গল্প

গল্প প্রলুব্ধ

প্রলুব্ধ

লেখক : মদন ঘোষ

বেলগাছটায় একটাও পাতা নেই৷ নেড়া বেলগাছটাকে দেখে মনে হবে, গাছটা মরে গেছে৷ অথচ বেলগাছটার ডালে ডালে অগণিত অসংখ্য বেল ঝুলছে৷ বেলগাছ লাগোয়া পেল্লায় লম্বা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নারকেল গাছ৷ বেলগাছ তলায় থাকে থাকে সাজানো বিস্তর ইট৷

বেলগাছের ডালে চুপটি করে বসে আছে একটা কাক, কাকের মুখের সামনে একটা পাকা বেল--- হলদে রং, পাকা বেল থেকে ভুরভুর গন্ধ, গন্ধ শুঁকে কাক অনুমান করতে পারল বেলটা পাকা৷ কিন্তু পাকা বেল কাকটা খাবে কী করে, নিরেট পাকা বেল, কাক ঠোঁট দিয়ে ভাঙতে পারবে না - সম্ভব নয়৷ না ভাঙলে খাবে কী করে! সব জেনেও কাক পাকা বেলের কাছে বসে আছে, পাকা বেল খাওয়ার কাকের খুব ইচ্ছা,লোভ৷ অমন সুন্দর একটা লোভনীয় পাকাবেল মুখের সামনে রয়েছে, খেতে না পারার জন্য কাকের মনে ভীষণ দুঃখ, আফশোস৷ কাকের খিদেও লেগেছে,কাক ইতিমধ্যে চারিদিকে ঘুরে এসেছে, কোথাও খাবার পায়নি৷ খাবারের বড় অভাব৷--- না খেতে পেয়ে কাকের সঙ্গী সাথি কত আপনজন মারা গেছে, মারা গেছে রোগ ব্যাধিতে, তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্র্যেগে কত কাক মারা গেছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই, ক্রমশ কাকেরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে৷

আচমকা কে যেন বলল,--- বেল পাকলে কাকের কী! বার বার তিনবার বলল, শুনে কাক থতমত খেয়ে ঘাবড়ে চারদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না৷ কাক কাউকে দেখতে না পেয়ে, নিজের মনে বলল,---অন্যমনস্ক ছিলাম ,ভুল শুনেছি, খিদের জ্বালায় মাথার ঠিক নেই, তাই ---৷

নারকেল গাছের ফোকরে বসে টুনটুনি ফের বলল,--- বেল পাকলে কাকের কী! বলেই টুনটুনি পাখি ফোকরে মু্‌খ লুকালো, ধূর্ত চতুর কাক নিরীক্ষণ করছিল, নজর এড়াতে পারল না, কাক টুনটুনিকে দেখতে পায়৷ ক্রোধে, ক্ষোভে কাক বলল---খুদে পুচকে টুনটুনি তুই ওকথা বলছিলিস? এত বড় আস্পর্ধা, আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস? জানিস ঠোক্কর মেরে তোর ভবলীলা শেষ করে, গপ করে গিলে খাব৷ খিদের জ্বালায় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে , তুই রসিকতা করছিস, বরদাস্ত করবনা কিন্তু ৷ টুনটুনি খুব ভালো করেই জানে, সে নিরাপদ আছে৷ কাক ওর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না, নারকেল গাছের ছোট্ট ফোকরে কাক কোনও মতেই প্রবেশ করতে পারবে না৷ অতএব---

টুনটুনি পূনরায় টিপ্পনী কেটে বলল--- কাক তুমি যতই ইন্তেজার করনা কেন, তুমি পাকা বেল কক্ষনও খেতে পারবে না--- সে গুড়ে বালি, বেলের কাছে বসে দুচোখ ভরে দ্যাখ আর গন্ধ শোক, তাতে তোমার খিদেও মিটবে না, পেটও ভরবে না৷

টুনটুনির ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কথাবার্তা শুনে রাগে কাকের সর্বাঙ্গ রি রি করছিল, কিন্তু কাক নিরুপায়, টুনটুনিকে আঘাত করা দূরের কথা, স্পর্শকাতেই পারবে না৷ নীরবে সহ্য করা ছাড়া কাকের কোনও গত্যন্তর নেই৷

টুনটুনি কিন্তু চুপ করে থাকে না, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেই থাকে বলে, কাক তুমি নিজেকে বড় চালাক বুদ্ধিমান মনে কর৷ নিরেট পাকা বেল ভেঙে খাবার হিম্মত তোমার হবে না --- পারবে না৷

টুনটুনির কুৎসা অপবাদ শুনে, কাক লজ্জায় অপমানে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ, টুনটুনিকে কিছু করতে না পেরে, রাগে, ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে কাক পাকা বেলটাকে ঠোকরাতে লাগল, বারংবার ঠোকরাতে পাকাবেল বোঁটা থেকে খসে পড়ল ৷ গাছতলার জড়োকরা ইটের ওপর পড়ে ,পাকা বেল দু-টুকরো হয়ে গেল৷ তাই না দেখে কাকের চোখ ছানাবড়া৷ কাক গাছের ডালে বসে বিস্ফারিত চোখে দেখে নিজের মনে বলল---ওরে বাবা, পাকাবেলের ভিতরটা কী সুন্দর সোনার মতো রং, শাঁসে ভরা, এবার তো পাকাবেল খেতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না, কাকের খুব আনন্দ হচ্ছিল --- ডানা ছড়িয়ে নাচের ভঙ্গি৷ আবেগে আপ্লুত হয়ে কাক টুনটুনিকে ডেকে বলল --- এই হারামজাদা,বদমায়েশ টুনটুনি, পুঁচকে ধানিলঙ্কা, আমায় তো ভর্ৎসনা করছিলিস, কোটর থেকে বেরিয়ে দ্যাখ, এবার আমি পাকা বেল খাবো৷

টুনটুনি নারকেল গাছের ফোকর থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, গাছের পাকা বেল, ইটের ওপরে পড়ে দুই টুকরো হয়ে গেছে, টুনটুনি দেখে বিস্ময়ে হতবাক৷ অমনটা যে হবে টুনটনি স্বপ্ণেও কল্পনা করতে পারেনি৷

টুনটুনি নিজের মনে বলল--- সত্যি তো এবার পাকা বেল খেতে কাকের কোনও অসুবিধা হবে না৷ লজ্জায় টুনটুনির মুখ ম্লান ফ্যাকাসে, দ্রুত ফেকরে মুখ লুকালো৷

কাক দেখে মুচকি হেসে বলল --- কীরে টুনটুনি,লজ্জা করছে? লুকিয়ে পড়লি কেন? খুব তো আমায় উপহাস করছিলিস৷ এবার থোতা মুখ ভোঁতা করে, ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে দ্যাখ, আমি মনের আনন্দ পাকা বেল খাবো৷ হতচ্ছাড়া৷

কাকের খুব গর্ব হচ্ছিল, নিজের মনে বলল--- একেই বলে ভাগ্য,কপাল, পাকা বেলের দিকে তাকিয়ে কাকের নোলায় জল৷ খিদের সময় অমন একটা অমৃত ফল খাওয়ার সুযোগ হয়ে যাওয়া পরম সৌভাগ্য৷ এতদিন যা অসম্ভব ছিল, আজ তা সম্ভবে রূপায়িত হওয়াতে কাক আনন্দে, আহ্লাদে আপ্লুত, আজ পর্যন্ত কেউ যা পারেনি, দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে নিজেকে ধন্য মনে করবে৷ কাক গাছের ডালে বসে চিন্তা ভাবনা করছিলো--- পাকা বেলএখানে বসে খাবে, না কি অন্য কোথাও নিয়ে যাবে৷ অতবড় পাকা বেল একার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়--- খেতে পারবে না৷ কাকের ইচ্ছা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে দেখাবে৷ দেখিয়ে বলবে--- দ্যাখ তোমরা, আমি অসাধ্য সাধন করেছি, তোমরা কেউ যা পারনি, আমি সেটাই করেছি৷ পরক্ষণে কাক ভাবল, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের ডাকলে ,সব্বাইতো হ্যাংলার মতো দলে দলে এসে জুটবে, সব্বাই মিলে চেটেপুটে খাবে, শেষ পর্যন্ত হয়তো আমার ভাগ্যেই জুটবে না--- আমি খেতে পাবো না, দরকার নেই কাউকে জানাবার, বলবার৷ এখান থেকে নিয়েগিয়ে, কোথাও লুকিয়ে রাখবো, রয়েসয়ে ধীরে সুস্থে ইচ্ছা খুশি মতো মনের আনন্দে আয়েশ করে খাবো৷ --- পাকা বেল যেমন মিষ্টি তেমন সুস্বাদ--- খেয়ে মনপ্রাণ ভরে যাবে৷ আজীবন মনে থাকবে৷ আমি ইতিহাস সৃষ্টি করবো--- আমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে৷ কাক থমকে সমঝে নিজের মনে বলল---আমি তো এখনও পাকা বেল খেলামই না,আবেগের বশে কি সব আবোল তাবোল বলছি৷ কাক গাছের ওপর থেকে নামতে ইতস্তত করছিল, কাকের মনে সংশয় কেউ আড়ালে আবডালে ওত পেতে লুকিয়ে বসে নেই তো? শেষে পাকা বেল খেতে গিয়ে অকালে প্রাণ না যায়৷ গাছের ডাল থেকে নামবে কি নামবেনা কাকের দোদুল্য মন, অবশেষে ডানামেলে নামতেই -সেই মুহূর্তে অকস্মাৎ একটা কিশোর ছেলে এসে , ইটের ওপর থেকে পাকা বেল কুড়িয়ে নিল, কাক ডালে গিয়ে বসল--- হতাশ হয়ে আক্ষেপ করে করুণ গলায় নিজের মনে বলল--- গড়িমসি করে সময় নষ্ট করলাম, পাকাবেল খাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে ফেললাম৷ অনুশোচনায় মনস্তাপে কাকের দুচোখ জলে ভরে গেল৷

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.