গল্প

গল্প কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

লেখক : কৃশানু মিত্র

জানও মা দেশটা একেবারে আলাদা’। মা বলে, তুই এই অবেলায় ফোন করলি! শরীর ঠিক আছে?’ ধুস, আজেবাজে প্রশ্ন না করে আমার ভাললাগা, অর্জিত অনুভুতির কথা শোন।'  মা রজনী অফিস ফেরতা এসি বাসে উঠে বসেছে। ভিড় খুব বেশি নয়, বাস ছাড়বো ছাড়বো করছে।  একজন সুদর্শন যুবক বাসে ভিক্ষা করতে উঠেছে। তার জীবনের করুন কাহিনী রজনীকে বেশ কাহিল করে দিয়েছে।

ফোনে কুন্দন তখনও বকবক করে চলেছে। কুন্দনের বক্তব্যে সারসংক্ষেপ হল নরওয়ে দেশটাতে তালাচাবির প্রচলন নেই। হোটেলে চেক ইন করতে গিয়ে ম্যানেজারের কাছে ঘরের চাবি চাইলে ম্যানেজার বলে এদেশে তালাচাবির ব্যাবহার নেই। আরও কথার ঢেউ একের পর এক আসছে। রজনী ঠিকঠাক শুনতে না পেয়ে ফোনে হ্যালো হ্যালো করছে। কী, কী বললি মিউনিখে কী ঘটেছে?’ কুন্দন বলে, সে এক অসম্ভব ঘটনা। সে দেশের এক নাগরিক সময়াভাবে টিকিট কাটতে না পের ট্রেনে উঠে পড়েছে। রজনী বলে,তাতে আমার কি?’ কুন্দন, চিবিয়ে চিবিয়ে বলছিল কথাগুলি। মায়ের কথার উত্তর না করে সে বলে চলে,’প্লাটফর্মে টিকিট চেকার থাকে না, ট্রেনেও নেই। আমারই কম্পার্টমেন্টেই সে ভদ্রলোক উঠে ছিল। মিউনিখে নেমে একটি টিকিট কেটে সে আইনত মেশিনে পাঞ্চ করল।' 'ওরে তুই ছাড় এবার আমি বাসে উঠেছি ভালো করে শুনতে পারছি না।' ওদিকে সুদর্শন যুবক চেঁচিয়ে বলে চলেছে- আমি বিকম অনার্স পড়ি। দাদারা দিদিরা আমাকে যদি তিনশ সত্তর টাকা দেন তাহলে আমি জওহরলাল এবং সীমা শ্রীবাস্তবের লেখা ফিনান্সিয়াল একাউন্টিং বইটা কিনতে পারি। রজনী বুঝে উঠতে পারে না কার কথা শুনবে। পুত্র নাছোড় আর পুত্র সম একজন ভিক্ষারত। 'জানো মা, নেদারল্যান্ডসের ঘটনা আরো মজার। আমি ডেন হাগ স্টেশনের বাইরে টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে একজন প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে একটা টিকিট কেটে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে চলে গেল। রজনী কারন জিজ্ঞেস করলে কুন্দন বলে, 'জার্মানি খুব নিয়মতান্ত্রিক আর নেদারল্যান্ডস লিবারেল উদারনৈতিক'। রজনী বলে, 'চাবি না থাকার নজির আমাদের দেশেও আছে।' 'দাদাভাই দিদিভাইরা আমার বইয়ের একশ কুড়ি টাকা আপনারা দিয়েছেন এখনও দুইশত পঞ্চাশ টাকা উঠলে আমার পক্ষে বইটি কেনা সম্ভব হবে।' রজনী ছেলেটিকে কিছু দিতে চায়। রজনীর চিত্তচাঞ্চল্যে জাগা অতি উৎসাহ নজরে পড়ার মতো।

কুন্দন প্রশ্ন করে 'মা,বলোনা কোথায় দেখেছো?' রজনী হিমালয় কথাটা উচ্চারণ করতেই ফোনের লাইনটা কেটে যায়।' ততক্ষণে ছেলেটি তার কাছে এসে হাজির হয়েছে। রজনীর মানসিক অবস্থান সে বুঝে নিয়েছে। রজনী এখন তার আক্রমণের লক্ষ্য যতটা টাকা জোটে কপালে। ছেলেটি বলে চলেছে- আমাকে দিলে আপনাদের ভাগে কিছু কম পড়বে না বরং ঈশ্বরের আশীর্বাদে নিশ্চিত লক্ষ্মী লাভ ঘটবে মাত্র আড়াইশো টাকার প্রয়োজন। রজনী ইতস্তত ভাবছে কত টাকা দেওয়া উচিত। রজনী সঙ্গে ছেলেটির চোখাচোখি হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে একশো টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দেয় রজনী। ছেলেটি হাত বাড়িয়েই ছিল। ঠিক সেই সময় অনীকের ফোন আসে। তড়িঘড়ি ফোন ধরতে গিয়ে রজনী কানেকশন কেটে ফেলে। ছেলেটি ততক্ষণে একশ টাকার নোট হস্তগত করেছে। ফের রিং বাজে ফোনে রজনী ফোনটা স্পিকারে দিয়ে দেয়। ভালোলাগায় তার মন ভরে আছে। গর্বিত ছেলেটি ফের ক্যাম্পেইন শুরু করে দিয়েছে- আপনাদের আশীর্বাদে আর মাত্র দেড়শ টাকা পেলে আপাতত আমি ভিক্ষাবৃত্তি থেকে নিষ্কৃতি পাব।

অনীক চাইছিল বান্ধবী রজনীর সঙ্গে হোলি কন্সপিরেসি দেখবে। সে কারনেই ফোন করা। স্পিকার অন থাকায় অনীকের কানে যায় ছেলেটির ব্যাথিত উচ্চারণে ভিক্ষার সুর। অনীক বলে, 'রজনী দেখত ছেলেটির গালে কি বসন্তের দাগ আছে?' রজনী হ্যাঁ বাচক উত্তর করলে অনীক জিজ্ঞেস করে, 'অরিজিন অফ ফিনান্সিয়াল একাউন্টিং বইটির জন্য 370 টাকা চাইছে কি ছেলেটি? রজনী অবাক হয়ে বলে,হু কী করে জানলি?’ অনীক বলে 63 নম্বরে একদিন আর সাঁকরাইল মিনিবাসে বারকয়েক আমি ছেলেটিকে দেখেছি। প্রথমবার একশো টাকা দিয়েছি। স্পিকার অন থাকায় পাশের একজন শুনতে পায়। সে রজনীকে কিঞ্চিত উত্তেজিত করলে রজনী ফোনটা কেটে দিয়ে সটান ছেলেটির কলার ধরে একশো  টাকা ফেরত চায়। ছেলেটি থতমত খেয়ে বাস থেকে নেমে পড়ে। রজনীও পিছুপিছু গিয়ে ছেলেটির হাত ধরে ফেলে। ছেলেটি বলে দিদি প্রথমেই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ক্ষমা!’ আমার অনুভুতিকে হত্যা করে ক্ষমা চাওয়া। ক্ষমাও একধরনের ভিক্ষাবৃত্তি’। ভিখারি কোথাকার’। পাশে বসা ভদ্রলোক বেশ কয়েক জন সহযাত্রীকে নিয়ে তড়িঘড়ি নেমে এসেছে ফুটপাতে। ছেলেটি একটু হলেও ঘাবড়ে গেছে কারন ওদের মধ্যে উদ্ধত একজন হাত চালাতে চাইছে। ছেলেটি কেঁদে বলে,মারবেন না আমায়।‘ মায়ের মন, একটু হলেও নরম। রজনী বলে, ‘আপনারা যান আমি বুঝে নেব।‘ ছেলেটি সাহস পেয়ে বলে, ‘কোথাও যদি একটু বসা যায় তাহলে আমার ফেরেপবাজ জীবনের কথা আপনাকে শোনাতে চাই। মানে কেন আমি এমন হলাম’। রজনী বলে, ‘আমি কিছু শুনতে চাই না তুমি আমার টাকা ফেরত দাও আর আমি ঠকতে চাই না’। কথা শেষ হওয়ার আগেই অনীকের ফোন বেজে ওঠে রজনী ঈঙ্গিতে ছেলেটিকে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতে বলে। তারপর ফোনে অনীককে বলে, 'দাঁড়া তোর সাথে পরে কথা বলছি। আমি ছেলেটাকে ধরে ফেলেছি।'

শেষমেশ বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানে ওরা পাশাপাশি বসে। ছেলেটি শুরু করে ‘আমি বিকম অনার্স এ ভর্তি হওয়ার আগে আমি হায়ার সেকেন্ডারিতে খুব ভালো ফল করেছিলাম। বাবার ইচ্ছে ছিল আমি চাটার্ড একাউন্টেন্ট হব। আমারও তেমন ইচ্ছা ছিল।‘ এইটুকু বলে ছেলেটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ নামিয়ে নেয়। রজনী বলে, ‘আবার গল্প দিচ্ছ?’ ছেলেটি বলে, ‘আমার কি দরকার ছিল আপনাকে এতশত বোঝাবার আমি আপনাকে আরামসে এড়িয়ে চলে যেতে পারতাম অথবা আপনার টাকা ফেরত করে দিলেই ল্যাটা চুকে যেত। আমি তা করিনি প্রথম দর্শনেই আপনার মধ্যে থাকা বিশুদ্ধ আবেগের পরিচয় আমি পেয়েছিলাম। অনেক মানুষ আছেন যারা বাধ্য হয়ে আমাকে টাকা দেন আপনি তেমন নয়’। রজনী বলে, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, আগে বাড়ো’। ছেলেটি রজনীর অস্বস্তি বুঝতে পেরে বলে, 'বাবা অনেক সাধ করে নাম রেখেছিল অশেষ। অশেষ মিথ্যাচারের ডুবে গেছি আমি।

যাহোক কলেজে পা দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই একসিডেন্টে আমার বাবা মারা যান। মা আর বড়দি এই আমাদের সংসার। লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই আমি বাধ্য হয়ে সাঁকরাইলের কেকের কোম্পানিতে চাকরি নিই। থাকা খাওয়া,মাস গেলে সাড়ে সাত হাজার টাকা মাইনে। সবাই মিলে একটা মোবাইল কেনা হয়েছিল। সময় ভাগাভাগি করে কর্ম অবসরে সবাই মিলে বিনোদনে ব্যস্ত থাকতাম। যে যার পসন্দ অনুযায়ী মজে থাকত। কেউ পর্নোগ্রাফি কেউ খেলা’। রজনী জিজ্ঞেস করে, তুমি কি দেখতে?’ অশেষ বলে, 'ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, মেসি রোনাল্ডো।

রজনী বলে, ‘তুমি তো তাহলে ভালো ছেলে’। মাথা নিচু করে থাকে অশেষ। রজনী বলে, ‘কি হলো?’ অশেষ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আমি বিদিশার প্রেমে পড়েছিলাম। বিদিশাকে সাজাবার জন্য কসমেটিকস সানগ্লাস সাজপোশাকের আরো কত কিছু যে মোবাইলে খুঁজতাম। বিদিশা সুন্দরি, গরিবের ঘরে জন্মালেও তার চাহিদার অন্ত ছিল না।‘ রজনী বলে, ‘তুমি বিদিশাকে বোঝাতে না কেন?’ অশেষ বলে ছাড়ুন ওসব কথা, আপনি বলুন আপনাকে কে ফোন করেছিল?’

‘অনীক আমার বন্ধু’। ‘না না, প্রথমে যাকে শারীরিক কুশলতার কথা জিজ্ঞেস করলেন আমি তার কথা জিজ্ঞেস করছি’। ‘ও বাবা তুমি সব শুনেছ? ও আমার পুত্র কুন্দন।‘ ‘কোথায় সে এখন?’ ‘কুন্দন লেখাপড়ার কাজে বিদেশে গেছে।‘ অশেষ অবাক হয়ে বলে, ‘বিদেশে লেখাপড়া করতে! কী বিষয় নিয়ে উনি পড়াশোনা করতেন?’ রজনী বলে, ‘সাইকোলজি, মানুষের মনের জটিলতায় ওর আগ্রহ। তুমি বিদিশার কথা কি বলছিলে?’ অশেষ বলে, ‘না থাক’। রজনী বলে, ‘কোনো কথা রেখে ঢেকে বলবে এমন বাসনা নিয়ে কি তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলে?’ ‘না তা নয়, বলছি, মানুষের জানা উচিত নিজের বা বন্ধুর চাহিদা বা ক্ষমতার সীমা।

টানলে রবারের মত ছিঁড়ে যেতে পারে সব কিছু সেটা বোঝা দরকার। বিদিশার জন্য আমি আমার নিজের পরিবারে টাকার যোগান কমিয়েছি। বিদিশার মা, মেয়ের জন্য বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ নিয়েছেন। বিদিশার ইচ্ছা সে নার্সিং কলেজে ভর্তি হবে। বিদিশার ইচ্ছায় তার মায়ের মনেও এমন অভিলাষ জন্ম নিয়েছিল। কষ্টার্জিত দু'লক্ষ টাকা কলেজে জমা করতে হয়েছে অথচ লেখাপড়া শিকেয় তুলে বিদিশা এখন প্রেমে থুড়ি পণ্যে মশগুল। একপাশে নিজের মা কে শোষণ করছে অন্যদিকে আমার আবেগ নিয়ে খেলছে।‘ রজনী জিজ্ঞেস করে, ‘তুমিই বা এই খেলায় তাল দিচ্ছ কেন? সব দোষ মেয়েদের উপর চাপিয়ে দিয়ে পরিত্রান পাবার চেষ্টা পুরুষের বহু ব্যবহৃত পথ।‘ অশেষ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে, তারপর বলে, ‘আমি ওর রুপে মোহগ্রস্ত ছিলাম। ওকে আরো আরো সুন্দর দেখতে চাইতাম। সকলের যেন তাক লেগে যায় ওর সৌন্দর্যে। সব্বাই ঈর্ষা করবে আমাকে এই ভুল চিন্তার রাহুগ্রাসে বন্দি ছিলাম আমি।‘ রজনী বলে, ‘আর এখন?’ অশেষ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, ‘হেয়ারস্টাইল করতেই মাসে হাজার টাকা চলে যেত। তারপর লিম্ফ্যাটিক ম্যাসাজ স্কিনের জন্য কসমেটিকস।‘ রজনী বলে, এতসব তুমি জানলে কি করে?’ ‘বিদিশার শখের জন্যই আমাকে মোবাইল কিনতে হল। এখন বুঝেছি পৃথিবীর বুদ্ধিমান মানুষ কেমন ভাবে গরীবকে বোকা বানায়।

আচ্ছা আপনারা সচ্ছল, কুন্দন কে মানুষ করার ক্ষেত্রে কোনদিন অর্থ নিশ্চয় বাধা হয়ে দাড়ায়নি?’ ‘না, মাধ্যামিক পাশ দেওয়ার আগে ছেলে বুঝতেই পারেনি বাবা-মায়ের টাকা পয়সা আছে’। রজনী হেসে ফের বলে, ‘বিষাণ মানে আমার স্বামী এবং আমি দুজনেই দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছি। আমরা দুজনেরই সম্যক উপলব্ধি হল দারিদ্র না দেখলে পরিশ্রম না করলে মানুষের চরিত্র গঠন হয় না। কুন্দন যখন ক্লাস টেন এ পড়ে সে তার বাবামায়ের অসুবিধা না হলে একটা এক্সট্রা রেফারেন্স বই কিনে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে ছিল। সে আরও বলেছিল,তোমাদের যদি অসুবিধে না হয় তবেই কিনে দিও। অসুবিধে থাকলে আমি লাইব্রেরী থেকে দেখে নেব। অথচ দেখো তুমিও দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষ।‘ অশেষ কিছুটা চুপ করে যায় তারপর বলে, ‘এখানে উলটপুরান।

বাবা মেয়ে সন্তানের প্রতি নজর না দিয়ে ছেলেকে উচ্চকক্ষ পথে স্থাপন করতে সর্বোচ্চ ঢেলেছেন। আর আমি বিদিশার মতো আরও আরও বখে গিয়েছি।‘ বাকরুদ্ধ অশেষ হঠাৎই কাঁদতে থাকে। রজনী অশেষের মাথায় হাত বোলাতে থাকে। ঠিক সেই সময় কুন্দনের ভিডিও কল আসে। 'কি গো, এখনও বাড়ি পৌছাওনি?’ রজনী বলে, ‘দাঁড়া আলোতে কিছু দেখা যাচ্ছে না আগে মোবাইলের ব্রাইটনেস বাড়াই। হ্যাঁ, এবার বল’। কুন্দন বলে দেখো হোটেলের ফ্রিজে 'রেডি টু ইট,স্টক', ব্যবহার করলে মূল্য দিতে হবে। মূল্যমান কেউ মেলাবে না। তুমি যা ডিক্লেয়ারেশন দেবে ওরা সেই মুল্য ধার্য করবে।‘ রজনী বলে, ‘তো, তুই কি পাগল হয়ে গেলি? ওসলো কেমন শহর তা না জানিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখানোর মানে কি?’ অশেষ বলে ওঠে, ‘বুঝেছি উনি বলতে চাইছেন হোটেল অথরিটি কিচ্ছুটি চেক করবে না। একদম বিশ্বাসে মিলায় বস্তু।‘ কুন্দন বলে, ‘মা, উনি ঠিক বুঝেছেন, ওনার পরিচয়?’ মোবাইল ঘুরিয়ে মা দেখায়, ‘এই দেখ ওর নাম অশেষ। ওর সঙ্গে আজ আলাপ হলো।‘ অশেষ হেসে বলে- দুর্ভাগ্যের পরিহাসে। রজনী বলে, ‘বাবাই , আমরা একদিন ওকে নিয়ে স্কাইপে বসতে পারি?’ কুন্দন বলে, অবশ্যই’।

রবিবার বিকেলে অশেষ এসেছে রজনীর বাড়িতে। বিষান কম্পিউটার খুলেছে। কুন্দন কে দেখা যাচ্ছে ওপারে। কথা শুরুর হবার তোড়জোড় হচ্ছে। রজনী- সেদিন ফোনে জার্মানি আর নেদারল্যান্ডসের ফারাক ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। কুন্দন- যাক, বুঝতে যে চেয়েছ এই বিষাণ বাবুর ভাগ্য। রজনী –বাবাই, ভালো হচ্ছে না কিন্তু। কুন্দন নরওয়ে জার্মানির গল্পটা সবাইকে একবার বলতেই অশেষ বলে আমি বলি? সবাই মৌনতায় সায় দেয়। অশেষ- জার্মানির জাত্যাভিমান কি এর কারন? কুন্দন- আমি সঠিক বলতে পারব না। এটা একটা কারন হতে পারে। তবে অন্যরা আত্মশৃঙ্খলায় বিশ্বাসী। অশেষ- আমি জানতে চাই নরওয়ের সামাজিক আবহর সংকেতে আপনি কেন এত উল্লসিত? কুন্দন- জীবনে এই অভিজ্ঞতা নেই বলে। অপু দুর্গা কেন অবাক হয়েছিল? এমন বিস্ময়কর সুন্দর যন্ত্রযান তারা কোনদিন দেখেনি, ঠিক কিনা। অশেষ- ঠিক। কিন্তু এমনটা কি করে হতে পারল? রজনী- এমনটা এদেশেও ছিল। বিষান- ঠিক,একবার আমরা ট্রেকিং করতে গিয়েছিলাম কুমায়ুন হিমালয়ে। আমাদের গাইড ছিল বলবন্ত সিং। আমরা আদর করে তাকে বল্লু নামে ডাকতাম। বল্লু একদিন বললো, বাবু হেমন্ত সিং আপলোগ ক্যা রুকস্যাকমে সে দারু নিকালকে পিতে হ্যায়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাহাড়ের লোক এমনটা তো করেনা। বল্লুর কথায় ছিল হাতুড়ির ঘা। সে বলেছিল,হেমন্ত সিং ছয় মাস কে লিয়ে বরোদা গ্যায়া থা, চোর ব্যানকে লৌওটা। রজনী- এমন অনেক উদাহরন আমি দিতে পারি। অশেষ- আমিও। কুন্দন- বল বল। অশেষ- এই যেমন,তোমাদের মতো পরিবার কি নরওয়েতে পাব? সবাই একচোট হেসে নেয়। কুন্দন- আমি তোমার জীবন বৃত্তান্ত শুনতে চাই। তারপর আমার কনসালটেন্সি শুরু হবে। অশেষ- আমি অশেষ। অক্ষম পিতার বয়ে যাওয়া ছোট সন্তান। দিদি বড়, বাবা পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন,মা বেঁচে আছেন। বাবা-মার প্রচ্ছন্ন মদতে দিদি কে শোষণ করে আমার বড় হয়ে ওঠা। আমি চাঁদ চাই নি তাই পাইনি বিষয়টা এমন ছিল। বাবা-মা চাইতেন ছেলে যেন অভাবের মুখ না দেখে কোনোদিন। বাবা দিনরাত পরিশ্রম করতেন।

ছোটবেলা থেকে লাই পেয়ে মাথায় উঠলেও লেখাপড়ায় আমি ভালো ছিলাম। আর থাকবো নাইবা কেন। ভালো টিউশনি পেয়েছি বরাবর। দিদি, কিছুই না পেয়ে কোনরকমে মাধ্যমিক পাশ দিয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। কুন্দন- বুঝলাম, তুমি কি জানো ভিক্ষাবৃত্তি আইনত অপরাধ। এমনকি দশ বছরের জেলও হতে পারে। অশেষ-আমাদের দেশে আইন মেনে কোন কাজ হয়?

কুন্দন- তোমার কি মনে হয়, চাকরি পেলে এই কাজ তুমি বন্ধ করে দেবে? অশেষ- নিশ্চয়। কুন্দন- চাকরি তো তুমি করতে। অশেষ- সম মাইনের চাকরি চাই।

কুন্দন- তাহলে সাড়ে সাত হাজার টাকা তোমার কাছে খড়কুটো ছিল বল। অশেষ- অবশ্যই। পাঁচ হাজার পরিবারকে দিতে হতো। বিদিশার জন্য বরাদ্দ ছিল দুহাজার। উভয়েরই চাহিদা বাড়তে থাকল অগত্যা বাধ্যতায় পেশার পরিবর্তন করতে হল। কুন্দন- হঠাৎ কেন এমন পেশা বাছতে হলো? অশেষ- যখন তরুণ-তরুণীদের দেখতাম ইউনিফর্ম পড়ে উচ্চ শিক্ষিত হতে যাচ্ছে যন্ত্রণায় আমার খুব ফেটে যেত। আমিও তো পড়তে পারতাম কি ছিল না আমার?

কুন্দন- এই পেশায় কিভাবে তুমি এলে? অশেষ- বিদিশাকে নতুন নতুন রুপে দেখতে পছন্দ করতাম আমি। আমরা দুজনে একসাথে মোবাইল ঘাঁটতাম এবং নিত্য নতুন পণ্যসম্ভারে আক্রান্ত হতাম জাগত নতুন ইচ্ছা। কুন্দন- তোমার কোন পণ্য বাসনা নেই বলতে চাও? অশেষ- তখন ছিল না। কুন্দন- আচ্ছা বল তোমার গতিরোধ করব না। অশেষ- বাজার, হরেক রকম পণ্যে বোঝাই। আধুনিক শিক্ষা হলো মানুষকে বাজারের টেনে নামানোর ছলাকলা। বিভিন্ন মানুষ আ্যকাডেমিক ডিগ্রি বোঝাই করে এগিয়ে চলেছে এই কাজ করতে। মোবাইল, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আপনার পছন্দের জিনিসের তালিকা আপনার কাছে হাজির করছে। উচ্চ মেধা সম্পন্ন মানুষ অংক কষে কম্পিউটারকে বলে দিয়েছে কিভাবে ভিখারির কাছে চন্ডী দাসের খুড়োর মতো দোলাতে হবে কল। কারণ বড় বড় কোম্পানি সমস্ত অংকবিদের মস্তিষ্ক কিনে নিয়েছে। মানুষকে তার পছন্দের উপর নির্ভর করেই ভিখারি বানানো যায়। কুন্দনদা, তুমি বলছিলে না ভিক্ষাবৃত্তি আইন সঙ্গত নয়। ভিখিরি বানান বন্ধ করতে গেলে বাজারে তালা লেগে যাবে। সবাই চুপ মেরে গেছে। কুন্দন- কিন্তু সাড়ে সাত হাজার টাকার রিস্ক তুমি নিলে কি করে? অশেষ- আমি জানতাম বাঙালি কামচোর জাত। গায়ে গতরে খেটে উপার্জন করতে পারে না। আর গায়ে-গতরে চাকরি বাজারে কিছু কম নেই। আমি যখন তখন এমনটা পেতে পারি। বিষাণ ফুট কাটে- তা বলে ভিক্ষাবৃত্তি! অশেষ- আমি ভিখারি নই। ভিখারি তাঁরা যাদের আমি ইমোশন বিক্রি করি। আমার আবেগ তাদের স্পর্শ করলে তাঁরা অর্থ দেন। রজনী- তার মানে আমি ভিখারি, তাইতো? বেফাঁস কথা বলে ফেলে চুপ মেরে যায় অশেষ। কুন্দন- জীবনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এমন ব্যবহার কোনদিন দেখিনি। শুধু প্রয়োগে রকম ফের ঘটেছে। অশেষ- ঠিক তাই আমি প্রযুক্তির কাছে শিখলাম কেমন ভাবে চলতে হবে। দরকার হলে পালটাবো অন্য ভাবে বিক্রি করব আবেগ। কুন্দন- উহু, প্রযুক্তি নয়। আসলে মানুষ প্রযুক্তি বানিয়েছে।

ধনী মানুষ জানে পণ্য বিলাসী কোটি কোটি ভিখারি তৈরি করতে পারলে বাজার চাঙ্গা হবে। আর আমার কাজ এখান থেকেই শুরু। রজনী- মানে? কুন্দন- অভাবে মানুষ ইচ্ছানুগ বাজারে যেতে পারবে বাসনায় অতৃপ্তি রয়ে যাবে। জন্ম নেবে মানসিক রোগ। অশেষ- ঠিক আর আমি চেয়েছি আবেগ হারিয়ে যাওয়া মানুষকে জাগিয়ে তুলতে। রজনী- উহু,তুমি এই টাকা ঢালো বিদিশার জন্য, বাজারে। তুমি আর বিদিশা দুজনেই রোগগ্রস্ত তোমাদের ইলাজের প্রয়োজন। অশেষ- বিদিশার সঙ্গে বহুদিন আমার দেখা হয়নি। আজ ভাবছি যাব। দেখি ফেরে কিনা। রজনী- তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েগেছে?একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অশেষ। কুন্দন-তোমার সঙ্গে আবারও বসতে হবে। পারবে সময় দিতে? অশেষ- মনে হয় না। রজনী- সেকিরে এইজন্য তোকে ভালোবেসে ফেললাম? অশেষ- মাথা নিচু করে।

রাতের খাবার খেয়ে অশেষ বাড়ি চলে গেছে। বিছানায় রজনী আর বিষান। বিষান রজনীর চিবুক ধরে বলে, তুমি সত্যিই জহুরী’। রজনী বলে, না হলে তোমায় খুঁজে পাই’। বিষান রজনীর কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে শুয়ে পড়ে। আজ সোমবার। ভোর হতে না হতেই রজনী উঠে পড়েছে। দুবেলার রান্না করে রেখে অফিস যাবে সে। নাগাড়ে ফোনটা বেজে চলেছে ধরতে পারছে না রজনী। ভাত নামিয়ে আঁচ কমিয়ে রজনী ফোনটায় দেখে ননদ মিঠুর মিসড কল। কল করলে ননদ বলে, ‘দাদার ফোন তো কখনো বন্ধ হয় না। বারবার রিং করছি ফোন সুইচড অফ বলছে। আমি ভয় পেয়ে যাচ্ছি।‘ ফোন রেখে রজনী আতিপাতি খুঁজতে থাকে বিষানের ফোন। কোথাও না পেয়ে উনুনের আঁচ বন্ধ করে রজনী মাঠে যায়। সকালবেলা রোজ নিয়ম করে বিষাণ মাঠে ব্যায়াম করে। রজনীকে দেখে বিষাণ বলে, ‘আমি তো কাল রাতে কম্পিউটার টেবিলের ফোন রেখেছি। তারপর থেকে ফোনে হাতই দিই নি।‘ রজনী বলে, ‘তাহলে কি ফোন ডানা মেলে উড়ে গেল?’

সদ্য কেনা অ্যাপেলের ফোন,দু জনেরই মন খারাপ হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি বাড়িতে এসে ওরা কুন্দন কে ফোন করে। আলোচনায় ঠিক হয় ওরা মিসিং ডায়েরি করবে কারণ বহু অফিশিয়াল তথ্য আজকাল ফোনে থাকে। বাড়ি থেকে চুরি হয়েছে বললে অশেষের নাম জড়িয়ে যাবে তাই অফিস যাওয়ার পথে হারিয়ে গেছে এই বলে ডায়েরি করা সহজ। বিষাণ বের হবে ঘর থেকে। রজনী দরজা বন্ধ করতে এসেছে। দরজা খুলে বিষাণ দেখে ছলছল চোখে অশেষ ওর আ্যপেল ফোন নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বিষাণ জিজ্ঞেস করে, ‘কি হলো বিদিশা পুরানো আ্যপেল চলবে না বলেছে?’ রজনী বলে, ‘ছিঃ,আমরা তোকে ভরসা করেছিলাম।‘ অশেষ,বিষাণের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে পালাতে চায়। তারপর ফিরে রজনীর দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,বিদিশা অ্যাপেলের সন্ধানে বাঘেদের ডেরায় হানা দিয়েছিল। সেখানে ওকে ছিঁড়ে খুবলে একদলা মাংস পিণ্ড বানিয়ে ট্রেন লাইনে ফেলে দিয়ে গেছে আপদেরা। আদতে বিদিশা ছিল নিলামে ওঠা দামী পণ্য। কুন্দন দা কে বলে দেবেন হয়ত এবার আমি বাসনা মুক্ত হতে পারব’।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.