দিনের মধ্যভাগই ছিল তখন। কথা ছিল সূর্য ওলটানো ফটিক কড়াইটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে শহরে তার সাদা আলো ফেলবে।আকাশকে দেখাবে নীল। সূর্যের আলো সাদা হলেও তাকে আমরা ঠিক সাদা দেখব না। দেখি না সাদা। হলুদ দেখি। আকাশ বর্ণহীন হলেও তা আমাদের চোখে নীল রঙেই ধরা পড়ে।
শহরের বাসিন্দা হওয়ায় সূর্য আমাকেও তার কৃপা থেকে বঞ্চিত নিশ্চয় করত না। সবার মতোআমার মাথাতেও নিশ্চয় এসে পড়ত সেই হলুদ আলো। সূর্য অনেকের মতো নিবাতনিকম্প আমাকেওসীমানাহীননীলিমায় বদ্ধ জাহাজে বসিয়ে দিত। আমি মধ্যদুপুরে কাউকে ভালোবাসতাম। মনের সুখে ভালোবাসতাম। সীমানাহীন নীলিমার মাঝে ভেসে বেড়াত জল, নদী, সমুদ্র। অন্তহীন অবকাশ থাকত আমার হাতে। অবকাশের কারণে অলস হাতটি আমার প্রণয়ীর হাতকে মুঠোয় পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠত।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলামজানি না। হয়ত সেই মানুষটি জানে যার পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, একই গাছের নিচে, একই ছাতার পরিধির মধ্যে, ভীষণ ঘনিষ্ঠ হয়ে। গম্ভীর, জেদী, প্রতিশোধপরায়ণমেঘদানবসূর্যকে বন্দী করে তার সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়েছে, সাম্রাজ্যে বিস্তার করেছে কালোর রাজত্ব। দানবরাজ ছেড়ে দিয়েছেআকাশে ভাসমাননদী-সমুদ্রের জল। জল ধুয়ে দিচ্ছে আমার শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ, আমার চুল, মাথা, গলা, কাঁধ, বুক, হাত সব। আমি অনুভব করতে পারছি। দেখতে পারছি না। দেখতে চাইছি না। দেখলে ভালো দেখাবে না, পরোক্ষভাবে সঙ্গীটিকে বলা হবে, আপনিও দেখুন। হয়ত সঙ্গীর চোখদুটো আমার আমন্ত্রণের অপেক্ষা রাখেনি। অপেক্ষা না রাখলে কি দেখছে সেই চোখ আমি বুঝতেও পারছি না। আশপাশের লোকগুলো হয়ত ভাবছে আমরা স্বামী-স্ত্রী। কারণ তারা আমাদের মিলিত হওয়ার আগে দেখেনি, দেখছে মিলিত হওয়ার পরে। লোকগুলো আমাদের স্বামী-স্ত্রী ভাবলেই ভালো। নইলে আমরা তাদের চোখে খারাপ হব।
আমি এসেছি মিহিকার বাড়িতে। মিহিকা আমার কলেজেরবান্ধবী। ওর বিয়ে হয়েছে বছরখানেক আগে। সতেরো তলায় তিন বেডরুমের নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে সে নিউ টাউনে।সুখবৃষ্টি নামে শাপুরজি পালোনজি দ্বারা নির্মিত সাশ্রয়ী মূল্যের গণ-আবাসন প্রকল্পে লটারিতে খুব সস্তায় পেয়েছে। সেখানে অনেকরকম সুযোগ-সুবিধা আছে।অসুবিধে বলতে শুধু অনেকটা ভেতরে, ভেতরে অর্থাৎ দূরে, চলাচলের জন্য যানবাহন দুর্লভ।
নতুন ফ্ল্যাটে নতুন সংসার বসানোর পর থেকেই মিহিকা আমাকে ডেকেছে। বান্ধবী যতই কাছের হোক দ্বিধা ছিল। তাছাড়া সমস্যাও। দু’জনই চাকরি করে।পাঁচদিন বাড়িতেই থাকে না। শনি, রবিতে থাকলেও ব্যস্ত থাকে। তবু জোরাজুরিতে শুক্রবার রাতে এসেছিলাম।আজ, সোমবার সকালেই আমার ফিরে যাওয়ার কথা, কিন্তু মিহিকা বলল, “থেকে যা। কাল ন্যাশনাল হলিডে। সকালেই আমরা দীঘার জন্য বেড়িয়ে যাব। বুধবার আমি এবং অভিনন্দন দু’জনেই অফিস বাঙ্ক করব।অভিনন্দন ইঞ্জিনিয়ার। মিহিকা আছে ফিশারিতে।
2
মিহিকার সতেরো তলার বারান্দায় বসে বসে কবিতা লিখছিলাম।
“মধ্যদুপুরে তাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে
জলে ডুবে, রোদ্দুরে ঝলসে গিয়ে, মরণের চিতাকাঠে চড়ে।
ভালোবাসতে ইচ্ছে করে
বিবিধ অবকাশ গড়ে।
মধ্যদুপুরে তাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে
অলস হাতের উষ্ণতা, চঞ্চলতা দিয়ে তার হাত ধরে,
দেড় দশক আগের ইতিহাস পড়ে
ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
ভালোবাসার ইচ্ছেতে ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমি তাঁর কথা শুনছিলাম কখনো তার নিজের গলায়, কখনো অন্যের। মনের ক্যানভাসে অনুমানের তুলি দিয়ে তাঁর মুখের ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলাম। অনুমানের তুলি চালিয়ে এমন ছবি আমি আগেও অনেকবার আঁকতে চেয়েছি কিন্তু একবারও শেষ করে উঠতে পারিনি। প্রত্যেকবার মনে হয়েছে এটা ঠিক হল না, সেটা ঠিক হল না। আজ মনে হচ্ছিল চোখদুটো নিশ্চয় এমন নয়। চোখের দৃষ্টিকে আরও তীক্ষ্ণ, আরও গভীর করতে হবে। চোখে ঢালতে হবে আরও জ্ঞানের মহিমা। আমি শুনছিলাম তিনি বলছেন, বিজ্ঞানীরা আমাদের নিজস্ব সৌরজগৎ কিভাবে তৈরি হয়েছে তা সরাসরি অধ্যয়ন করে জানতে পারেননি, তবে কম্পিউটার সিমুলেশনের সাথে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একটা পরিসরে তরুণ নাক্ষত্রিক সিস্টেমের পর্যবেক্ষণগুলিকে একত্রিত করে আজ থেকে চার দশমিক ছয় বিলিয়ন বছর আগে কি ঘটে থাকতে পারে তার একটা মডেল তৈরি করেছেন।
আমি শুনছিলাম তিনি সূর্যকে নিয়ে অনেক কিছু বলছেন।সূর্যের ভেতরের স্তর―কেন্দ্র, বিকিরণ অঞ্চল, পরিবাহী অঞ্চল। বাইরের স্তর―ফটোস্ফিয়ার, ক্রোমোস্ফিয়ার, করোনা। সেখান থেকে তিনি নেমে এসেছেন সূর্যের আলোতে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোচনায়। বোঝাচ্ছেন কোন কণিকার উপর আলো পড়লে সেই কণিকা আলোকে কিভাবে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয় যাকে বলা হয় আলোর বিক্ষেপণ। বলছেন যে রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম সেই রঙের বিক্ষেপণ তত বেশি, সূর্যের আলোয় হলুদ রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অধিক হওয়ায় তা কম বিক্ষিপ্ত হয়, বেশিটা পৌঁছে যায় পৃথিবীতে এবং নীল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হওয়ায় তা পৃথিবীতে পৌঁছনর আগেই আকাশে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং আকাশকে নীল আভা দেয়।
সূর্য নিয়ে তিনি আমাকে যে ধারণা দিয়েছেন তাতে মনে হয়েছে সূর্য আমাদের পিতৃস্থানীয়। সে তার কর্তব্য থেকে কখনো বিচ্যুত হয় না। অশেষ তার স্নেহ, অশেষ তার ভালোবাসা। স্নেহ, ভালোবাসা সে নিরন্তর আমাদের বর্ষণ করে চলে তবু আমরা তা থেকে বঞ্চিত হই আমাদেরই অক্ষমতাহেতুএবং কখনো কখনো সূর্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্ররচনাকারী বাষড়যন্ত্ররচনাকারীদের জন্য। আবহাওয়ার পূর্বাভাস শুনেছিলাম। দিনের শেষভাগে সারা শহরে বর্জ্যপাতসহ ভারী বর্ষণ হবে। রোদ এবং বৃষ্টির মধ্যে বেশি সময়ের ব্যবধান ছিল না। তবু আমার মন কবিতা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। বের করে নিয়ে এসেছিল আমাকে কলকাতার এই জনবিরল রাস্তায় ।
আমার দৈবচক্রে লাভ করা গাছের নিচে বৃষ্টিতে ভেজার সঙ্গীটিও ভিজে কাদা। তার হাতে ধরা ছাতাটি কাঁপছে। অর্থাৎ তার হাত কাঁপছে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় থাকেন?”
উত্তরকে সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে মিহিকার বাড়িকে নিজের বাড়ি বানিয়ে দিলাম। “সুখবৃষ্টিতে।”
“সুখবৃষ্টি!” হাসল সে। দাঁতে বাড়ি খেতে খেতে বেরিয়ে এসেছে শব্দ। শরীরের উষ্ণতা ধুয়ে গেছে তারও।
“হাউজিং কমপ্লেক্সের নাম।” আমার দাঁতও না খোলার প্রতিজ্ঞায় পা রাখতে চলেছে। কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে। “আপনি শোনেননি?”
“শুনেছি।” সে জিজ্ঞেস করে, “কি করে ফিরবেন?”
বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে বৃষ্টি ভোর পর্যন্ত চলবে।
“ভাবছি।”
“ঠাণ্ডা লাগছে আপনার।”
“নিশ্চয় আপনারও?”
বরাবরই বাইরে বৃষ্টিতে ভিজলে মনে হয় কখন বাড়ি ফিরে শুকনো জামা পরব, শরীরের ওপর ঠাণ্ডার প্রকোপটা কমবে; মনে হয় কখন বিছানায় যাব, শুকনো চাদরটা উঠিয়ে দেব গায়ে, চাদরের আদরে শরীর গরম হতে থাকবে, আমি ডুবে যেতে থাকব প্রেম-ভেজা উপন্যাসে।
সে বলে, “হ্যাঁ।” কি ভেবে জানি না সে জিজ্ঞেস করে, “কি করেন?” আমাদের মাঝখান থেকে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকার অস্বাভাবাবিকতা অনেকটা সরে যাওয়ায় এতক্ষণ বাদে ওর মুখের দিকে তাকাই। বলি, “একটা স্কুলে পড়াই।”দেখি ওর দৃষ্টি আমার মুখের উপর পড়েই প্রতিফলিত হয়ে চলে গেল সামনের রাস্তার ওপারে গাছটার দিকে।আমার দৃষ্টি অনুসরণ করল তার দৃষ্টিকে। গাছের হাজার বিন্দু থেকে জলের ধারা। সেও যুদ্ধ করে যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলের পৃথিবীঘেঁষা স্তরটিতে যে তাণ্ডবলীলা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বাঁচতে। গাছের অধিবাসীরা একেবারে নিশ্চুপ। অসহায় তারাও আমাদের মতো অপেক্ষা করছে প্রকৃতি কখন শান্ত হবে তার।
সুখবৃষ্টি একটা বিশাল হাউজিং প্রকল্প। ব্যাপক ল্যান্ডস্কেপিং। সেখানে আছে অ্যাম্পিথিয়েটার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যালয়, কমিউনিটি সেন্টার। আমার স্কুলটি সুখবৃষ্টিতে হলেও তা প্রিস্কুল হতে পারে, প্রাইমারি স্কুল হতে পারে, সেকেন্ডারি স্কুলও হতে পারে। আমার স্কুল ‘সুখবৃষ্টি’র বাইরেও হতে পারে। সেব্যাপারে সি কিছু জিজ্ঞেস করে না। সে বলে, “এখন একটা এক্সপ্লশন হওয়া দরকার। আকস্মিক বিস্ফোরণ। অনেক এনার্জি রিলিজ হবে তাহলে। অনেক তাপ বিকিরিত হবে।”
মুষলধারার মাঝে তার কোন বিস্ফোরণ থেকে উত্তাপ পাওয়ার ইচ্ছের কথা জেনে আমি হাসি। আমার হাত কাঁপতে কাঁপতে তার হাতকে এক সেকেন্ডের জন্য ছুঁয়ে ফেলে। আমার মধ্যে অন্য ভাবনা আসে। নিউক্লিয়ার ফিউশন। তিনি বলেছিলেন, সূর্যের মুল অংশে হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হচ্ছে। একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি হতে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু লাগে। প্রক্রিয়া চলাকালীন কিছু ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আমার হাতের দুটো বিন্দুর তার হাতের দুটো বিন্দুর সঙ্গে মুহূর্তের মিলন আমাকে উত্তাপ দেয়।
“সরি।”
“কেন?” আমি ভাবি সরি আমারই বলা উচিত। তাকে ছুঁয়ে ফেলার জন্য।
“এক্সপ্লশন, ফিশন, ফিউশন আপনার আগ্রহের বিষয় নাও হতে পারে।”
প্রথমদিকে বিজ্ঞান আমার আগ্রহের বিষয় ছিল না। পরে হয়েছে। আমার দাদা আমার থেকে দু’বছরের বড়। ক্লাস ফাইভে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার সময় সেখানকার ফার্স্ট বয়কে হার মানিয়ে দিয়ে ফার্স্ট হল। নজর কাড়ল অনেক শিক্ষকের। ক্লাস সিক্স থেকে সেভেন-এ ওঠার সময় দাদা পাকা করে নিল নিজের জায়গা। ক্লাস সেভেন থেকে এইট-এ গিয়ে বসল নিজের দ্বারা সংরক্ষিত সেই জায়গাতেই। যোগ্যতা দিয়ে স্কুলের সব শিক্ষকের মধ্যমণি হয়ে উঠল সে। শিক্ষকরাও হয়ে উঠলেন তার কমবেশি শ্রদ্ধার এবং ভালোবাসার মানুষ। তাঁদের গল্পে মুখরিত হতে থাকল আমাদের বাড়ি। ঘন ঘন কানের পর্দায় বাড়ি মারল সুশীলসরকারের নাম।
সুশীলসরকার নামটি বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবু একদিন দাদা বাড়ি এসে অন্য কথা বলল। “আজ ক্লাসে স্যারের জলের গ্লাসটি আমার ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল।”
জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”
“গ্লাসটা কাচের ছিল।”
“কি হল তারপর?”
“কি আর হবে! ভেঙ্গে গেল গ্লাস।”
“তারপর? বল না তারপর কি হল।” মন আমার মানে না। তারপর কি হল অবিলম্বে আমাকে শুনতেই হবে। গতকালই সদৃশ ঘটনা ঘটেছিল আমার ক্লাসে। একটি মেয়ের ঢাকনা খোলা জলের বোতলটি হাত থেকে মেঝেতে পড়েছিল। বোতল থেকে সামান্য একটু জল বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তাতেই তাকে কান ধরে দশ মিনিট সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হল।
দাদা বলে, “স্যার তাকিয়ে ছিলেন গ্লাসটির দিকে তার ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর আমাকে বললেন, কতরকম সুন্দর সুন্দর শব্দ আমায় শোনালে বলো তো?”
আবার জানতে চাইলাম, “তারপর কি হল?”
“আমি লজ্জা পেলাম। মনে হল খুব অসাবধানতার কাজ করেছি।”
আমার এগারো বছর বয়সী মন দুর্বল হয়ে গিয়েছিল তাঁর প্রতি। আমার মা, বাবা দু’জনেই কলেজে পড়াতেন। তাঁদের কাছে শুনেছিলাম বিভিন্ন মহাপুরুষের উক্তি।ব্রিটিশ লেখক সি, এস, লিউইস বলেছিলেন, “এডুকেশন উইথআউট ভ্যালুজ, অ্যাজ ইউজফুল অ্যাজ ইট ইজ, সিমস র্যা দার টু মেক ম্যান আ মোর ক্লেভার ডেভিল।” সুশীল স্যার খুব সুন্দর মানুষ উপহার দেবেন পৃথিবীকে। আইনস্টাইন বলেছিলেন, “এডুকেশন ইজ হোয়াট রিমেনস আফটার ওয়ান হ্যাজ ফরগটন হোয়াট ওয়ান হ্যাজ লার্নড ইন স্কুল।” অর্থাৎ স্কুল থেকে বেরিয়ে একজন স্কুলে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার যতটুকু মনে রাখবে সেটাই হবে তারশিক্ষা। সুশীল স্যারের কাছ থেকে প্রাপ্ত দাদার সেই অভিজ্ঞতাকে আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে মনে হয়েছিল যে অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।
এমন আরও নানা কথা ভাবতে ভাবতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। অন্যমনস্ক হয়ে দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তার পর?”
“তারপর সুশীল স্যার শব্দের কম্পাঙ্ক নিয়ে পড়াতে শুরু করলেন।”
*****
সঙ্গী তখনও সামনের গাছের দিকে তাকিয়ে। তার মানে সে আমার ভেজা শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ, আমার চুল, মাথা, গলা, কাঁধ, বুক, হাত কিছুই দেখেনি! যদি না দেখে থাকে তাহলে আমার সম্মানিত বোধ করা উচিত নাকি উচিত নয় ভেবে পাই না। ভেবে পাই না একজন নারীর শারীরিক সৌন্দর্যের প্রতি একজন পুরুষের অনাকৃষ্ট থাকাকে তাকে অসম্মান করা বলে কি না।
বললাম, “পদার্থবিজ্ঞানে আমার যথেষ্ট আগ্রহআছে, যদিও আমি ...।”
“কি সাবজেক্ট পড়ান?”
“সেটাই বলছিলাম, যদিও আমি জীববিদ্যা নিয়ে ডিগ্রি করেছি।”
“ওহ্। পদার্থ বিজ্ঞান, জীবন বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান...বিজ্ঞানেরই খেলা চারিদিকে।”
মাথার উপরে পাখিরা ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে। কম হয়েছে বৃষ্টির তেজ।
৩
খুব দেখতে ইচ্ছে করত তাকে। কিরকম একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছিল তাঁর প্রতি। কিশোরী থেকে যুবতী হয়েছি, যুবতী থেকে মহিলা, চাকরি করছি, অনুভূতি সেই একই আছে। কি বলে সেই অনুভূতিকে? প্রেম? ভাবতাম এমন কোন পুরুষের সংস্পর্শে এলাম না যেসেই অনুভূতিকে পালটে দিতে পারে, যে আমাকে বিয়েতে উৎসাহিত করতে পারে। মা-বাবা বিয়ের জন্য চাপ দিলে সেই অনুভূতি আমাকে বারবার বাধা দিতে বাধ্য করে, ‘আমার সে আছে’ ভাবনাটিকে মনের মধ্যে প্রকট করে রেখে দেয়। ভাবনাকে আমি মুখে প্রকাশ করতে পারি না। কবিতায় প্রকাশ করি।
কিন্তু...কিন্তু আজ বৃষ্টিতে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সঙ্গীটি আমার মনের মধ্যে গেঁথে থাকা ভাবনাকে ফিকে করে দিল। বৃষ্টি কম হলেও আমার ফিরতে ইচ্ছে করল না। ভাবলাম, এত তাড়াহুড়ো কীসের? তাছাড়া বাহানা তো আছেই। সে আমাকে নিয়ে জানতে চেয়েছে। আমিও তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি তার নাম, ধাম, পেশা নিয়ে।
নিজের সঙ্গে আলোচনা চলে।
―কি দিয়ে শুরু করব?
―নাম?
―না না।
―তাহলে ধাম।
―না না। কোথাও যেন বাধা পাচ্ছি। খুব বেশি আগ্রহ দেখানো হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
―তাহলে পেশা।
―পেশা? পেশা...পেশা...হ্যাঁ, পেশা হতে পারে। সেও জানতে চেয়েছিল আমার পেশা।
আমার প্রশ্ন, “আপনি কি করেন?”
“কবিতা লিখি।”
“আপনি একজন...!” কবিতা লেখেন শুনে দূরত্ব একটু কম অনুভব করলাম। “ইচ্ছে আছে আর কয়েকবছর চাকরি করে টাকা কামিয়ে শুধু কবিতা লিখে যাব। শুধুই কবিতা, আর কিছু না।”
“অর্থাৎ আপনি এখন কবিতা লেখেন...অল্প অল্প।”
আমি হাসি। সঙ্গীর কথা শুনে মনে হল তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কবি। “আপনার নামটা জানতে পারি?”
“তপস্যা।”
“পদবী?”
“ভুলেই গেছি পদবী,” সে হাসে, “লোকে আমাকে শুধু তপস্যা বলেই জানে।”
“কোথায় থাকেন?”
“দক্ষিণ কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতার শহরতলীতে।”
“আমিও...”
“আমিও...কি?”
“বলছিলাম আপনি সেখানেই ফিরে যাবেন তো?”
“নিশ্চয়।”
“আমিও ওদিকে যাব, তবে আজ নয়, দু’তিন দিন পর।”
সে এবং আমি হাঁটছি সুখবৃষ্টির দিকে। সুখবৃষ্টির গেট পর্যন্তই অনেকটা রাস্তা। হাঁটছি, হাঁটছি। আমার ভেতরে কম্পিত হচ্ছে কবিতা―
শূন্যস্থান ভেদ করে আমার জানালায় লাফিয়ে পড়ে রোদ,
জানালা খুলে যায়,
রোদ ঘরে ঢোকে।
আমি রোদে মোমবাতি জ্বালাই তোমার ভালোবাসার আলাপ শুনব বলে।
শূন্যস্থান ভেদ করে আমার জানালায় লাফিয়ে পড়ে রোদ,
জানালা খুলে যায়,
রোদ ঘরে ঢোকে।
রোদে বসে আমি তোমার ভালোবাসার ছায়া দেখতে চাই।
তার ভেতরেও কম্পনরত শব্দের উথালপাথাল ছিল। সেগুলো কি করে যেন বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে মৃদু আঘাত করে। আমিপড়ে নিতে সক্ষম হই সেই এলোমেলো শব্দগুলোকে।
শূন্যস্থান ভেদ করে আমার জানালায় লাফিয়ে পড়ে রোদ,
জানালা খুলে যায়,
রোদ ঘরে ঢোকে।
সঙ্গে নিয়ে আসে তোমার যৌবনের আগুন আমাকে পুড়িয়ে দেবে বলে।
সে বলে,
“পৃথিবীর একটাই চাঁদ।”
“একটাই সূর্য।”
“আমার আরেকটা চাঁদ ছিল।”
জিজ্ঞেস করি, “আরেকটা চাঁদ?”
“একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। উচিত নয় জেনেও।”
“উচিত নয়! কেন?”
“আমার থেকে অনেক ছোট ছিল।” সে স্মৃতিচারণা করতে থাকে, “একবার মাত্র এক ছাত্রের সঙ্গে দূর থেকে দেখেছিলাম।...”
তার কথার মাঝখানে জিজ্ঞেস করে ফেলি, “আপনি কি শিক্ষকতাও করেন?”
“হ্যাঁ।”
“কোন স্কুলে?”
“নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে।”
মাথায় যেন সহসা একটা বাজ পড়ে। সে বলে, “...নীল চোখ, সাদা রঙ, সঙ্গে কালো চুল, লাল ঠোঁট; প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের এক অদ্ভুত সমবায়। ভুলতে পারিনি। এখন নিশ্চয় সে বড় হয়েছে।”
“ছাত্র! আপনি কি আবির তলাপাত্রের কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ।”
“আমি তার বোন।”
“কিন্তু তোমার চুল?”
“রঙ করেছি।”
সুশীল স্যার একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। আবার জোর বৃষ্টি নেমেছে। আবার আমরা দু’জন খুব কাছাকাছি। মাথার উপরে কোন গাছ নেই। শুধু ছাতা। তিনি ধরে আছেন। তাঁর শরীরের সঙ্গে আমার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির মাঝখানেই পৃথিবীতে ভালোবাসার বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। খুব ভালো লাগছে আমার বিদ্যুতের পরিষেবা নিতে। হেঁটে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতে সুশীল স্যার তাঁর ছাতাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, “সে আমার ছাত্র। আমার শোভা দেয় না।” তিনি উলটো পথ নিলেন। বৃষ্টির কুয়াশা ঢেকে দিল তাঁকে দ্রুত।