উপন্যাস

উপন্যাস হারিয়ে যাওয়া জন্মভূমি

হারিয়ে যাওয়া জন্মভূমি

লেখক : ভগীরথ মিশ্র

দ্বিতীয় ভাগ

  সন্ধে তখন গড়িয়ে গিয়েছে, এমনি সময়ে বঙ্কুবিহারীর দুয়োরে রামগতির বিশেষ দূত কাঞ্চন গগৈ এসে হাজির।

বঙ্কুবিহারীকে আগামীকাল বেলা দশটার মধ্যে জেলা পার্টি-অফিসে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন রামগতি বড়ুয়া । একটা নাকি দারুণ সুখবর রয়েছে।

ড. সেনের সম্বর্ধনা-সভার পর, গত ক’দিন বঙ্কুবিহারী’র ডানচোখটা সমানে নেচে চলেছে। কাজেই, কাঞ্চন মারফৎ রামগতি’র নির্দেশটা পাওয়ামাত্র মগজের মধ্যে তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ শিহরণ ! আচমকা হাইকমাণ্ডের থেকে এত জরুরি তলব ! কী নাকি দারুণ সুখবর !  তবে কি….তবে কি…এ্যাদ্দিন বাদে সত্যি সত্যি...!

আগামীকাল বেলা দশটা অবধি যেন তর সইছিল না বঙ্কুবিহারী’র। উৎসাহের আতিশয্যে কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, রামগতিদা ফ্রি থাকলে আমি কিন্তু আজ সন্ধ্যেতেই যেতে পারি পার্টি-অফিসে। আমার কোনো অসুবিধে নেই।

--- আজ গিয়ে কী করবেন বঙ্কুদা? কাঞ্চন নির্লিপ্ত গলায় বলে, স্যার তো আজ হেড-কোয়ার্টারে নেই। ফিরবেন অনেক রাতে। আমায় ফোনে কথাটা জানিয়েছেন।

জেলা-সভাপতি রামগতি বড়ুয়া যে হেডকোয়ার্টারে নেই, এটাই তো জানা ছিল না বঙ্কুবিহারী’র। কোথায় গেলেন? কবে গেলেন? কেন গেলেন ? তার চেয়েও বড় কথা, একা গেলেন, নাকি সঙ্গে কাউকে নিয়ে গেলেন ? একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন তাৎক্ষণিকভাবে ভিড় করে আসে বঙ্কুবিহারীর মগজে । বিশেষ করে শেষ প্রশ্নটা তাঁর কাছে যারপরনাই ভাইট্যাল। কারণ, এই প্রশ্নটার পেছনে একটা গভীর তাৎপর্য রয়েছে। জেলা বা রাজ্য-সভাপতি ট্যুর করাকালীন কাকে কাকে সঙ্গে নিচ্ছেন, রাজনীতিতে এটা একটা বড়সড় ব্যাপার। কারণ, জেলা অথবা রাজ্য-সভাপতি ইদানীং কাদের বেশি পছন্দ করছেন, এর থেকে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। সেই অনুযায়ী দলের মধ্যম-তলার নেতাদের ডোবা-ভাসা’র ব্যাপারে অস্পষ্ট হলেও একটা ছবি পাওয়া যায়।

--- অ…। পুনরায় কাঞ্চনের দিকে তাকান বঙ্কুবিহারী। বলেন, রামগতিদা একাই গিয়েছেন, নাকি সঙ্গে কেউ… ?

--- না,না, একাই। শ্যালিকা’র বাড়ি গিয়েছেন তো।

--- ও…শ্যালিকা’র বাড়ি ? কোনো উৎসব-টুৎসব রয়েছে নাকি ?

--- তা জানিনে। কাঞ্চন বুঝি যেতে পারলেই বাঁচে, আজ সকালেই গিয়েছেন। বলেছেন ফিরতে রাত হবে।

যাক বাবা। রামগতিদা একাই গিয়েছেন। মাখন মহান্তিটা এঁটুলি’র মতো সঙ্গে লেপটে যায়নি তবে ! তাহলে আর দেখতে হত না ! লোকটা যতক্ষণ সঙ্গে থাকত, সারাক্ষণ বেছে বেছে বঙ্কুবিহারী’র নামে সমানে বিষ ঢালত রামগতিদা’র কানে।

কাঞ্চনের জবাব শুনে তাই এতক্ষণে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে বঙ্কুবিহারী’র। বলেন, ঠিক আছে, তুমি রামগতিদাকে জানিয়ে দাও, আমি কাল দশটার মধ্যেই পৌঁছে যাবো।

কাঞ্চন চলে যাবার পরও, ওর শেষ কথাগুলো বারবার ঝংকার তোলে বঙ্কুবিহারী’র মগজে। একটা দারুণ সুখবর আছে ! একটা দারুণ সুখবর…!

খুশির চোটে বউকে চেঁচিয়ে ডাকেন বঙ্কুবিহারী, আর এক কাপ চা দাও তো মনোরমা।

--- এই ভরসন্ধ্যেয় কাঞ্চন গগৈ এসেছিল কেন ? স্বামীর সুমুখে চায়ের কাপটা নামিয়ে দিতে দিতে মনোরমা শুধোন, কপাল-টপাল পুড়ল নাকি? মাখন মহান্তিটা আবার কিছু প্যাঁচ কষেছে ?

বঙ্কুবিহারী ভালোমতোই জানেন, ঝানু পোলিসিয়ানের বউ হওয়ার সুবাদে গোটা জেলার রাজনীতির মানচিত্রটা মনোরমাকে সারাক্ষণ দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতে হয়। বাস্তবিক, সারা জেলার রাজনীতির হালচাল, সব কিসিমের ওঠা-পড়া, ডোবা-ভাসার হাল-খবর মনোরমা’র একেবারে নখদর্পনে। সেই সুবাদে তিনি ভালোমতোই জানেন, মাখন মহান্তি নামক বজ্জাতটা অনেকদিন যাবৎ সমানে লেগে রয়েছে বঙ্কুবিহারী’র পেছনে। ইতিমধ্যে দু’একটা খুচরো ক্ষতিও করে দিয়েছে লোকটা। সেসব কাটিয়ে উঠে এই মাত্র বছরটাক হল পৌরপিতার পোস্টটা পেয়ে হালে অল্পস্বল্প পানি পেয়েছে লোকটা। কিন্তু মনোরমা সারাক্ষণ আশঙ্কায় থাকেন, এই বুঝি কোনো চতুর বুলবুলিতে তাঁদের বহুকষ্টে ফলানো ধানগুলি সাবাড় করে দেয়। এব্যাপারে সন্দেহভাজনদের তালিকায় মাখন মহান্তিকেই পয়লা নম্বরে রেখেছেন মনোরমা।

বউয়ের আশঙ্কা জড়ানো কথাগুলো শুনতে শুনতে উজ্জ্বল হাসেন বঙ্কুবিহারী। চায়ের কাপে লম্বা চুমুক মেরে বলেন, আরে, না, না। শুনলে না, কাঞ্চন বলে গেল, সুখবর আছে ! তাবাদে, সুকোমল সেনের সম্বর্ধনা সভায় মাখন মহান্তির মাজাটি আমি এক্কেবারে ভেঙে দিয়েছি। আগামী ছ’টি মাস সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

শত্রুর সম্পর্কে স্বামীকে অতখানি নিশ্চিন্ত থাকতে দেখে আরো দুর্ভাবনায় পড়ে যান মনোরমা। এই বোকার হদ্দ লোকটাকে নিয়ে কী যে করেন তিনি !

কেঠো গলায় বলে ওঠেন, ওই আনন্দেই থাকো তুমি ! জানো তো, মাখন মহান্তি’রা হল ঘুণপোকার জাত। পাকা বাঁশের মধ্যেও ঢুকে পড়ে নিঃশব্দে কুরে কুরে ফোঁপরা করে দেয়, বাঁশ জানতেই পারে না।
কথাটা অবশ্য ঠিক। মনে মনে স্বীকার করতেই হয় বঙ্কুবিহারীকে। বলেন, যা বলেছ ! তবে, এক্ষেত্রে মনে হয় ভালো খবরই পাবো। শালী’র বাড়ি বেড়াতে গিয়েও ওখান থেকে যখন খবরটা জানিয়েছেন রামগতিদা, জরুরি খবর, সন্দেহ নেই। আর, কাঞ্চন তো বলেই গেল। রামগতিদা নিজমুখে জানিয়েছেন দারুণ সুখবর রয়েছে।

--- ভালো হলেই ভালো। বলতে বলতে নিজের কাজে চলে যান মনোরমা। বঙ্কুবিহারী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কল্পনার জাল বুনেই চলেন সারা সন্ধ্যে।

একসময় আর নিজের কৌতূহলকে কিছুতেই বাগ মানাতে পারেন না বঙ্কুবিহারী। ফোন করেন জেলা-অফিসের সর্বক্ষণের সচিব প্রশান্ত দেবকে।

বলেন, আচ্ছা প্রশান্ত, রামগতিদা কাল আমায় সকাল-সকাল ডেকে পাঠিয়েছেন। কেন ডেকে পাঠিয়েছেন, তুমি জানো ?

--- না তো দাদা। প্রশান্ত নিরীহ গলায় জবাব দেয়, তিনি তো তাঁর শ্যালিকা’র বাড়ি গিয়েছেন।

--- আরে জানি, জানি। গলায় কিঞ্চিৎ বিরক্তি ফুটিয়ে বঙ্কুবিহারী বলেন, আমি জানতে চাইছি, আচমকা অত জরুরি তলব কেন, তুমি জানো?

--- না, দাদা। আমায় কিছু বলেননি।

--- অ…কিছু বলেননি ? কিঞ্চিৎ হতাশ গলায় বঙ্কুবিহারী শুধোন, আচ্ছা, রামগতিদা জানিয়েছেন, কী নাকি একটা দারুণ সুখবর রয়েছে… কী ধরনের সুখবর, …তুমি শুনেছ কিছু?

--- না, দাদা, আমায় স্যার কিছুই বলেননি।

---অ…, আচ্ছা। সবদিক থেকে হতাশ হয়ে একসময় ফোন ছেড়ে দেন বঙ্কুবিহারী। ততক্ষণে তিনি অন্য একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছেন। সুখবর একটা অবশ্যই অপেক্ষা করছে বঙ্কুবিহারী’র জন্য, এবং বঙ্কুবিহারী’র বিবেচনায়, কথাটা এতটাই গোপনীয় যে, জেলা-অফিসের সর্বক্ষণের সচিবেরও তা জানা নেই।

ফলত, গোটা বিষয়টা বঙ্কুবিহারীর প্রত্যাশাকে বেশ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এবং তারই পরিণতিতে, সারা সন্ধ্যে বুনতে থাকা কল্পনার জালটি আরও বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে।

 সেদিন অনেক রাত অবধি কাঞ্চনের কথাগুলো মগজে সমানে ঘাই মারতে থাকে বঙ্কুবিহারী’র। অনেক রাত অবধি ঘুম আসে না চোখে। মধ্যরাত পার করিয়ে বিছানায় যান তিনি।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.