সুন্দরগড়ের যক্ষের ধন
লেখক : সু বী র মু খো পা ধ্যা য়
বিরক্তকর কান্নার গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এই রাত্রে, এই বনাঞ্চলে? দিনেরবেলাতেই ভয়ে অনেকে প্রবেশ করে না, তবুও রাত্রে এই কান্নার শধ। মনে হচ্ছে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। কিন্তুù কেন? এই নিশুতি রাত্রে, ঘন অন্ধকারে কান্না, বেশ বিচলিত বোধ করেন এই বনের সর্বেসর্বা শ্রী ভূতেশ্বর বাবা। পাশের জামগাছ থেকে রূপান্তùরিত হয়ে একজন সাধারণ মানুষের বেশে। গাছতলায় এসে---কে কাঁদে, কেন কাঁদে, কিসের দুঃখ? প্রশ্নগুলি শুনে বালক ডাবলু বেশ হকচকিয়ে উঠে বলে---আমি, আমি ডাবলু, সৎমা মারে, খেতে দেয়না, তাড়িয়ে দিয়েছে, দুদিন কিছু খাইনি বড্ড খিদে পেয়েছে। ভূতেশ্বর এখানে কেন এলে?
ডাবলু---আজ্ঞে, না জেনেই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি, এখন আর হাঁটতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে, তাই বসে পড়েছি।
ভূতেশ্বর---বেশ, এখন কিছু খেয়ে নাও। রূপান্তùরিত লোকটি উপরে হাত তুলে কি যেন বিড়বিড় করে বললেন, সঙ্গে সঙ্গে হাতে এসে গেল একটা খাবারের প্যাকেট।
ডাবলু দেখল, একি ভোজবাজি? চম্কে উঠেও খিদের যন্ত্রণায় পোলাও, পনিরের প্যাকেট পেয়ে, গোগ্রাসে খেতে লাগল। এমন সময়ে দুদিকে দুটি বাঁদর এসে দুটি জলের বোতল সামনে রেখে দিয়ে বলে---প্রভু, আর কি লাগবে?
লোকটি মানে ভূতেশ্বর বাবা--- দুটি ভালো মিষ্টি নিয়ে এসো। ওরা যেন নিমেষে উড়ে গেল। অচিরেই ফিরে এলো দই, মিষ্টি নিয়ে।
কলি নামের বাঁদরটি এসে---নে খেয়েনে। ভালো করে খা। অন্য বাঁদরটির নাম ফলি।
সে বলে---যেখান থেকে এসেছিস, সেখানে চলে যা।
প্রতিবাদ করে ভূতেশ্বর---না যাবে না। এখানেই থাকবে, ও অত্যাচারিত। এখানে সবার সাথেই থাকবে।
ফলি---কিন্তুù ও ঘুমাবে কোথায়? ভূতেশ্বর সব ব্যবস্থা করে দিচিছ। বললেই উপরে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। সঙ্গে সঙ্গেই একটা চৌকি, বালিশ, তোষক, মশারি সবপ এসে গেল।
কলি---এগুলি পাতা হবে কোথায়?
ভূতেশ্বর---আমার পাশেই থাকবে। মানে এই জামগাছের নিচেই থাকবে।
ফলি---বেশ ভালো ব্যবস্থাই হল।
কলি---উড়ে এসে জুড়ে বসল।
ভূতেশ্বর---কোনো কথা বলবে না, ও আমার আশ্রিত সন্ন। ওকে সবাই দেখে রাখবে, বনের সবাইকে বলে দিও এটাই আমার আদেশ।
কলি, ফলি---(সমস্বরে) যথা আজ্ঞা প্রভু। ডাবলুর ব্যবস্থা বেশ ভালোই হল।
ডাবলু মানুষ বিহীন। এই বনাঞ্চলে। বেশ ঘুরে বেড়ায় হাতি, চিতা হায়না, শিয়াল। বাঘ, জংলি কুকুর, শুধু শুধু তাকিয়ে দেখে। কেউ কিছু বলে না। এমনকি সর্পরাও পাশ দিয়ে চলে যায়। কিছুই বলে না। ও জেনেছে যে, এই বলে সবাই ভাতৃজ্ঞানে থাকে। মারপিট করে না। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে।
আজ ভূতেস্বর বাবার সঙ্গে রয়েছেন একজন বৃদ্ধা। উনিও রূপান্তরিত, আসলে ইচছাধারী ভূত, পেতনি এরা। বৃদ্ধার নাম ভূতনী। সবাই ওনাকে মা বলে। এবার ভূতনী-মা-বাবা ডাবলু। কোনো অসুবিধা হলে বলবে।
ডাবলু---না ভালোই আছি। খাচিছ, ঘুরে বাড়াচ্ছি। ওই পশ্চিম কোনো একটা সমাধি দেখেছি, আবার তার থেকে খানিকটা দূরে, নদীর কাছে একটি কালী ম¨ির দেখেছি, দেখে মনে হল বহু পুরানো।
ভূতনী---এই সমাধি রাজা বীরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর।
ডাবলু---উনি তো হি¨ু। তবে সমাধি কেন?
ভূতনী---হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো, তবে উনি ছিলেন বেশ পরাক্রমী রাজা, বেশ সম্পত্তির মালিক এবং ওই চৌধুরী বংশের বেশ কিছু পুরানো গুপ্তধন ছিল। রাজা বীরেন্দ্র ছিলেন প্রজাবৎসল, জ্ঞানী, গুণী এবং তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। উনি তন্ত্রচর্চায় নিপুণতা লাভ করেন কুলগুরু মাধবাচার্যের সহায়তায়।
এমন সময় চলে আসেন ভূতেশ্বর বাবা---হ্যাঁ, মাধবাচার্য ছিলেন আমার গুরুদেব। অত্যন্ত দক্ষ তান্ত্রিক। বাকসিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। মুখের ফুৎকারে কাঠে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন। বহু মানুষ তাঁরই কৃপায় আরোগ্য লাভ করেন।
ডাবলু---উনি আছেন কি?
ভূতেশ্বর---উনি দেহ রেখেছেন, তবে এঁদের তো মৃত্যু নেই। প্রয়োজনে ডাকলে আসেন। মাধবাচার্যের পরামর্শে গুপ্ত জায়গায় রাখা আছে এই চৌধুরী পরিবারের গুপ্তধন। পাহারায় আছে মন্ত্রপূত মাথায় মণিসহ বিশেষ ধরনের নাগ, নাগিণী।
ডাবলু---তাহলে তো ওই ধন কাজেই লাগবে না।
ভূতেশ্বর---লাগবে। সৎ, ভালো কাজে লাগবে। তবে প্রকৃত সৎ মানুষ, নির্লোভ ব্যক্তিই পারবেন এই গুপ্তধন কাজে লাগাতে।
ডাবলু---এভাবে গুপ্তধনও রাখার কারণ কি?
ভূতেশ্বর---কারণ আছে বৈকি? তবে শোন।
ভূতনী---বেলা হয়ে গেছে, ডাবলুর স্নান, খাওয়া হবে না?
ডাবলু---মাগো, গল্পটা শুনেই যাব। বলুন বাবা, বেশ মজা পাচিছ।
ভূতেশ্বর---চৌধুরীদের রাজপরিবারে উৎসব, আন¨ লেগেই থাকত এবং প্রজারাও এতে যোগদান করত, প্রচুর খাওয়া দাওয়া হতো, আশপাশের রাজারা বেশি ঈর্ষাপরায়ণ ছিল, হিংসা করত। এত জৌলুষ ওরা সহ্য করতে পারছিল না। তলে তলে ওরা শত্রুতা শুরু করল। ওরা গোপনে বর্গিদের নেতা ভাßñর পণ্ডিতকে সব মিথ্যা করে জানায় এবং ওই নেতা ছিল লুণ্ঠনবাজ। তিনি এতে বিশেষ উৎসাহিত হয়েছিল। কথাটা গুপ্তচর মারফত জানা যেতেই জানানো হয় কুলগুরুজিকে।
তখনই আসনে বসে স্বামী মাধবাচার্য ধ্যানযোগে সব অবগত হয়েছিলেন। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ভাßñর পণ্ডিত ছিলেন অতি ভয়ঙ্কর অত্যাচারী লুণ্ঠনকারী। ইতিমধ্যেই উনি প্রচুর ধনলুণ্ঠন করেছিলেন। ওই লোভীগুপ্তধনের লোভে চৌধুরী পরিবারের প্রাসাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার আগেই ঘটে গেল এক চমৎকার কাহিনী। দুর্ধর্ষ ভাßñর পণ্ডিত দলবল নিয়ে এগিয়ে আসছেন এমন সময় বলয়াকারে অগ্নি জ্বলে উঠল হঠাৎ। চারদিকে আগুন। ওই আগুন ঠেলে ওই বর্গিবাহিনী আর এগোতে পারল না। এসব চমৎকারিত্ব ঘটিয়েছিলেন তান্ত্রিক মাধবাচার্য। ভাßñর পণ্ডিত বিফল হয়ে ঘোড়া চালিয়ে, দলবল নিয়ে দূরে চলে যেতেই, আগুনও নিভে গেল। দেখা গেল আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। রক্ষা পেল চৌধুরী পরিবার এবং তাঁদের ধনরত্ন। এখনও সঞ্চিত আছে ঐ ধন। কলি, ফলি দুই বাঁদর সর্দার দলবল নিয়ে হাজির ডাবলুর কাছে।
কলি--- সবাইকে দেখে রাখ। এই ডাবলুকে, ও আমাদের ভাই, সবাই ওকে সর্বদাই সাহায্য করবে। শুনে একটু খারাপ লেগেছে ডাবলুর। শেষ পর্যন্তù বাঁদর ওকে ভাই বলছে?
ফলি--- ঠিক আছে, ভাইসব, কিছু কলা নিয়ে এসে ডাবলুকে দিয়ে যাবে। মনে রেখো এটা বাবা ভূতেশ্বরের আদেশ। বনের সবাইকে জানিয়ে দিও। ওই পুরানো কালি ম¨িরে রোজ কে যেন ফুল, জল, বাতাসা দিয়ে যায়। আবার পাশের শিবùলিঙ্গেও কে যেন রোজ বেলপাতা দিয়ে যায়। লক্ষ করে ডাবলু দেখেছে আড়াল থেকে দুটি বানর এই কাজটি করে এবং ঐ সময় ম¨িরের সামনে দুই, তিনটে হাতি শুঁড়ে করে জল ছিটিয়ে দেয় শিবলিঙ্গে। পুলকিত হয় ডাবলু বানরের কালিপূজা আর হাতিদের শিবপূজা দেখে। এরপরেও লক্ষ করা গেল ঐ শিবলিঙ্গকে ঘিরে আছে বেশ কিছু সাপ। হঠাৎই পিছনে চলে আসেন ভূতেশ্বর বাবা--- কি দেখছো?
ডাবলু? এ এক রহস্যময় ম¨ির। এই শিব যথার্থই ধনেশ্বর। ওনার কাছেই আছে প্রচুর ধন-সম্পত্তি। তবে নেওয়ার সাধ্য কারো নেই, চেষ্টা করলেই মৃত্যু অবধারিত
ডাবলু--- কই কিছু তো দেখছি না?
ভূতেশ্বর--- সহজে ঐ ধনদৌলতের দেখা পাওয়া যাবে না। এর জন্য সাধনা, পূজা মহাদেবের সন্তুùষ্টির বিশেষ প্রয়োজন। উনি সন্তুùষ্ট হলে, কৃপা করলেই তবেই সব কিছু সম্ভব হবে।
ডাবলু--- তবে, আপনি যে বললেন ভালো কাজে ঐ ধন লাগানো যাবে।
ভূতেশ্বর--- কে করবে? কিভাবে করবে? সৎ মানুষের বড়ই অভাব।
ডাবলু--- বাবা, যদি সরকারকে দেওয়া যায়?
ভূতেশ্বর--- এটা ম¨ বলোনি, দেখা যাক, ভবিষ্যতে ঠাকুরের কি ইচ্ছা হয়?
তবে প্রচার আছে যে এই বনের মধ্যে ভূত আছে এবং এই ভূত গুপ্তধন পাহারা দেয়। এই প্রচারের জন্য মাঝেমধ্যেই চোর ডাকাতদের উৎপাত হয় এবং প্রায়ই দুএকটা লাশ পড়ে থাকে। সর্পাঘাতে মৃত্যু, না হয় হায়না, বন্যকুকুর, বাঘের আক্রমণে চোর, ডাকাতদের লাশ পড়ে থাকে। সেগুলি আবার মাংসাশী প্রাণীরা নদীর ধারে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তুù তবুও উৎপাত কমে না। অথচ কেউ জানে না ঠিক কোথায় গুপ্তধন আছে? ওরা খুঁজতে আসে, কিন্তুù এখানে ঐ ম¨ির, আর সমাধি ছাড়া কিছুই নেই। প্রচারের মাহাত্ম্য এতই বেশি, সবাই আকৃষ্ট হয়, ঐ লটারি পাওয়ার মত। এটা ভূতেশ্বর বাবা জানেন, তবে উনিও জানেন ঐ গুপ্তধনের হদিশ পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। একমাত্র ভূতেশ্বর সন্ধান দিলেই তা সম্ভব। আর ভূত্বেশ্বর বাবাকে ধরাও সহজ নয়, যখন তখন যে কোনো রূপ ধরতে পারেন। যক্ষের মতো আগলে বসে আছেন। আর কতকাল এই ধন পাহারা দেবেন। এবার সৎকাজে দান করে। মুক্ত হবেন এই দায় থেকে। হয়তো চলে যাবেন অন্য কোথাও। ডাবলু জেনেছে ভূতনীমার থেকে ঐ ভূতেশ্বর বাবা আসলে কে? রাজা বীরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীরই হলেন অশরিরী ভূতেশ্বরবাবা। তান্ত্রিক মাধবাচার্যের কৃপায় মরণের পরেও অশরিরী হয়েও বংশের ধনসম্পত্তি রক্ষায় এই বনাঞ্চলে থাকেন। এই বনাঞ্চল জায়গাটা বরাবরই চৌধুরীদের রাজত্বের অংশই ছিল, তাঁদের রাজত্বের নাম ছিল সু¨রগড়। এই সু¨রগড়ই ছিùল দীঘি, হাতিশালা, ঘোড়াশালা ইত্যাদি। সু¨রগড় সবদিক থেকেই সু¨র ছিল। ফসল হতো প্রচুর, অফুরন্তù মাছ ছিল দীঘিতে, শোনা যায় ঐ দীঘিতে স্নান করে আসতো গভীর রাত্রে জলপরীরা। সু¨রগড় কত প্রাচীন, এই নিয়ে আছে বিতর্ক। মতভেদ তবে বেশ পুরানো এই নিয়ে স¨েহ নেই। জনশ্রুতি একসময়ে ঐ কালিম¨িরে নাকি অমাবস্যার রাত্রে নরবলি এবং মহিষবলি হতো। রাজoোহী, অপরাধীদেরই বলি দেওয়া হতো। সেসব অতীত এখন শুধু গল্প, কাহিনী, তবে মাঝে মধ্যেই কাগজের লোকজন, সরকারি দপ্তরের মানুষজন আসেন এই বনাঞ্চল সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ করতে। এই বনাঞ্চলের ইতিহাসের টানে চলে আসে বনদপ্তর, আসে প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তর। আজ ঐরকম একটি দল এসেছে। তারাও জানতে চায় এর অতীত, এমন সময় দেখা হয়ে যায় ডাবলুর সঙ্গে। ঐ দলের বড়কর্তা সমরবাবু ডাবলুকে--- তুমি এই বনে কি করছো?
ডাবলু---এখানে থাকি।
সমরবাবু---তোমার বাবা, মা... তোর খাওয়া, থাকার ব্যবস্থা...
সমর---ভূতেশ্বর বাবা, সে আবার কে?
ডাবলু---আছে, আছে, তবে আপনারা এই বনে কেন?
সমর---আমরা সরকারের লোক, বন তো সরকারের।
ডাবলু--- এই বনতো সু¨রগড়ের রাজাদের। এখানে রাজত্ব করতেন চৌধুরীরা।
সমর---আর কি জান? রাজাদের ধন-সম্পত্তির খবর কিছু জানা আছে?
ডাবলু---না, সে সব জানি না, বলেই ছুটে চলে যায় দূরে।
সমরবাবু---এই তোমরা সবাই যাও। বাচ্চাটাকে ধরে নিয়ে এসো, ও অনেক কিছু জানে। এখানে থাকে তো।
কয়েকজন লোক ধেয়ে যায় বাচ্চাটা মানে ডাবুলকে ধরতে। ডাবলু নিকটের একটি গাছে উঠে পড়ে, এমন সময় হাতির দল এসে পথ
আটকায় ঐ লোকদের এবং তাড়া করতে থাকে। গাছের উপর থেকে ডাবলু সব দেখে, বুঝল বিপদ সামনে। ওই হাতির দল ওই মানুষগুলিকে তাড়া করে পায়ের তলায় পিষে দেবে। ডাবলু চিৎকার করে বলে--- হস্তীরাজ, গজেন্দ্র থেমে যাও। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাজ হল। হাতিরা থেমে গেল। তবে পথ আটকে রেখেছে, যাতে ডাবলু সুরক্ষিত থাকে। সবাই অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখে ভাবছে, কি অসাধারণ ক্ষমতা ঐ বালকের, বনের পশুও, ওর কথা শোনে? এদিকে গজেন্দ্র, উড়ে গিয়ে সব বার্তা দিয়েছে প্রভু ভূতেশ্বরকে। সব শুনে বুঝে হাওয়ার গতিতে বৃদ্ধের ছদ্মবেশে সামনে হাজির হয়েছেন ভূতেশ্বরবাবা। দেখেই বুঝে গেছে ডাবলু, মাথার উপরে চক্কর দিচ্ছে বাজ, উড়ে গিয়ে বনের অন্য পশুদের ডেকে আনার কাজে ব্যস্ত। সমর--- আপনি এই বনে, চারিদিকে বন্যজন্তুù, বি¡ধর সর্পকুল, আপনার ভয় করে না।
উত্তর দেয় ডাবলু---ওনাকে সবাই সম্মান করে। ওনার কথা বন্যরাও শোনে। মানে, এই বনে বহুদিন আছেন।
সমর---বেশ তাহলে বলুন তো! সু¨রগড়ের রাজাদের কীর্তি কাহিনী।
ভূতেশ্বর---সোজা কথায় বলুন। জানতে চাইছেন ঐ রাজাদের গুপ্তধনের খবর।
সমর---বেশ বুদ্ধিমান আপনি, ঐ ধনসম্পত্তির মালিক এখন সরকার এবং উদ্ধার হওয়া ধনরত্ন মানব কল্যাণেই ব্যয় হবে, এবার বলুন সব।
ভূতেশ্বর---সব জানাবার আগে, আমার শর্তগুলি শুনুন। প্রথম শর্ত এই ধনসম্পত্তি উদ্ধারের সময়ে সর্বাগ্রে বিশিষ্ট পুরোহিত দিয়ে মহাদেব, কালী, মনসা, কুবের এবং যক্ষের বিশেষ সন্তুùষ্টি পূজা করতে হবে, যজ্ঞ করতে হবে। তারপর পাশে ফাঁকা জমিতে একটি ম¨ির করতে হবে,
ওখানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে শিব, কালীকে এবং নিত্যপূজার ব্যবস্থা করতে হবে। এই সব প্রতিশ্রুতি পেলে, তবেই সন্ধান দেব ঐ গুপ্তধনের। শুনেই সমরবাবু কিন্তুù গুপ্তধন যে পাওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা কি আছে?
ভূতেশ্বর---আছে। ব্রিটিশ সরকারের একটি পুরানো মুদ্রা এবং একটি মোহর আপনাকে দিচ্ছি, এবার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হয়েছে। সমরবাবু হাসতে হাসতে বলেন---এবার যদি আপনাকে গ্রেপ্তার করি, তবে কেমন হবে? হাসতে হাসতে ভূতেশ্বর বাবা বললেন---পারবেন না, বৃথা লোকক্ষয় হবে। চারিদিকে উপরে চেয়ে দেখুন। সমরবাবু চারিদিকে চেয়ে দেখলেন বন্যরা প্রস্তুত আক্রমণ শানাতে। সর্পকুল ফণা ড¥zচিয়ে আছে উপরে পাহারায় চক্কর মারছে বাজ, ঈগল, অন্যসব পক্ষীকুল। এসব দেখে সমর---না, না, একটু তামাশা করলাম আর কি? ঠিক আছে আমার উপরওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে সব জানাচ্ছি, আজ চলে যাচ্ছি।
ভূতেশ্বর---আমাকে না পেলে, ওই ডাবলুকে সব জানিয়ে দেবেন, চালাকি করবেন না। ফল ভালো হবে না।
সমর---না, ওসব কিছু হবে না, কথামতো কাজ হবে। সবাই চলে গেল। ভূতেশ্বর বাবা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন।
সরকার সব দাবি মেনে নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বেশ দ্রুত গতিতেই সব কাজ এগিয়ে চলেছে। এর মধ্যেই ভূতেশ্বর বাবা বিশেষ সভা ডেকেছেন। সব বন্যরাই আমন্ত্রিত এবং বিশেষ আহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিয়াল, বাঘ, হায়না, বন্য কুকুর, চিতা, ঈগল, বাজদের দেওয়া মুরগির মাংস। বাঁদর ও হাতিদের দেওয়া হয়েছে কলা, ছাতু। সর্পকুলদের দেওয়া হয়েছে দুধ, ছোট মাছ। সবাই ভোজনে ব্যস্ত, এমন সময় ভূতেশ্বর বাবা--- বন্যবাবারা, বিশেষ বার্তা দেব এখন, আমাদের এই বনাঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটাই সরকারের ইচ্ছা। তাই আমরা সবাই দক্ষিণের সীমানা পেরিয়ে যে গভীর জঙ্গল আছে, সেখানেই চলে যাব। এখন থেকেই ওখানে আম, জাম, কলার গাছ বসিয়ে দাও, যদিও জানি কিছু ফলের গাছ আছে। আমরা যেমন ছিলাম, তেমনি একত্রে থাকব। মিলেমিশে থাকব। এবার চিতা বলে--- প্রভু ওখানে মাংস পাওয়া যাবে তো!
জবাব দেয় ডাবলু---এখন যেমন বাজার থেকে মুরগির মাংস আসে, তেমনিই আসবে। একটু দূরত্ব বাড়বে। এবার সকলের হয়ে প্রশ্ন করে গজরাজ--- প্রভু, আপনি মাথার উপরে থাকবেন তো, নাকি অন্য কোথাও চলে যাবেন!
ডাবলু---কেন যাবেন, উনি যেতে পারেন না।
এবার ভূতনীমা--- দেখ, আমাদের বয়স হয়েছে, অশরীরী অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।
বন্যরা সমস্বরে---হবে না, মানছি না, মানব না। এবার আসরে নামেন ভূতেশ্বর বাবা--- শোনো, তোমরা আমার সন্তùান, তোমাদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবু... আবার সমস্বরে---বাবা এসব কথা বলবেন না। আমরা জানি আপনাদের ইচ্ছামৃত্যুর বরপ্রাপ্তি ঘটেছে। সুতরাং আপনি এবং
ভূতনীমা আছেন, থাকবেন।
ভূতেশ্বর---বেশ বাবারা, তোমাদের ইচ্ছাই পূরণ হোক। তবে কাজ শুরু করে দাও। এমন সময় সামনে চলে আসে বাজেন্দ্র। সব জানিয়ে দেয় বাবাকে।
এই প্রসঙ্গে কলি, ফলি, দুই বাঁদর বলে--- ওরা জানাচ্ছে কাজ প্রায় শেষের পথে। সম্ভবত কাল নতুন ম¨িরে ঠাকুরদের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে এবং পূজাও হবে।
ভূতেশ্বর---আমি নিজেই যাব সব দেখতে। তোমরাও আশপাশে থাকবে।
পূজা-অর্চনা হচ্ছে। সঙ্গে চলছে পুরানো ম¨ির ভাঙা। হঠাৎই ওখান থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকটা তক্ষক সাপ। ভূতেশ্বর বাবার ইশারায় ওরা দূরে চলে গেল। অভ্যাসমতো হাতিরা শুঁড়ে করে জল এনে মূর্তিগুলোতে ছিটিয়ে দিল। অবাক বিস্ময়ে সমরবাবুর দলবল সব দেখছে। ভূতেশ্বর বাবা সাবধান করে দিয়েছেন সবাইকে, ওদেরকে কেউ বাধা দেবেন না। দিলেই কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে। ওদের পূজা করতে দিন। এরপর এল বাঁদররা, এসে মূর্তিগুলি ফুল, বেলপাতা দিয়ে সাজিয়ে দিল। ঠাকুরের সামনে রাখল জল, বাতাসা।
সমরবাবু---বাবা সাহেব, এবার কোনদিকে খননকার্য করিলে যখের ধন পাওয়া যাবে, ওই দেখুন সরকারি ব¨ুকধারিদের পাহারায় উদ্ধার হওয়া ধনদৌলত চলে যাবে সরকারি তহবিলে।
ভূতেশ্বরবাবা---শিবলিঙ্গের স্থানের নিচেই খনন করুন। শুরু হল খননকার্য। বেশ খানিকক্ষণ খোঁড়ার পরও, সবাই হতাশ। এখনও কোনো গুপ্তধনের সন্ধান নেই।
সমরবাবু উত্তেজিত হয়ে বলেন---এটা কি হল বাবা ভূতেশ্বর,আমাদের সাথে প্রবঞ্চনা? মিথ্যাচার?
শুনেই সামনে আসেন ভূতনী---উনি সিদ্ধ মানুষ ছিলেন, খাঁটি। সৎব্যক্তি পূর্ব জনমে উনি ছিলেন রাজা বীরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। উনি মিথ্যা বলেন না, খুঁড়ে যান। এমন সময়ে গর্তের ভিতর থেকে চারটি বিষধর সাপ বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে ভূতেশ্বর---তোমরা বেরিয়ে যাও, কাউকে আঘাত করবে না, আমিই আদেশ দিয়েছি। সাপ চারটি বেরিয়ে এসে ভূতেশ্বর বাবার পায়ের কাছে প্রণাম করে।
ভূতেশ্বর---যাও, তোমরা দূরে যাও। সতর্ক রক্ষী তোমরা, তোমাদের থাকার উপযুক্ত ব্যবস্থা হবে। আবার শুরু হল খননকার্য। এবার পাওয়া গেল বেশ বড় একটা লোহার ঢাকনা। আয়তাকার ঢাকনার মুখ সরাতেই, দেখা গেল একটা চৌবাচ্চা। তাতে ভর্তি সোনা, মণি, মুক্তা, হিরে, জহরত, অসংখ্য মোহর, স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা ইত্যাদি। এসব দেখেই তবে সাবধান করে দিচ্ছি কেউ লোভবশত একটাও সরাবেন না। সর্পাঘাতে প্রাণ যাবে। দূরে সবাই পাহারায় আছে। এবার সমরবাবু সামনে এসে প্রণাম করতে যান ভূতেশ্বর বাবাকে। স্পর্শ করার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন ভূতেশ্বর ওঝা, আর ভূতনীমা। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখল অবাক করা দৃশ্যাবলী।
ডাবলু---তাহলে পেলেন তো যখের ধন। মানব কল্যাণে লাগাবেন।
সমর---খোকা চল, আমাদের সাথে তোমার খাওয়া পরার সব ব্যবস্থা করে দেব।
ডাবলু---তা হয় না, আমি ভূতেশ্বর বাবা, ভূতনীমা এবং এই বন্ধুদের ছেড়ে কোথাও কোনোদিন যাব না--- এরাই আমার একান্ত আপনজন।