প্রবন্ধ

প্রবন্ধ মংগলের মাঙ্গল্য

মংগলের মাঙ্গল্য

লেখক : তুষার রায়

পর্ব ৩
পৃথিবীর কেবল মাত্র চারটি দেশ আজ পর্যন্ত মঙ্গলের কক্ষপথে মহাকাশ যান স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে: এরা হল-রাশিয়া,আমেরিকা,ইয়োরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ই এস এ আর আমাদের দেশ।আমাদের গর্ব এই যে প্রথম প্রচেষ্টাতেই আমাদের সফলতা এসেছিল।মাত্র ছয় মাস মঙ্গলের আকাশে থাকার জন্য পাঠানো ‘মঙ্গলযান’ সাড়ে সাত বছর মঙ্গল পরিক্রমা করে আর অসংখ্য তথ্য পাঠিয়ে কেবল মাত্র ইসরো (ISRO )’কেই নয় সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞান সংস্থাগুলিকেও সমৃদ্ধ করছে।অবশেষে, ২০২২ এর এপ্রিল মাসে ইসরো মঙ্গলযানের সঙ্গে যোগাযোগ সূত্র হারিয়ে ফেলে: সম্ভবত ‘মঙ্গলযান’ এর ইন্ধন ফুরিয়ে গিয়েছিল অথবা ওর সূর্য-প্যানেল গুলি ঠিক মত কাজ করতে না পেরে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ শক্তি সংগ্রহ করতে অক্ষম হয়ে পড়েছিল।সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে ইসরো আগামী বছর(২০২৪) অথবা ২০২৬ এ মঙ্গলযান-২ শুধু ওই গ্রহের কক্ষপথেই নয় একেবারে গ্রহের উপরেই নামার প্রচেষ্টা করবে।এই অভিযানের অমূল্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আগামী দিনে ইসরো আমাদের নিকটতম গ্রহ শুক্র অভিযানরও প্রচেষ্টা করতে পারে।
এরপরে,পঞ্চম দেশ হিসাবে ইউ এ ই (UAE)বা ইউনাইটেড আরব ইমাইরেটস,জাপানের প্রাযুক্তিক সহায়তায় ‘হোপ’ (Hope) নামের একটি মহাকাশ যান মঙ্গলের কক্ষপথে স্থাপন করল ৯ই ফেব্রুয়ারি,২০২১ তারিখে।
আজ পর্যন্ত মঙ্গলে পাঠানো রোভারদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল কিওরিওসিটি(Curiosity) আর সবচেয়ে ছোট ছল সোজর্ননার(Sojorner)। আজ পর্যন্ত যত সফল মঙ্গল অভিযান হয়েছে তার মধ্যে ‘নাসার’ “অপরচুনিটি” (Opportunity) নামের রোভার ছিল সবচেয়ে সফল মঙ্গল যান। অপরচুনিটি ২০০৪ থেকে শুরু করে দীর্ঘ ১৫ বছর সফলভাবে কাজ করে অসংখ্য ছবি আর তথ্য পাঠিয়ে ‘নাসা’কে সমৃদ্ধ করেছে। অপরচুনিটি এই দেড় দশক যাবত মঙ্গলের মাটিতে মোট ৪৫ কিলোমিটার ‘পথ’ চলে অবশেষে ২০১৮ সালে মঙ্গলের মাটিতেই ‘দেহরক্ষা’ করেছে।
ঠিক তিন বছর আগে ২০২০ সালের ২৩শে জুলাই তারিখে চীন তাদের প্রথম মঙ্গল যান ‘ঝুরঙ্গ’ মঙ্গলের মাটিতে নামিয়েছিল,কিন্তু মঙ্গলের প্রচণ্ড ‘ধুলোর-ঝড়’ থেকে বাঁচাবার জন্য ঝুরঙ কে অস্থায়ীভাবে গভীর নিদ্রায় রাখা হয়েছিল। জানা গেছে সেই ‘নিদ্রা’ থেকে গত বছর(২০২২) মে মাসের ২০ তারিখ থেকে গভীর-নিদ্রা বা হাইবার- নেশন (Hibernation)থেকে ফিরে আসেনি বলে জানা যায়।
এরপর এলো নাসা’র যুগান্তকারী মঙ্গল অবতরণ-১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ এ-‘পারসিভিয়ারেন্স’ অভিযান। দু’শ সত্তর কোটি($2.7Billion) আমেরিকান ডলারের অধিক খরচের এই মঙ্গল অভিযান। খরচের হিসাবে এই অভিযান এখন পর্যন্ত সকল অভিযানকে ছাপিয়ে গেছে।পৃথিবীর আকাশ ত্যাগ করে ২০৩ দিনে ৪৭.২ কোটি কিলোমিটার মহাকাশে উড়ে রোবট চালিত হেলিকপ্টার,‘ইনজিনিউটি’ (Ingenuity) কে কোলে নিয়ে মঙ্গলে নামলো রোভার ‘পারসিভিয়ারেন্স’। সেটা ছিল ১৮ই ফেব্রুয়ারি,২০২১ সাল।‘ইনজিনিউটি’ মঙ্গলের উপর প্রথম উড়ে ইতিহাস সৃষ্টি করল ঐ-বছরের (২০২১)এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখে।পৃথিবী ছাড়া আর কোন গ্রহের উপর আজ পর্যন্ত কোন উড়োজাহাজ (হেলিকপ্টার) ওড়েনি।’ইনজিনিউটি’ নামক এই উড়োজাহাজটি সরাসরি খাড়াভাবে(Vertically ) উঠে মঙ্গলের মাটির মাত্র ১৫ ফুট উপর দিয়ে উড়ে তথ্য আর অনেক চিত্র পাঠিয়েছে। আবার কাজ শেষে খাড়াভাবে নেমে এসেছে রোভার,পারসিভিয়ারেন্সে।আমরা জানি মঙ্গলের আবহাওয়া ভীষণ হাল্কা-আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়ার এক শতাংশেরও কম।এই হালকা আবহাওয়ায় একটি হেলিকপ্টারের ওড়া কি করে সম্ভব? আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞানের কি অসাধারণ নিদর্শন এই মঙ্গল যান-পারসিভিয়ারেন্স আর ইনজিনিউটি।এদের দেখে এক বারও কি মনে হয় যে মঙ্গল গ্রহে মানুষের ‘বসতি স্থাপন’ একদিন সম্ভব হবে না?
বর্তমান সময়ে (জুলাই-আগস্ট,২০২৩) মোট তিনটি যান মঙ্গলের উপর বিভিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছে।এগুলি হল, নাসা’র কিওরিওসিটি এবং পারসিভিয়ারেন্স আর চীন দেশের ‘ঝুরঙ্গ’,যদিও ঝুরঙ্গ আপাতত গভীর ’নিদ্রামগ্ন’।
কিওরিওসিটিঃ
একটি এস ইউ ভি(SUV) গাড়ির সমান রোভারটি ২৬ নভেম্বত,২০১১ এ পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে পরের বছর ৬ ই আগস্ট মঙ্গলের বিশাল ‘খাঁড়িতে’ নামলো।রোভারটি দশ ঘণ্টায় মঙ্গলের এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ চলতে পারে।এখন পর্যন্ত তথ্য থেকে জানা গেছে যে মঙ্গলে একসময় প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। কিয়োরিওসিটি সাড়ে নয় ফুট লম্বা,প্রায় নয় ফুট চওড়া আর ৭ফুট ৩ইঞ্চি উঁচু।
পারসিভিয়ারেন্সঃ
এর পর ২০২০ সালের ৩০শে জুলাই উৎক্ষিপ্ত হল আর এক যুগান্তকারী রোভার,পারসিভিয়ারেন্স।প্রায় সাত মাস মহাকাশের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে পরের বছর(২০২১) ১৮ই ফেব্রুয়ারি পারসিভিয়ারেন্স মঙ্গলের মাটিতে পা রাখল।এখন পর্যন্ত রোভারটি মোট ২ বছর ৫ মাসের মত সময় মঙ্গলের মাটিতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছে।পারসিভিয়ারেন্স মঙ্গলের উপর অনেক পাথর উল্টে-পাল্টে অনুসন্ধান করে জানিয়েছে যে একদা মঙ্গলে প্রবহমান জলের স্রোতের আভাস আর ‘জীবন’ থাকার প্রবল সম্ভাবনার ইঙ্গিতও দিয়েছে।পাঠানো তথ্য থেকে আরও জানা গেছে যে মাত্র ৪ লক্ষ বছর আগেও মঙ্গলে স্নো-ফল আর হিমানী সম্প্রভাত হয়েছে।এই রোভারটি এতই অসাধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন যে মঙ্গলের উপরেই রকেট চালিয়ে মঙ্গলের মাটি-পাথর কুড়িয়ে আবার ঘরে(পৃথিবীতে) ফিরে আসবে,সম্ভবত ২০৩৩ সালে।এই প্রথম সৌরমণ্ডলের অন্য একটি গ্রহ থেকে রকেট চালিয়ে একটি মহাকাশযান পৃথিবীতে ফিরে আসবে। কি অসাধারণ আর উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা,মনে হয় যেন ‘কল্পবিজ্ঞান’।কিন্তু সত্যি।
ঝুরঙ্গঃ চীন দেশের প্রথম মঙ্গল যান(রোভার) ‘ঝুরঙ্গ’ ২০২০ সালের ২৩শে জুলাই উৎক্ষিপ্ত হয়ে ১৫ই মে ২০২১ তারিখে মঙ্গলের মাটি স্পর্শ করেছিল।আকারে এটিও ‘নাসা’র কিউরিওসিটির কাছাকাছি।এক সপ্তাহ পরে ২২শে মে তারিখ থেকে ঝুরং কাজ করতে লেগেছিল বলে জানা যায়।কিন্তু মঙ্গলের ‘কুখ্যাত’ অসাধারণ ধুলোর ঝড় থেকে রক্ষা করার জন্য ওকে ‘ঘুম পাড়িয়ে’ ঢেকে রাখা হয়েছিল।গত বছরের(২০২২) ডিসেম্বর পর্যন্ত ওকে গভীর ঘুম থেকে জাগানো হয়েছে কিনা জানা যায়নি।
ওদিকে, ইয়োরোপীয় স্পেস সংস্থা, ESA এপ্রিল,২০১৮ থেকে মঙ্গলের উপর মিথেনের বাড়া-কমা নিরীক্ষণ করে চলেছে আর জানিয়েছে যে ২০২২শে ওদের মঙ্গল ‘রোভার’ রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন(Rosalind Franklin)মঙ্গলের মাটি খুঁড়েও মিথেনের পরিমাণ পরীক্ষা করবে। ‘নাসা’র রোভার ‘পারসিভিয়ারেন্স’ও বিশেষ পাইপে করে মঙ্গলের মাটি নিয়ে আসবে পৃথিবীতে আরও বিষদ পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য।
(ক্রমশ)

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.