প্রবন্ধ

প্রবন্ধ বিধবা বিবাহের প্রথম উদ্যোক্তা রাজা রাজবল্লভ সেন

বিধবা বিবাহের প্রথম উদ্যোক্তা রাজা রাজবল্লভ সেন

লেখক : তীর্থ মিত্র

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে
ক্লীবে চ পতিতে পতৌ”।

অর্থাৎ পতি নিখোঁজ বা তার মৃত্যু হলে, নপুংসক বা পতিত হলে স্ত্রী আবার বিবাহ করতে পারেন।
বেদের চারটি ভাগের অন্যতম ভাগ সংগিতার অন্তর্গত, পরাশর সংগিতার এই শ্লোকটি লিখে পাঠিয়েছিলেন হুগলির ত্রিবেনীর মহা পন্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ঢাকার দেওয়ান মহারাজ রাজবল্লভ সেনকে।
এ প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে যা না বললেই নয়, আমরা সকলেই জানি ১৮৫৬ সালে ২৬শে জুলাই লর্ড ডালহৌসির সহায়তায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড ক্যানিং ‘বিধবা বিবাহ’ আইন প্রণয়ন করেন। যদিও সেই আইন কেবল বিধবা বিবাহকেই অনুমতি দিয়েছিল।
উপরোক্ত প্রসঙ্গে আসি। মহারাজা রাজবল্লভ সেন। জন্মের সঠিক সময় জানা না গেলেও ইতিহাহের পাতা থেকে জানা যায় ১৭০৭ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিক্রমপুরের লৌজং থানার অন্তর্গত বেজগাও গ্রামে। পিতা কৃষ্ণজীবন ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। সামান্য করণিকের চাকরি করতেন। রাজা রাজবল্লভ প্রথম জীবনে করণিকের চাকরি করলেও তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে মহারাজা খেতাব নিয়ে ঢাকার দেয়ান হন প্রথমে তারপর মুংগেরের ফৌজদারের পদও লাভ করেন। ক্রমশ যথেষ্ট বিত্তশালী হয়ে ওঠেন।
রাজা রাজবল্লভ যেমন বিত্তশালী ছিলেন তেমন মুক্তহস্তে দানও করতেন। তিনি প্রজাদের সুবিধার জন্য বেশকিছু খাল খনন করেন। যে খালগুলির মধ্যে ‘তালতলা খাল’ বিখ্যাত। এছারা অনেক মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি মন্দিরের দেবতার সেবার জন্য সম্পত্তিও দান করে গেছেন।
১৯৫৭ সালে মীরজাফর আলী খানের ষড়যন্ত্রে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লার পতনের অন্যতম কারিগর ছিলেন এই মহারাজা রাজবল্লভ। ১৯৫৭ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত যখন বাংলায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময় মীরজাফর আলী খান এবং ঘসিটি বেগমের অন্যতম উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন তিনি। শেষে ১৭৬৩ সালে নবাব মীর কাশিম, নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয় নিশ্চিত করার জন্য তার ভূমিকা বুজতে পেরে তাকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন।এজন্য বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে মহারাজা রাজবল্লভ সেনের পরিচয় বিশ্বাসঘাতক রূপে, এ প্রসঙ্গ ভিন্ন। এক্ষেত্রে আলোচনার জন্য নয়, কেবল উল্লেখ করা মাত্র।

মহারাজা রাজবল্লভ সেনের প্রথমা স্ত্রী শশীমুখীর গর্ভে দুই কন্যা ও সাতপুত্রের জন্ম হয়। দুই কন্যার মধ্যে কনিষ্ঠা কন্যার নাম ছিল ‘অভয়া’। অভয়া আবার সন্তানদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠও। তৎকালিন সামাজিক ‘গৌরি দান’ এর রীতি অনুযায়ী অভয়ার আট বছর বয়সে বিবাহ হয় বর্তমানে খুলনা জেলার অন্তর্গত সেনহাটি গ্রামের রূপেশ্বর সেনের সাথে। সে বিবাহ স্থায়ী হয়নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রুপেশ্বর এর মৃত্যু হয়, আট বছর বয়সী বালিকা অভয়া বিধবা হয়।আট বছর বয়সী সেই বালিকার বৈধব্য মেনে নিতে পারেন নি রাজা রাজবল্লভ।
সেই সময় ভারতের পণ্ডিতদের পীঠস্থান ছিল নবদ্বীপ। সারা ভারতে খ্যাতি ছিল নবদ্বীপের। সেই খ্যাতি ম্ল্যান করে দিয়েছিলেন হুগলির ত্রিবেনীর মহা পন্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। তার মতো শ্রুতিধর পণ্ডিতব্যক্তি গোটা ভারতে দ্বিতীয় ছিল কিনা সন্দেহ। পন্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মতামতের কথা রাজা রাজবল্লভ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের পণ্ডিতদের জানালে কেউ অমত করেন নি। কেননা জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কথার বিরোধিতা করার সাহশ কারো ছিল না। রাজা রাজবল্লভ মহা সমারহে আয়োজন করতে শুরু করেন অভয়ার দ্বিতীয় বার বিবাহের। ঠিক সেই সময় বিরোধিতা করেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিদ্যানুরাগী মানুষ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু উগ্র রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষও ছিলেন তিনি। ধর্মের নামে অন্ধ শাসক খুব কমই দেখা গেছে। তার মনে হয়েছিল এই বিবাহ মহাপাপের সমতুল। সমগ্র নবদ্বীপের পণ্ডিতদের কাছে মতামত চান এ বিশয়ে তাঁদেরও জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কথার বিরোধিতা করেন নি প্রথমে। শেষে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নানা উপহার পাঠান রাজা রাজবল্লভকে, সেই উপহারের সাথে একটি গোশাবকও পাঠান এবং বলেন বিবাহ শেষে রাজা রাজবল্লভ যেন ওই গোশাবকের মাংস খান। কেননা বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ হলেও লোকাচার বিরুদ্ধ, দেশাচারকে লঙ্ঘন করে, তাই মহাপাপ। গোমাংস খাওয়ার মতো।

রাজা রাজবল্লভ এমনিতে সাহসী হলেও এই সব বিষয়ে যথেষ্ট ভিতু ছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতামতের বিরোধিতা করার সাহস ছিল না। সেই আয়োজন বন্ধ করে দেন।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.