গল্প

গল্প বেসরকারিকরণ

বেসরকারিকরণ

লেখক : তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

চুরি হওয়ায় নিশীথবাবু স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন
কর্তব্যরত অফিসার বললেন, কি ব্যাপার বলুন
নিশীথবাবু বললেন, চুরি হয়েছে, ডাইরি করবো
কর্তব্যরত অফিসার বললেন, আপনি কার পুলিশ চান ?
নিশীথবাবুর দুই ঠোঁটের মধ্যে হাফইঞ্চি ফাঁক হলো, অবাক হয়ে বললেন, মানে !
----- মানে আবার কি ! মানে আপনি রিলায়েন্সের পুলিশ না আদানির পুলিশ না টাটার পুলিশ কোনটা চান ?
----- মানে !
----- শুধু মানে মানে করে ! যা বললাম বাংলায় বললাম তো, মানে বুঝলেন না
অফিসারের ধমক খেয়ে সব কথা হারিয়ে ফেলেছেন নিশীথবাবু, কিছু বলতে পারছেন না, কিছু বুঝতে পারছেন না, তিনি তো জানেন পুলিশ প্রশাসানের, অফিসার এ সব কি বলছেন !
নিশীথবাবুকে চুপ করে থাকতে দেখে অফিসার কি বুঝলেন তা উনিই জানেন, কিন্তু বললেন এই মুহূর্তে ঐ তিনটে কোম্পানিরই পুলিশ দিতে পারবো, তবে বছর খানেকের মধ্যে আরো কয়েকটা কোম্পানির পুলিশ বাজারে এসে যাচ্ছে, অপশন বেশি থাকবে, আপনাদের বেছে নিতে সুবিধা হবে
শুনতে শুনতে নিশীথবাবুর নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড় , পুলিশ তো একটা সরকারি ব্যাপার সেখানে অফিসার ভদ্রলোক এসব কি বলছেন !
নিশীথবাবু বোবা,
তাই অফিসার নিজের কথা বলায় বেশ মেজাজ পাচ্ছেন, বললেন, সরকার কি সুন্দর দেশটা কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলুন তো ! সব বেসরকারি হওয়ার পরে আমরা কি ভেবে ছিলাম ? অনেক যোগ্যতা আছে সরকারের, সব বেসরকারি করতে পেরেছে, কিন্তু পুলিশ বেসরকারি করতে পারবেনা, কিন্তু সেটাও তো করে দেখিয়ে দিলো, বাবা একেই বলে দক্ষতা
অফিসার সব ক'টা দাঁত বের করে হাসলেন
নিশীথবাবু অনেক কষ্টে নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন , এ সব কবে হলো ?
মুহূর্তেই কে যেন অফিসারের হাসি ব্লটিংপেপার দিয়ে শুষে নিলো, এবারেও অফিসার সব ক'টা দাঁত দেখালেন, তবে হাসিতে নয়
বললেন, কোন দেশে থাকেন আপনি ! টি ভি দেখেন না ! কাগজ পড়েন না ! আরে বাবা ব্রেনবুক তো করেন, এ্যাপননস্টপ তো দেখতেই হয়, তার কোনো একটা থেকে খবরটা পান নি ! আজব লোক তো আপনি !
অফিসার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, বেশ উত্তেজিত, দাঁড়ান দাঁড়ান একটা ছবি নিই আপনার , ব্রেনবুকে পোস্ট করবো, নীচে ক্যাপসান দিতে হবে, এ যুগেও আছে এমন মানুষ !
অফিসার নিশীথবাবুর সামনে চলে এসেছেন, মোবাইলে নিশীথবাবুর ছবি নিচ্ছেন
নিশীথবাবুর নিজেকে মনে হচ্ছে লোকালয়ে ঢুকে পড়া বাঘরোল,
তিনি কি করে বোঝাবেন পাঁচঘন্টা ঘুমিয়ে তাকে উনিশ ঘন্টার জীবন বাঁচিয়ে রাখতে হয়
বাজারের সামনে কচুরি সিঙারা তেলেভাজার দোকান নিশীথবাবুর
সেটা কে সচল রাখতে গিয়ে একা মানুষ নিশীথবাবুকে দিনের মধ্যে আঠেরো উনিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকতে হয়, তাও মাঝে মধ্যে মনে হয় এবার ওপারে চলে গেলে মন্দ হয় না
সেই মানুষ কখন কাগজ পড়বে ! কখন টি ভি দেখবে ! ব্রেনবুক করবে, এ্যাপননস্টপ খুলবে, আর কেনই বা খুলবে !
মানুষের তো এইসব কতো কিছু আছে, তাও তার তেলেভাজা দোকানের ঐ ছোটো বেঞ্চটা'র দরকার পড়লো !

নিশীথবাবু জানে কারা নিয়েছে,
লাখ টাকার বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দুলালরা রাতে ফুটপাতেই মদ খাবে কিন্তু ফুটপাতে বসতে পারবেনা, তাদের ফুটপাথের ধারে ঝুপড়ি দোকানের বেঞ্চ টুল এইসবের দরকার পরে, তা দরকার পড়ুক, দরকার ফুরলে জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে দাও, তা নয়, কোথায় পেতেছিল তাই মনে করতে পারেনা,
বাইকে যেমন ফুল ট্যাঙ্ক তেল থাকে, পেটে তখন ফুল বডি মদ
একবার ভেবেও দেখেনা ঝুপড়ির দোকানে বেঞ্চটা কতো দরকারি
তা খবরেরকাগজ খুললে, টি ভি দেখলে, ব্রেনবুক করলে, এ্যাপননস্টপ দেখলে যে ঐ লোকগুলোর সঙ্গেই দেখা হবে,
তা হলে কেনো, কেনো এই সব জিনিস নিশীথবাবু দেখবেন ! কিছুতেই দেখবেন না
এবার আর কয়েক মুহূর্ত আগের মতো ভয় পেলেন না নিশীথবাবু, কি রকম মরিয়া হয়ে বলে উঠলেন ,আমি ওসব করিনা, দেখিনা, আমি কোনো খবর পাইনি, এ সব কি বলছেন রিলায়েন্সের পুলিশ, আদানির পুলিশ, টাটার পুলিশ, কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা আমি
এবার অফিসার ভদ্রলোক একটুও রাগ করলেন না, মোলায়েম হেসে নিজের চেয়ারে ফিরে গেলেন, নিশীথবাবুর দিকে হাল্কা হাসি নিয়ে বললেন, বসুন
নিশীথবাবুর ভেতরটা ব্রেক কষলো, হটাৎ অফিসার এতোটা পাল্টে গেলেন !
যাই হোক অফিসারের সামনে এসে চেয়ারে বসলেন
অফিসার ভদ্রলোক তার টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা কাগজ বের করলেন, টেবিলের ওপরে নিশীথবাবুর সামনে রেখে বললেন, এই দেখুন,৩১.০১.২০৩৫ তারিখের অর্ডার, প্রাইভেটাইজেশান অফ পুলিশ, তার মানে প্রায় চার মাস হতে চললো, আর এটা আপনি জানেন না ! এটা তো ভাইরালও হয়েছে
নিশীথবাবু আবার বোবা, দেশ কতো এগিয়ে গেছে, তিনি কিছুই জানেন না, শুধু তেলেভাজাই ভেজে গেলেন
নিশীথবাবুর ম্রিয় মুখের দিকে তাকিয়ে অফিসার বললেন, ওসব কথা থাক, আপনি কার পুলিশ নেবেন বলুন, যদি রিলায়েন্সের নেন তবে একজন অফিসার দুজন কনস্টেবল পরবে তিন হাজার চারশো, যদি আদানির নেন তবে একটা প্যাকেজ পাচ্ছেন, ওদেরটা চার হাজার দুশো, তবে একটা নিলে একটা ফ্রি পাচ্ছেন
----- ফ্রি !
------ হ্যাঁ, মানে যে চুরির জন্য আপনি অফারটা নিলেন, তার পরের চুরিটার তদন্ত ফ্রি, আর চুরি তো লেগেই আছে, এই অফারটার কথা ভেবে দেখতে পারেন, আর টাটার টা হচ্ছে এক অফিসার এক কনস্টেবল বাইশো টাকা, প্রতি এক্সট্রা অফিসার পাঁচশো, এক্সট্রা কনস্টেবল তিনশো, ছোটো চুরির কেসে এই শেষের অফারটা কিন্তু বেশ ভালো
নিশীথবাবুর মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে থানায় না থেকে তার হাসপাতালে থাকলে ঠিক ছিলো
বোবা নিশীথবাবুর দিকে তাকিয়ে অফিসার বললেন ঘাবড়াবেন না, আমি আপনাকে সঠিক এস্টিমেট করে দিচ্ছি, মানে চুরির ওপর বিচার করে আপনি প্যাকেজ বাছুন, মানে চুরি যাওয়া জিনিসের মূল্যের থেকে প্যাকেজের দাম বেশি হলে তো চলবে না,
অফিসার দম নিলেন তারপর বললেন আপনার কী চুরি গেছে
নিশীথবাবু আমতা আমতা করে বললেন, বেঞ্চ
---- বেঞ্চ ! মানে বসার বেঞ্চ !
---- হ্যাঁ
---- হে হে, ভ্যাগ্গিস কোনো প্যাকেজ নিয়ে নেননি, বেঞ্চের দাম আর কতো হবে, হাজার দুয়েক টাকার মধ্যে তো হয়ে যাবে, আর যে কোনো প্যাকেজ দু হাজার টাকার ওপরে, ডাইরি করা মানে তো আপনার লস, না, না, একদম ডায়রি করবেন না
নিশীথবাবু বুঝলেন এবার যে ভাবেই হোক তাকে থানা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে না হলে এ জীবনে তার নিঃশ্বাস নেওয়া হবেনা
নিশীথবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তা হলে আমি আসি
অফিসার একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ আসুন.....
নিশীথবাবু দরজার দিকে পা তুলে ছিলেন, অফিসার বললেন, দাঁড়ান দাঁড়ান, তিনশোটা টাকা দিয়ে যান
----- কেনো !
----- সার্ভিস কাম গাইডেন্স চার্জ
----- মানে !
----- এই যে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলা হলো, আপনি তো ব্যাপারটা জানতেনও না, কতো কিছু জানলেন, তারপর আপনার কতোগুলো টাকা বেঁচে গেল, দুম করে তো একটা ডায়রি করে বসছিলেন, এই যে আপনাকে হিসেব করে বুঝিয়ে দিলাম ডায়রি করার থেকে নতুন বেঞ্চ কিনে নিলে আপনার টাকা সাশ্রয় হবে,তা এর জন্য একটা চার্জ লাগবে না !
অফিসার আবার মোলায়েম হাসলেন, বললেন এটা জেনে আপনার ভালো লাগবে এই যে টাকাটা আপনি দিচ্ছেন এটা কোনো কোম্পানির ঘরে যাচ্ছেনা, এটা সরকারের ঘরেই জমা পড়বে, এবার থেকে তদন্ত করবে প্রাইভেট সংস্থা, তার জন্য যা টাকা লাগবে তা আপনাকে দিতে হবে, আমরা শুধু এই সামান্য মূল্যে আপনাকে গাইডেন্স দেবো, এতে আপনার কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে, দুম করে প্যাকেজ নেওয়ার আগে আপনি বুঝে যাবেন আপনার ডায়রি করা উচিত হবে কি না, বুঝলেন তো, তিনশোটা টাকা বের করুন
নিশীথবাবু পকেট থেকে নিজের প্রাণটা বের করে ফেললেন

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.