক্ষণ ধরে আবেগমথিত কন্ঠে যা বললেন, তার মর্মার্থ হল, আন্তর্জাতিক পুরস্কারটা পাওয়ার পর সারা দেশে অনেক সম্বর্ধনা পেয়েছি। ভালই লেগেছে। বিদেশের মহার্ঘ খাদ্যের চেয়ে নিজের বাড়িতে মায়ের হাতের তৈরি পরমান্ন অনেক বেশি সুস্বাদু। বলতে গেলে, অমৃততুল্য। তবে, আজ এই সভায় এসে যা পেলাম, তা আমার কাছে এক পরম প্রাপ্তি। পৃথিবীর কোনো প্রাপ্তির সঙ্গেই তার তুলনা চলে না। নিজের হারিয়ে যাওয়া জন্মভূমিকে খুঁজে পাওয়া, একজন স্বভূমিচ্যুত মানুষের কাছে সেটা যে কতখানি সৌভাগ্যের কথা, তা বুঝি কেবল ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউই অনুধাবন করতে পারবেন না ! এবং তার জন্য গোয়ালপাড়া পুরসভা’র পৌরপিতা মিঃ বঙ্কুবিহারী সেনডেকা মশাইয়ের কাছে আমি আজীবনকাল কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হয়ে রইলাম।

বলাই বাহুল্য, ড. সেনের উচ্চারিত শেষ বাক্যটি মাখন মহান্তি’র কানে বিষাক্ত শলাকা হয়ে প্রবেশ করে মর্মমূলকে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করে তুললেও এই মুহূর্তে বুঝি কিছুই করবার ছিল না তাঁর। তিনি কেবল এইটুকুই বুঝে ফেলেন যে, এই মুহূর্তে বঙ্কু’র চলছে কেন্দ্রে বৃহস্পতি এবং তাঁর ঘরে রাহু ও শনি একযোগে প্রবেশ করেছে। ভাবতে গিয়ে আজকের গোটা সভাটাকেই নিমপাতার মতো হালকুচ তেতো লাগতে থাকে মাখনের।
ততক্ষণে ড. সেন শুরু করেছেন তাঁর পরবর্তী ভাষণ।

--- আজকের সভায় অকপটেই বলছি, আমার হারিয়ে যাওয়া জন্মভূমিটিকে আজ আর আমার বড় বেশি মনে নেই। এমনকী, এতকাল বাদে গ্রামের নামটাও ঠিক-ঠিক মনে পড়ছে না…। লখীপুর, নাকি লখীমপুর, নাকি লখীমগঞ্জ…। গ্রামটাকে নিয়ে কেবল কিছু ঝাপসা, ঘষাঘষা, এলোমেলো স্মৃতি….।
বলতে বলতে ড. সেনের চোখদুটি স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠতে থাকে। কণ্ঠস্বরও হয়ে ওঠে আবেগমথিত... । স্মৃতির কোন্‌ সুদূর রাজ্য থেকে তিনি বলতে থাকেন…, বেশ প্রশস্ত ভিটের ভেতর গাছগাছালবেষ্টিত একটা কোঠা বাড়ি…। বাড়ির দক্ষিণে একটা ফাঁকা মাঠ...। মাঠের একপ্রান্তে আমাদের মতো কচিকাঁচাদের বৈকালিক দোল খাওয়ার জন্যই বোধ করি, একটা অজস্র ঝুরিওয়ালা আদ্যিকালের বটগাছ...। অল্প দূরে একটা সাবেক আমলের শিবমন্দির…। বড়রা বড়ই ভয়ভক্তি করতেন ওই শিবঠাকুরকে…। মেয়েরা কথায় কথায় মানত করতেন ওঁর সামনে...। আমাদের বাড়িতে এক বুড়ো দাদু ছিলেন। তিনি ছিলেন সারা আসাম মুলুকের একজন নামকরা কবিরাজ। বহু দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা আসত তাঁর কাছে। ভাসাভাসা মনে পড়ছে, আমাদের বাড়ির সদর মহলের প্রশস্ত দাওয়ায় বসে বসে দিনভর খলনোড়া দিয়ে গাছগাছড়া পিষত প্রায় আধা ডজন মানুষ। ব্যস, জন্মভূমির স্মৃতি বলতে আমার এইটুকুই। বড়দের কাছে শুনেছি, ওই শিবমন্দিরটা নাকি আমার কবিরাজদাদুর বাবা স্বপ্নাদেশ পেয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন...। জ্ঞান হওয়া অবধি আমিও শুনেছি,  ওটা সেন-কবিরাজদের শিবমন্দির…।  

--- মনে পড়ছে…গ্রামের থেকে খানিক দূরে একটা হৃষ্টপুষ্ট নদী…।   নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে পাখির দল। মনে আছে, ওই নদীর পাড়ে আমরা বিকেল বেলায় খেলে বেড়াতাম, আর ছুটির দিনে চড়ুইভাতি করতে যেতাম…। …ব্যস, মোটামুটি…জন্মভূমির স্মৃতি বলতে আমার এইটুকুই।

 তারপর… এল ওই সর্বনাশা রাতটা…।
আমি তখন বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, আমি তখন বাবার কোলে। আমাকে কোলে নিয়ে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়চ্ছিলেন বাবা। পিছু পিছু ছুটছিলেন মা'ও। তাঁর পিছু পিছু আরো অনেক মানুষ। আমি কিছুক্ষণ বাদে আবার বাবার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, আমি তখন আর-একজনের কোলে। তাকে আমি চিনিনে।

বলতে বলতে প্যান্টের পকেট থেকে সাদা ধবধবে রুমালটা বের করে দু’চোখের কোণা আলতো করে মুছে নেন ড. সেন। গলাটা সহসা বেজায় ভারী হয়ে আসে…। ওই অবস্থায় তিনি অনেকক্ষণ ধরে প্রায় কান্নাজড়িত গলায় এবং অনেক কবিতার পংক্তি ও উপমা সহকারে যা-সব বলতে থাকেন, তার চোদ্দআনাই নিজের হারিয়ে ফেলা জন্মভূমির জন্য বুক-নিংড়োনো হাহাকার ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং বক্তৃতার এক্কেবারে শেষে, অন্তত একটিবারের জন্য নিজের সেই হারিয়ে ফেলা জন্মভূমির মাটিতে পা রাখবার বাসনা জানিয়ে তিনি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে বসে পড়েন।

উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে যাঁরা ইতিমধ্যে প্রফেসর সেনের বক্তৃতার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা সবাই যারপরনাই অবাক মানে। বাস্তবিক, আজ মানুষটার হল কি! যে-মানুষ কিনা বক্তৃতাকালে অর্থনীতির বাইরে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন না, সেই তিনি গোটা বক্তৃতা জুড়ে কেবল স্মৃতিচারণ আর হাহাকার করে গেলেন! আর ওই করতে গিয়ে তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কত কত মহার্ঘ উক্তি, কাব্যকণা,…শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, কোন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ নয়, তাঁদের সামনে কথা বলছেন একজন কবি,দার্শনিক। স্থানীয় কলেজগুলোর অর্থনীতির প্রফেসররা, যাঁরা প্রফেসর সেনের থেকে অর্থনীতির ওপর মূল্যবান কথা শুনতে এসেছিলেন, তাঁরা অবশ্যই কিঞ্চিৎ হতাশ হলেন, কিন্তু আপামর শ্রোতৃমণ্ডলী একেবারে বিগলিত, কিনা, কী বক্তৃতাই না শুনলাম!  অত বড় মানুষ, দুনিয়া জুড়ে কত নামডাক তাঁর, দিনভর কত গভীর বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হয়, কথা বলতে হয়, সেই তিনি কিনা বলে গেলেন,সহজ সরল ভাষায়,কত সুন্দর সুন্দর কথা,---'সে আজিকে হল কতকাল/ তবু যেন মনে হয়, সেদিন সকাল…..।' কিংবা 'বন থেকে পশুকে তুলে আনা যায়, কিন্তু পশুর মন থেকে বনকে সরিয়ে ফেলা যায়না।' গোছের কত-কত আবেগমাখা কথা ! শুনতে শুনতে গোয়ালপাড়ার আপামর মানুষ বিস্মিত, চমৎকৃত, আপ্লুত। বাস্তবিক, এতকাল একমাত্র প্রফেসর ইমরান হোসেনের মুখেই এইজাতের কথাগুলো শুনতে পেত গোয়ালপাড়ার মানুষ। কারণ, তিনিও এই এলাকারই সন্তান। গোয়ালপাড়াতেই জন্ম তাঁর। পড়াশোনাও এখানেই। বড় হয়ে গৌহাটি চলে গেলেন। এখন গৌহাটি এলাকার কোন একটা কলেজে যেন পড়ান। আগে মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠনে বক্তৃতা দিতে আসতেন। তখন গোয়ালপাড়ার মানুষ শুনতে পেতেন এই ধরনের কাব্যিমাখা কথা। ইদানীং তিনি আর আসেন না। আসলে, ইদানীংকালের সভা-সমিতিতে আর আগের মতো কবি-সাহিত্যিক-অধ্যাপকের মতো গুণীজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না। এখন সাহিত্যসভা, মনীষীদের জন্মজয়ন্তীসহ সব ধরনের অনুষ্ঠানে যারা আসে, তারা প্রায় সবাই রাজনীতির লোকজন। তাঁদের বক্তৃতায় আলোচ্য বিষয়ের চেয়ে সিংহভাগ জুড়ে থাকে ছিরিছাঁদহীন রাজনীতির কথা। থাকে, মধু’র বদলে পরস্পরের প্রতি তিক্ত হুল…। ইতরোচিত ভাষায় পরস্পরের প্রতি চোখা চোখা বাণ নিক্ষেপ করে তাঁরা বীরদর্পে মঞ্চ ছাড়েন। শ্রোতারাও বুকের মধ্যে একরাশ অতৃপ্তি নিয়ে যে-যার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। কেবল আজ, বহুকাল বাদে, গোয়ালপাড়ার মানুষ ফের শুনতে পেলেন এমন উচ্চাঙ্গের কাব্যিমাখা আলঙ্কারিক বক্তৃতা। তাও এমন একজনের কাছে, অর্থনীতির মতো নিরস ও জটিল বিষয় নিয়ে সম্বৎসর বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান যিনি সারা দুনিয়া জুড়ে। সব মিলিয়ে আজকের সভাটা পনেরোআনা শ্রোতার কাছে সেই কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এবং ড. সেনের মতো মানুষের মুখ থেকে এমন একটি বক্তৃতা বের করে আনবার পেছনে যা-কিছু কৃতিত্ব, প্রায় সবটুকুই পৌরপিতা বঙ্কুবিহারী সেনডেকা’রই প্রাপ্য। কারণ, তিনি তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে ড. সেনের জন্মভূমি সম্পর্কে এমন-একটি মূল্যবান তথ্য না-পেশ করলে, ড. সেনের বুকের ভেতর থেকে এমন-একটি হৃদয়-নিংড়োনা ভাষণ কখনোই বেরিয়ে আসতো না ।

সব মিলিয়ে, সভাশেষে যখন বাড়ি ফিরলেন বঙ্কুবিহারী, প্রাণটি তাঁর একেবারে কানায় কানায়। গৃহিণীসহ বাড়ির সবাইকে, এমনকী, পড়শিদের মধ্যে যারা ওই সভায় যেতে পারেনি, তাদেরও জনে জনে ডেকে বিতাং করে জানালেন তাঁর সাফল্যের কাহিনী।  
ওই নিয়ে রাতের বেলায় একটা ডগোমগো স্বপ্নও দেখে ফেললেন।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.