গল্প

গল্প গাছবাড়ি ও সি-বীচ

গাছবাড়ি ও সি-বীচ

লেখক : গাছবাড়ি ও সি-বীচ

ধর্মতলা থেকে দীঘা যাওয়ার ১১৬ বি জাতীয় সড়কের ধারেই পূর্ব মেদিনীপুরের হার্ট নন্দকুমার ব্লকের হলদি নদীর উপর মাতঙ্গিনী সেতু পেরিয়ে, মা নাচীন্দা মন্দির এলাকায় মারিশদা থানার অন্তর্গত দুরমুঠ বাস স্ট্যান্ড থেকে কলেজ রো দিয়ে খানিক যাওয়ার পর কলেজের মাঠ পেরিয়ে জঙ্গল ও শ্মশান ভুমি মিলেমিশে একাকার। গভীর রাতে এই জঙ্গলে তরঙ্গ ধ্বনির মাধ্যমে অজানা রহস্যের কালো বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। জঙ্গলে তরঙ্গের সাথে যুক্ত নাইটজার পাখির ‘চিউব’ হাক ডাক, সঙ্গে সঙ্গে ঝিঁঝিঁর কিরিরিরি ডাক, সব কিছু মিলেমিশে বিরামহীন অদ্ভুত গাম্ভীর্যতার তরঙ্গে জঙ্গল জড়োসড়ো। এই রহস্যের পরিবেশ সবসময় উপভোগ করেন সৌভাগ্যবান সৌম্যকান্তি। সৌম্যকান্তি উপলব্ধি করেন এমন রহস্যময় পরিবেশের স্বাদ পাওয়া সত্যিই আনন্দের, বর্তমানে শুক্লপক্ষ চলছে, কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ণিমার গোল থালার মত চঁাদ যখন উঁকি মারে তখনই ফুটফুটে স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় টি টি পাখিরা বেসুরো করে ডেকে ডেকে মন ভরিয়ে দেয়। সৌম্যকান্তি টি টি পাখির ডাক সবসময় পছন্দ করেন কিন্তু কথা কম বলেন।
জঙ্গলকে আরো সমৃদ্ধ ভাবে দেখার জন্য, আনন্দ উপভোগ করার জন্য গভীর বনাঞ্চলে ছোটখাটো ‘গাছবাড়ি’ বানানো হয়েছে! দুপুরবেলায় আশেপাশে ছাত্রছাত্রীরা ঘুরে বেড়ালেও ক্লাস করলেও খাওয়া-দাওয়ার শেষে এখানে ঘঁাটি গেড়েছে সৌম্যকান্তি ও নিমাই। বাঘ বাবাজি যখনি মড়ি স্পর্শ করার জন্য আসবে, তখনই নিমাই টর্চের আলো ফেলবে, আর সৌম্যকান্তি ঘুম পাড়ানি গুলি ফায়ার করবে। এই সন্ধিক্ষণের জন্য নিঃশব্দ কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষা। শব্দ তো দূরের কথা ফিসফিস করে কথা বলা যাবে না, কাশি পেলেও কাশা যাবেনা।
ক্রমে ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, কলেজের সবাই একে একে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। সৌম্যকান্তি ভেবেছিল সন্ধ্যার সময় হয়তো বাঘ আসতে পারে। বস্তুতঃ‌ সন্ধ্যেবেলায় বাঘ শিকারের সন্ধানে বের হয় কিন্তু সব্বাইকে হতাশ করে বাঘ সন্ধ্যায় আসেনি জঙ্গলে। সাড়া শব্দের জন্য বাঘ সম্ভবত টের পেয়েছে। মোটামুটি একটা আইডিয়া এলো কালকে অবশ্যই আসতে পারে।
রাতে ‘গাছবাড়ি’র আপত্তি জানিয়েছিল বৃক্ষবন্ধু কমল। কিন্তু সৌম্যকান্তি ও নিমাইয়ের মাতব্বরীর কাছে হার মানতে বাধ্য। গভীর জঙ্গলে ভয়ংকর ভাবনা অথচ বাঘের পাত্তা নেই। যেই আসুক না কেন দৃঢ় সংকল্পের সাথে এর জটিল মোকাবেলা করবে সৌম্যকান্তি।
রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে হঠাৎ টি.টি পাখির ডাক শোনা গেল, দুধের মতো জোৎস্না শোভিত আকাশে দুটি পাখি টি.টি টিটিউ ডাকতে ডাকতে উড়ে বেড়াচ্ছে। হুতোম পেঁচা ডাকলো ক্র্যা, ক্র্যা, ক্যাচ ক্যাচ করে। সঙ্গে নাইটজার ও ঝিঁঝিঁর একটানা একঘেঁয়ে ডাকের শব্দে আকাশ বাতাস জঙ্গল মুখরিত।
অপেক্ষার প্রহর চলছে, প্রতীক্ষাও চলছে। বাঘ ধারে কাছে নেই হিংস্র বুনো জন্তুকে ধরতে হলেই ধৈর্যই ও সাহস অবশ্যই প্রয়োজন। যে কোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। আসলে প্রকৃতির অন্দরমহলে ঘোরাঘুরি করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না।
‘নন্দিনী’ জঙ্গলে না এলে সৌম্যকান্তিও জানতে পারতো না শয়তানগুলো এই জঙ্গলে অনেক কিছু করলেও অবশেষে কিছু রয়ে থয়ে গেছে। বাঘ, হরিণ ও হাতি নেই বললেই চলে। জঙ্গল পাতলা হয়ে গেছে।
বেশ কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর হঠাৎ শব্দ কানে এলো, সুবর্ণ সুযোগ ভেবে বন্দুক তাক করে বসেছে। মাংস চিবানোর শব্দ কানে যেতেই কনুইয়ের ঠেলা মারল নিমাইকে। টর্চের আলো ফেলাতেই ডোরাকাটা হলুদ বিদ্যুৎ নজর কাটলো। সৌম্যকান্তি বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিলেই ছড়াৎ শব্দ হলো, কিন্তু বাঘ বাবাজি এক লাফে গভীর জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
টর্চের আলোয় জানা গেল গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, বাঘের শরীরের বিদ্ধ না হয়ে গুলিটা বিঁধেছে মৃত গরুর গায়ে। সৌম্যকান্তি আফসোস করল, ফসকে গেল।
কি ভাবছো এখন?
কি ভাববো? সারারাত নিশব্দে বসে থাকতে হবে, তবে বাঘ কি আর আসবে? সৌম্যকান্তি হতাশা ছুড়ে বলল— আর কোন উপায় নেই, এই সময় গাছবাড়ি থেকে নিচে নেমে আসা মারাত্মক। ধূর্ত বাঘ ওঁৎ পেতে বসে আছে নামলেই ঘ্যাঁক করে ধরে ফেলবে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সৌম্যকান্তি বলল— ধূস আর সহ্য হচ্ছে না, শুধু বসে থাকা, বাঘ সম্ভবত আর আসবে না। সৌম্যকান্তি’র কথা সমাপনান্তে বাঘের ভয়ঙ্কর গর্জন শোনা মাত্রই গুলির শব্দ। একসঙ্গে বহুগুলি। মনে হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আর্তনাদও শোনা গেল। তারপর হঠাৎ চুপ কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৌম্যকান্তি বলল— এবার নেমে যাবো। বাঘ ওঁত পেতে বসে নেই মনে হচ্ছে।
দীঘা-ধর্মতলা বা দীঘা অন্যান্য রুটের বাস সারাদিনরাত চলে। সুতরাং সৌম্যকান্তি’র মন খারাপের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কালবিলম্ব না করে দলবল নিয়ে দীঘার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন, সকালবেলায় দীঘা বর্ডার স্ট্যান্ডে নেমে অটো করে প্রথমে উড়িষ্যার বিখ্যাত বাবা চন্দনেশ্বর মন্দিরে পৌঁছালেন। যত্ন সহকারে পূজা দিলেন। মনসকামনা পূর্ণ করবার জন্য কায় মনোবাক্যে বাবা চন্দনেশ্বর কে ডেকে সৌম্যকান্তি দলবল নিয়ে অটোতে উঠে আবার উদয়পুর সী বিচে পৌঁছালেন। উদয়পুর সী বিচের স্নান ও গান সম্মানের, সরকারি বিধি নিষেধ কিছুটা হলেও শিথিল তাই ভ্রমনপিপাসু মানুষ বেশিরভাগ নাগরিক উদয়পুর সীবিচে অবগাহনে যান। যদিও উদয়পুরের থেকে দীঘা বিশিষ্ট সুন্দর সাবলীল। স্নান পর্ব সমাপ্তি করে পুনঃরায় নিউ দীঘার হোটেলে ফিরে এসে খানিক হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যেবেলা চন্দ্রালোকিত উজ্জ্বল আলোর খেলায় আত্মহারা হয়ে সৌম্যকান্তি ও তার সাগরেদরা অটোতে করে মেরিন ড্রাইভে শংকরপুর ঘোরাফেরা করলেন। শঙ্করপুরের মৎস্য বন্দর সুনাম রয়েছে, তারপর ফিরে আসার পথে ন্যায় কালী মন্দির পড়ে। সৌম্যকান্তি ঘুম ঘুম চোখে কালী মায়ের পূজো দিলেন সবাই মিলে আবার কঁাথির পাশেই, দু’ কিলোমিটার দূরে প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মত দুরমুঠের ‘নন্দিনী’ জঙ্গলে ফিরে এলেন। নিঝুম গ্রাম। কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর্তনাদ কুকুরগুলো সামান্য ভয় পেয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলেও পুনরায় ফিরে এসেছে। নিমাই বলল— বাঘের হাত ও সাপের হাত থেকে রেহাই পেলেও কুকুর বেঘোরে প্রাণ কেড়ে নেবে মনে হচ্ছে।
কলেজের বারান্দায় পৌঁছালো সৌম্যকান্তি ও নিমাই, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাওয়ার বের করল— বয়লার মুরগির মাংস আর পরেরটা এনেছে গ্রামের মোড়ল।
কলেজের সামনে খেলার মাঠের কোন বরাবর ‘নন্দিনী’ জঙ্গল ও শ্মশান। কলেজের সামনেই খালি নিমগাছ। সন্ধ্যেবেলার নির্জন পরিবেশের জ্যোৎস্না স্নাত জঙ্গলে নির্মল আকাশে গোলাকার উজ্জ্বল চঁাদ যেন খিলখিল করে হাসছে। সবকিছু মিলেমিশে নেশা ধরানোর পরিবেশ, তবুও একদল কঠিন হৃদয় মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে এসে মাতব্বরি করে ডিউটি ফাঁকি দিয়ে বাড়ির দিকে উঁকি মারে, হায়রে অসহায় সমাজ ব্যবস্থা।
হঠাৎ জলপান করার উপক্রম হয়েছিল সৌম্যকান্তি’র। এমনসময় জঙ্গলে খুচ খুচ শব্দে কে যেন পায়ে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। মানুষ না বনমানুষ নাকি বন্যপ্রাণী।
নিমাই সতর্কভাবে পিস্তলের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে নিজেকে কোন আক্রমণের জন্য প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত। হেঁটে আসা প্রাণী যদি মানুষ হয় তাহলে নিমাই পিস্তল ব্যবহার করবে। আর বন্যপ্রাণী হলে ঘরের মধ্যে ঢুকে প্রাণীকে ওড়া ফায়ার দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করবে। সৌম্যকান্তি নিমাই ও ভালোবাসার ছেলে মুক্তি মিলে সিদ্ধান্ত নিল আবার জঙ্গলে যাবে। মুক্তির পেছনে নিমাই সতর্ক হয়ে রওনা দিল, হাত দিয়ে রিভালবার শক্ত করে ধরল। বিশ্বাস নেই মুক্তিপদ কে। সত্যি যদি দলবল নিয়ে কেউ যদি আক্রমণ করে তাহলে নিমাই বন্দুক ব্যবহার করতে বাধ্য।
নিমাই এক পা, দু পা করে গুটি গুটি করে জঙ্গলে ঢুকছিল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল রহস্যের অঁাতুড়ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। রোমাঞ্চকর উত্তেজনা ও টানটান আবেগে ওদের শরীর মন স্নায়ু টগবগ ফুটছিল। চারপাশে গুরু গম্ভীর জঙ্গল, জ্যোৎস্না স্নাত জঙ্গল ঠিকই কিন্তু সেই আলো গহন জঙ্গলের তলায় পৌঁছায় না। স্বাভাবিকভাবে নিচে অন্ধকার। পাক্কা পনেরো মিনিট হঁাটার পর নিমাই’রা গোলাকার জায়গায় এসে থামলো। ছোট্ট ডোবা, জ্যোৎসোনার আলোয় জলের সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত শালুক ফুল।
মুক্তিপদ ডোবার অপরপারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল— ওই দেখেন ওইখানে কি যেন পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো ফেলা মাত্র ডোরাকাটা বিদ্যুৎকে দেখে সবাই চমকে উঠেছিল। চিরনিদ্রায় শায়িত মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে ডোবার পাড়ে বাঘ বাবাজি, মনে হচ্ছে বাঘটি মরার প্রাক্কালে এক ঢোক জল খেতে এসেছিল কিন্তু শেষ অবধি জল খাওয়া হলো না গো, বেচারা বাগ বটে। মৃত বাঘ কে দেখে সৌম্যকান্তি নিমাই ও মুক্তির চোখে জল। ভয়ংকর হিংস্র প্রাণী বাঘ অথচ তার এমন অবস্থা, শুয়ে আছে ঘুমোচ্ছে, নিস্তেজ শান্ত।
শুধু মান অভিমান নয়, এক করুণ প্রতিবাদের বিকট ভাবনা উপলব্ধি করতে পারল নিমাই। সেই সুতীব্র প্রতিবাদের তীক্ষ্ণতায় নিমাই বাবাজির হৃদয় খান হয়ে যাচ্ছিল। নিমাই দৃঢ় কন্ঠে চিৎকার করে বলে উঠল —ঐ মৃত বাঘের শিকারি কে এবং কোথায়?

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.