গল্প ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট
ইহারে কয় টক শো৷ যদিও এখানে টক ঝাল নোনতা নানান রেসিপি আছে৷ খবরের রেসিপি৷ খবরের চাটনি৷ আলটাগরা আর জিভে টকাটক শব্দ তুলে আচারের স্বাদ৷ তেমন একটা অনুষ্ঠানে আমার ডাক পড়ল৷ হ্যাঁ, এইসব টিভি শোতে আজকাল আমার ডাক পড়ে৷ কেননা, আমার কিঞ্চিৎমাত্র, যাকে বলে নামডাক, হয়েছে৷ আমি যেসব আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারি তেমনটা নয়৷ আলোচনার বিষয় পছন্দ হলে, সে-বিষয়ে কিছু বলার থাকলে, যাই৷ আমার গলার জোর নেই৷ ঝগড়া করতে পারি না৷ আমি শুধু আমাকে যা প্রশ্ণ করা হয় তার উত্তর দিই৷ তর্ক নয়, কিন্তু নিজের ব্যক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে জানতে পারি৷ আমাকে নিয়ে ডাকাডাকি চলে৷
এমনই একটা টক শোতে আমাকে ডাকা হল৷ বিষয়টা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়৷ ধর্ষকদের কী শাস্তি দেওয়া উচিত৷ মৃত্যুদণ্ড?নাকি, বড়জোর যাবজ্জীবন কারাবাস৷ এই প্রসঙ্গ আগেও উঠেছে৷ কেউ কেউ আছেন, যাঁরা মৃত্যুদণ্ডের কট্টর বিরোধী৷ কী যেন বলেন তাঁরা?ওহো, মৃত্যুদণ্ড মানে রাষ্ট্রের হাতে হত্যা৷ এটা ঠিক নয়৷ হিংসার শাস্তি হিংসা দিয়ে হয় না৷ জেলখানাকে যেন কী একটা বলা হয়? ওহো, সংশোধনাগার৷ সেখানে নাকি অপরাধীদের, যাদের নৃশংসতা মারাত্মক, তাদেরও চরিত্র পবিত্র করে তোলা হয়৷ আমার মনে হয়, এতে অপরাধকে তোল্লা দেওয়া হয়৷ হত্যা করবে, ধর্ষণ করবে, ধর্ষণ করে হত্যা করবে, হত্যা করে ধর্ষণ করবে, তারপর তার জেলের ভাত নিশ্চিত৷ জনগণের করের টাকায় দুবেলা খাওয়া নিয়ে ভাবনা নেই৷ এটা কি? ইয়ার্কি নাকি?
কথাটা উঠেছিল সেই কুখ্যাত দিল্লি গণধর্ষণ কাণ্ডের বিষয়ে৷ যেখানে একটি চলন্ত ফাঁকা বাসে এক তরুণীকে বীভৎসভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়৷ সেই নৃশংসতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, তুলনাও নেই৷ হতভাগ্য তরুণীটিকে বারবার ধর্ষণ করে তার পায়ুপথে লম্বা লোহার রড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ বারবার করে৷ মেয়েটির শরীরের ভিতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়৷ তছনছ হয়ে যায়৷ শেষে তাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়৷ মেয়েটি তখনই আর নেই, শুধু তার ক্ষতবিক্ষত শরীরটা নির্জন রাস্তায় পড়ে আছে৷
দেশজুড়ে এর প্রতিবাদে ঝড় ওঠে৷ কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয়৷ আজকাল একটা কথা খুব উঠেছে---উই ওয়ান্ট জাস্টিস৷ কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী, বিভিন্ন এনজিও, সমাজকর্মী, এমনকি নেহাত ছাপোষা মানুষও বলছে উই ওয়ান্ট জাস্টিস৷ অনেকক্ষেত্রেই এটা বাতেলা কিংবা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রকৃত সংগ্রাম বলতে কী বোঝায় তা এখানে অনেকে জানেই না৷ জাস্টিস কে দেবে ভাই? রাষ্ট্র?সংবিধান?রাষ্ট্র দেশের মানুষের কথা শুনছে না৷ আর সংবিধান? ভাই, সেটা তো সিলেবাসে পড়ে না৷
নির্যাতিত মেয়েটির নাম সবাই জানে৷ এ লেখায় তার নাম দেওয়া যাক মণিকা৷ অপরাধেরও কমবেশি আছে৷ আমরা নানারকম নিষ্ঠুর নির্যাতনের কথা জানি৷ ধর্ষণেরও কম-বেশি আছে৷ কিছু অপরাধ লঘু, ছিঁচকে চোর পকেটমারি এর মধ্যে পড়ে৷ আর কিছু অপরাধ গুরু৷ হত্যা, ধর্ষণ যার মধ্যে পড়ে৷ আর কিছু অপরাধ বিরল থেকে বিরলতম, মণিকার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, সেটা এর বীভৎসতম উদাহরণ৷ ধর্ষণের পর পায়ুপথে লোহার রড ঢুকিয়ে শরীরের মধ্যের যন্ত্রগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া, হত্যা---এ অপরাধ বিরল নয়! যে পিশাচগুলো এই কাণ্ড করেছে, তারা কি চূড়ান্ত শাস্তির যোগ্য নয়?
এই নিয়ে টক শো৷ আমি আছি আর আছেন এক বিখ্যাত বিদগ্দ মানুষ৷ তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী৷ ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের কট্টর বিরোধী৷ সংবাদ চ্যানেলটি এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে৷ দুজনকে লড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা আর কী৷ চ্যাঁচামেচি খ্যাঁচাখ্যাঁচিতে আসর গরম হবে৷ টিআরপি বাড়বে৷ কিন্তু আমি তো ঝগড়া করতে পারি না৷ বরং আমার কথার মধ্যে কথা বললে আমি চুপ করে যাই৷ কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে নড়ি না৷ প্রায় সব জায়গায় আমার যুক্তি জিতে যায়৷ আমার প্রকৃত প্রতিবাদের আবেগ জিতে যায়৷ আজ কী হবে জানি না৷ ভদ্রলোকের চ্যাঁচানোর অভ্যাস আছে৷ তাঁর নাম... ম্ম্ম্... ধরা যাক... সুজিত পাত্র৷
আমার পক্ষে হোক বা বিপক্ষে হোক, আমি ব্যক্তিগত স্তরে সৌজন্যে বিশ্বাস করি৷ সুজিত পাত্রের নাম সবার মতো আমিও জানি৷ টিভিতে দেখেছি৷ দেখা হতে বললাম---নমস্কার, কেমন আছেন?
সুজিত পাত্র বললেন---আপনি?
---আমার নাম মরীচিকা সেন৷ এই একটু লেখালেখি করি৷
---ও আচ্ছা, আপনি মরীচিকা সেন৷ আজ প্রোগ্রামে আপনার সঙ্গেই আমি আছি৷
---না না, আমি আপনার সঙ্গে আছি৷ আপনার উপস্থিতিটাই প্রধান৷ আপনার টক শো দেখি৷ লেখালিখির সঙ্গেও পরিচিত৷ কেবল আপনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতটা এই প্রথম৷ নমস্কার৷
ভদ্রলোক এবারেও প্রতিনমস্কার জানালেন না৷ এইরে, বোঝাই যাচ্ছে গোড়া থেকেই তিনি আমায় পছন্দ করছেন না৷ এই অপছন্দ অনুষ্ঠানে তীব্রতর হতে পারে ভেবে একটু অস্বস্তিতে পড়লাম৷
প্রাথমিক পরিচয়টা যেন কেমন আশঙ্কাজনক৷ আমি ঠিক করলাম, বেশি কথা বলবই না৷ শুধু যুক্তিগুলোতে অনড় থাকব৷ আর, ওঁর প্রতি আমার কিছু প্রশ্ণ আছে৷ সুযোগ পেলে সেগুলো পেশ করার চেষ্টা করব৷
অনেক এই ধরনের প্রোগ্রামে অংশ নিলেও প্রতিবারই শুরুতে বুক গুরগুর করে৷ সঞ্চালক অমিতের সঙ্গেও আমার পরিচয় আছে৷ চুপিচুপি ওকে বললাম---অমিত, খুব কঠিন কঠিন প্রশ্ণ কোরো না যেন৷
অমিত হাসল, বলল---আরে দুর৷ ভয় পাচ্ছ নাকি৷ তোমার টক শো খুব ভালো হয়৷ ভিউয়ার্সদের ভালো লাগে, ভালো ফিডব্যাক পাই৷
আমি বললাম---সে ঠিক আছে৷ কিন্তু ইনি বেশ লড়াকু৷
---আরে সে তো তুমিও তাই৷ আজ প্রোগ্রাম জমে যাবে৷ আয়্যাম কোয়াইট কনফিডেন্ট৷
---ওকে দেন৷
অনুষ্ঠান শুরু হল৷ অমিত প্রথম প্রশ্ণটাই আমাকে করে বসল৷
---মরীচিকা, কেউ কেউ বলেন, যার মধ্যে সুজিতদা তো অবশ্যই আছেন, যে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট মানে রাষ্ট্রের প্রতিহিংসা, এ বিষয়ে তুমি কী বলবে?
আমি নিজেকে গুছিয়ে নিলাম৷ প্রথম প্রশ্ণটাই আমাকে করার অর্থ হল সুজিত পাত্রকে আমার বিরোধিতা করে বক্তব্য পেশের সুযোগ করে দেওয়া৷ এসব আজকাল আমি বুঝি৷
তিন সেকেন্ড পরে আমি বললাম, ---প্রথমেই বলি, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড অত্যন্ত বিরল ঘটনা৷ যাকে বলে বিরল থেকে বিরলতর অপরাধে এটি প্রয়োগ করা হয়৷ যে অপরাধ মারাত্মক সহিংস, সেটা যে করেছে তাকে বাঁচিয়ে রাখলে সে আবার আরেকটা একইরকম অপরাধে লিপ্ত হতে পারে৷ তার মধ্যে সেই অপরাধপ্রবণতা বিদ্যমান৷ তাছাড়া, এইরকম ঘৃণ্য ও নৃশংস অপরাধীকে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে সমাজে তার একটা প্রভাব পড়ে, সমাজবিরোধীরা অপরাধ করার আগে দুবার পরিণতির কথা ভাবে, সে অপরাধ থেকে বিরত হয়৷ সমাজ বাঁচে, মানুষ বাঁচে৷ সমাজে মানুষের বেঁচে থাকার পক্ষে যে এতটাই বিপজ্জনক, তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই বলেই আমি মনে করি৷
অমিত সুজিত পাত্রের দিকে ফিরে কিছু বলার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন৷ প্রথম থেকেই তাঁর স্বরে একটা রণংদেহি ভাব, ---ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দিয়ে সমাজে কি অপরাধ কমেছে?
আমি ও অমিত কিছু বলার আগেই ঠান্ডা মাথায় বললাম---একটি মানুষ, যেভাবেই হোক, ধরা যাক পথ-দুর্ঘটনায় মারা গেলে তার মানে কি আর পর্থ-দুর্ঘটনা ঘটবে না?
---বাজে কথা৷ আপনি আমার কথার উত্তর এড়িয়ে গেলেন৷ আমরা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নিয়ে কথা বলতে এসেছি৷
---ঠিক বলেছেন৷ আমরা এখানে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নিয়েই কথা বলতে এসেছি৷ ভুল বলেছেন, আমি আপনার কথার উত্তর এড়িয়ে যাইনি৷ জাস্ট একটা উদাহরণ দিলাম৷ ফর্মুলার চেয়ে এগজ্যাম্পেল বোঝার পক্ষে সহজ৷ রবি ঠাকুর কী বলেছেন জানেন নিশ্চয়ই৷ অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে৷ আমিও অন্যায়ের, অপরাধের, উপযুক্ত শাস্তি চাই৷
---না, সব মানুষের বাঁচার অধিকার আছে৷ রাষ্ট্র সেটা কেড়ে নিতে পারে না৷
---এগজ্যাক্টলি৷ যারা সেই অধিকারকে হরণ করে, তার যোগ্য শাস্তি হওয়া দরকার৷
---কিন্তু সেটা কিছুতেই ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নয়৷
তর্ক জমে উঠছিল৷ প্রথমেই সুজিতবাবু কলহের সুযোগ খুঁজছেন৷ অমিত হস্তক্ষেপ করল৷
---দর্শকরা নিশ্চয়ই আমাদের অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন৷ রিমোটে হাত দেবেন না৷ ফিরে আসছি ছোট্ট একটা ব্রেকের পর৷
ব্রেক হল৷ সঙ্গে সঙ্গে সুজিত পাত্র আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ---ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হিংসাকে লিগালাইজ করে৷
---না, এতে রাষ্ট্র সমাজে নাগরিকদের জীবন সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব পালন করে৷
---আপনি ভুলভাল কথা বলছেন৷
আমি শান্তস্বরে বললাম---আমার ভুলভাল কথাগুলো না হয় আমি দর্শকদের সামনেই বলব৷
আমি অমিতের দিকে তাকালাম---আর অমিত, এই অনুষ্ঠানটা তো কোনো নাচাগানার প্রোগ্রাম নয় যে দর্শকরা এটা উপভোগ করবে৷ আমরা, বলতে গেলে, একটা জরুরি কিন্তু অপ্রিয় বিষয় নিয়ে কথা বলছি৷ তাই নয় কি?
অমিত মাথা নাড়ল, বলল---না, তুমি পাবলিক সাইকোলজি বোঝো না, আর আমাদের সেটাই প্রথমে বুঝতে হয়৷ এইসব প্রোগ্রাম মানুষ চা, কফি, পটেটো চিপ্স নিয়ে বসে বসে দেখে আর এনজয় করে৷
আমি মাথা ঝাঁকালাম৷ এই উন্মার্গগামী সমাজ হিংসা ভালোবাসে৷ নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধ ও শুভ রাষ্ট্রের কর্তব্য শক্ত হাতে তা নিয়ন্ত্রণ করা৷
ব্রেকের পরে ফিরে এলাম৷ আমি কি বড্ড বেশি প্রগল্ভ হয়ে যাচ্ছি৷ কিন্তু আমি নিজের মধ্যে একটা আবেগ বোধ করছি৷ তার নাম ক্রোধ৷ তার নাম জেদ৷ আমার মতামতকে আমি সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত করব৷ করবই৷
যে দুর্বিষহ ঘটনাকে ভিত্তি করে বা যে পরিপ্রেক্ষিতে এই টক শো, সেটা সেই মণিকা কাণ্ড৷ যাকে বাসের ড্রাইভার, হেল্পার, কন্ডাক্টর-সহ ছজন মিলে গণধর্ষণ করে হত্যা করেছিল৷ আর যে পায়ুপথে লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়ে সব ছিঁড়েখুঁড়ে থেঁতলে দিয়েছিল, তার বয়েস মাত্র পনেরো৷ এসবই তদন্তে প্রকাশ৷ ছেলেটি নাবালক, কাজেই তার ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের কথাই নেই৷ সে তিন বছরের জন্য একটা হোমে থাকবে৷ তারপর তার সারাটা জীবন আরও অপরাধের জন্য সে মুক্ত৷ যে পিশাচকিশোর সেই এত নিষ্ঠুর এত নির্দয় হতে পারে, তার সারাজীবন মুক্ত থাকার দায়িত্ব কে নেবে? সে নিজেই নাকি?সংশোধনাগারে তার চিত্তশুদ্ধি ঘটবে? আরও কী অদ্ভুত, ভারাভারা রাও থাকেন ‘জেল’-এ, আর এই অপরাধীরা থাকবে ‘সংশোধনাগার’-এ৷
জনতার দাবি এবং দেশের সংবিধান অনুযায়ী বাকিদের প্রাপ্য শাস্তি ফাঁসি৷ অপরাধীদের একজন জেলেই মারা গেছে৷ বাকিদের যাবজ্জীবন হওয়ার দাবি হল এই সুজিত পাত্রের মতো কিছু ‘মানবাধিকারকর্মী’-র৷ যাবজ্জীবন মানে তো কয়েকবছর মাত্র৷ তারপর সে মুক্ত হয়ে সমাজে ঘোরাঘুরি করবে, এতে কি সমাজ বিপন্ন হবে না? এই বিপজ্জনক জঞ্জালগুলোকে একেবারে সাফ করে দেওয়াই উচিত৷ যা বলছিলাম, আজকাল জেলখানাকে একটা গালভরা নামে ডাকা হয়৷ ‘সংশোধনাগার’৷ এখানে নিরপরাধ নাগরিকের করের পয়সায় দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষা হয়৷ এটা সমর্থনযোগ্য হতে পারে? ছি! আমাদের দেশে জনসংখ্যা প্রায় গণনার অতীত, অপরাধ ভুরি ভুরি৷ এই দেশকে নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রণে রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে৷ পণ্ডিতদের শোরগোলে কান না দিয়ে যেখানে যে শাস্তি হওয়া উচিত সেটা দিতেই হবে৷ মানবাধিকারকর্মীরাই গলা ফুলিয়ে বলেন না, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তাদের এ সমাজে বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই!
তুমুল তর্কের দিকে এগোচ্ছিল টক শো৷ একসময় দাঁড়ি টানতেই হল৷ অমিত নিজেই সঞ্চালক হওয়া সত্ত্বেও আলোচনাটা তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল৷ আমিও বোধহয় অন্যান্য বারের তুলনায় বেশি কথা বলেছি৷ গলা শুকিয়ে গেছে৷ সামনে কফির মাগে আর্ধেক কফি৷ আমি বিরক্ত গলায় অমিতকে বললাম---অমিত, কফিটাও পুরোটা দিতে পারো না? জুড়িয়ে গেছে৷
অমিত দেখলাম খুশিতে ডগোমগো৷ বলল---আজকে তো প্রোগ্রাম পুরো গরমাগরম৷ থ্যাঙ্কিউ মরীচিকাদি, থ্যাঙ্কিউ সুজিতদা৷ তারপর একটি ছেলেকে ডেকে বলল, ---এই, সুজিতদা আর মরীচিকাদির জন্য কফি আন৷ গরম হয় যেন৷ আর পুরোটা ভরে দিস৷ কী, আপনারও চলবে তো, সুজিতদা?
সুজিত পাত্রের মেজাজ দেখলাম বেশ খারাপ৷ একঝটকায় ঝোলাব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললেন---না, আর বসতে পারব না৷ অন্য আরেকটা চ্যানেলে শো আছে৷
আমি বললাম---সুজিতদা, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল৷ ভেবেছিলাম প্রোগ্রামের পর একটু কথা বলব৷ সেটা হল না৷ তাও একটা প্রশ্ণ করতে চাই৷
সুজিত পাত্র বিরক্ত স্বরে বললেন---কী প্রশ্ণ!
---সুজিতদা, আপনার মেয়ে আছে?
সুজিত পাত্র একটু থেমে বললেন---হ্যাঁ৷
---কত বয়েস?
---কেন হঠাৎ?
---না, তাই বলছিলাম আর কী, ঈশ্বর ওকে ভালো রাখুন, কিন্তু ওর সঙ্গে যদি এই নৃশংস ঘটনা ঘটে, আপনি কি অপরাধীর চূড়ান্ত শাস্তি চাইবেন না?ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট?
সুজিত পাত্র প্রায় পাঁচ-সাত সেকেন্ড সময় নিলেন৷ বললেন---না৷
আমার মনে হল বলতে গিয়ে তাঁর গলাটা একটু কেঁপে গেল কি! নাহ্, আমি বোধহয় ভুল শুনেছি৷
আমি আবার বললাম---ক্ষমা করবেন সুজিতদা, আপনি আসলে এই অবধি ভাবতে পারেন যে আপনার মেয়ে কখনো এই মারাত্মক পরিস্থিতিতে পড়বে না৷ তাই তার পরের কথা আপনি ভাবতেও পারছেন না৷ যাই হোক, ওকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন৷ ভালো থাকবেন৷ আবার দেখা হবে৷
আমার মাথার মধ্যে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল৷ কফি এসে গেল৷ অমিত কফির মাগে চুমুক দিয়ে বলল---সত্যি বলছি, বহুদিন পরে এমন একটা প্রোগ্রাম পেলাম যেখানে আমাকে কিছুই করতে হল না৷ ফাটাফাটি৷ আমিও পার্সোনালি স্পিকিং, ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের দরকার আছে বলেই বিশ্বাস করি৷ আই সাপোর্ট ইউ৷
আমি বললাম---বিশেষত আমাদের মতো অনুন্নত বা যাকে বলে ‘উন্নয়নশীল’ দেশে৷ যেখানে সমাজে বৈষম্য বেশি৷ শ্রেণিবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য৷ যেখানে শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতার অভাব৷
---ঠিক৷
---ঠিক? গোলি মারো ঠিকে৷ যে রাষ্ট্র বৈষম্য মেটাতে পারে না, শিক্ষাকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিতে পারে না, সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে পারে না, সে কে হে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার? ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই? বালের রাষ্ট্র৷
---সে কী! এক্ষুনি তো হেব্বি বলে এলে৷ আর খিস্তিটা অন্য ক্যামেরা দিতে পারতে৷ লোকে মজা পেত৷ দেশের লোক অশিক্ষিত হতে পারে, খিস্তি সবাই বোঝে৷
আমি কফি শেষ না করেই বললাম---ঠিক আছে অমিত৷ আমি উঠি৷ ভালো থেকো৷ সি ইউ৷
---সে কী, অর্ধেক খেলে যে! গরম আছে এখনও৷
---ও থাক৷ থ্যাঙ্কস৷ চললাম৷
ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, রাষ্ট্র ব্যাপারটাই একটা ইউটোপিয়ান ধারণা৷ রাষ্ট্র মানে দেশ নয়, নেশন নয়, সেটা প্লেন অ্যান্ড সিম্পল একটা রাজনৈতিক দল৷ তারা তাদের রাজনৈতিক ভাবধারা অনুসরণ করে দেশ চালায়৷ না হলে, ইউটোপিয়ান যে রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র প্রকৃতই জনগণ দ্বারা নির্বাচিত এবং তার পরিবর্তে জনগণের মঙ্গলের প্রতি দায়বদ্ধ, তাতে তার হাতে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের অধিকার থাকা উচিত৷
মাথাটা গরম লাগছিল৷ বাড়ি ফিরে স্নান করলাম৷ অর্চি এখনো ফেরেনি৷ আমি শরীরে ফ্রেশ হলাম, কিন্তু মেজাজটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে৷ ফেসবুক আমার স্ট্রেস বাস্টার৷ সোফায় বডি ফেলে খুটুর খুটুর শুরু৷ তারপর মনে হল, আমার মাথার মধ্যে যে কথাগুলো ঘুরছে, সেগুলো এক্ষুনি কারও সঙ্গে শেয়ার না করতে পারলে ঠিক হবো না৷ টাইমলাইনে লিখতে শুরু করলাম : আজ অমুক চ্যানেলে গেছিলাম ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নিয়ে টক শো-তে...
তারপর এলাম আসল কথায়৷
হে ঈশ্বর, আমাকে একদিনের জন্য পুরুষ করে দাও৷ আমি ওনার মেয়েকে ধর্ষণ করে মজা লুটি৷ তারপর আমার শাস্তি হোক৷ না, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নয়৷ ‘সংশোধনাগার’-এ গিয়ে ডালভাত খাই৷ এভাবেই কবছর পর স্বভাব-চরিত্র বদলে যাবে৷ ভালো ছেলে হয়ে থাকলে এমনকি আগেই শাস্তি শেষ হয়ে যাবে৷ ভালো ছেলে হয়ে রাষ্ট্রকে বলব : ভুল হয়ে গেছিল স্যার৷ আর করব না৷ ব্যস মিটে গেল৷
অত সহজে কী সব মেটে৷ নেটদুনিয়ায় হইচই পড়ে গেল৷ মরীচিকা সেন সুজিত পাত্রের মেয়েকে ধর্ষণ করতে চায়৷ মরীচিকা সেন বিকৃতমস্তিষ্ক, পারভার্ট৷ এর সমাজে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই৷ একে সমাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত৷
তার মানে, আমাকে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দেওয়া উচিত৷
v
আমি মৃত্যুদণ্ড মাথা পেতে নিয়ে প্রমাণ করব রাষ্ট্রের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অধিকার থাকা উচিত৷
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.