প্রবন্ধ

প্রবন্ধ মানব মনের মুক্তি

মানব মনের মুক্তি

লেখক : অমিতাভ মাইতি

"নব বসন্তের দানের ডালি
এনেছি তোদেরি দ্বারে,
আয় আয় আয়,
পরিবি গলার হারে।
লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী
মরিছে কেঁদে..."

(রাগ : কালাংড়া, তাল : ষষ্ঠী, পর্যায় : প্রকৃতি)
'নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা'য় (১৯৩৮) রবীন্দ্রনাথ শ্রেণী-গোত্র-লিঙ্গ পরিচয় অতিক্রম করে মানবের মুক্তির ক্যানভাস এঁকেছেন। সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন তাঁর রচিত 'নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা'য়। সমাজের নিপীড়িত অবহেলিত পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে যে রবীন্দ্রনাথ, তা আমরা বার বার তাঁর লেখনির মধ্যে খুঁজে পাই। 'চন্ডালিকা' নৃত্যনাট্য মন্থনে আমরা রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে এই মূল স্বর অর্থাৎ অস্পৃশ্যতা ও কায়েমী আধিপত্যবাদের বিরোধিতা অনেক বেশি মাত্রায় দেখতে পাই।

"ওকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,
ও যে চন্ডালিনীর ঝি..."
(রাগ : ইমন-ভূপালি, তাল : দাদরা, পর্যায় : নাট্যগীতি)

সমাজের নিষ্ঠুর বর্ণপ্রথা ও লোকাচারের শিকার চন্ডালকন্যা 'প্রকৃতি'। ধর্মের মধ্যে বৈষম্য, জাতপাতের ভেদাভেদ ও অস্পৃশ্যতার মতো বিষয়গুলো যে কতটা ঠুনকো, তা কত সহজে চোখে আঙ্গুল দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন এই নৃত্যনাট্যে।

'চন্ডালিকা'য় তিনি অস্পৃশ্য নারীর প্রতীকী চরিত্র হিসাবে এক 'প্রকৃতি' নামের তরুণীকে তুলে ধরেছেন, যে অন্য জাতের কাছে অচ্ছুত। এখানে মানবতা লঙ্ঘিত হয় যখন চন্ডাল কন্যা প্রকৃতি ফুলওয়ালী, দইওয়ালা এবং চুড়ি বিক্রেতা দ্বারাও অবজ্ঞাত ও প্রত্যাখ্যাত হয়। এই অবজ্ঞাই প্রকৃতিকে রাগান্বিত করে তোলে ঈশ্বরের প্রতি --

"যে আমারে পাঠাল এই
অপমানের অন্ধকারে
পূজিব না, পূজিব না
সেই দেবতারে পূজিব না..."
(রাগ : সোহিনী, তাল : কাহারবা-তেওড়া-দাদরা, পর্যায় : নাট্যগীতি)

এইভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে দিয়ে চলছিল প্রকৃতির জীবন। ধীরে ধীরে জীবনের প্রতি তার একটা বিতৃষ্ণা জন্ম নিচ্ছে বোঝা যায় যখন সে তার মাকে বলে --
"কাজ নেই, কাজ নেই মা,
কাজ নেই মোর ঘরকন্নায়।
যাক ভেসে যাক
যাক ভেসে সব বন্যায় ..."
(রাগ : বেহাগ-ইমন, তাল : কাহারবা, রচনাকাল : ১৩৪৪/১৯৩৮)

এমনি একদিন প্রকৃতি কুয়ো থেকে জল তোলার সময় এক তৃষ্ণার্ত সৌম্যকান্তি বৌদ্ধ ভিক্ষুক (নাম আনন্দ) তার কাছে এসে জল চাইল --
"জল দাও আমায় জল দাও,
রৌদ্র প্রখরতর, পথ সুদীর্ঘ,
আমায় জল দাও..."
(রাগ : ভৈরবী, তাল : কাহারবা, রচনাকাল : ১৩৪৪/১৯৩৮)

সেই সৌম্যকান্তের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত কুন্ঠিত প্রকৃতি করজোড়ে বলে --
"ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো মোরে --
আমি চন্ডালের কন্যা,
মোর কূপের বারি অশুচি।
তোমারে দেব জল হেন পুণ্যের আমি
নহি অধিকারিণী,
আমি চন্ডালের কন্যা।"

বৌদ্ধ ভিক্ষুক আনন্দ প্রকৃতিকে মানবতার বাণী শোনায় --
"যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা।
সেই বারি তীর্থবারি
যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে..."

অবশেষে প্রকৃতির হাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুক আনন্দ জলপান ক'রে তৃষ্ণা নিবারণ করে, আর তাতেই প্রকৃতির সমস্ত অবগুন্ঠন খুলে যায়। নিজেকে সে অচ্ছুত, সমাজে অস্পৃশ্য অবহেলিত নারী থেকে মানুষ হিসাবে আবিষ্কার করে। সে আনন্দে মুক্তির স্নান করে --
"শুধু একটি গণ্ডূষ জল,
আহা নিলেন তাঁহার
করপুটের কমলকলিকায়।
আমার কূপ যে হল অকূল সমুদ্র..."
প্রকৃতি সৌম্যকান্তি আনন্দের মধ্যে নিজের ভেতরকার ঈশ্বরকে দেখতে পায়। আপন সত্তার স্বরূপ তার কাছে উন্মোচিত হয়। দেহকেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক দর্শন এই নাটকের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রবলভাবে তুলে ধরেন, যা প্রাচ্য দর্শনের মূলমন্ত্র।

বৌদ্ধ ভিক্ষুক আনন্দের সান্নিধ্য যেমন চন্ডাল কন্যা প্রকৃতির হৃদয়ে আনন্দের হিল্লোল তোলে, সমস্ত অন্ধ কুসংস্কার মন থেকে ঝেরে ফেলে, তেমনি বিশ্বপ্রেমিক, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ জগতের আনন্দযজ্ঞে চারিদিক উদ্ভাসিত করে ফসল কাটার আহ্বান জানান --
"মাটি তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে,
আয় আয় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,
মরি হায় হায় হায়...।"
(রাগ : বাউল, তাল : দাদরা, পর্যায় : নাট্যগীতি)

এদিকে চন্ডালকন্যা প্রকৃতি সৌম্যকান্তি আনন্দের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে --
"দিন যায়, রাত যায়, সব যায় --
আমি বসে হায়!
দেহে বল নাই, চোখে ঘুম নাই --
শুকায়ে গিয়েছে আঁখিজল..."
(রাগ : মিশ্র বেহাগ, তাল : ত্রিতাল, পর্যায় : প্রেম ও প্রকৃতি)

বৌদ্ধভিক্ষুক আনন্দ যে তাকে সমস্ত জাতপাত, অস্পৃশ্যতার ঊর্ধ্বে মানুষ সত্য এই অমৃত বাণী শুনিয়ে তার মনের সমস্ত অবগুন্ঠন উন্মোচন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তাইতো প্রকৃতি সমস্ত মন প্রাণ আজ আনন্দের প্রতীক্ষায় তৃষ্ণার্ত --
"চক্ষে আমার তৃষ্ণা,
ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন,
সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে..."
(রাগ : বৃন্দাবনী সারং-আড়ানা, তাল : ঝাঁপতাল, পর্যায় : প্রকৃতি)

নাটকের অন্তিম লগ্নে দেখা যায় মন্দিরে নৃত্যরত প্রকৃতি আর মন্ত্র উচ্চারণে নিমগ্ন তার মা, মায়া। এই দৃশ্যটা 'চন্ডালিকা' নৃত্যনাট্যের একটা বিশেষ দৃশ্য। দেহ আর মননের যুক্তযুক্তির মধ্য দিয়ে পরমে পৌঁছনোর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। নিজ দেহে ব্রহ্মান্ড আবিষ্কার করে প্রকৃতি। প্রকৃতির সেই নৃত্য কোন ট্র‍্যাডিশনাল নৃত্য নয়। সমস্ত ফর্মকে ভেঙেচুরে সাবকনশাস বডির আন-কনশাস উচ্চারণ। এ যেন সময়কে অতিক্রম করে মহাজাগতিক হয়ে ওঠে প্রকৃতি। সমাজ, রাজনীতির যে বাঁধন আছে তার সমস্ত কিছুর অবগুন্ঠন খুলে পরম-আনন্দের দেখা পায় প্রকৃতি। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করেন যে, সবার উপর মানুষ সত্য।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.