গল্প

গল্প ভালোবাসার পরীক্ষা

ভালোবাসার পরীক্ষা

লেখক : চন্দ্রনাথ বিশ্বাস

বিপুলবাবু রানাঘাট শহরের একেবারে জমজমাট জায়গায় আজ দীর্ঘদিন ধরে বাস করেন৷ বাড়ির সন্নিকটেই সমস্ত বাজার, দোকান, শপিং মল, ব্যাঙ্ক, নার্সিংহোম ইত্যাদি বর্তমান৷ বাড়ি থেকে স্টেশন ৫ মিনিটের পথ৷ যোগাযোগের জন্য বাড়ির সম্মুখে সর্বসময়ের জন্য অটো, টোটো, ভ্যানরিকশা দাঁড়িয়ে থাকে৷

তিনি রানাঘাট পৌরসভায় চাকুরি করেন স্থায়ীভাবে দীর্ঘদিন৷ বাড়িতে তার একমাত্র স্ত্রী হৈমন্তী দেবী ও একজন অল্পবয়সের মেয়ে পরিচারিকার কাজ করে৷ অনেকদিন হয়ে গেলো তাদের বিয়ে হয়েছে৷ এখনো পর্যন্ত কোনো সন্তান হয়নি৷ মোটামুটি বেশ সচ্ছল পরিবার৷ ঐ এলাকায় সমস্ত দোকানদার থেকে টোটোওয়ালা সকলেই বৌদি বলতে অজ্ঞান৷ হৈমন্তী দেবীকে এককথায় বিপুলবাবুর চেয়েও তিনি সকলের কাছেই খুবই পরিচিত৷ কারণ তার ব্যবহারে সকলেই মুগ্দ৷

তবে বাড়িতে ইদানীং দুজনের মধ্যে খুবই ঝগড়াঝাঁটি হয়৷ যদিও পরে আবার মিলও হয়ে যায়৷ এইজন্যে বিপুলবাবু ভাবেন--- হৈমন্তী সেই আগের মতো আমাকে ভালোবাসে না৷ যতক্ষণ বাইরে থাকি, ততক্ষণই ভালো থাকি আর সেও ভালো থাকে, এটা তার ধারণা৷

প্রতিদিনকার মতো বিপুলবাবু রোজ অফিসে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই চলে যান এবং টেবিলে যত কাজ থাকে সেগুলো একটাও ফেলে রাখেন না৷ কিন্তু ইদানীং একটু তাকে অন্যমনস্ক দেখা যাচ্ছে৷ আর টেবিলের অনেক কাজ জমে যাচ্ছে, এটা ব্যাপারটা তার পাশের টেবিলের শঙ্কর বেশ অনুধাবন করছে৷ আজ কদিন ধরে অফিসে বিপুলদা এসে কি যেন চিন্তা করে৷ ব্যাপারটা কি হলো? একদিন শঙ্কর নিজের চেয়ার ছেড়ে বিপুলদার কাছে গিয়ে তার এইরকম মনোভাবের কথা জিজ্ঞাসা করলো৷

---কি ব্যাপার বিপুলদা--- কি চিন্তা করছেন? বাড়িতে বৌদির সঙ্গে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে? না অন্য কিছু সমস্যা?

বিপুলবাবু বলেন--- না তেমন কিছু নয়৷ তবে আমি দিন দিন তোমার বৌদির কাছ থেকে যেন দূরে সরে যাচ্ছি৷ সর্বদা খুঁটিনাটি বিষয়ে আমার সঙ্গে অশান্তি করে৷ আমার ধারণা আমাদের মধ্যে আর সেই ভালোবাসা নেই৷ কি যে করি! মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছি৷

শঙ্কর বলে--- আরে এটা কোনো সমস্যা নাকি! এ তো সব দম্পত্তির মধ্যেই হয়ে থাকে৷ এসব নিয়ে আপনি কেন মানসিক কষ্ট পাচ্ছেন৷ কিছুদিন পর দেখবেন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আসলে বৌদি আপনাকে অত্যধিক ভালোবাসেন৷

বিপুলবাবু বলেন--- না-না, তোমার ধারণা ভুল৷ হৈমন্তী আমাকে মোটেই ভালোবাসে না৷ দিন যত এগোচ্ছে তত যেন আমার প্রতি আন্তরিক টানটাও কমে যাচ্ছে তার৷ খারাপ ব্যবহার করে আমার সঙ্গে৷

শঙ্কর আবার বললো--- বিপুলদা আপনার বৌদির প্রতি একটা ভুল ধারণা জন্মেছে৷ আপনি দেখতে চান, বৌদি আপনাকে কেমন ভালোবাসে? আর কত টান আছে আপনার প্রতি৷

বিপুলবাবু বললেন--- কিভাবে?

শঙ্কর বললো--- তাহলে টিফিন সময়ে কমনরুমে বসে একটা প্ল্যান করবো৷

বিপুলবাবু বললেন--- তুমি যে প্ল্যানই করো না কেন হৈমন্তী খুব বুদ্ধিমতী৷ ঠিক ধরে ফেলবে৷ বুঝতে পারলে বাড়ি একেবারে মাথায় তুলে চিৎকার করবে৷

শঙ্কর বললো--- আরে না-না৷ অত সহজ নয়৷ এটা ভালোবাসার পরীক্ষা৷ যদি এই প্ল্যানটা সফল হয়ে যায় তাহলে মাঝেমধ্যে আমিও গিয়ে বৌদির কাছ থেকে ভালোমন্দ খেয়ে আসবো৷

অনেক ভেবেচিন্তে শঙ্কর বললো--- আপনার একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টের অভিনয় করতে হবে৷ তাতে বৌদির আপনার প্রতি ভালোবাসার গভীরতা বোঝা যাবে৷

বিপুলবাবু---শঙ্করের সমস্ত প্ল্যান শুনে তার মধ্যে কোনো গলদ খুঁজে পেলো না৷ রাজি হয়ে গেলেন৷

শঙ্কর বললো--- এর জন্য আপনার কিছু খরচা করতে হতে পারে৷ কারণ এরকম অভিনয় করানোর জন্য, একজন পরিচিত ব্যক্তির দরকার৷

বিপুলবাবু বললেন--- শঙ্কর অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করো৷ যেন কোনো গলদ না থাকে৷ আমার একজন পরিচিত দোকানদার আছে৷ তাকে দিয়ে করানো যেতে পারে৷ শুধু ১০০ টাকা দিলেই সে রাজি হয়ে যাবে৷

ভাবনা অনুযায়ী পরের দিনই সেই দোকানদারকে ডেকে আনলেন শঙ্করের কাছে৷

শঙ্কর তাকে বুঝিয়ে দিলো--- কিভাবে তাকে অভিনয় করে মোবাইলে কথা বলতে হবে৷

শঙ্কর দোকানদারকে বললো--- তুমি বৌদির নম্বারে ফোন করে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে বলবে--- দাদার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে৷ মোবাইলটা রাস্তার পাশে পড়েছিলো৷ আমি সেই ফোন থেকেই আপনাকে ফোন করছি৷ দাদার মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টে একটা পা ভেঙে গেছে৷ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ সাথে ওনার এক কলিগ শঙ্করদা গেছেন৷ আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন হাসপাতালে৷ শঙ্করের শেখানো অনুযায়ী দোকানদারও ঠিক সেইভাবেই বৌদিকে ফোন করে জানালো৷

শঙ্কর ভাবলো--- এবার বৌদি নিশ্চয়ই দ্রুত হাসপাতালে চলে আসবেন৷

শঙ্করের পরিকল্পনা অনুসারে বিপুলবাবু পায়ে প্লাসটার করে ইমারজেন্সির বাইরে বেঞ্চে বসে থাকবেন এবং এখানেই একটা আবেগঘন নাটকও সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে৷ এরপর বৌদির কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন৷ সেই আশায় তিনি সেখানে বসে থাকবেন৷

প্রায় ১০ মিনিট পর বিপুলবাবুর বাড়ির পরিচারিকা ফোনে জানালো--- দাদার অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে বৌদিমণি একেবারে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেছেন৷ মাথায় অনেকখানি ফেটে গেছে৷ ব্যান্ডেজ, আইসব্যাগ, তুলো এসব নিতে পাশের ফার্মেসীতে যাচ্ছি৷ বৌদিকে কোনোরকমে শুইয়ে দিয়ে এসেছি ঘরে৷

বিপুলবাবু এ খবর শুনেই নিমেষে তার হুঁশ ফিরে এলো৷ দোকানদারটা একটা বদের হাড্ডি৷ আমার মনে হয় ফোনে নিশ্চয়ই ওভার অ্যাক্টিং করে ফেলেছে৷

যাইহোক দুজনে সঙ্গে সঙ্গে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাড়ি ফিরে এলাম৷ এসে দেখলাম হৈমন্তীকে একটা ঘরে শুয়ে রাখা হয়ে৷ চোখবন্ধ করে আছে৷ বিপুলবাবু হৈমন্তীকে দেখে একেবারে অনুশোচনায় ভেঙে পড়লেন! সঙ্গে আহা! করতে করতে মাথার কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখলেন৷

এরপর শঙ্কর দেখলো--- বৌদি একটা চোখ খুলে বিপুলদাকে বললেন--- সব কিছুতেই তোমার অ্যাক্টিং! পায়ে তো তোমার কোনো আঘাতের চিহ্ণই নেই৷ দিব্যি তো চলাফেরা করছো৷ এই তোমার মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টে পা ভাঙা৷

বিপুলবাবু বেশ উদ্বেগের সঙ্গে বললেন--- আরে বাদ দাও আমার পায়ের কথা৷ তোমার এখন অবস্থা কি? মাথায় কতখানি ফেটে গেছে আগে বলো৷

হৈমন্তীদেবী এবার বিছানাতে উঠে বসে বললেন--- কই আমার তো কিছু হয়নি৷ আমার আবার কি হবে? অভিনয়টা শুধু তুমি একাই করতে পারো৷

এমন লোককে দিয়ে ফোন করিয়েছিলে, যার সাথে আমার প্রায়ই দেখা ও কথা হয়৷ অন্য কোনো অপরিচিত লোক পেলে না৷

তোমার সাথে প্রায় এক যুগের অধিক সময় ধরে সংসার করছি৷ তোমাকে চিনতে কি আর বাকি থাকে?

আমি শুধু দেখলাম--- আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি শুনে তোমার কি প্রতিক্রিয়া হয়৷

শঙ্কর ঐখানে দাঁড়িয়ে বিপুলদা ও বৌদির কথা শুনে ভাবে আমারই তো অজ্ঞান হয়ে যাবার জোগাড়৷ এবার পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজতে হবে৷

বিপুলদা বৌদির দিকে তাকিয়ে বললেন--- ধরো যদি সত্যিকারের আমার অ্যাক্সিডেন্ট হতো, আর কখনো যদি ফিরে না আসতাম আমি তাহলে...

হৈমন্তী দেবীর কণ্ঠস্বরে লুকানো আবেগ যেন উঁকি দিলো৷ কান্না কান্না দৃষ্টিতে বিপুলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন--- এমন খবর শোনার আগেই যেন উপরওয়ালা আমাকে তুলে নেন!

এইবার শঙ্কর ভাবলো---আজ এই মুহূর্তে তাদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসার মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে একজন অপরিচিত বলে মনে হচ্ছে৷

পা ভাঙা এই কাহিনী নিয়ে হই চই শুরু হওয়ার আগেই আমি আস্তে করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়লাম৷ এককথায় বলতে পারি পালিয়ে বাঁচলাম৷ এরপর কয়েকদিন বিপুলদার আশেপাশে যাওয়াটা ঠিক হবে না৷

কামনা করি, তাদের এই ভালোবাসা জন্মজন্মান্তর অক্ষুণ্ণ্ থাকুক৷

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.