গল্প একটি নারী জীবন
শিয়ালদহ থেকে ৩টে ২৭ এর ট্রেন টা প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে উর্মি ধরে ফেললো। বাড়িতে সপ্তর্ষিকে বৃদ্ধা মায়ের কাছে রেখে এসেছে। গতকাল থেকে ছেলেটার জ্বর। ডাক্তার জ্বরের ওষুধ দিয়ে বলেছেন ব্লাড টেস্ট করাতে। সকালে আসার সময় ১০১ জ্বর দেখে এসেছিল। গতকাল ১০৩ জ্বর ছিল। কৃষ্ণনগর পৌঁচ্ছাতে পৌঁচ্ছাতে ছটা বেজে যাবে তারপর আরো ১৫ মিনিট লাগবে বাড়ি পৌঁচ্ছাতে। ছেলেকে নিয়ে যাবে ব্লাড টেস্ট করাতে। মন চাইছিল না আজ অফিসে আসতে। বড়বাবুকে ফোন করতেই বললেন আসতেই হবে, জরুরী ফাইল টা উর্মির আলমারিতেই। ঐ ফাইল ক্লিয়ার না করলে টেন্ডার ভরা যাবে না। কি আর করা যাবে, সকালে কোন রকমে নাকে মুখে গুঁজে সকাল ৭ টার লোকাল ধরে অফিস। মাকে বলে এসেছিল খিচুড়ি বানিয়ে ছেলেকে আর মাকে খেয়ে নিতে। ব্যারাকপুর আসতেই জানালার ধারে একটা বসার জায়গা পেলো উর্মি। বসেই ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে জল খেলো।
উর্মির হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ'তো ২৮ শে জানুয়ারী, বিবাহ বার্ষিকী। দেখতে দেখতে দশটা বছর কেটে গেলো। উর্মি আর মনেও করতে চায় না এই দিন টাকে।
অথচ জীবন টা শুরু করেছিল অনেক স্বপ্ন নিয়ে। সুশোভনের সাথে পরিচয় হয়েছিল ওদের কলেজের রজত জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে। উর্মির বাবাই ছিলেন তখন ঐ কলেজের প্রিন্সিপাল। উর্মি ছিল মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই খুব আদরে আদরে বড় হয়েছিল।
উর্মির মনে পড়ে গেলো সুশোভনের সাথে প্রথম আলাপের কথা । সুশোভন'ই ছিল কলেজের একজিবিশনের দায়িত্বে রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে। খুব সুন্দর ভাবে একজিবিশনের বিভিন্ন সায়েন্টিফিক ও যান্ত্রিক মডেল গুলো বুঝিয়ে ছিল সেদিন মাকে আর ওকে। প্রথম পরিচয়েই উর্মি সুশোভন কে পছন্দ করে ফেলেছিল। উর্মি তখন কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আর সুশোভন থার্ড ইয়ারে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল।
সেদিন বিচিত্রা অনুষ্ঠান শুরুর একটু পরেই উর্মি হলের বাইরে বেড়িয়ে এসে সুশোভন কে দেখলো কয়েকটা ছেলের সাথে গল্প করছে। উর্মি ওদের মাঝে গিয়ে সুশোভন কে বললো - একটু শুনবেন । সকলেই উর্মির দিকে অবাক চোখে তাকালো।
সুশোভন বললো - বলুন।
উর্মি বললো - এখানে চায়ের ব্যবস্থা আছে? আমি আর মা খেতাম। বাবা তো স্টেজে বসে আছেন তাই মা বললো আপনাকে বলতে।
সুশোভন মনে মনে ভাবলো প্রিন্সিপালের মেয়ে বলে কথা, তাই বললো - আসুন গেটের কাছেই চায়ের স্টল আছে।
চায়ের স্টলে সুশোভন দু'টো চায়ের অর্ডার দিতেই উর্মি বললো - কেন আপনি খাবেন না? সুশোভন কিছু না বলেই তিনটে চায়ের অর্ডার দিয়ে দু'টো আগে দিতে বললো।
উর্মি বললো - By the way আমি উর্মি মজুমদার।
সুশোভন হেসে বললো - আমি সুশোভন বসু।
উর্মি চা খেতে খেতে বললো - চায়ের জন্য ধন্যবাদ।
সুশোভন - It's my pleasure.
উর্মি - চা'টা বানিয়েছেও ভাল।
সুশোভন হাসলো।
উর্মি - আপনার মেয়ে বন্ধু নেই?
সুশোভন কথাটা শুনে হতচকিত হয়ে বললো - এখন পর্যন্ত তো নেই।
উর্মি - আপনি কোথায় থাকেন?
সুশোভন - চকের পাড়া।
উর্মি - কাল বিকালে ৪ টের সময় পোস্ট অফিসের মোড়ে আসতে পারবেন?
সুশোভন - কেন?
উর্মি - এমনি, আপনার সাথে দেখা করতাম,গল্প করতাম ।
সুশোভন - ঠিক আছে।
সুশোভন নিজে গিয়ে উর্মির মায়ের হাতে চা পৌঁছে দিল।
পরের দিন যথারীতি দুজনের দেখা হ'ল পোস্ট অফিসের মোড়ে।
পরবর্তী কালে এই দেখা করাটা বিভিন্ন জায়গায় হতে লাগলো এবং প্রেমে পরিণত হ'ল।
দেখতে দেখতে সুশোভন কোর্স কমপ্লিট করে আর্মিতে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে জয়েন করলো রাঁচিতে।
উর্মি ও অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে ইংরেজি নিয়ে এম এ তে ভর্তি হ'ল।
প্রেমের কথা দুই বাড়িতেই জানা জানি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই ।
সুশোভন দের ট্রান্সপোর্ট এর বিজনেস, বিরাট বাড়ি, দুটো বাস,দুটো লড়ি। জমিজমা ইত্যাদি।
বিশাল বাড়িতে মা থাকেন আর সুশোভনের থেকে দশ বছরের বড় দাদা আর তার স্ত্রী। ছেলে পুলে হয়নি তাদের। বাবা বছর চারেক আগে মারা গেছেন ক্যন্সারে। বড়দাই বিজনেস টা দেখা শোনা করেন এবং রাজনীতি ও করেন।
এই সব দেখে উর্মির বাড়ি থেকেও সব মেনে নিয়েছিল।
অবশেষে এম এ পড়তে পড়তেই দুই বাড়ির আগ্রহেই ২৮ শে জানুয়ারী ২০১০ তে ওদের ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেলো।
উর্মি এম এ টা কমপ্লিট করবে বলে সুশোভনের চাকরি স্থলে পনেরো'টা দিন কাটিয়ে ফিরো এলো এবং শশুড় বাড়িতেই থেকে গেলো।
সুশোভন ছুটি পেলেই কিংবা কলকাতার কোন কাজ নিয়ে উর্মির কাছে চলে আসতো।
দেখতে দেখতে বিয়ের এক বছর কেটে গেলো।
সেবার সুশোভন তিন মাস পর বাড়ি এলো, প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে দুজনে একসাথে কাটাবে বলে। সুশোভন বাড়ি এলেই উর্মির খুব যত্ন করে। উর্মির মা বিয়ের সময় বলেছিলেন - জামাই -বাবা উর্মির খেয়াল রেখো, ও কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আদরে আদরে বড় হয়েছে।
প্রথম বিবাহবার্ষিকী সকলের সাথে মানাবে বলে কোথাও ঘুরতে গেল না। আত্মীয় স্বজন মিলে খুব সুন্দর করে বিবাহ বার্ষিকী পালন করলো। অনেকদিন পর দুজনে দুজনকে পেয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো একে অপরকে।
কুড়িটা দিন কি ভাবে কেটে গেলো দুজনেই বুঝতে পারলো না। সুশোভন রাঁচিতে ফিরে গেল। দুই দিন পরে সুশোভনের ফোন এলো - বিশেষ কাজে জম্মু যাচ্ছি দুই মাসের জন্য।
উর্মি বি এডের পরীক্ষার জন্য তৈরী হচ্ছে।
হঠাৎ কোথা থেকে উর্মির জীবনে বিশাল ঝড় এলো!
সেদিন হঠাৎ সকাল থেকেই মুষল ধারে বৃষ্টি এলো তার সাথে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। বাড়িতে মা একা। ভাসুর পার্টির মিটিং করতে গেছেন করিমপুর। ফিরতে দেরি হবে। তার স্ত্রী গেছেন বাপের বাড়ি, পলাশী।
উর্মি ওপরে থাকেন মা নিচের ঘরে।
দুজনেই বেশ তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরেছে।
তখন মাঝ রাত হবে বোধহয়, দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হ'ল। উর্মির ঘুম ভেঙ্গে গেলো, কিছু বোঝার আগেই আবার কড়া নাড়ার আওয়াজ হ'ল - উর্মি একটু ভয়ে ভয়ে বললো - কে?
ভাসুরের গলা পেলো।
ভাসুর বললেন - ছোট বৌ দেখোতো কিছু খাবার আছে নাকি।
ভাসুরের গলা শুনে বুকে বল এলো।
উর্মি বললো - আপনি ঘরে গিয়ে বসুন, আমি দেখছি।
উর্মি লাইট জ্বেলে দরজা খুলতেই দেখে ভাসুর সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।
উর্মি বললো সরুন আমি রান্না ঘর থেকে খাবার আনি।
কিছু বোঝার আগেই ভাসুর উর্মির মুখ চেপে ধরে ঘরে ডুকিয়ে দরজায় খিল দিলো। বিশাল বপু চেহারার কাছে পেরে উঠতে পারলোনা উর্মি, তবুও মরিয়া হয়ে সর্বনাশ হতে বাঁচতে শেষ চেষ্টা করতেই ভাসুর পিস্তলের ঠান্ডা নল টা মুখে গুঁজে দিলো। ভাসুরের মুখ দিয়ে মদের গন্ধে বমি এলো।
ভাসুর পিস্তল টা মুখে গুঁজে রেখেই বললো - কাক পক্ষী ও যেন জানতে না পারে!
পরক্ষণেই তলপেটে বিশাল এক লাথি খেয়ে জ্ঞান হারালো উর্মি। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সব শেষ হয়ে গেছে! অনুভব করলো সারা শরীরে যন্ত্রণা। অন্ধকার ঘর, শরীরে বস্ত্র নেই! প্রথমেই মনে হ'ল আত্মহত্যার কথা। কোন রকমেই পোষাক হাতরে গায়ে জড়িয়ে আবার মাথা ঘুরে বিছানায় পরে জ্ঞান হারালো।
সকালে বৌমার সারা শব্দ না পেয়ে শাশুড়ি উপরে এসে দেখে বৌমার ঘর বাইরে থেকে বন্ধ। বিপদের গন্ধ পেয়ে দরজা খুলে বৌমার ঘরের আর বৌমার অবস্থা দেখে কিছু বুঝতে বাঁকি রইলো না।
জলের ছিটে দিয়ে বেশ কয়েকবার ঝাপটা দিতেই উর্মি চোখ মেলে তাকাতেই শাশুড়ি কে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
শাশুড়ি ফোন করে বড় বৌমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কৃষ্ণনগরে ফিরে আসতে বললেন। উর্মি তখনও কেঁদেই চলছে। শাশুড়ি জোর করে এক গ্লাস গরম দুধ খাওয়ালেন।
শাশুড়ি গেটের দারোয়ান কে নিজের ঘরে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলেন - বড় দাদা কখন এসেছিলো?
দারোয়ান বললেন - রাত দুটো নাগাদ এসেছিলেন আবার এক ঘন্টা পরে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।
উর্মির কাছে এর থেকেও একটা বড় দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিলো সেটা কল্পনার অতীত!
বড় বৌ দশটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছে ঘটনা টা জেনে উর্মি কেই এর জন্য দোষী সাব্যস্ত করলো।
বড় বৌ বললেন - এতে উর্মিই তার স্বামী কে প্ররোচিত করেছে এবং তার একমাত্র লক্ষ্য এই বাড়ীর সম্পত্তি।
ঠিক তখনই উর্মির ফোন বেজে উঠলো। উর্মি তখন বেহুঁশ কিংবা গাঢ় ঘুমে অচেতন। শাশুড়ি ফোন তুলে ওপার থেকে যে কথা শুনলেন তাতে জ্ঞান হারালেন।
বড় বৌমা ফোন টা তাড়াতাড়ি তুলে হ্যালো বলতেই - ওপার থেকে ভেসে এলো - আজ ভোরে জঙ্গী হামলায় সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন সুশোভন বসুর মৃত্যু হয়েছে।
বড় বৌমা দারোয়ান কে ডেকে পাশের বাড়ির লোককে ডেকে পাঠালেন।
শাশুড়িকে জলের ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেন। শাশুড়ি কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন।
বড় বৌমা নিজের বর কে ফোন করতেই ফোন সুইচ অফ পেলেন।
উর্মি সুশোভনের শ্রাদ্ধ শান্তি করে নিজেকে শক্ত করে দাঁড় করালো। সব মিটে যেতেই ঐ বাড়ি থেকে চলে এসেছিলো বাপের বাড়ি।
কিছুদিনের মধ্যেই উর্মি বুঝতে পারলো সে অন্তঃসত্ত্বা।
মা ও বাবা abortion করিয়ে নিতে বলেছিলো।
উর্মি বাচ্চা টাকে মারেনি।
বাবা মেয়ের কষ্ট দেখতে না পেরে এক বছরের মধ্যেই Heart attack হয়ে মারা গেলেন ।
উর্মি নিজের যোগ্যতায় কলকাতায় চাকরি পেয়েছে বছর পাঁচেক হ'ল।
আজ দেখতে দেখতে আট পেরিয়ে নয়ে পা দিয়েছে।
সপ্তর্ষি।
কৃষ্ণনগর স্টেশনে ট্রেন টা ঢুকছে।
উর্মির আর সেই বিভীষিকাময় দিন গুলো মনে করতে একদম ইচ্ছা করে না ।
তবুও বার বার একটা চিন্তা উর্মির মন টাকে কাঁটা ফোটায় - সপ্তর্ষির বায়োলজিক্যাল বাবা কে?! সুশোভন না সে ... ।
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.