প্রবন্ধ

প্রবন্ধ জিম করবেট জঙ্গলে

জিম করবেট জঙ্গলে

লেখক : সমীর রায়

হঠাৎই সামনের জঙ্গল ফুঁড়ে কালো দৈত্যের মতো বেরিয়ে এল বিশাল দাঁতালটা৷ আমাদেরকে দেখতে পেয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল৷ স্থির কৌতূহলী চোখে দেখছে সে৷ সেই সময় নজরে পড়ল তার কানের পাশের লম্বা বড় ক্ষতচিহ্ণটা৷ রক্ত ঝরছে সেখান থেকে৷ ভয়ে মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে আমাদের৷ একে একলা হাতি তার উপরে আবার আহত৷ জঙ্গলে এর চেয়ে বিপজ্জনক আর কি-ই বা হতে পারে?

হাতিটার দিকে চেয়ে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে আমাদেরও৷ প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কার প্রহর গুনছি, তেড়ে আসবে না তো হাতিটা?

আমাদের পিছনে একটা সরু নড়বড়ে কাঠের সেতু৷ তার নিচে খরশ্রোতা রামগঙ্গার গান৷ সাদা, কালো, খয়েরি রঙা অজশ্র নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে ফেনা তুলে নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে নদীটা৷ আমাদের জিপসিটা ওই সেতু পেরিয়ে ওপার থেকে এপারে এসেছে৷ এপার ওপার দু’পারেই ঘন জঙ্গল৷ শুধু মাঝখানের অংশটুকুই যা উন্মুক্ত৷ তবে নদীটার পরিধি বিশাল হলে হলেও মাঝের অল্প অংশ জুড়ে তার জলধারা বইছে৷ বাকিটা শুধুই নুড়ি পাথরের সারি৷

হাতিটা যদি তেড়ে আসে তাহলে জিপ নিয়ে পালানোর কোনও উপায় নেই আমাদের৷ কারণ যে সরু রাস্তাটার উপরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা, তার দু’পাশে পাথরের নুড়ি৷ নদী আর জঙ্গলের মাঝে যে শ’তিনেক ফুটো ব্যবধান, সেই অংশে মাটি মোরাম ফেলে রাস্তাটা অস্থায়ীভাবে তৈরি করেছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টা৷ সেটা এতই সরু যে কোনওমতে একটা জিপসি জাতীয় গাড়ি যেতে পারে শুধু৷ গাড়ি ঘুরিয়ে পিছনে পালানোর কোনও উপায়-ই নেই৷ আমাদের অবস্থান রাস্তায় প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়৷ সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে গজরাজ৷ অতএব সে যদি তাড়া করে তাহলে জিপ থেকে নেমে নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে দৌড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই৷ কিন্তু এভাবে কি তার নাগাল এড়াতে পারব?

ড্রাইভার শাহরুখ ছাড়া জিপের সওয়ারি আরও তিনজন৷ আমি, প্রদ্যুত দাস আর সুদীপ বক্সী৷ তিনজনেই বন্যপ্রাণ আলোকচিত্রী৷ চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা বিশাল উন্মুক্ত এই নদী প্রান্তরে দাঁড়িয়ে মনের সুখে পাখিদের ছবি তুলছিলাম আমরা৷ মাথার উপরে ঝকঝকে নীল নিেের্মঘ আকাশ৷ দিনের আলো নিভতে এখনও অনেক দেরি৷ চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে অজস্র রঙ-বেরঙের পাখি৷ নানারকমের বক, মাছরাঙা, টিটি, চিল সহ আরও নানা প্রজাতি বেরিয়ে পড়েছে দিনান্তের নরম আলোয়৷ সব মিলিয়ে ফটোগ্রাফির জন্য আদর্শ পরিবেশ৷ প্রয়োজনীয় সুন্দর আলো আর সাবজেক্টের উজ্জ্বল উপস্থিতি৷ আমরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিলাম৷ একের পর এক ভালো ভালো ছবিতে ভরে উঠছিল ক্যামেরার মেমরি কার্ড৷ ঠিক তখনই ঘটে গেল ছন্দপতন৷ জিম করবেটের এই জঙ্গলে হাতির দেখা পাওয়াটা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক৷ হাতিরাও ট্যুরিস্ট দেখতে অভ্যস্ত, ক্যামেরা হাতে জিপসি আরোহীদের দেখে সাধারণত তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া থাকে না তাদের তরফে৷ ভয় পায় না ট্যুরিস্টরাও৷ কিন্তু এই হাতিটির ক্ষেত্রে এমনটা না হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ এই একলা ও সাধারণ দলবদ্ধ হাতিরা মোটেই সমস্যা করে না৷ বড় জোর আড়চোখে ট্যুরিস্টদের একবার দেখে নিয়ে তাদের স্বাভাবিক বন্য ছন্দেই চলে৷ কিন্তু একেলা হাতি মানেই দলছুট৷ হাতিদের দলে সর্দার থাকে একজন. তার নির্দেশই মেনে চলে সবাই৷ কিন্তু গোলমাল বাঁধে তখন যখন দলের কোনও নব্য দাঁতাল দলপতি হবার বাসনা নিয়ে সর্দারের নির্দেশ অমান্য করে৷ যুদ্ধ বাঁধে তখনই৷ যে জয়ী হয় সে-ই থাকে সর্দার, পরাজিত হয়ে যায় দল থেকে বিতাড়িত৷ এই বিতাড়িত একেলা হাতিরাই অবসাদগ্রস্ত হয়ে গোলমাল বাঁধায়৷ এই হাতিটি যে তেমনই একটা হাতি তাতে আমরা নিশ্চিত৷ ওর ক্ষতচিহ্ণ আর নিঃসঙ্গতাই তার সাক্ষী৷

ড্রাইভার শাহরুখ ফিসফিস করে বলল, ‘আপ সব চুপচাপ বৈঠ রহে৷ একদম বাত মাত করিয়ে৷’

গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছে শাহরুখ৷ চলার উপযোগি পেট্রজালিত সাইলেন্সার লাগানো জিপসির ইঞ্জীনের ক্ষীণ শব্দটুকুও আর নেই৷ শুধু শোনা যায় রামগঙ্গার গান আর অজস্র পাখির কলকাকলি৷ কিন্তু সেসব শোনার মতো মানসিক অবস্থা এখন নয় আমাদের৷ আতঙ্কিত বিস্ফোরিত দুটি চোখ মেলে চেয়ে আছি আমরা হাতিটার দিকে৷ আতঙ্কের কারণও আছে যথেষ্ট৷ একলা হাতির আগ্রাসি রূপ গতকালই দেখেছি আমরা৷ সকালের সাফারিতে বেরিয়েছিলাম৷ বাংলো ছেড়ে সবে কিছুটা এগিয়েছি, ঠিক তখনই দেখা মিলেছিল এমনই এক একলা হাতি৷ দূরত্ব একটু বেশি থাকায় আমরা জীপ থামিয়ে ছবি তুলছিলাম তার৷ কিন্তু হঠাৎই শুঁড় উঁচিয়ে চিৎকার করতে করতে তেড়ে এসেছিল হাতিটা৷ শাহরুখ চটজলদি গাড়িটা তীরবেগে ছুটিয়ে দেওয়ায় খুব জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছি৷ কিন্তু এখন তো আর সেই সুযোগও নেই৷ হাতিটা যদি তাড়া করে তাহলে জীপ থেকে নেমে কোন দিকে কিভাবে দৌড়াব সেই কথাই ভাবছিলাম৷

কিন্তু তার আর প্রয়োজন হল না৷ এবার আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্নই৷ আহত ও একেলা হলেও হাতিটির শারীরি ভাস্ময় আক্রমনাত্মক কিছু লক্ষণই দেখা গেল না৷ আমাদের দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ধীর পায়ে নদীর দিকে হাঁটতে লাগল সে৷ রাস্তা ছেড়ে সে খানিকটা সরে যেতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললাম আমরা৷ শাহরুখ গাড়িটা এবার একটু নিরাপদ জায়গায় দাঁড় করাল৷ আর আমরা মনের সুখে হাতিটির ছবি তুলতে লাগলাম৷

শাহরুখ বলল, ‘বহুত জোর বাঁচ গিয়া স্যার৷’

‘সে আর বলতে৷’

শাহরুখকে সমর্থন করে বললাম আমি৷ ভাগ্য দেবতাকে বারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছিল প্রদ্যুতদা আর সুদীপ বক্সীও৷ হাতিটি ততক্ষণে আরও দূরে চলে গিয়েছে৷ ঘাস বনটা পেরিয়ে নদীতে নেমে জলে বসে পড়ল সে৷ বোধহয় এভাবেই শরীরের যন্ত্রণার জ্বালা জুড়োতে চায়৷ হয়তো অপমানেরও৷

আমাদেরকে দেখেও হাতিটির আক্রমণাত্মক না হয়ে ওঠাটা যথেষ্ট বিস্মিত করেছে আমাকে৷ তাজা ক্ষত যার শরীরে, যেভাবে রক্ত পড়ছিল তাতে দেখলেই বোঝা যায় সদ্য মার খেয়ে এসেছে, অথচ তার শারীরি ভাষায় আগ্রাসনের কোনও চিহ্ণই নেই৷ আমি ভাবছিলাম, এই মুহূর্তে বোধহয় যন্ত্রণার চেয়ে অভিমানটাই বেশি প্রকট হয়ে আছে ওর মনে৷ তাই অমন ঝিমিয়ে আছে৷

জিম করবেটের জঙ্গলে টুরিস্টদের হাতির হাতে আক্রান্ত ঘটনা প্রায়ই ঘটে৷ তবে জিপ উল্টে দেওয়া বা তাড়া করার কথা শুনলেও কোনও ট্যুরিস্টের মৃত্যু হয়েছে বলে শুনিনি৷ জঙ্গল লাগোয়া গ্রামবাসী ও বনবিভাগের কর্মী হাতির আক্রমণে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল৷ পায়ে হেঁটে জঙ্গলে টহল দিচ্ছিলেন তিনি৷

হাতি ছাড়া জিম করবেটের মুখ্য আকর্ষণ হল বাঘ৷ হামেশায় দেখা মেলে তাদের৷ তবে হাতিদের মতো তাদেরকে নিয়ে ততটা ভয় নেই৷ ট্যুরিস্ট দেখতে অভ্যস্ত বাঘগুলো মানুষ দেখে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়াই জানায় না৷ কেউ কেউ তো আবার ফটোগ্রাফারদের পোজ দেয়৷ তবে মেজাজ খারাপ থাকলে অথবা কোনও কারণে উত্যক্ত হলে কখনো কখনো হামলা করে৷ এমন ঘটনা অবশ্য খুব কমই ঘটে৷ আসলে এই জিম করবেটের জঙ্গলে বন্য জন্তুদের নিয়ে তেমন ভয়ের কিছু নেই৷ হাতি, বাঘ কিংবা অন্য কোনও জন্তু জানোয়ার, হামলা সাধারণত করে না৷ বহু সাধারণ ট্যুরিস্ট কুমায়ুন হিমালয়ে ঘোরার সময় করবেটকেও তাদের সফল সূচিতে জুড়ে নেয়৷ অনেকে বাচ্চাদেরকে নিয়েও জঙ্গলে যায়৷ বনবিভাগ জালঘেরা ক্যান্টরের মাধ্যমে নিরাপদে বনভ্রমণ করানোর ব্যবস্থা রেখেছে৷ যারা হামলার মুখে পড়ে তারা বেশিরভাগই ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার৷ ভালো ছবির লোভে ট্যুরিস্টদের প্রচলিত রুট ছেড়ে ওরা জঙ্গলের কোর এরিয়ার গভীরে যায়৷ কখনও কখনও বন্য জন্তুর খুব সামনেও চলে যায়৷ আর তখনই ঘটে বিপদ৷

আমরা এখন আছি ধিকালা জোনে৷ পাঁচশো কুড়ি বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এই জিম করবেটের জঙ্গলে মূলত সাতটি ফরেস্ট রেস্ট হাউসেই ট্যুরিস্টদের আনাগোনা বেশি৷ ধিকালা, বিজরানি, গৈরাল, সুলতান, সরাপদুলি, ঝিরনা ও মৌলনি৷ পর্যটকদের প্রথম পছন্দ অবশ্যই ধিকালা৷ কারণ এখানে আরামে থাকার জন্য সমস্ত আধুনিক সুবিধা মেলে৷ ইলেকট্রিসিটি, বড় রেস্টুরেন্ট, বিলাস বহুল বাংলো থেকে হাতি সাফারি সব কিছুই পাওয়া যায়৷ বাকি বন বাংলোগুলোয় খাবার ব্যবস্থা থাকলেও ইলেকট্রিসিটি নেই, জেনারেটার কিংবা সোলার লাইটই ভরসা৷ ধিকালার মতো এতগুলো ঘরও নেই৷ সেগুলো ততটা আধুনিক মানেরও নয়৷

তবে ধিকালায় আরামে থাকার বন্দোবস্ত থাকলেও সেটাকে ঠিক বনবাংলো বলে মনে হয় না৷ জঙ্গলের বাহান্ন কিলোমিটার ভিতরে একেবারে কোর এরিয়ার মধ্যে যেন ছোটখাটো একটা টাউনসিপ৷ কিন্তু অবস্থান ভারি সুন্দর৷ রামগঙ্গার একেবারে ধারেই৷ বাংলোয় বসে দেখা যায় নদীর ওপারের জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়৷ নজরে পড়ে রামগঙ্গার তীরের তৃণভূমিতে বিচরণরত হাতি, হরিণ, বনশুয়োরের দলের৷ ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে বাংলো থেকে বাঘদর্শনও হয়ে যেতে পারে৷

জিম করবেটের অবস্থান কুমায়ুন হিমালয়ের পাদদেশে৷ বিশাল এই জঙ্গল বন্যাপ্রাণে বেশ সমৃদ্ধ৷ হাতি, বাঘ ছাড়াও এখানে আছে বেশ কয়েকটি প্রজাতির হরিণ৷ তার মধ্যে চিতল হরিণের সংখ্যাই সবথেকে বেশি৷ সম্বরও আছে প্রচুর৷ এরা আকারে বেশ বড়৷ সংখ্যায় কম হলেও বেশ কিছু বার্কিং ডিয়ারও আছে এখানে৷ সম্বর আর চিতলের থেকে আয়তনে বেশ কিছুটা ছোট৷ পাহাড়ি জঙ্গলে থাকতেই এরা পছন্দ করে বেশি৷ বাঘ দেখলেই এরা কুকুরের মতো ঘাউ ঘাউ করে ডাকে৷ যাকে বলা হয় টাইগার কলিং৷

এই মুহূর্তে সেই টাইগার কলিংই শোনা যাচ্ছে৷ সামনের জঙ্গলের দিকে একটা বার্কিং ডিয়ার থেমে থেমে ডাকছে৷ এভাবে ডেকে অন্য বন্যপ্রাণীদের বাঘ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয় তারা৷ বাকিং ডিয়ার ছাড়াও অন্য প্রজাতির হরিণরা এবং বাঁদররা বাঘ দেখলেই তাদের সাধারণ ডাক ছেড়ে এক বিশেষ ধরনের শব্দে ডাকে৷ সেগুলোকেও টাইগার কলিং বলে৷ ওই ডাক শুনে গাইড আর ড্রাইভাররা বাঘের অবস্থান বুঝতে পারে৷ আমাদের ড্রাইভার শাহরুখও কান পেতে বার্কিং ডিয়ারটার ডাক শুনছিল৷ সে বলল, ‘লাগতা নজদিকই হ্যায়৷ ইধার তরফ৷ একবার ট্রাই করে?’ প্রদ্যুতদা বলল, ‘লাভ নেই গিয়ে৷ আলো কমে এসেছে৷ জঙ্গলের ভিতরে ছবি ভালো হবে না৷ তার চেয়ে এখানেই থাকি, কিছুটা আলো আছে৷ রিভার ল্যাপউইংগুলো ভালো পোস দিচ্ছে৷’ প্রদ্যুতদাকে সমর্থন করলাম আমিও৷ সুদী বক্সীরও একই মত৷ সত্যিই জঙ্গলের ভিতরে এখন ছবি ভালো হবে না৷ নদীর ধারে এই উন্মুক্ত প্রান্তরে এখনো ভালো আলো আছে৷ সাবজেক্টেরও ছড়াছড়ি৷ আসলে গতকাল বাঘের ভালো ছবি পেয়ে গিয়েছি আমরা৷ তার থেকে ভালো ছবি যে এই কম আলোয় সম্ভব নয় সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত৷ তাছাড়া আদৌ যে এখন বাঘের দেখা পাওয়া যাবে কি না সেই ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তাও নেই৷

আরও কিছুক্ষণ নদীর ধারে কাটানোর পর যখন আলে আরও কমে এল তখন আমাদের জিপসি চলতে শুরু করল৷ আমরা এখন ফিরে যাব ধিকালা বন বাংলোয়, যেখানে তিন দিন ধরে ঘাঁটি গেড়েছি৷ আজই তার শেষ রাত৷ আগামী কালই আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব৷

সেই ব্রিজটা পেরিয়ে যে পথে আমরা এসেছিলাম সেই পথেই ফিরে যাচ্ছিলাম আমরা৷ নদী প্রান্তর ছাড়িয়ে ঘন জঙ্গলের কাঁচা রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে চলতে লাগল আমাদের জিপসি৷ শেষ বিকালের ম্লান আলোয় পথের উপরে কোথাও কোথাও বসেছিল ইন্ডিয়ান পিটা এবং চেস্টনাট হেডেড বিইটার পাখিরা৷ ইঞ্জিনের শব্দ পেয়ে ডান ঝটপটিয়ে উড়ে যাচ্ছিল তারা৷ কোথাও বা বনমোরগরা অতি দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে ওপারের জঙ্গলে চলে যাচ্ছিল৷ মাঝেমধ্যেই দেখা মিলছিল চিতল হরিণ আর ময়ূরের৷ বাংলোয় ঢোকার কিছুটা আগে কয়েকটা সম্বর দেখতে পেলাম৷

জিম করবেটে সম্বর বেশি দেখা যায় ঝিরনা রেঞ্জে৷ এরাই বাঘেদের সব থেকে পছন্দের শিকার৷ কারণ করবেটের হরিণ প্রজাতির মধ্যে এরাই সব চেয়ে আকারে বড়ো৷ একবার ধরতে পারলেই তিন চারদিনের খাবার জুটে যায়৷ তাছাড়া এদের ধরা ততটা কঠিন নয়৷ সম্বর দ্রুত দৌড়াতে পারলেও তারা খুব বোকা৷ দৌড়াতে দৌড়াতে মাঝেমধ্যেই পিছন ফিরে দেখতে যায় শিকারি কতটা কাছে এসেছে৷ যার ফলে গতি কমে গিয়ে ধরা পড়ে যায়৷

বাংলোয় যখন ফিরলাম তখন দিনের আলো শেষ হয়ে এসেছে প্রায়৷ ম্লান আলোয় ধুলো উড়িয়ে সাফারি শেষে ফিরছে একের পর এক জিপ৷ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যে প্রায় কুড়িটি জিপসি এখান থেকে সাফারিতে বেরোয়৷ সেগুলো সব গেট পেরিয়ে লাইন দিয়ে ফিরছে৷

ধিকালা বনবাংলোর চৌহুদ্দি বিশাল, প্রায় ত্রিশ বিঘা তো হবেই৷ বন্যজন্তুর হামলার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য চারদিকে মৃদু ভোল্টেজের ইলেকট্রিক তারের বেড়া দিয়ে সীমানা তৈরি করা হয়েছে৷ গেট দক্ষিণ দিকে, শাল কাঠ আর দড়ি দিয়ে তৈরি সেটা৷ সব শুদ্ধ বত্রিশটা ঘর আছে এখানে৷ কিন্তু সেগুলো সব একটা বিল্ডিঙের মধ্যে নয়৷ কিছুটা দূরে দূরে কটেজের মতো করে তৈরি করা হয়েছে৷ একটা বড় রেষ্টুরেন্ট,সুতেনিওর সপ আর মিউজিয়ামও আছে ভিতরে৷ আর আছে একটা প্রেক্ষাগৃহ, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় জিম করবেট জঙ্গলের বিষয়ে তথ্যচিত্র দেখানো হয়৷ আমাদের কর্টেজটা একেবারে শেষপ্রান্তে, যার বারান্দায় বসে দেখা যায় রামগঙ্গা নদী ও তার ওপারের জঙ্গল ঢাকা পাহাড়৷ এখান থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য ভারি মনোরম৷ পাহাড়টার পিছন থেকে উঠে আসা রাঙা সূর্যের আলোয় রামগঙ্গার জল রক্ত রঙে ঝলসে ওঠে যেন৷ আশেপাশের তৃণভূমিতে চরে বেড়ায় বন্যজন্তুরা৷ এখন সেখানে একপাল চিতল হরিণ আর কয়েকটা হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ বনশুয়োরও রয়েছে কয়েকটা৷

আমি ক্রমে না গিয়ে বাইরের বাগানের বেঞ্চে বসে পড়লাম৷ যতক্ষণ দিনের আলো থাকবে ততক্ষণ থাকব এখানে, উদ্দেশ্য একটাই যতক্ষণ পারা যায় এই অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যকে চাক্ষুস করা৷ আগামীকাল সকালের সাফারি সেরেই তো চলে যেতে হবে এখান থেকে৷ একটা কালি তিরি ডাকছে থেমে থেমে৷ ‘তিক তিতরিক তিতক তক’ করে ভারি অদ্ভুত সুরে ডাকে ওরা৷ তীক্ষ্ন অথচ সুন্দর সেই ডাক ছড়িয়ে পড়ছে বহু দূর পর্যন্ত৷ সব মিলিয়ে মনে এক অদ্ভুত নেশা জাগানো পরিবেশ চারদিকে৷ যেন মনে হয় পৃথিবীর মধ্যে এ যেন এক অন্য পৃথিবী৷ মনখারাপ লাগছিল আগামীকাল এখান থেকে চলে যাব বলে৷ আবার কবে আসতে পারব কে জানে!

প্রয়োজনীয় তথ্য

কিভাবে যাবেন : করবেট যাবার সব থেকে সুবিধাজনক পথ হল মোরাদাবাদ হয়ে যাওয়া৷ হাওড়া এবং শিয়ালদহ থেকে প্রচুর ট্রেন মোরাদাবাদ যাচ্ছে প্রতিদিন৷ মোরাদাবাদ থেকে রামনগর আশি কিলোমিটার৷ রামনগরই জিম করবেটের প্রবেশ পথ৷ দিল্লি অথবা নৈনিতাল থেকেও যাওয়া যায়৷

কোথায় থাকবেন : রামনগর ও তার আশপাশ এলাকায় প্রচুর হোটেল ও রিসর্ট আছে৷ তার মধ্যে বেশ কয়েকটা বিলাস বহুল, বিশেষ করে রামগঙ্গা ঐ জঙ্গলের আশেপাশের রিসর্টগুলো৷ তবে জঙ্গলের ভিতরের বনবাংলোগুলোয় থাকার মজাই আলাদা৷ তবে সেখানে বুকিং পাওয়া খুবই কঠিন৷ দু’মাস আগে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে অতি দ্রুততার সঙ্গে বুক করতে হবে৷ কারণ মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব রুম বুক হয়ে যায়৷ ফরেস্ট বাংলো অনলাইনে বুকিং-এর ওয়েবসাইট---

www.corbettonline.uk.gov.in

জিপ সাফারি এবং অন্যান্য সহায়তার জন্য ফোন করুন মোহিত সিং বিস্তকে---৯৪৫৬৩২৩২৫০/৯৮৩৭৩২৫৬৫১

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.