প্রবন্ধ

প্রবন্ধ উৎসবের রথ

উৎসবের রথ

লেখক : রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

শাস্ত্রে আছে ‘রথস্থ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’। অর্থাৎ রথে অবস্থিত বামন জগন্নাথকে একবার দর্শন করলে মানুষের আর পুনর্জন্ম হয় না। ভবিষ্যপুরাণে আছে সূর্যদেবের রথযাত্রার কথা, দেবীপুরাণে মহাদেবীর আর পদ্মপুরাণ বা স্কন্দপুরাণে বিষ্ণুর রথযাত্রার কথা। হিন্দুদের বড় বড় ধর্মীয় উৎসব, তার মধ্যে রথযাত্রা এক বিরাট উৎসব। পুরীর জগন্নাথ, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, শ্রীরামপুরের মাহেশ, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ, কলকাতা ও বাংলাদেশের ইসকন সবাই একসাথে রথযাত্রায় মেতে ওঠে। এছাড়া প্রবাসে লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, সিডনি, সিঙ্গাপুর, পার্থ, ভেনিস এই শহরগুলোও এই উৎসবের আনন্দ থেকে বাদ যায় না।

দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনকে স্মরণ করেই এই রথযাত্রা। কথিত আছে রথের দড়ি টানলে সর্ব মনস্কামনা পূর্ণ হয়। পুরীর অপর নাম শ্রীক্ষেত্র বা পুরুষোত্তম ক্ষেত্র। আগে জগন্নাথের রথযাত্রার জন্য পুরীতে ছয়টি রথ ব্যবহার করা হত। এখন তিনটি। রথ তৈরির কাঠ আসে পুরীর নিকটবর্তী দাশপাল্লা ও রনোপুর জঙ্গল থেকে। রথ তৈরি শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে। রথযাত্রা পালিত হয় আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে। এই দিন সুসজ্জিত তিনটি রথ বের হয়। দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ। গুন্ডিচা মন্দির উড়িষ্যার পুরী শহরের উত্তর কোণে, জগন্নাথের মাসির বাড়ি। গুন্ডিচা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী। রথযাত্রায় প্রথমেই যায় বলরামের রথ। রথের নাম তালধ্বজ। এই রথ চুয়াল্লিশ ফুট উচুঁ, চাকা আছে চোদ্দটি। সারথির নাম মাতালি। এরপর যায় বোন সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন বা পদ্মধ্বজ। এই রথের উচ্চতা তেতাল্লিশ ফুট, চাকা আছে বারোটি। সারথির নাম অর্জুন। এরপর যায় জগন্নাথদেবের রথ। রথের নাম নান্দীঘোষ বা কপিধ্বজ বা গরুড়ধ্বজ। এই রথ পঁয়তাল্লিশ ফুট উঁচু, চাকা আছে ষোলটি। সারথির নাম দারুক বা দারুকা। জগন্নাথদেবের রথের রক্ষী গরুড়। রথের দ্বাররক্ষী জয় ও বিজয়। মাসির বাড়ি থেকে আবার সাত দিন পর মন্দিরে ফিরে আসেন জগন্নাথ।

শ্রীরামপুরের মাহেশে ১৮৮৫ সালে মার্কিন-বার্ন কোম্পানির কারিগরি সহায়তায় বারোটি লোহার চাকা বিশিষ্ট সম্পূর্ণ লোহার কাঠামোর পঞ্চাশ ফুট রথ তৈরি হয়। এটি ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ও বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা। সাতদিন বাদে উল্টোরথের দিন রথটি মন্দিরে ফিরে আসে। মাহেশের রথের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানী’ উপন্যাসে ফুল বেচতে এসে রথের মেলায় রাধারানীর হারিয়ে যাওয়ার অশ্রুবিধুর কাহিনী।

রথের মেলা মানেই পাঁপড় ভাজা, জিলিপি, নাগরদোলা, সার্কাস, ম্যাজিক ইত্যাদির সমারোহ। এছাড়া লটকন বা আঁশফল আর কাঁঠালের চারদিক মৌ মৌ করা সুগন্ধ। রথ দেখা আর কলা বেচা সে তো আছেই। ছোট বড় সবার মিলনক্ষেত্র এই মেলা; হারিয়ে যাওয়ার মেলা। তারি মাঝে কবিগুরুর দুটি লাইন মনে পড়ে যায় ‘পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসে অন্তর্যামী’।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.