প্রবন্ধ

প্রবন্ধ মংগলের মাঙ্গল্য

মংগলের মাঙ্গল্য

লেখক : তুষার রায়

দ্বিতীয় ভাগ

মঙ্গলের আকাশে বাতাসে যেন আজকাল কেবলই ‘পৃথিবী’ নামের গ্রহের গন্ধ।ওখানের আকাশ-বাতাস (আর যদি কোন প্রকারের ‘প্রাণ’ থেকে থাকে) অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে-কি ব্যাপার?পড়শি গ্রহের অধিবাসীদের এত কিসের আগ্রহ ‘আমাদের পৃথিবীতে’?এই মুহূর্তে কমসে-কম পাঁচটি দেশের অভিযান-ঝাণ্ডা উড়ছে, মঙ্গলের কক্ষ-পথে,ওর আকাশে এমন কি ওর মাটিতেওঃ আমেরিকা,রুশ,ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন,ভারত,ইউ এ ই আর চীন দেশের ঝাণ্ডা উড়িয়ে প্রায় ‘যান-জট’ বা ট্রাফিক-জাম লাগিয়ে দিয়েছে।কেবল ২০২১ এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মে’র মাঝামাঝি পর্যন্তই তিন-তিনটি অভিযান মঙ্গলে পৌঁছে গেছে।তাই ‘মঙ্গল-বাসিরা’ রীতিমত 'তটস্থ' হয়ে উঠেছে। সূর্য থেকে মঙ্গলের গড় দূরত্ব ২২৮0 লক্ষ কিলোমিটার; সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণের জন্য মঙ্গলের সময় লাগে পার্থিব ৬৮৭ দিন। কিন্তু মঙ্গলের দিন আমাদের দিনের(২৪ঘন্টা)তুলনায় মাত্র ৩৭মিনিট ২৩ সেকেন্ড বেশী।তার মানে মঙ্গল তার অক্ষের চারিদিকে আমাদের তুলনায় কিছু আস্তে ঘুরছে। মঙ্গল আকারে(ব্যাসঃ ৬৭৯০ কিলো-মিটার) আমাদের পৃথিবীর (ব্যাস: ১২,৭৫০কিলোমিটার)প্রায় অর্ধেক।গ্রহটি আকারে আমাদের পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক হলেও দুই গ্রহের স্থলভাগ প্রায় সমান কারণ মঙ্গলে ত আর আমাদের মতন প্রশান্ত মহাসাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরের মত বিশাল জল-ভাগ নেই। কিন্তু মঙ্গলের দিন-রাত্রি আর ঋতু পরিবর্তনও আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে তুলনীয়। মঙ্গলের ঋতু পরিবর্তনের ব্যাপারটা আমাদের পৃথিবী থেকে দেখা যায় কি? হ্যাঁ। কি ভাবে ভাবে?ওর মেরুতে বরফ রাশির নিয়ত বাড়া-কমা দেখে। এইভাবেই এই গ্রহের সঙ্গে আমাদের গ্রহের বেশ কিছু মিল দেখা যায়।মঙ্গলের উপর থেকে সংগৃহিত তথ্য থেকেই বৈজ্ঞানিক মহলের দাবী এই যে,একদা ওখানে প্রচুর তরল জলের অবস্থান ছিল। আমাদের এই পৃথিবীর উপরিভাগে রয়েছে সুবিশাল সমতলভূমি,শতকরা ৭১ ভাগ দিগন্ত প্রসারিত সমুদ্র, সুবিশাল পর্বত শ্রেণী, সুদূর প্রসারী উপত্যকা,উঁচু উঁচু মালভূমি আর অসংখ্য আগ্নেয়গিরি।তুলনামূলক ভাবে,মঙ্গল গ্রহের উপরিভাগের সমতল আমাদের পৃথিবীর শুকনো স্থলভাগের প্রায় সমান সমান হলেও,এর উপরেও সুউচ্চ পর্বতমালা, উপত্যকা,অধিত্যকা আর বিশাল বিশাল আগ্নেয়গিরির অবস্থান সত্ত্বেও পৃথিবীর অনুপাতে সুবিশাল তরল জল-ভাণ্ডার নেই। ‘নাসা’র ‘মার্স এক্সপ্রেস অরবিটার’ নামক মহাকাশ যানের তথ্য অনুসারে এই গ্রহের উত্তর মেরুর নিকট আছে ৮১.৪ কিলোমিটার চওড়া ‘কোরোলেভ ক্র্যাটার’ নামক এক সুবিশাল খাড়ি বা ক্র্যাটার।এর গভীরতা ২ কিলোমিটার,আর এর ২২০০ বর্গ-কিলোমিটার অঞ্চল কঠিন বরফে ভরা।আমাদের পৃথিবীর বিশাল ক্র্যাটার যা আমরা অনেকেই দেখেছি-সেটি হ’ল উত্তর আমেরিকার “গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন”। তুলনামূলক ভাবে জানাই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন মাত্র ৪৪৩ কিলোমিটার লম্বা,২৯ কিলোমিটার চওড়া আর ১.৬কিলোমিটার গভীর কিন্তু আমাদের পৃথিবী মঙ্গলের তুলনায় ১০ গুন বেশি ভারী। ‘মঙ্গল গ্রহে প্রাণ আছে’ হয়ত,আমাদের মত জীব নয়,অন্য রকম দেখতে-এই রকম বিশ্বাস আমাদের অনেক পুরানো।“মঙ্গল থেকে অদ্ভুত-দর্শন ‘মানুষ’ নেমে এসেছে পৃথিবীতে”-এ ধরনের শিরোনাম-যুক্ত সান্ধ্য পত্রিকা প্রায়ই দেখা যেত একসময়। “কোই মিল গিয়া” নামের একটি হিন্দি চলচ্চিত্র আমরা অনেকেই দেখেছি।সেখানেও অন্য -২- গ্রহ থেকে এসেছে এক প্রাণী। এই ধরণের ধ্যানধারণার কারণ হ’ল আমাদের দুই গ্রহের প্রকৃতিগত মিল আর অপেক্ষাকৃত কম দূরত্ব। কিন্তু এখনও পর্যন্ত, বর্তমান বা সুদূর অতিতে মঙ্গলে প্রাণের কোন অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু ক্রমাগত সংযোজিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে সুদূর অতিতে সম্ভবত ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি বছর আগে মঙ্গলের উপরিভাগের আবহাওয়ার জলিয় বাষ্প ছিল,এমন কি ক্ষুদ্র কোন প্রাণের(Micro-Organism) অস্তিত্বও থাকা অসম্ভব ছিলনা-এমন ধারণাই পোষণ করেন বর্তমান সময়ের বৈজ্ঞানিক মহল। প্রশ্ন উঠতে পারে,সমগ্র সৌরমণ্ডলের গ্রহদের মধ্যে একমাত্র মঙ্গলেই আমাদের লক্ষ্য নিবদ্ধ হয়ে আছে কেন? তার কারণ এই যে আমাদের এই দুই গ্রহের মধ্যে কিছু কিছু সমতা বিদ্যমান। আরও এই জন্যে যে মঙ্গলের বর্তমান প্রকৃতিগত অবস্থা আমাদের পৃথিবীর গঠন-কালের অবস্থার সংগে মিল রয়েছে।তাছাড়া,মঙ্গলের শীতল আবহাওয়া এবং গভীর অভ্যন্তর ‘প্লেট-বিহীন’ হওয়াতে মঙ্গল আদিম যুগ থেকে প্রায় অপরিবর্তিত থেকে গেছে।বৈজ্ঞানিকেরা মনে করেন মঙ্গলের সমতলের অন্তত দুই তৃতীয়াংশ ৩৫০কোটি বছর পুরানো আর সেইজন্যই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি-রহস্য হয়ত ওখানে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।প্রাণীর সম্ভাব্য বাসস্থান বা অস্থি-কঙ্কালের অবস্থানের উপর তাই অধুনা নাসা (NASA) এবং ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের (ESA) গবেষণার বিশেষ আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।নাসা’র ২০১৮ সালের ঘোষণায় জানা যায় যে মঙ্গলের উপর ঋতু অনুসারে মিথেন(CH4 )গ্যাসের কম-বেশি হওয়ার সংকেত পাওয়া গেছে। আমরা জানি, মিথেন গ্যাস কেবল দুই প্রকারে তৈরি হওয়া সম্ভব:এক,কোন ক্ষুদ্র প্রাণীর (Micro-Organism) দ্বারা অথবা হয় কোন ভূতাত্ত্বিক(Geological) কারণে। অতএব,মিথেন গ্যাস যখন আছে তখন হয়ত কোন ক্ষুদ্র প্রাণীর অবস্থান থাকা অসম্ভব নাও হতে পারে। মঙ্গল অভিযান: আজ পর্যন্ত পঞ্চাশটি অভিজান হয়েছে মঙ্গলে।এই গ্রহের উপর প্রথম সাফল্যমণ্ডিত উত্তরণ হয়েছিল আমেরিকার (নাসা- NASA) “ভাইকিং-১” নামক মহাকাশ যানের।সেটা ছিল ১৯৭৬ এর জুলাই মাস।আবার ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে নামল “ভাইকিং-২” নামক আর একটি মহাকাশ যান।এইভাবে একের পর এক অভিযান হয়েছে মঙ্গলের উপর।প্রায় দু’বছর আগে ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকার পারসিভিয়ারেন্স(Perseverance) মিশন নিয়ে এ পর্যন্ত ৫০ টি মঙ্গল অভিযান হয়েছে।এত বেশী অভিযান সৌরমণ্ডলের আর কোন গ্রহে,এমনকি চাঁদেও হয়নি। এদের মধ্যে সবচেয়ে শেষেরটি (চীনের ১৫ই মে ২০২১ এর অভিযান বাদ দিলে) হয়েছে মাত্র দু’বছর পাঁচ মাস আগেঃ ১৮ই ফেব্রুয়ারি,২০২১এ। আবার আমাদের আপন, গৌরবময় জাতীয় মহাকাশ সংস্থা, ইসরো ( ISRO) এর বিরাট সাফল্যমণ্ডিত মঙ্গল-যান অভিযানের কথাও ভুললে চলবে না। আমাদের“মঙ্গল-যান” ৫ই নভেম্বর,২০১৩ তে শুভ-যাত্রা করে ২০১৪’র ২৪শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলের কক্ষে প্রবেশ করে অসংখ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য পাঠিয়েছে। “মঙ্গলযান”এখনও ‘কাজ’ চালিয়ে যাচ্ছে এবং মূল্যবান তথ্য পাঠাচ্ছে। আগামী বছর ২০২৪ সালে আবার আমাদের একটি নতুন মঙ্গল-যান অভিযানের কথা আছে। রাশিয়া বা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন(USSR) ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি মঙ্গল-যান “লাল গ্রহে” নামাতে সক্ষম হয়েছিল; কিন্তু তারপরে তার সংগে যোগাযোগ স্থাপন ও কায়েম রাখা সম্ভব হয়নি।এর পরে ১৯৯৬ সালে রাশিয়া আর একবার “মার্স ৯৬” নামে একটি মঙ্গল অভিযান এর প্রস্তুতি নিয়েছিল,কিন্তু সেটি পৃথিবীর কক্ষপথ ত্যাগ করতেই সক্ষম হয়নি বলে জানা যায়।এরপর রাশিয়া কোন মঙ্গল অভিযান করেছে বলে জানা যায়নি। পরের বছর (১৯৯৭) ৪ঠা জুলাই আমেরিকার ‘মার্স-পাথ ফাইন্ডার’ -৩- (Mars path finder) নামের এক মঙ্গল যান নামাল আর পরের দিন প্রথম রোবট-চালিত ‘রোভার’ বা চলমান গাড়ি,’সোজর্নার’ (Sojourner),মঙ্গলের উপর চলতে শুরু করেছিল। এরপর ২৫শে ডিসেম্বর,২০০৩এ ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির( ESA )প্রথম মঙ্গল-যান, ‘মার্স এক্সপ্রেস’ যোগ দিল মঙ্গলের আবর্তে।পরের বছর(২০০৪) জানুয়ারিতে নাসার(NASA)মঙ্গল অভিযানের নতুন একজোড়া রোভার- ‘স্পিরিট’(Spirit) আর ‘অপরচুনিটি ’(Opportunity)নামল মঙ্গলে।‘স্পিরিট’ ৬ বছরের বেশি কাজ করে ২২শে মার্চ,২০১০পর্যন্ত অনেক তথ্য পাঠিয়েছে পৃথিবীতে.আর ‘অপরচুনিটি’ ২০১৮এর ১০ই জুন পর্যন্ত অসাধারণ কাজ করেছে।নাসা(NASA) আবার ২০১২’র ৬ই আগস্ট ‘মার্স বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’(MSL: Mars Science Laboratory)এর অন্তর্গত ‘কিওরিওসিটি’(Curiosity )নামের রোভার নামালো মঙ্গলে।‘কিওরিওসিটি’র কাজ ছিল মঙ্গলের জলবায়ু আর ভূতত্ত্ব অনুধাবন করা।এরপর এলো ভারতের ইতিহাস সৃষ্টিকারী “মঙ্গল-যান” অভিযান। নভেম্বর ২০১৩’র ৫ তারিখে বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে শ্রীহরিকোটার সতিশ ধাবন মহাকাশ কেন্দ্র থেকে পি এস এল ভি–এক্স এল সি২৫ (PSLV-XLC25) রকেট দ্বারা উৎক্ষিপ্ত হল আমাদের গর্বের মহাকাশযান। কোলে নিয়ে গিয়েছিল ‘মঙ্গলযান’কে। কেবল ভারতের নয়, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠিত সমগ্র মানবজাতির সেই আশার মঙ্গল যান ২৯৮ দিন মহাকাশে উড়ে প্রথম একমাস পৃথিবীর কক্ষপথে,পরে কিছুদিন সূর্যকেন্দ্রিক কক্ষপথে আর পরিশেষে ২০১৪’র ২৪শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছে গেল “চন্দ্রযান”।এইভাবে ভারত হয়ে গেল পৃথিবীর চতুর্থ ( রাশিয়া, আমেরিকা, ইয়োরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি,ভারত) দেশ যারা মঙ্গল গ্রহে মহাকাশ যান পৌঁছাতে সক্ষম হল- শুধু তাই নয়,প্রথম প্রচেষ্টাতেই পেল অভাবনীয় সফলতা-যা অন্য কোন দেশ তখন পর্যন্ত করতে পারেনি।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.