প্রবন্ধ

প্রবন্ধ শতবর্ষের আলোয় মৃণাল সেন

শতবর্ষের আলোয় মৃণাল সেন

লেখক : অরুণা সরকার

মৃণাল মানেই এক তরুণের প্রতিবাদী মুখ, টিঁকে থাকার লড়াই -- বিনোদনের জন‍্য, বক্স অফিসে সাফল‍্যের জন‍্য, রাষ্ট্রক্ষমতাকে তুষ্ট করার জন‍্য যিনি চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেন না। গল্প বলার প্রথাগত ধারাকে ভাঙতে ভাঙতে, 'নব-তরঙ্গে'র সূচনায় এবং নতুন নতুন আঙ্গিক - রূপকল্প-কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্পে তিনি এক স্বতন্ত্র ভাষা সৃষ্টি করেছেন। কলকাতা-ত্রয়ী-- সত‍্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হলেও, আপন অনুভব ও মনস্বিতায় মৃণাল অনন‍্য। এক ব‍্যতিক্রমী স্রষ্টা।সত‍্যজিৎ নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন,
"They( Ritwik and Mrinal) were making films very different from mine, very different, but very powerful, I think".

আট বছর বয়সে চ‍্যাপলিনের 'দ‍্য কিড' দেখা থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি মৃণালের আগ্রহ জন্মায়। ছাত্রাবস্থায় এবং তারপরেও মৃণাল বিভিন্ন দেশীয়, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র দেখা এবং চলচ্চিত্র-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ক বইপত্রের পাঠ নিয়েছেন।

কল্পিত বা আরোপিত নয়; গণনাট্যের সঙ্গে জড়িত মৃণাল সেন, গ্রামীণ প্রেক্ষাপটকে প্রত্যক্ষ দর্শন এবং অভিজ্ঞতার উপাদান দিয়েই বুনতে চেয়েছেন জীবন্ত এক নকশি- কাঁথা 'রাতভোর' (১৯৫৫) -- মৃণালের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ। এই চলচ্চিত্র দর্শকের মনে বিশেষ স্থান পায়নি।

সমকালীনতায় বিশ্বাসী মৃণাল তাঁর চলচ্চিত্রে শুধুমাত্র সমসময়ের ভারতবর্ষ নয়, সমসময়ের বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহেরও সংযুক্তিকরণ করেছেন। ১৯৫৪ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি এবং ১৯৫৮ সালে চীন দ্বারা তিব্বত অধিগ্রহণ -- এই গোটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মৃণাল সেনের দ্বিতীয় ছবি 'নীল আকাশের নীচে'(১৯৫৯) -- এই চলচ্চিত্র ভাবনার রসদ জোগায়।

চীনা ফেরিওয়ালা ওয়াংলু (কালী বন্দোপাধ‍্যায়) রোজগারের ভাবনায় এদেশে আসে। ক্রমে, পরবাসী ওয়াংলুর মনে এদেশের প্রতি নৈকট্যবোধ গাঢ় হয়।

ব্রিটিশ - বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সে অংশ নেয়। দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের একাত্মতা, আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ববোধ ছবিটিকে স্থানীয় পরিচিতি থেকে বিশ্বজনীনতায় উত্তীর্ণ করে।

আবেগের অতিরেক নয়; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গায়ে গায়ে ঘটে যাওয়া ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বঙ্গদেশে যে মর্মান্তিক ও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, সমকালের বিশ্ব-ইতিহাসের সেই চেতনা নিয়ে এবং তার সঙ্গে সমাজ - বাস্তবতার উপকরণ সম্পৃক্ত করে মৃণাল সেন নির্মাণ করলেন 'বাইশে শ্রাবণ'(১৯৬০) চলচ্চিত্র। দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের কুৎসিততম রূপের তিক্ততায়

একটি নিম্ন- মধ‍্যবিত্ত পরিবারের দম্পতির মধ‍্যে অন্তঃশীল সম্পর্কের বিশ্বাস - ভালোবাসা - নির্ভরতার গ্রন্থিগুলি চিরে চিরে উন্মোচন করেন পরিচালক। দাম্পত‍্য-জীবন ব‍্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মন্বন্তরের ফলে ক্ষুধার তাড়না, জীবন - মৃত‍্যুর টানাপোড়েন, হতাশাপূর্ণ সমাজের জ্বালা-যন্ত্রণা, মূল‍্যবোধের ক্ষয় -- একটি সর্বাঙ্গসুন্দর সার্থক সমাজ গঠনের প্রধান অন্তরায়।ঐতিহাসিক পটভূমিকায় নারীমুক্তির মতো আধুনিক জ্বলন্ত সমস্যার প্রসঙ্গ উঠে আসে এখানে। মনন-ভাবনায় সমকালীন মৃণালের এই চলচ্চিত্রে অনেকেই দেশীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে আধুনিকতাকে প্রত্যক্ষ করেন।

মধ‍্যবিত্তের ঘটমান জীবনচর্যার নানান কাহিনী, তাদের মূল‍্যবোধ, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের আলেখ‍্য রূপাঙ্কনের প্রয়াস মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে স্পষ্ট। মধ‍্যবিত্ত নারী পুরুষের প্রেমকথা, দাম্পত‍্য জীবন, বিবাহ বিচ্ছেদ, পুরুষ - নিয়ন্ত্রিত সমাজে নারীর বিড়ম্বনা ইত্যাদি নিয়েই মৃণাল সেন নির্মাণ করেন 'পুনশ্চ'(১৯৬১), 'অবশেষে'(১৯৬৩) এবং 'প্রতিনিধি'(১৯৬৪)।

দ্বন্দ্বে, দ্বিধায়, মূল‍্যবোধের দোলাচলে আকীর্ণ তৎকালীন মধ‍্যবিত্তের প্রতি পরিচালকের অনুরাগ নিজস্ব ভাবনায় জারিত হ'য়ে এক প্রত‍্যক্ষ সত‍্যের গতি পেয়েছে 'আকাশ কুসুম' (১৯৬৫) চলচ্চিত্রে। বিভিন্ন রকম কলাকৌশল ক'রে প্রেম করা সত্ত্বেও ধনী কন‍্যা অধরাই থেকে গেল নায়কের কাছে।। শৈলীগত পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণে চলচ্চিত্র শিল্পে এটি একটি অন্য মাত্রা স্পর্শ করেছে।

নাগরিক ভুবন সোম (উৎপল দত্ত) টেবিলের দলিল - দস্তাবেজে মুখ গুঁজে থাকা একজন বিপত্নীক, নীতিপরায়ণ দোর্দন্ডপ্রতাপ আমলা। গুজরাটে শিকারে গিয়ে সে গ্রাম‍্যললনা গৌরীর দেখা পায়। গোটা দিন সহজ, উচ্ছল, চঞ্চল গৌরীতে সে বিমোহিত। ভুবন সোমের নৈতিকতার স্খলন ঘটে। গৌরীর চকিত স্পর্শ কি তার ভাবনার প্রাঙ্গণে,' দৈন‍্যের সঞ্চয়?' বিশ্বকবির ভাষায়, "মম ভীরু বাসনার অঞ্জলিতে/ যতটুকু পাই রয় উচ্ছলিতে।" এই আমলাই যখন কর্মস্থলে ফিরে আসে, সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত এক অন‍্য মানুষ; সে কি তাঁর ব্যক্তি-হৃদয়ের পরিবর্তন? নাকি ব‍্যক্তি-আমলার অহম-বোধের পরাভব? নাকি গোটা আমলাতন্ত্রের পরাভব? মৃণালের যুগান্তকারী সৃষ্টি 'ভুবন সোম'(১৯৬৯)-এর মাধ্যমে ভারতের চলচ্চিত্রে 'নবতরঙ্গ'-এর প্রারম্ভ হয়। গতানুগতিকতার বাইরে এসে,নতুন আঙ্গিকে এবং রূপকল্পে মৃণাল ভারতীয় চলচ্চিত্রে স্বতন্ত্র এবং আধুনিক ধারার সৃষ্টি করলেন।

সত্তর দশকের উত্তাল দিনগুলোতে বজ্রগর্ভ বিপ্লবের নেশায় তরুণদের উন্মাদনা, প্রতিবাদে ভাঙচুর, আন্দোলন, একদিকে ঔপনিবেশিকতাবাদের সর্বগ্রাসী মনোভাব, অপর দিকে দ্বিধাদ্বন্দ্বময় মধ‍্যবিত্তের মূল‍্যবোধের দোলাচল, দারিদ্র‍্য, বেকারত্ব, ছিন্নমূলের যন্ত্রণা, রাজনীতিতে অমানবিকতা, কলকাতা শহরের তৎকালীন ঘটমান বর্তমানের তীব্র সঙ্কটময় মুহূর্তগুলিকে মৃণাল সেন ধরবার চেষ্টা করেছেন তাঁর 'কলকাতা - ত্রয়ী'তে। মৃণাল সেন পারিবারিক সূত্রে স্বাদেশিকতার আবহে বড় হয়েছেন।

স‍্যুটের অভাবে চাকরীপ্রার্থী বেকার যুবকের যখন চাকরীটা হ'ল না, রাগে ক্ষোভে সে ম‍্যানিকুইনের জামাকাপড় টেনে হিঁচড়ে ম‍্যানিকুইন ভেঙে ফেলেন। তার ভেতর থেকে উদগত হয় বহুমুখী জিজ্ঞাসা। 'কলকাতা-ত্রয়ী'-র প্রথম চলচ্চিত্র 'ইন্টারভিউ'(১৯৭০)-তে এই প্রতীকী প্রতিবাদ গোটা সমাজের বিবসন চিত্রপটকে আমাদের সামনে টান টান ভাবে তুলে ধরে। সমকালীন সময়ে সাম্রাজ‍্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে-- এ তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এখানে প্রথাগত ধারার ন‍্যারেটিভ ফর্ম ভেঙে প্রতীকে - রূপকল্পে - আবেগে মৃণাল নির্মাণ করলেন স্বতন্ত্র এক শৈলী।

সত্তরের দশকে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস‍্যা তীব্র মাত্রা ধারণ করে। চতুর্দিকে জনরোষ। মানুষে মানুষে হানাহানি। নকশাল বাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উত্তাল দিনরাত্রির এক তাৎপর্য- মন্ডিত ক্ষতবিক্ষত সময়কে ফুটিয়ে তুলেছেন মৃণাল সেন তাঁর 'কলকাতা-ত্রয়ী'-র দ্বিতীয় চলচ্চিত্র 'কলকাতা-৭১' (১৯৭২)-এ। এর অন‍্যতম নায়ক কুড়ি বছরের এক গুলিবিদ্ধ যুবক চারটি ছবির মধ‍্যেই যোগসূত্রের মতো আবর্তিত। তারই মধ‍্যে উঁকি দিয়েছে অন্তর্লীন এবং অমোঘ এক রাজনৈতিক বার্তা -- বিপন্ন সেই সময়ে দারিদ্র্য , শোষণ, পেষণ থেকে মুক্তির পথ 'লড়াই'। চারটি পৃথক গল্পকে একই বুনটে মৃণাল নির্মাণ করলেন এই চলচ্চিত্র। পরীক্ষা নিরীক্ষার নানা ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে তিনি তাঁর চলচ্চিত্রকে রক্তাক্ত করেছেন,উজ্জ্বল করেছেন।

'কলকাতা - ত্রয়ী'র শেষ চলচ্চিত্র 'পদাতিক' (১৯৭৩)। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ-ভ‍্যান থেকে পালিয়ে এক যুবক এক অভিজাত মহিলার বাড়িতে আশ্রয় পায়। যুবকটি নিজস্ব জীবনবোধ দিয়ে এই ভাবনায় স্থিত হয় যে সুস্থ সমাজ গঠনে, বিচ্ছিন্নতা নয়, জনসমাবেশের রাজনীতির প্রয়োজন।

অল্প সংখ‍্যক শূণ‍্যপদের জন‍্য বিশাল জনতার লড়াই শ্রেণি শক্তির দ‍্যোতক। সাম্প্রতিকতার এই রণদামামা বিভিন্ন আধুনিক প্রতীকী রূপের মধ‍্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে। 'কোরাস' (১৯৭৪) চলচ্চিত্রে মৃণাল সেন সমকাল ও মধ‍্যবিত্তের লড়াই এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে গিয়ে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার হদিশ নেবার চেষ্টা করেন। এই চলচ্চিত্রে যে অমোঘ বার্তা মৃণাল পাঠালেন, তা হ'ল-- ইচ্ছা বা আবেগ যদি ব্যক্তিবলয় থেকে সমগ্রতার অভিমুখে ধাবিত হয়, বঞ্চনার অবসান ঘটে।

আদিবাসীরা সরল, বিশ্বস্ত এবং আবেগপ্রবণ মানুষ। আধুনিক নাগরিক সভ‍্যতা কিভাবে তাদের সারল‍্যকে বিপর্যস্ত করে, তারই প্রতিফলন দেখা যায় মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র 'মৃগয়া' (১৯৭৬) - তে। ব্রিটিশ ও মহাজনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের সততা ও সংহতি যে ভেঙে যায়নি, 'মৃগয়া' -ই তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।

তেলেগু ভাষায় নির্মিত 'ওকা উরি কথা' (১৯৭৭)- য় দরিদ্র পিতা অর্থ-কীর্তি-স্বচ্ছলতাকে তুচ্ছ অনুভব করেন। তাঁর বিশ্বাস শ্রম দ্বারা অর্জিত অর্থ চলে যায় মালিকের মালিকানায়। এই চলচ্চিত্র দেখে সত‍্যজিৎ রায় মুগ্ধ হন।

একটি মধ‍্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী একটি মেয়ের রাতে অফিস থেকে সময়মত বাড়ী ফিরতে না পারা নিয়ে মৃণাল নির্মাণ করলেন 'একদিন প্রতিদিন' (১৯৮০) চলচ্চিত্র। একদিকে পরিবারের আশঙ্কা, উৎকন্ঠা; অপরদিকে প্রতিবেশী নামক সমাজ থেকে উঠে আসা বিভিন্ন প্রশ্ন, যে প্রশ্নের তীব্র খোঁচায় শুধু পরিবার অথবা মেয়েটি নয়, সমাজ-দেহও কালে কালে বিদ্ধ হয়। এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি নিকটজনের ভেতরের মানুষটিকে বাইরে টেনে এনে চিরে চিরে দেখিয়েছেন মৃণাল। ক্ষয়িষ্ণু মধ‍্যবিত্ত সমাজের স্বার্থান্বেষী, সংকীর্ণ-চেতা এবং সার্বিকভাবে বিপর্যস্ত মূল‍্যবোধকে চিত্রিত করেন তিনি। নারী-পুরুষের বৈষম‍্য এবং নারী-স্বাধীনতাকে খর্ব করবার প্রয়াস সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

সমাজ-বাস্তবতার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষক মৃণাল সেন ফ্লাশব‍্যাক পদ্ধতিতে না গিয়ে, নতুনতর আঙ্গিকের ব‍্যবহার করে, কলাকুশলীদের সঙ্গে গ্রামে এসে শুটিং ক'রে, চলচ্চিত্রের ভেতর চলচ্চিত্র সৃষ্টি ক'রে, ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক কাহিনী চিত্রিত করতে প্রয়াসী হলেন 'আকালের সন্ধানে' (১৯৮০) চলচ্চিত্রে, যেখানে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের কথা একই সঙ্গে এসে মিশেছে ১৯৮০ -র চরম দারিদ্র্যের মোহনায়। ১৯৮০-তে এসেও চতুর্দিকে ভাতের অভাব নির্দেশ করে আকাল; আকাল তাদের "সব্বাঙ্গে"।

গ্রামে এসে শুটিংয়ের সময়েও সকলে এই সত‍্যের সম্মুখীন হলেন, গ্রাম ও শহরের জীবনযাত্রার মধ্যে রয়েছে দুর্ভেদ‍্য এবং দুর্বোধ‍্য ব‍্যবধান। গ্রামের দায় - দৈন‍্য, ক্লেশ-নৈরাশ‍্য, লজ্জা-লাণ্ছনা, দীনতা-স্বার্থপরতা, সরলতা-জটিলতা নিয়ে তারা এক আলাদা পৃথিবী। আলাদা পৃথিবীতে মানাতে না পেরে তারা আবার শহরের স্টুডিওতে ফিরে গেলেন।

অপঘাতে মরা ছেলে, পালানের বাবা যখন নিঃশব্দে, বিনা প্রতিবাদে বাবুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, মধ‍্যবিত্ত বাবুদের বিবেকহীনতা এবং স্বার্থপরতার মুখোশ তখন আপনা থেকেই খুলে গেল 'খারিজ' (১৯৮৩) চলচ্চিত্রে।

এখনকার ভগ্নপ্রাসাদ একসময়ের ঐশ্বর্যের প্রতীক। মানবিক আবেদনে ভরপুর 'খন্ডহর' (১৯৮৪) এক নারীর করুণ জীবন কাহিনী। শিল্প সৃষ্টিতে ভাষা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয় -- হিন্দি,ফরাসি ও ইংরেজি - তিনটি ভাষায় তৈরী হয় 'জেনেসিস' (১৯৮৫)।

জনৈক প্রৌঢ় অধ‍্যাপক, কোন কারণ ছাড়াই একদিন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হন 'একদিন অচানক' (১৯৮৯) চলচ্চিত্রে। মধ‍্যবিত্তের অস্তিত্বের সংকটের মূল যে কতটা গভীরভাবে প্রোথিত, সেটাই এখানে দেখালেন মৃণাল।

সোভিয়েট ইউনিয়ন যখন ভেঙে পড়ল, বার্লিন দেওয়াল যখন খসে পড়ল, একটি মধ‍্যবিত্ত বাড়িতে যেন শোষণহীন স্বপ্ন একটি বড় 'জিজ্ঞাসা' হয়ে দাঁড়াল -- 'মহাপৃথিবী' (১৯৯১) একটি মহাকালের রূপ। সাদাত হাসান মান্টোর গল্প অবলম্বনে ১৯৯৩-তে মৃণাল নির্মাণ করেন 'অন্তরীণ'। ২০০২-তে মৃণালের শেষ ছবি 'আমার ভুবন'। এই ছবিটি-ও কায়রো ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা চলচ্চিত্রকারের পুরস্কার পায়।

মৃণাল সেন তাঁর জীবৎকালেই হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। মস্কো, বার্লিন, কান্,ভেনিস, কারলভি ভ‍্যারি, মন্ট্রিয়াল, শিকাগো, কায়রো - জগতের প্রত‍্যেকটি ফিল্ম উৎসবে তিনি পদক অর্জন করেন। ভুবন সোম, কোরাস, মৃগয়া, আকালের সন্ধানে সহ ১৬ টি ছবির জন‍্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পান।এছাড়াও সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রী, ভারত সরকারের পদ্মভূষণ এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরষ্কার, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান, রাশিয়ার অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত হন। ভারতীয় সংসদের সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন তিনি।

মৃণাল সেন জীবিত থাকলে এ বছর (২০২৩) তাঁর শতায়ু পূর্ণ হ'ত; শুধুমাত্র সেইজন‍্যই নয়, তাঁর কালোত্তীর্ণ কীর্তি, জীবনবোধে দীপ্ত, স্বতন্ত্র শিল্পধারায় সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র-সৃষ্টি আমাদের কাছে স্মরণ-গাথা হয়ে আছে। তাঁর সৃষ্টির মধ‍্যেই তাঁর অধিষ্ঠান, তাঁর পূর্ণতা। তাঁর সৃষ্টিই আমাদের প্রেরণা। সমকালের দর্পণ হয়েও মৃণালের চলচ্চিত্র একালের এবং আগামীকালেরও।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.