প্রবন্ধ

প্রবন্ধ মঙ্গলের মাঙ্গল্য

মঙ্গলের মাঙ্গল্য

লেখক : তুষার রায়

-১-
জলহীন,বায়ুহীন,প্রাণহীন,পাথুরে পাহাড়,উপত্যকা আর মালভূমি বেষ্টিত এক মহা-মরু-সম ‘অ-মঙ্গলে’ গ্রহ,অথচ নাম মঙ্গল।

মঙ্গল কথাটা এসেছে আমাদের পৌরাণিক দেবী মঙ্গলার নাম থেকে আর ইংরাজিতে মার্স(Mars) কথাটা নেওয়া হয়েছে রোমান যুদ্ধের দেবতার নাম থেকে-কারণ এর লালচে রঙ যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঝরা রক্তের রঙ এর সংগে সমঞ্জস্য রাখে। সৌরমণ্ডলের আটটি ‘পূর্ণ’ গ্রহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযান হয়েছে মঙ্গল গ্রহে। চাঁদে মানুষের পা পড়ার অনেক আগে মঙ্গলকে জানার জন্য মানুষের অভিযান শুরু হয়েছিল। আজ পর্যন্ত এই গ্রহ সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান সবচেয়ে বেশি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘মার্সনিক-১’(Mars 1M)নামক প্রথম মহাকাশ যান মঙ্গল অভিমুখে পাঠাবার প্রয়াস করেছিল অক্টোবর,১৯৬০ সালে। দুর্ভাগ্যবশত এই প্রথম মঙ্গল অভিযানের প্রচেষ্টা সফল হয়নি।কিন্তু এটাও সত্যি যে ছয়-দশকেরও আগে মঙ্গলকে জানার আগ্রহ জন্মেছিল মানুষের মনে যখন ঘরের কাছে চাঁদে যাবার কথা হয়ত ভাবেও নি।এই প্রচেষ্টার পরই শুরু হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী-ব্যাপী মঙ্গল অভিযানের প্রতিযোগিতা।

এই প্রতিযোগিতার ফল স্বরূপই প্রথম সাফল্য এলো পাঁচ বছরের মধ্যেই: আমেরিকার(নাসা) ‘ম্যারিনার-৪(Mariner-4) মহাকাশযান ওই গ্রহের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ওর সম্বন্ধে প্রথম তথ্য জানাল। ম্যারিনার-৪, ১৯৬৪ এর ২৮শে নভেম্বর,পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় আট মাস মহাকাশে ভ্রমণ করে পরের বছর ১৪-১৫ জুলাই,তারিখে মঙ্গলের আকাশে পৌঁছেছিল আর উড়তে উড়তে ইংগিত দিয়েছিল যে ঐ মরু-সদৃশ গ্রহে একদা জলের প্রবল বন্যা প্রবাহিত হত।এর পর ম্যারিনার-৯, ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে নিয়মিতভাবে মঙ্গল পরিক্রমা আরম্ভ করল।এই প্রথম মানুষের তৈরি কোন ‘বস্তু’ সৌরমণ্ডলের অন্য একটি গ্রহকে পরিক্রমা করতে সক্ষম হল।ম্যারিনার-৯ হল মানুষের তৈরি মঙ্গলের প্রথম ‘উপগ্রহ’।এর পর ম্যারিনার-৬ (জুলাই,১৯৬৯) আর ৭ (আগস্ট ১৯৬৯) মঙ্গলের অসংখ্য ছবি পাঠাল।পরে ১৯৭৬ থেকে ভাইকিং-১ আর ভাইকিং-২ জোড়া-মঙ্গল যান অসংখ্য ছবি পাঠিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। সেই প্রাথমিক তথ্যভাণ্ডারই আজও মঙ্গল সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের প্রধান সেতু। এই দুটি মঙ্গল অভিযানই গ্রহটির উপরিভাগের প্রায় ৯৭ ভাগ জরিপ করতে সক্ষম হয়েছিল।

এবার এই গ্রহ সম্বন্ধে কিছু প্রাথমিক তথ্য জানা যাক:

মঙ্গল গ্রহ বা ইংরাজিতে প্ল্যানেট মার্স হল সূর্য থেকে চতুর্থ গ্রহ, আমাদের পৃথিবীর পরেই আর সৌরমণ্ডলের ছোট গ্রহদের মধ্যে দ্বিতীয়-মার্কারি বা বুধের পরেই।পৃথিবী থেকে খালি চোখে স্পষ্টভাবে আর সহজেই যাদের দেখা বা চেনা যায় তারা হল সূর্য,চাঁদ,শুক্র(শুকতারা) ও মঙ্গল।এইবার আমাদের এই সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন গ্রহের অবস্থানগুলি একবার মনে করিয়ে দিলে বোধ হয় বুঝতে সুবিধে হতে পারে: সূর্যের কাছ থেকে শুরু করে প্রথম গ্রহ মার্কারি(বুধ), ভেনাস(শুক্র), পৃথিবী, মঙ্গল(Mars),বৃহস্পতি(Jupitor), শনি(Saturn), ইউরেনাস(Urenus), নেপচুন(Neptune), প্লুটো(Pluto)। অবশ্য, সম্প্রতি(২০০৬সাল)পূর্ণ গ্রহের নতুন গুণ বা ধর্ম অনুসারে প্লুটোকে পূর্ণ গ্রহের দল থেকে বের করে একটি অন্য দলে ফেলা হয়েছে-তাকে বলা হচ্ছে ‘বামন গ্রহ’ বা ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট। এই গ্রহগুলি কিন্তু এক সরল রেখায় নেই আর না আছে একই সমতলে(Plane)।

এই মুহূর্তে কমসে-কম পাঁচটি দেশের অভিযান-ঝাণ্ডা উড়ছে,মঙ্গলের কক্ষপথে,ওর আকাশে এমন কি ওর ‘মাটিতে’ও। আমেরিকা,রুশ,ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন,ভারত,ইউ এ ই ,চীন-দেশের ঝাণ্ডা উড়িয়ে প্রায় ‘যান-জট’ বা ট্রাফিক-জাম লাগিয়ে দিয়েছে।কেবল ২০২১ এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মে’র মাঝামাঝি পর্যন্তই তিন-তিনটি অভিযান মঙ্গলে পৌঁছে গেছে।

-২-
প্রত্যেক গ্রহ আপন আপন কক্ষপথে ভিন্ন ভিন্ন সমতলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং কক্ষপথের দৈর্ঘ্য অনুসারে প্রদক্ষিণের সময় হয় ভিন্ন ভিন্ন। মঙ্গলকে “রেড প্ল্যানেট”বা “লালচে গ্রহ”ও বলা হয় কারণ এই গ্রহের উপরিভাগে প্রচুর পরিমাণে লোহা আছে যা যুগ যুগ ধরে অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আয়রন অক্সাইড(iron oxide) হয়ে গেছে। এই আয়রন অক্সাইড বা জংধরা লোহার আস্তরণের জন্যই একে লালচে দেখায়। সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব ২৩ কোটি কিলোমিটার,সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণের জন্য মঙ্গলের সময় লাগে পার্থিব ৬৮৭ দিন।কিন্তু মঙ্গলের দিন আমাদের দিনের(২৪ঘন্টা)তুলনায় মাত্র ৩৭মিনিট ২৩ সেকেন্ড বেশী। মঙ্গল আকারে(ব্যাস ৬৭৯০ কিলোমিটার) আমাদের পৃথিবীর (ব্যাস: ১২,৭৫০কিলোমিটার)প্রায় অর্ধেক। আকারে আমাদের পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক হলেও দুই গ্রহের স্থলভাগ প্রায় সমান কারণ মঙ্গলে ত আর প্রশান্ত মহাসাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরের মত বিশাল জল-ভাগ নেই।এর দিন-রাত্রি আর ঋতু পরিবর্তন আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে তুলনীয়। মঙ্গলের ঋতু পরিবর্তনের ব্যাপারটা আমাদের পৃথিবী থেকে দেখা যায় কি? হ্যাঁ।কি ভাবে? ওর মেরুতে বরফ রাশির নিয়ত বাড়া-কমা দেখে। এইভাবেই এই গ্রহের সঙ্গে আমাদের গ্রহের বেশ কিছু মিল দেখা যায়। এই গ্রহের তাপমান ? মঙ্গলের নিরক্ষীয় বা ইকোয়েটার অঞ্চলে আরামপ্রদ ৮০ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু মেরুতে প্রচণ্ড শীত: -১৯৯ডিগ্রি ফারেনহাইট বা মাইনাস -১২৩ সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল খুব হালকা-আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়ার ১০০ ভাগের এক ভাগ মাত্র। কিন্তু কার্বন-ডাই অক্সাইড আছে প্রচুর পরিমাণে-শতকরা ৯৬ ভাগ,আর আছে আমাদের গ্রহের ন্যায় নাইট্রোজেন এবং আর্গন গ্যাস।অক্সিজেন নেই বললেই চলে,শতকরা মাত্র ০.১৩ ভাগ। কিন্তু, বৈজ্ঞানিকরা বলেন,আদিম যুগে ওই গ্রহে তরল জলের বন্যা হওয়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে।তার মানে হয়ত একদিন ওখানে প্রচুর তরল জলের(নদী/সমুদ্র) অবস্থান ছিল। আবহাওয়া এত হালকা কিন্তু দিন-রাতে হাওয়া চলে প্রচণ্ড গতিতে।তাই সময়ে সময়ে এমন ধুলোর ঝড় উঠতে পারে যা সম্পূর্ণ গ্রহটিকেই কিছুদিনের জন্য ঢেকে দিতে পারে। আমাদের পৃথিবীর অর্ধেক হলেও মঙ্গল কিন্তু আমাদের হারিয়ে দিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাপারে: এক-উপগ্রহ বা চাঁদ ।পৃথিবীর অর্ধেক কিন্তু এর দুটি চাঁদ আছে: ফোবস(Phobos) আর ডেইমস্‌ (Deimos)। দুই: মঙ্গলে আছে সৌর মণ্ডলের সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি- অলিম্পাস মন্‌স (Olympus Mons)যা অনেকগুলি বড় বড় পর্বতের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। বৈজ্ঞানিক মহলের হিসাব মতে এরকম আরও অনেক আগ্নেয়গিরি আছে এই অঞ্চলে। মঙ্গলের নিরক্ষীয়(Equator)অঞ্চলে অবস্থিত এই পর্বতমালা আমাদের হিমালয়ের সর্বোচ্চ চুড়া এভারেস্টের তিনগুণ(৬৯,৮৩৯ ফুট)উঁচু; এভারেস্ট কত উঁচু মনে আছে ত মোটে ২৯,০০২ ফুট। এরকম উঁচু আরও অনেক পর্বত রয়েছে মঙ্গলের নিরক্ষীয় অঞ্চলে।

এতই অসুন্দর,অস্বাচ্ছন্দ্য,অ-সুহৃৎ মৃত্যুপুরী তবুও বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিকদের মঙ্গলের উপর এত ঔৎসুক্য কিসের?

কারণ,সর্বসম্মতিক্রমে সমগ্র বৈজ্ঞানিক মহলের দৃঢ় বিশ্বাস যে:

“যদি কোন দিন বিশেষ কোন কারণে আমাদের এই পৃথিবী ছেড়ে অন্যত্র যেতে হয় তাহলে সেটি সম্ভব হবে কেবল মঙ্গল গ্রহেই”-

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.