প্রবন্ধ বিস্মৃতপ্রায় কবি অজিত দত্ত
কবি অজিত দত্ত , ১৯০৭ সালে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 1930 সালে এম.এ পাস করে ঢাকা , কলকাতা বিভিন্ন কলেজ অতিক্রম করে , শেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটে। বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্তের মিলিজুলি সম্পাদনায় " প্রগতি" পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে। রোমান্টিক প্রেমের কবি হলেও সমকালীন কবিদের মধ্যে যে উগ্ৰ রবীন্দ্র বিরোধিতা ছিল , কবি অজিত দত্ত তা মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন না। ১৯৭৯ সালে পরলোকগমন করেন।
অজিত দত্ত মোট সাতটি কাব্য সংকলন বিনির্মান করেছেন---
১৯৩০ এ "কুসুমের মাস", ১৯৩৮ শে "পাতালকন্যা", ১৯৪৫-এ " নষ্ট চাঁদ", ১৯৪৬ এ "পুনর্ণবা" ১৯৫০ এর "ছড়ার বই" , ১৯৫১ এ "ছায়ার আলপনা" ১৯৫৯ এ "জানালা"।
কবি অজিত দত্ত মূলত রোমান্টিক প্রেমের কবি। নারী ও প্রকৃতিকে শুভ দৃষ্টিতে দেখেছেন " কুসুমের মাস" কাব্যগ্ৰন্থের নাম কবিতায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত---
"আমিও কুসুমপ্রিয়। আজকে তো কুসুমের মাস।
মোর হাতে হাত দাও, চলো যাই কুসুম- বিতানে ।
বসিয়া নিভৃত কুঞ্জে কহিব তোমার কানে - কানে,
কোন ফুলে ভরিয়াছে জীবনের মধু অবকাশ"।
এই কাব্য গ্ৰন্থ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য--"প্রতিটি কথায় বর্ষার কোনো সিক্ত ফুলের মৃদু স্পর্শ, লঘু সৌরভ"। কবি জীবনানন্দের সুযষ নায়িকা 'বনলতা' তেমনি কবি অজিত দত্তের নায়িকা 'মালতী সুতরাং নায়িকার মালতীর চিত্রাঙ্কন স্বাভাবিক---
"মালতীর জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত্রি হয়েছে আতুর
একটি চুম্বন - তবে একটি গভীর আলিঙ্গন,
নিটল যৌবন তার রূপমদ্যে আজি ভরপুর
আকাশেও জ্যোৎস্না নয়, মালতীর সোনার স্বপন"।
জনপ্রিয় 'মালতি' আলোচনায় জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন-- "সৌন্দর্যের পরম প্রকাশে , মৃত্যু ও অমৃত পিপাসার মহাসঙ্গমে, অজিত দত্তের কুসুমের মাস প্রেম চেতনার তুঙ্গশিখর স্পর্শ করেছে। মৃত্যুকে সম্মুখে রেখেই কবি প্রেমের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন----।----কবিচিত্তে এই প্রেমের আলম্বন --- স্বরূপিনীর নাম "মালতী" । মৃত্যুস্বয়ম্বরা এই মালতি কে ভালোবেসেই কবি পেয়েছেন জীবনসত্য কে"।
কবি অজিত দত্ত র "পাতালকন্যা" কাব্যগ্রন্থের 'রাঙা সন্ধ্যা' কবিতায় লিখেছেন----
"তুমি নীড়, তুমি উষ্ণ কোমল, পাখার শব্দ ক্ষীন।
তবু সে আমাকে ডাকে , ডাকে শুধু ছেদহীন ক্ষমাহীন"।
কবির ''নষ্টচাঁদ" কাব্যগ্রন্থের কবিতায় স্বপ্নচ্ছন্নতা মিলিয়ে গেছে সত্যচেতনার উপলব্ধিতে '"তুমি পাশে থাকো রুপোর কাঠিতে মূর্ছিতা চিরদিন"।
রোমান্টিক কবি 'আকাঙ্ক্ষা'কবিতায় অকপটে তার ভাবনাকে ব্যক্ত করেছেন---
"আমি শুধু এ জীবনে আহরিতে চাই প্রাণ ভরে
তোমার সুন্দর প্রেম , তোমার সিন্ধুর মতো স্নেহ"।
এ প্রসঙ্গে উত্তর আধুনিক ভাবনার কবি রেবা সরকার এর কয়েকটি চরণ প্রধানযোগ্য । কবি রেবা সরকার এর "স্বভূমে আমি একা"কাব্যগ্রন্থের 'ভালোবাসার কথা' কবিতায় কবি বলেছেন--
"সেদিন মা টেলিফোনে জানতে চায় সম্পূর্ণ
ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথা
অথচ সত্যি কথা আমি আজও জানাতে পারি না"
কবি অজিত দত্তের অধিকাংশ কবিতা সনেট কেন্দ্রিক। ষষ্ঠক - অষ্টক অনবদ্য যোজনায় , টেকনিক ,মিল বিন্যাস, ব্যঞ্জনার সংযম ও ভাবের পিনন্ধতায় ভরপুর।
অজিত দত্তের কাব্যের ভাষা মার্জিত সংযত আবার মাঝেমধ্যে পরিহাস রসিকতা রয়েছে। উদাহরণস্বরপ "বদ্যিনাথ ও পদ্যলেখে'কবিতার চরণ স্মরণযোগ্য---
"চোদ্দখানা ডিকশনারি
চলন্তিকা সঙ্গে তারি
সামনে থাকে , তার উপরে
দুজন ডি-লিট মাইনে করে
কাজেই আছেঃ কখন কি যে
আটকে যাবে, বদ্যি নিজে
তাই কি জানে"?
কবি ছোটদের জন্য 'দামু' কবিতায় অলংকার ও ছন্দের দোলা প্রয়োগ করেছেন। যেমন ---
"কিছু খায় ছিনিয়ে সে কিছু চেয়ে - চিন্তে,
দাম দিতে ভোলে সদা, সব-কিছু কিনতে,
যায় আমাজাদিয়া-ই
খায় দাম না দিয়াই"!
কবি অজিত দত্তের কাব্যের করণকৃতি আলোচনা প্রসঙ্গে সমালোচক জগদীশ ভট্টাচার্যের মন্তব্য স্মরণযোগ্য ----
"এই জীবন রসিক কবির বিশুদ্ধ কাব্যলীলা 'স্বাদু স্বাদু পদে পদে'। জীবনকে, জীবনের মহিমাকে তিনি ভালোবেসেছেন ---- প্রেমকে প্রেমের বেদনাকে। তার কাব্যে এই ভালোবাসাই শরতের নির্মল আকাশের নীলিমার মত বারবার কাব্যরসিকের মনে ফিরে ফিরে আসবে। যুগ জীবনের দুর্যোগ ঘনঘটায় সে নীলিমা হয়তো মাঝে মাঝে ঢাকা পড়বে । কিন্তু কবিতার জীবনের ছোট্ট জানালায় বসে নিজের মতো করে , বিশ্ব জীবনের যে আনন্দরূপ সহৃদয় সমাজকে উপহার দিয়েছেন, সেই আনন্দের ঋনশোধ চিরকালের কাব্যরসিক অবশ্যই করবেন"।
তথ্যসূত্রঃ--
১.প্রগতি--বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত
২.বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস--(-আধুনিক যুগ---১৯৫০-২০০০)
দেবেশ কুমার আচার্য্য।
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.