গল্প

গল্প স্মৃতিময়

স্মৃতিময়

লেখক : ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

সবাই জীবনই স্মৃতিময়। তবে কিনা জীবনের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় অতীত একসময় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। তবুও কখনও কোনওভাবে হঠাৎ করে মনে যদি দোলা লাগে তখনই গুনগুনিয়ে উঠি ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার—।'

এবার থামতেই হচ্ছে। বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের অনেক কিছুই তো স্মৃতিময়। তাই আমার স্কুল জীবনের একটি ঘটনার কথাই আগে বলি।

আমি তখন হাওড়া রামকৃষ্ণপুর হাই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সেবার পুজোর আগেই আমাদের বাৎসরিক উৎসবের দিন স্থির হল। এই উৎসবের সময় ছোটদের জন্য কোনও নাটক মঞ্চস্থ হলে স্যারেরা আমাকে দিয়েই অভিনয় করাতেন বেশি। এতে অনেক ছেলেই ঈর্ষা করত আমাকে। এদের মধ্যে পূর্ণেন্দু নামে একটি ছেলে আমাকে একদমই সহ্য করতে পারত না। সে থাক, পরে অবশ্য সে আমার খুবই অনুগত হয়েছিল।
সে কথা যাক, পূর্ণেন্দু, আমি ও আরও দু একজন অভিনয়ের জন্য মেকাপ নিয়ে বসে আছি। শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। সভাপতি প্রধান অতিথি এলেই শুরু হবে অনুষ্ঠান ।

এমন সময় হঠাৎই কার যেন মনে হল, এই যাঃ সভাপতি ও প্রধান অতিথি বরণের মালা তো আনা হয়নি। কিন্তু এখন মালা আনতে যাবেটা কে? স্টেজের কাছ থেকে কেউ তো নড়তে চায় না ।

অবশেষে পূর্ণেন্দুই ওর এক বন্ধুকে নিয়ে এগিয়ে এসে স্যারেদের বলল, 'আমাকে টাকা দিন মালা আমিই এনে দিচ্ছি।'

স্যারেরা বললেন, তুই কী করে যাবি? তুই তো এখন মেকাপ নিচ্ছিস?’

পূর্ণেন্দু বলল, ‘আমার এখনও কমপ্লিট হয়নি, আমি যাব কি আসব।' বলেই তৈরি হয়ে নিল।

এরপর ওর এক সঙ্গীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল চোখের পলকে।

এই পূর্ণেন্দু হল আমাদেরই প্রিয় শিক্ষক হরিপদবাবুর নাতি। দুরন্তপনায় ওর জুড়ি ছিল না।

যাই হোক সভাপতি, প্রধান অতিথি আসার আগেই ফুলমালা নিয়ে ফিরে এল ও। এতে স্যারেরাও বেজায় খুশি। নাঃ ছেলেটা চঞ্চল হোক উপস্থিত বুদ্ধি মাথায় আছে। শুধু মালা নয় বুদ্ধি করে দুটো ফুলের তোড়াও নিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে সভাপতি প্রধান অতিথি সবাই এসে হাজির হলেন এবং তাঁরা মঞ্চেও এসে বসলেন। সভাপতি হয়েছিলেন এখানকার স্থানীয় এস. এন. এ. এবং প্রধান অতিথি হয়েছিলেন এই অঞ্চলেরই একজন স্বনামধন্য ডাক্তার। ওঁরা এসে মঞ্চও আলোকিত করলে পাঁচ-ছয় বছরের একটি বালিকাকে দিয়ে মাল্যদানও করানো হল। হাততালিতে মাতিয়ে দিলেন দর্শকরা।

কিন্তু একি! মালা পরার পর মাননীয় অতিথিদের নাক হঠাৎ সিঁটকে গেল কেন? বার বার দুজনে কি যেন শুঁকলেন। তবে কি মালা পছন্দ হয়নি ওঁদের? না হলেও কিছু আর করার নেই। মালা গলা থেকে খুলে দুজনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর রেখে দিলেন টেবিলের ওপর।

এরপর শুরু হল উদ্বোধনী সঙ্গীত। একেবারেই বেসুরো গলায় গান। তাই হাসির হুল্লোড় উঠল চারদিক থেকে। সভাপতি প্রধান অতিথিও হাসি চাপতে রুমালে মুখ মোছার ভান করলেন।

উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর শুরু হল সভাপতি প্রধান অতিথির ভাষণ। সভাপতি মহাশয় ভাষণ দিতে উঠে বললেন, ‘মাননীয় শিক্ষক মহাশয়, অভিভাবকবৃন্দ ও ছাত্রবন্ধুগণ! আজ এই আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে আমি সত্যই অভিভূত। এমনই যে আমার মুখ দিয়ে আর কথা সরছে না। শুধু তাই নয়, অভিজ্ঞতাও যা হল তাতে মনে হল এ কোনও দুরন্ত কিশোরের কাজ। দুরন্তপনার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে দেখলাম তা চিরকাল মনে থাকবে। এই একই অভিজ্ঞতা প্রধান অতিথি মহাশয়েরও। তবু অনুরোধ, যে বা যারা করেছে এই কাজ তাদের যেন শাস্তি দেওয়া না হয়। কেননা এরাই আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ।'

এমন কথা শুনে শিক্ষকরাও প্রত্যেকের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন।

সভাপতি মহাশায় বললেন, ‘আমি আমার ভাষণ এখানেই শেষ করছি। তার কারণ আমাকে এবং প্রধান অতিথি মহাশয়কে তখুনি বাড়ি গিয়ে স্নান করতে হবে। তবে তার আগে হেডমাস্টার মহাশয়কে একবার মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি।

লজ্জিত হেডমাস্টার মহাশয় সঙ্কুচিত হয়ে মঞ্চে এসে বললেন, ‘চলুন, কী এমন ব্যাপার ?
‘বলব। তার আগে বলুন, ‘এই মালা কাদের দিয়ে আনিয়েছিলেন?'
‘আমরা ফুলমালা কাজের চাপে আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই দুজন ছাত্রকে দিয়ে আনিয়েছিলাম।'
সভাপতি মহাশয় হেসে বললেন, তাহলে ঠিকই ধরেছি এ কোনও দুষ্টু ছেলের কাজ।'
হেডমাস্টার মহাশয় এবং আরও দু একজন স্যার এবার কাছে এসে বললেন, ‘ওরা কী করেছে বলুন? কান ধরে ওঠবস করাবো ওদের।’
‘না না, তা করবেন না।' বলে ফুলমালা দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কী? '
‘আজ্ঞে খই,।’
‘এদিকে কী লেগে?'
‘সিঁদুর।’
‘আর এই গন্ধটা ?’
‘সেন্টের।’
‘তাহলে আর কিছু কি বুঝতে বাকি থাকে?’
স্যারেরা সবাই মাথানত করলেন।
হেডমাস্টার মহাশয় জিভ কেটে বললেন, ‘ক্ষমা করুন। দোহাই আপনাদের। আমাদের স্কুলের বদনাম। এ তো মরার গলা থেকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া মালা আর তোড়া। এ নিশ্চয়ই এখানকার বাঁশতলা ঘাটের শ্মশান থেকে কুড়িয়ে এনেছে ছেলে দুটো। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।'

এম এল এ প্রধান অতিথি মহাশয় বললেন, ‘আর ছিঃ ছিঃ করে লাভ নেই। এখন কাউকে দিয়ে এগুলো ফেলিয়ে হাত ধোবার ব্যবস্থা করুন।
সকলের মাথা হেঁট করে দিয়ে সভাপতি এবং প্রধান অতিথি মহাশয় বিদায় নিলেন। এরপরেই মঞ্চ থেকে ডাকিয়ে আনা হল পূর্ণেন্দুকে।
সমস্ত স্যারেরা একবার ওর পর থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন।
আমাদের আর এক স্যার নববাবু বললেন, 'এখন আর ওকে কিছু বলার দরকার নেই। যা হবার তা অনুষ্ঠানের শেষেই হবে।'
একটু পরেই শুরু হল অনুষ্ঠান। শাজাহান থেকে নেওয়া একটি দৃশ্যের। পূর্ণেন্দু তো পাট একদম মুখস্তই করেনি। তার ওপরে কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ভুলে মেরে দিল সব। অথচ ওর আর আমার অভিনয়ের ওপরই নির্ভর করছিল সব। কেননা এই নাটকের দুটিই মাত্র চরিত্র। তার একটি আমি, অন্যটি ও। আমি অভিনয় করার উৎসাহে জলের মতো মুখস্ত করেছিলাম ডায়লগগুলো। ও তা করেনি। তাই বারে বারে আটকে যাচ্ছিল অবশেষে হরিপদবাবু স্টেজের পিছন থেকে ওর ডায়লগগুলো জোরে জোরে প্রশ্ট করতে লাগলেন। আর সেগুলো মাইক্রোফোনে ধরা পড়ে যাচ্ছেতাই শোনাতে লাগল। যাতে হাসির হুল্লোর উঠল চারদিক থেকে।

আমারও তখন যত না হাসি পেল রাগ হল ততটাই। পূর্ণেন্দু যদি এভাবে না ডোবাত তাহলে সেদিনের সেই অভিনয়ের স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে থাকত আমার জীবনে। যাই হোক, পরবর্তীকালে সে অবশ্য খুব ভালো ছেলে হয়ে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল ওর জীবনে। হোক সে দুরন্ত, তবু সব ভালো যার শেষ ভালো। এখন সে প্রবাসী।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.