গল্প

গল্প মাটি মা

মাটি মা

লেখক : জগন্ময় মিশ্র

বাবা দীর্ঘ চৌদ্দ বছর হাঁপানি রোগে কর্মক্ষমতা হারিয়ে দেহ রাখলেন৷ সংসারে আয় বলতে পনেরো বিঘে জমি৷ বিঘে দুয়েক বাগান৷ ভাইদের উপার্জনের পয়সা সে গ্রহণ করেনি৷ পিতৃশ্রাদ্ধের সমস্ত খরচা বন্ধু বান্ধবদের কাছে ধার দেনা করে সম্পন্ন করতে হল৷ বছর দুয়েকের মধ্যে জমির আয়েই দেনা পরিশোধ হবে একথা ভেবে নিয়েছিল শিবব্রত৷ কিন্তু তার ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মিল ঘটল না৷ পিতৃশ্রাদ্ধ শেষ হবার মাস দুয়েকের মধ্যেই অজ্ঞাত কারণে সংসারে অশান্তির ঝড় বইতে শুরু করল৷ ভাই-বউরা জমির অংশ নিয়ে সংসার ভাঙার তাদিগে অশান্তির আগুন বিভিন্ন দিক হতে লাগাতে শুরু করল৷ সে আগুনে সংসার পুড়ে খাঁক হয়ে এল৷ একদিন শিবব্রত দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে গেল৷ সংসারের সবকিছু আত্মসাৎ-এর অভিযোগ গ্রামের লোকেদের কাছে শুনে একদিন এ আগুন নেভাতে চাইল শিবব্রত৷

মেজভাই সুব্রত এবং ছোটো ভাই দেবব্রতকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এসব কি শুনছি?’

মেজভাই সুব্রত প্রথম মুখ খোলে, বলতে থাকে, যা রটে তার কিছুটা তো বটে দাদা? সংসারে জমি বাগানের আয়টা তো কম নয়৷ এতদিন বাবা বেঁচেছিলেন কিছু বলিনি৷ এবার জমি সম্পত্তি ভাগ করে আপন আপন বুঝে নাও৷ যা হয়েছে পিছন দিকে যাচ্ছি না৷ আর যেন না হয়৷ তোমার বউমারা তো পরের ঘরের মেয়ে৷ আমরা সহ্য করলেও ওরা সহ্য করবে কেন?

তোরাও কি আমাকে বউমাদের মতো বুঝেছিস?

তাছাড়া আর কি৷ তুমি তো এতদিন জমি বাগান আয়ের কোনো হিসেব রাখনি৷ দীর্ঘদিনের হিসেব বোঝানো আর সম্ভবও নয়৷ তাই তোমার বউমারা, প্রতিবেশিরা যা বলছে এটাই ঠিক বলে ধরে নিতে হয়৷
ছোটোভাই দেবব্রত কোনো প্রতিবাদ করে না৷ পরোক্ষভাবে এ উক্তি তারও৷ যেন আকাশ থেকে পড়ে শিবব্রত৷ ভাবতে থাকে একথা শোনার মুহূর্তে তার মাথায় বাজ পড়ল না কেন? কেন যে এখনও জীবিত আছে৷
ক্রুদ্ধস্বরে শিবব্রত বলতে থাকে, জানিস বাবার শ্রাদ্ধে দেনা বিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে৷ ওই ... দোকানদার গোকুলকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবি৷
দেনা করার আগে যখন আমাদের জিজ্ঞেস করনি এখন সেকথা বলা কোনো মানেই হয় না৷ ওসব দেনার অংশতে আমরা নেই, ছোটো ভাই দেবব্রত নিঃসংকোচে কথাগুলো বলে ফেলে৷ সেদিন শিবব্রত ওদের মনোভাবের কথা বুঝতে পারে৷
পরদিন সমান অংশে জমিগুলো ভাগ করে বসত বাড়ি ওদের ছেড়ে দিয়ে দুবিঘে বাগানবাড়ির উপর দুই কামরার একটা চালা ঘরে উঠল৷ আয় বলতে গেলে তার বাগানের আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, পাশে বিঘে দুয়েক খোলা জমি৷ অথচ জমি তাদের মাত্র পাঁচবিঘে ছিল৷ মাটির সঙ্গে লড়াই করে নিজে লাঙল আর দশ বিঘে বাড়িয়ে ছিল সে৷ দুবিঘে জমির উপর বাগান তারই হাতে তৈরি৷ বসত বাড়িটাও মাটি থেকে দ্বিতল পাকা হয়েছে৷ সেটাও ভাইদের ছেড়ে দিয়ে এসেছে৷ ভাইদের কথা মেনে নিয়ে আপন বসতবাড়ি ছেড়ে বাগানে আশ্রয় নিয়েছে৷ অথচ যে ভাইদেরকে একটি দিনের জন্য মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি৷ প্রচণ্ড পরিশ্রমে সংসারে শ্রী ফুটিয়ে তুলেছিল, কিন্তু আজ সে কথা ভাইরা কেউ মানল না৷ একবার ভাবল না পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ দাদার কথা৷ এদের জন্যেই তো সে সংসার করেনি৷ ভাইদের মানুষ করে তুলতে তার চল্লিশ বছর কেটেছে৷ নিজে সংসার করার কথা ভাববার সময়ও পায়নি৷ দুই ভাই যখন চাকরি পেল যৌবন তখন পশ্চিম আকাশে সূর্যের মতো ঢলে পড়েছে৷ তাই আর সংসার করা হয়নি তার৷ কিন্তু এসবের আজ কোনো মূল্য নেই৷ এরজন্যে তার কোনো প্রতিবাদও নেই৷ কার কাছে প্রতিবাদ করবে? সন্তানতুল্য ভাইদের কাছে! না না জীবনের কোনো অবস্থায় সে তা করতে পারবে না৷ আর কার জন্যেই বা করবে? আর কটা বছরই বা বাঁচবে সে?

কিন্তু ভাইরা ছাড়লেও দীনেশ তাকে ছাড়েনি৷ দীর্ঘ ত্রিশ বছর তাদের খেতে কাজ করে চুলে পাক ধরিয়েছে৷ শিবব্রতর ভাইদের এহেন আচরণে সে প্রতিবাদ করতে ছাড়েনি৷ শিবব্রতর সামনেই দু-ভাইকে একদিন ধিক্কার জানিয়ে বলেছিল, কীরকম মানুষ গো তোমরা? লেখাপড়া শেখার এই গুণ তোমাদের? ধম্মে সইবে?

সুব্রত মারমূর্তিতে বলেছিল, তুই বলার কেরে হারামজাদা? খুব ধম্মোজ্ঞান তোর৷ বেরো বলছি এখান হতে৷
শিবব্রত পরিস্থিতি সামলে দিতে দীনেশকেই ধমক দিয়ে বলেছিল, হারামজাদা তোকে আমাদের সংসার নাক গলাতে হবে না৷ চুপ কর৷
আমি হক কথা বলছি৷ তোমার কথা এরা কেউ চিন্তা করলে না৷ শেষ বয়সে কে দেখবে তোমাকে?
আবার ধমক দিয়ে উঠেছিল শিবব্রত৷ তুই যা তো এখান থেকে৷
বাগান বাড়িতে দীনেশ এসে শিবব্রতর কাছে দিনরাত্রি থাকে৷ টুকটাক বাগানের কাজ করে৷ উনুন ধরিয়ে দেয়৷ আনাজ কেটে দেয়৷ বাগানের ফসলও বিক্রি করে এনে দেয়৷
শিবব্রত কতবার বলেছে, তুই তোর ঘরে যা৷ এখানে আমার একা থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না৷
তা কি হয় বড়োকত্তা? তোমার খেতে খেটেছি আজ চল্লিশ বছর৷ আমার পাওনা থেকেও বেশি দিয়ে তুমি আমার সংসারে অভাব আসতে দাওনি৷ আজ তোমার বিপদের দিনে তোমাকে কি ছাড়তে পারি? তুমি যতদিন থাকবে ততদিন তোমার দেখাশুনোর দায়িত্ব আমার৷ আমি বেইমান হতে পারব না বড়োকত্তা৷

আর কোনো কথা বলতে পারেনি শিবব্রত৷ তার পাশের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল দীনেশ৷ বছর চারেক কেটে গেছে৷ জমি বাগানের আয় থেকে গোকুলের দেনাটা শোধ হয়েও ব্যাঙ্কেও কিছু টাকা জমেছে৷ বাগানের গাছগুলোও তাদের মালিকের সঠিক পরিচর্যার ফলে ভরে উঠেছে৷ মানুষ বেইমান কিন্তু তারা তো বেইমান নয়৷ তাই তারা সযত্নে বেড়ে ওঠায় দেনা সুদে-আসলে প্রতি বৎসর শোধ করে ফল দিয়ে৷ শিবব্রতও এই বাগানের গাছগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে৷ বসন্তে যখন গাছগুলোতে মুকুলে ভরে ওঠে৷ বাউল বোলতারা গুঞ্জন তোলে তখন তার মনেও ফাল্গুনের গুঞ্জন৷ জীবনের আঘাতের কথা, ভাইদের কথা সে ভুলে যায়৷ মনে পড়ে যায় তার খেতের কথা, তার মাটি মায়ের কথা৷ মাটিকে সে মা বলেই জানে৷ গর্ভধারিণী মা যেমন তার প্রাণ দিয়ে সন্তানকে প্রতিপালন করে এই মাটি মা তার ফসল দিয়ে তার সন্তানদের প্রতিপালন করে৷ এই মাটি মায়ের বুকে শ্রম দিয়ে ফসল তুলে ভাইদের মানুষ করতে পেরেছে৷ তাই এই জমি ও এই জমির মাটি তার এক মা৷ এই মাটি মাকে ভালোবেসে নিজের হাতে আম কাঁঠালের বাগান লাগিয়েছিল৷ আজ তারা মানুষ হয়ে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে৷ এমনকি এই আয় তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়৷ ব্যাঙ্কের খাতা ভারী হতে থাকে৷ এই বাগানে এসে দীর্ঘ চার বছরে অন্তরের ক্ষত শুকিয়ে গেছে৷ তখন বসন্তকাল৷ দু-চারটে কোকিল আমগাছের মগডালে বসে ডেকে চলেছে৷ অজস্র ভ্রমর আমের শাখায় মুকুলে ঘুরে ঘুরে গুঞ্জন তুলেছে৷ মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনের কথা৷ দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে মাটি কুপিয়ে ফসল ফলানোর কথা৷

ঠিক এই মুহূর্তে দীনেশ এসে বলে, বড়োকত্তা আপনার ভাইদের জমিগুলো এরকম পতিত আছে৷ এবার ফসল হয়নি৷ দেখে মায়া হল আমার৷ দীনেশের কথায় শিবব্রত অন্য জগতে চলে যায়৷ ভাবতে থাকে ভালোভাসার সংসার৷ ভালো না বাসলে মাটিও বন্ধ্যা হয়ে যায়৷ ফসল হয় না৷ যে জমি শ্রম পেয়ে ভালোবাসা পেয়ে তার কাছে ফসলে ভরে উঠেছিল৷ আজ সেই জমি বন্ধ্যা হতে চলেছে? ভাইরা চাকরি করে৷ কাদামাটিতে পা দিতে সম্মানে লাগে৷ আগে কতবার একথা সে ভাইদের বুঝিয়েছে, ওরে মা আর মাটি যে এক৷ চাকরি করলেও নিজের হাতে মাটি চাষ করবি৷ দেখবি ফসলে উপচে উঠবে মাটি৷ মায়ের মতো মাটিকে ভালোবাসলে মাটি তোকে ভালোবাসবে৷ কিন্তু তার সেকথা কেউ শোনেনি৷ তাই তো ফসল হয়নি জমিতে৷ এটা শিবব্রতর দৃঢ় বিশ্বাস৷ একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে থাকে, জমি চাষ ওরা করতে পারবে না দীনেশ৷

জমি চাও ওরা করবেও না৷ শুনলাম ওই সিমেরের দু-বিঘে বাকুরীটো বিক্রি করবে৷ সেজকত্তা৷
কে বললে তোকে?
আমি শুনলাম৷ ওই রহিম কিনবে৷
তুই এখনই যা রহিমের কাছে৷ ওকে বলবি ও জমি আমি কিনব৷
কিন্তু তুমি অত টাকা পাবে কোথা? তাছাড়া রহিম যদি সেজকত্তাকে বায়না দিয়ে থাকে?
বায়না দিলে তো কী হয়েছে৷ ও জমি আমি কিনেছি৷ আবার আমি কিনলে ও বায়না ফেরত নেবে৷ ঘরের জমি ঘরে থাকবে৷ আমি কিনলেও ভাইরা পাবে৷ মরার পর আমি তো আর জমি সঙ্গে নিয়ে যাব না৷ যতদিন বাঁচি ততদিন তো মাটিকে রক্ষা করি৷
বায়না করলে কি কেউ জমি দিয়ে দেয়? বিশেষ করে অত ভালো জমি৷ তবে তুমি যখন বলছ রহিমের কাছে গিয়ে জেনে আসি৷ চলে যায় দীনেশ৷ শিবব্রতের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে৷ মুখে বিষাদের ছায়া৷ কি অভাব সেজ ভায়ের, যে জমি বিক্রি করতে হবে? যে জমি তার অন্নে তাকে মানুষ হতে সাহায্য করেছে, বিনা প্রয়োজনে সে জমি বিক্রি করতে এতটুকু মায়া হল না৷ আবার বিক্রির আগে তাকে একবার জিজ্ঞেসও করলে না?

কিছুক্ষণের মধ্যে দীনেশ ফিরে এসে বলে, ও জমির দাম পুরোটাই মিটিয়ে দিয়েছে রহিম৷ ও জমিই নেবে টাকা ফেরত নেবে না৷
কী বললি? দাম মিটিয়ে দিয়েছে? তো কি হয়েছে? জমির আমি একজন শরিক৷ আমি নেব বলতে আমাকে দিতে বাধ্য৷ চলত আমার সঙ্গে?
শিবব্রত দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দেয় রহিমের বাড়ির দিকে৷
রহিমের বাড়ির সামনে এসে ডাকে, রহিম ঘরে আছিস?
রহিম ঘর থেকে বের হয়ে বলে, এসো বড়োকত্তা, ঘরের ভিতর থেকে আসন এনে দাওয়ায় বসিয়ে বলতে থাকে, তোমার ভাইকে জমি কেনার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ জমি কিনলে তোমার অমত হবে কিনা৷ ওতো তোমার অমতের কথা আমাকে বলেনি৷ তাই টাকাও ওকে মিটিয়ে দিয়েছি৷
বেশ করেছিস৷ এবার আমার কাছে কিছু বেশি টাকা নিয়ে জমিটা আমাকে ফেরত দে৷
তাই কি হয় বড়োকত্তা৷ সব টাকা তো আমি জোগাড় করতে পারিনি৷ অন্য জায়গায় দশ কাঠা জমি বিক্রি করে তবে অত টাকা জোগাড় করেছি৷ যাকে আমি জমি বেচেছি সে তো আমাকে আমার জমি ফেরত দেবে না৷ টাকাটা রেখে দে৷ টাকা থাকলেই তো জমি হবে৷
তাই কি হয় বড়োকত্তা? তোমার অত টাকা আছে৷ তুমি অন্যের কাছে কিনে নিও৷ ও জমি যখন আমি কিনেছি তখন ফেরত দেব না৷
ও জমি ডাঙা ছিল ৷ দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে কুপিয়ে জমি তৈরি করেছি৷ ও জমি ঘরের বাইরে পরের হাতে যাবে এ আমি সহ্য করতে পারব না৷
চল দীনেশ, একবার ওই হতচ্ছাড়া ভাইটার কাছে যাই৷ ওকে বলে দেখি৷
ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বসত বাড়িটার কাছে গিয়ে হাঁক পাড়ে, সুব্রত আছিস৷
সুব্রতর স্ত্রী বেরিয়ে আসে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলতে থাকে, ওতো এখনও সুকল হতে ফেরেনি৷
শিবব্রত চড়া সুরে বলে, তা হ্যাঁ, বউমা সুব্রত জমিটা বিক্রি করে দিয়েছে শুনলাম৷ আমাকে কি একথা জানাবারও প্রয়োজন মনে করলে না?
তার জমি সে বেচেছে৷ আপনাকে জানাবে কেন?
আমাকে জানালে যে আমি কিনে নিতাম৷
আপনি অত টাকা দিয়ে কিনতে পারতেন না৷ তাছাড়া জমি তো টাকা দিলেই কিনতে পাওয়া যাবে৷ ওটাই আপনাকে কিনতে হবে এমনকি কথা আছে?
কথা আছে বউমা৷ ওই জমির ফসলেই ওরা প্রতিপালিত৷ ও জমি আমাদের আর এক মা৷ বুড়ো বয়সে আপনার ভীমরতি ধরেছে বলে তো আমাদের ধরেনি? ওসব আজে-বাজে কথায় আর আমাদের ঠকাতে পারবেন না৷ এতদিন অনেক ঠকিয়েছেন৷ সবকিছু নিজেই আত্মসাৎ করেছেন৷ আর কোনোদিন এরকম অন্যায় দাবি নিয়ে এখানে আসবেন না৷ কথাগুলো বলেই ঘরে ঢুকে সশব্দে খিল এঁটে দেয় সুব্রতর স্ত্রী৷

সুব্রতর স্ত্রীর এহেন উক্তি শুনে দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে বাগানবাড়িতে ফিরে আসে শিবব্রত৷ বউমার মতের বাইরে যাবে না সুব্রত একথা আগেই জেনেছে৷ তাই সুব্রতের সঙ্গে কথা বলেনি৷ গভীর চিন্তায় এর সমাধান সূত্র খুঁজতে থাকে৷ দীনেশ ওকে চিন্তিত দেখে বলে, বড়োকত্তা অত চিন্তা করছ কেনে৷ ওদের জমি ওরা যা খুশি করেছে৷

ও জমি শুধু জমি নয় ও যে আমার মা৷ একদিন কত ফসল ও দিয়ে এসেছে সে তো তুইও জানিস৷ তাই ও জমি আমি জীবিত থাকতে পরের হাতে তুলে দিতে পারব না৷ তাতে মরতে হয় মরব৷
ওসব খ্যাপামো ছেড়ে চান করে এসো৷ রান্নায় বসবে৷ ততক্ষণে আনাজগুলো আমি কেটে রাখি৷ উনোনটাও ধরিয়ে দিই৷
শিশি থেকে তেল নিয়ে মাথায় গায়ে মেখে গামছা কাঁধে বেরিয়ে যায় শিবব্রত৷ একসময় দিনটা শেষ হয়৷ কিন্তু ভাবনা শেষ হয় না শিবব্রতর৷ শুধু ভাবতে থাকে সুব্রতর কথা৷ তাকে ভাইরা চেনে৷ জমি তার কাছে মায়ের সমান একথাও জানে৷ জমি বিক্রি করলে অন্তরে বিরাট আঘাত পাবে একথাও অজানা নয়৷ তবে কি তাকে আঘাত দিতেই এ জমি বিক্রি করে দিয়েছে বউমার ষড়যন্ত্রে? চিন্তায় সারারাত তার চোখের দুটি পাতা এক হয়নি৷ সকালে উঠে বাগানে পায়চারি করে চলেছে বর্তমান সমস্যার সমাধান সূত্র খুঁজতে৷ সূর্যদেব তখন পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছেন৷ শিবব্রত বাগান থেকে বেরিয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখতে পায় তার জমিতে রহিম হাল চালাচেছ৷

চিৎকার করে ওঠে শিবব্রত, দীনেশ উঠে আয়, দ্যাখ রহিম আমাদের জমিতে হাল চালাচেছ ওকে বাধা দিতেই হবে৷
একরকম ছুটে গিয়ে জমির মাথায় দাঁড়িয়ে বলতে থাকে, রহিম জমি হতে উঠে যা৷ ভালো হবে না বলে দিচিছ৷
তুমি ফিরে যাও বড়োকত্তা, ন্যায্য পয়সা দিয়ে জমি কিনেছি৷ তুমি ওঠাবার কে?
দীনেশ হাঁকতে থাকে, বড়োকত্তা ফিরে এসো৷ রহিমের সঙ্গে পারবে না৷ ও তোমার অন্তরের কথা বুঝবে না৷
কথা শোনে না শিবব্রত৷ দুটো বলদের জোয়ালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে, নে হাল চালা, আমার মাকে রক্ষা করতে আমার জীবন দেব৷ যতদিন বেঁচে আচি এ জমি তুই চাষ করিস না৷ আমি তোকে দ্বিগুণ টাকা দেব৷ তাই কি হয় নাকি৷ সরে যাও তুমি৷ এ কেমন বদমায়েশি তোমার?

এ বদমায়েশি নয় রে রহিম৷ এ আমার কর্তব্য৷ যদি এ কথা না মানিস তবে নে হাল চালা৷ রহিম ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে৷ গোরুর পিঠে সজোরে লাঠি মারে৷
বাঘের মতো বদল দুটো জোয়ালের ধাক্কায় তাকে মাঝখানে শুইয়ে দেয়৷ লোহার লাঙলটা এসে শিবব্রতর বুকে গভীরে বিঁধে যায়৷ শিবব্রত ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে থাকে, আমার মাটি মা তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তোমার ইজ্জত আমি রক্ষা করতে পারলাম না৷

দীনেশ ছুটে এসে শিবব্রতর মাথাটা কোলে নিয়ে বলতে থাকে, এ তুমি কি করলে বড়োকত্তা! রহিম তুই একটা রিকশা ডাক এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷
কিন্তু শিবব্রতর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না৷ দীনেশের চিৎকারে অনেকেই এসে জড়ো হয়৷ সুব্রত এসে স্থির চক্ষু নিয়ে দাদার দিকে চেয়ে থাকে৷ স্ত্রীর কাছে সব কথা সে শুনেছে৷ দাদাকে সে জানে৷ বিবেক খোঁচা দেয়, তার জন্যে দাদার এই অপমৃত্যু৷ তাই দাদাকে স্পর্শ করার সাহস পায় না৷ অবরুদ্ধ কান্নায় নীরব অনুতাপে পুড়তে থাকে৷

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.