দীপাবলী সংখ্যা
অগ্নিযুগের পাঁচ বীরকন্যা
লেখক : অরুণা সরকার
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে সময়ের সাথে সাথে নারীর মধ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন কন্যা, জায়া, জননী -- এই তিনটি শব্দের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল নারী। এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা ছিল শত শত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় হাজারো বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে কিছু দুর্বার নারী প্রচলিত ছক ভেঙে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে গেছেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। প্রায় দুশো বছর ধরে ব্রিটিশরা তাদের শাসনের বেড়াজালে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য কিছুসংখ্যক আত্মপ্রত্যয়ী সাহসী নারী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে স্মরণযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা বোধ করেননি। আজ এইরকম পাঁচজন বীরকন্যাকে নিয়ে আমার আলোচনা।
স্বপ্নের গতিপথ-ও বুঝি পাল্টায়! প্রতিভাদেবীর আদরের 'রানী' বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্কুলে উষাদির নেকনজরে পড়া পড়াশুনায় তুখোড় এই কন্যা যখন, পুরুষবেশী অসম সাহসী লক্ষ্মীবাঈ-এর,ব্রিটিশদের হাত থেকে ঝাঁসিকে রক্ষা করার গৌরবগাথা শুনতেন, তাঁর সমস্ত সত্তার গোপন থেকে গোপনতম অলিন্দ অন্য এক স্বপ্নের জোয়ারে ভাসতে থাকে। মাতৃভূমিকে বিদেশীদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য আকুল হলেন তিনি। অনুভব করেন ওই তাঁর পথ; যদি বা কিছু বাঁধন বা আগল ছিল ক্ষুদিরাম-কানাইলাল পড়বার পরে সব ঘুচে গেল। রানী হলেন চট্টগ্রামের বাঙালী কন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যিনি মাত্র একুশ বছর বয়সো ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আপোসহীন লড়াই করে বাংলার প্রথম মহিলা শহীদ হয়েছিলেন। এই প্রীতিলতা যিনি কিনা মাকে সবসময় সাহায্য করতেন, মায়ের হাতের বাতাস খেতে খেতে আমগাছের ছায়ায় বসে বাঁশিতে সুর তুলতেন, নাটক লিখে ঘরে ভাইবোনদের দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করাতেন, তিনিই হলেন প্রথম বাঙালী নারী যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বুকে লড়াই-এর আগুন ও তেজ, সঙ্গে প্রতিভা -- মেধাবী প্রীতিলতা ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পান; ঢাকা ইডেন কলেজে আই.এ পড়াকালীন তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব জোরালো এবং সুস্পষ্ট রূপ পায়। তিনি দিপালী সংঘের শ্রীসঙ্ঘ নামক এক বিপ্লবী উসংগঠন এবং সামাজিক কাজে যুক্ত হলেন। প্রতিভা কখনো চাপা থাকে না। প্রীতিলতা আই.এ পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর বেথুন কলেজে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতক হন। আগুনরঙা ফিনিক্স পাখির মত এক বিপ্লবীর পোড়া ছাই থেকে জেগে ওঠে আরেক বিপ্লবী। মাষ্টারদার বিপ্লবী দলের সদস্য, রাজবন্দী এবং মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের বোন এই পরিচয়ে প্রীতিলতা প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন আলিপুর জেলে। মৃত্যুর আগে রামকৃষ্ণ তাঁর অপূর্ব সাংগঠনিক শক্তির উজ্জ্বল সাক্ষর রেখে গেলেন বীরকন্যা প্রীতিলতার কাছে যিনি তখন থেকেই অন্তরে বিপ্লবী কর্মকান্ডে সরাসরি যুক্ত হওয়ার তাগিদ অনুভব করতে লাগলেন। শ্যামলা, রোগা-পাতলা প্রীতিলতা মাষ্টারদার কাছে এই আবেদন নিয়ে দাঁড়ালেন -- স্বাধীনতার লড়াই-এ নারী ও পুরুষ উভয়েরই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা উচিত; মাষ্টারদার জহুরীর চোখ হীরে চিনতে ভুল করেনি। স্নাতকোত্তর পর্বে চট্টগ্রামে শিক্ষিকার নিশ্চিত চাকরী-জীবন এবং সুখী গৃহকোণ ছেড়ে দেশের স্বার্থে বিপ্লবী দলে যোগ দিলেন প্রীতিলতা। তিনি টেলিগ্রাফ কর্মক্ষেত্র ধ্বংস এবং রিজার্ভ পুলিশ লাইন দখলের অপারেশনে জড়িত ছিলেন। জালালাবাদ যুদ্ধে বিস্ফোরক সরবরাহ করেছেন -- প্রীতিলতা শুধু একজন নিষ্ক্রিয় অস্ত্র পরিবহনকারীই ছিলেন না, ঐতিহাসিক মার্শাল আর্ট, লাঠি খেলা এবং বন্দুক যুদ্ধে প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন। অন্যান্য মেয়েদের-ও অস্ত্র তোলার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে মাষ্টারদার সঙ্গে প্রীতির সাক্ষাতের খবর পেয়ে ধলঘাটে ইংরেজ সৈন্যরা বাড়ি ঘেরাও করে। প্রীতিলতা তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইলে মাষ্টারদার সাথে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
ঐতিহাসিক দিন। ১৯৩২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবের বাইরে সাইনবোর্ডে ঝোলানো আছে "কুকুর ও ভারতীয়দের অনুমতি নেই।" মাষ্টারদার পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ মিশন। নেতৃত্বে আছেন প্রীতিলতা, পাঞ্জাবী পুরুষের ছদ্মবেশে। বিপ্লবীরা রাত ১০-৪৫ মিঃ ক্লাবে আগুন লাগান। শুরু হয় তুমুল বন্দুক যুদ্ধ। এক বিরাট রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। প্রীতিলতা মারাত্মক ভাবে আহত হন। তার সহযোদ্ধাদের তিনি পালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন এবং তার পরিবর্তে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন। মাত্র একুশ বছর বয়স তখন। একুশের অঙ্গীকার!
ক্যামেরায় কথা বলছেন বার্কলে গ্রাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজমের তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা, সিঙ্গেলি অ্যাগনিউ। সিঙ্গেলি তথ্যচিত্র তৈরি করবেন ৯২ বছর বয়সী ডাক্তারের জীবন নিয়ে। কানপুরে ডাক্তারের ক্লিনিকে বসেই কথা চলছে। ডাক্তার সিঙ্গেলিকে বললেন, 'লড়াই চলবে।' ইনি কি শুধুই ডাক্তার? নাকি অন্য পরিচয় আছে? ডাক্তারীর ছাত্রী যখন, তরুণী তখনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, ভারতের জাতীয় সেনাবাহিনীর ঝাঁসি রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন, স্বাধীনতার পরপরই কানপুরে শরণার্থী এবং সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মধ্যে তাঁর চিকিৎসা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং অবশেষে স্বাধীনতা - উত্তর ভারতবর্ষে অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন এর সদস্য হিসাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রচার চালিয়েছেন। ইনি হলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ক্যাপ্টেন ডাক্তার লক্ষ্মী সেহগল। মা সমাজকর্মী আম্মু স্বামীনাথনের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুপ্রাণিত হয়ে লক্ষ্মী ধর্মের গোঁড়ামি এবং বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পাশাপাশি আবার মাদ্রাজ কুইন মেরি কলেজ থেকে এম বি বি এস করার পর ১৯৪০ সালে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় ডিপ্লোমা অর্জন করে মাদ্রাজের কস্তুরবা গান্ধী হাসপাতালে ডাক্তার হিসাবে যোগদান করেন। তাঁর বাবা ছিলেন মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাই) হাইকোর্টের আইনজীবী। পাইলটের সঙ্গে অল্প বয়সে বিয়ে হলেও বিয়ে টেঁকেনি। সহৃদয় অথচ লড়াকু মনের লক্ষ্মী একদিকে সিঙ্গাপুরে ভারত থেকে আসা দরিদ্র ও অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ক্লিনিক খোলেন আবার নিজেকে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। সিঙ্গাপুরে জাপানি দখলের সময়, ১৯৪২ সালে, লক্ষ্মী যুদ্ধবন্দীদের চিকিৎসা করেন। সুভাষচন্দ্র বসু এখন সিঙ্গাপুরে। ডাঃ লক্ষ্মী আপ্লুত তাঁর নেতৃত্বদানের ক্ষমতায়। সুভাষচন্দ্র গঠন করলেন INA-এর অল উইমেন ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট। ডাঃ লক্ষ্মী হলেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী, ঝাঁসীর রানী রেজিমেন্টের প্রধান কমান্ডিং অফিসার এবং পরবর্তিতে আজাদ হিন্দের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদে নেতাজীর একমাত্র মহিলা মন্ত্রী। বার্মা ফ্রন্টে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করার পর রেজিমেন্টের প্রধান ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী গ্রেপ্তার হলেন এবং রেঙ্গুনে এক বছরের ও বেশি আটক থাকলেন। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে তাকে আবার ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়। ভারতে ফিরে আসা INA - র নিঃস্ব পরিবারের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন। INA উদ্বাস্তুদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন করেন। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী লাহোরের আই এন এ - র একজন আফিসার কর্ণেল প্রেম কুমার সেহগালকে বিয়ে করেন। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে কানপুরে আসেন। ভারত স্বাধীন হল। ভারত ভাগ হওয়ায় হতাশ হয়ে তিনি পাকিস্তান থেকে কানপুরে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
কবিতাগুলি স্বচ্ছ হীরকখন্ডের মত নিজস্ব দ্যুতিতে উজ্জ্বল। সুললিত ছন্দের কবিতা লিখে ভূষিত হলেন 'The Nightingale of India' -- এই ভূষণে। কবিত্বশক্তির জোরেই তাঁকে বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল পড়ার জন্য। শুধু কি তাই? কবিতার মতোই সমভাবে উজ্জ্বল এবং ব্যতিক্রমী তাঁর মেধা। বয়স তখন মাত্র বারো, ম্যাট্রিকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম হলেন। একের পর এক বাজিমাত! বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও উর্দু, তেলেগু ও ফার্সি ভাষায় সমানভাবে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। কে ইনি? এর সঙ্গে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের কি সম্পর্ক? ইনি হ'লেন বিজ্ঞানী-দার্শনিক-শিক্ষাবিদ ও হায়দ্রাবাদের নিজাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কবি বরদাসুন্দরী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা সরোজিনী। বিয়ের আগের পদবী চট্টোপাধ্যায়, পরে নাইডু। সরোজিনী নাইডু ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করা কালীন ডঃ গোবিন্দ রাজুলু নাইডুর সঙ্গে পরিচয় ; ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর বিয়ে। কবি-চেতনার পাশাপাশি বিপ্লব চেতনায় সম্পৃক্ত এবং সমৃদ্ধ সরোজিনীর ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সক্রিয় অবদান মনে রাখার মতো। বিশিষ্ট বাগ্মী হওয়ার সুবাদে দেশে বিদেশে ভারতীয়দের পক্ষে একজন নেতৃস্থানীয় প্রবক্তা হিসাবেই পরিচিত হন তিনি। সরোজিনীর কবিসত্তা যেমন মায়ের কাছে থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করা, রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের আকাঙ্ক্ষা পৈতৃক সূত্রে লাভ করেন। বাবা অঘোরনাথ রাজনীতিতে অংশ নেওয়ায় তাঁকে কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে পদচ্যুত করা হয়। ভাই বীরেন ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী। রক্ত কথা বলে। ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করার সময় তিনি ভোটাধিকার আন্দোলনের সাথে জড়িত হন। এই অভিজ্ঞতার পর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দিলেন তিনি। ইতিমধ্যে সরোজিনী সমাজকল্যানমূলক কাজে ব্রতী হওয়ায় ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কায়সার-ই-হিন্দ পদক দেন যা তিনি পরে অমৃতসর গণহত্যার প্রতিবাদে ফিরিয়ে দেন। অমৃতসর গণহত্যা নিয়ে এডউইন মন্টাগুর সঙ্গে তাঁর প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ছিল। সরোজিনীর জীবনে মহাত্মা গান্ধীর স্পর্শ যেন জিয়ন-কাঠি। মহাত্মার জাদুস্পর্শে সরোজিনী সোচ্চার হয়ে উঠলেন নারীর মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে, যুবশক্তির বিকাশ নিয়ে। জাতীয়তাবাদ তো সবার উপরে। চম্পারনে নীল চাষীদের হয়ে আন্দোলন, গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে শামিল হন তিনি। দেশের মানুষের স্বার্থে সফর করলেন পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯২৫ সাল। সাক্ষী হয়ে রইল ভারতবর্ষের ইতিহাস। সরোজিনী হলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম ভারতীয় মহিলা সভাপতি --- যা আটবছর আগে ইংরেজ নারীবাদী অ্যানি বেসান্ত দ্বারা হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রচার উদ্দেশ্যে ১৯২৮ - ২৯ - এ আবার উত্তর আমেরিকা সফর। ভারতে ফিরে আসার পরে একের পর এক ঘটনাপ্রবাহ। ১৯৩০ -এ ডান্ডি মার্চে অংশ নিলেন। গান্ধী, নেহেরু ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হ'ল। গান্ধী, আব্বাস তৈয়বজি এবং কস্তুরবা গান্ধীর গ্রেপ্তারের পর ধরসানা সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত-ছাড়ো আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন সরোজিনী। ব্রিটিশ -বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার জন্য ১৯৩০ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার কর্তৃপক্ষের দ্বারা গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হন। ব্রিটিশ আলো। কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিনিধি দলে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে লন্ডনে তিনবার গোলটেবিল আলোচনায় গান্ধীর সাথে ছিলেন। মুথুলক্ষী রেড্ডির সাথে ১৯১৭ সালে তিনি উইমেন্স ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছরে নাইডু অ্যানি বেশান্তের সাথে লন্ডনে সার্বজনীন ভোটাধিকারের পক্ষে কথা বলেন। কবিতার মধ্যেও ছিল দেশপ্রেমের আলো। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৪৮ সালে ভারতের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল হলেন উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল সরোজিনী নাইডু।
দারিদ্র্যের জ্বালায় তাঁকে মাত্র বারো বছর বয়সে ষাট বছরের পাত্রের গলায় মালা দিতে হয়েছিল। ছবছর যেতে না যেতেই অর্থাৎ মাত্র আঠারো বছর বয়সে সিঁথির সিঁদুর গেল ঘুচে। এই দারিদ্র্যের কারণে স্কুলে পড়ার আনন্দ অধরাই থেকে যায়। মনের গোপনে হতাশা না পুষে নিজের শর্তে বেঁচেছেন ইনি। বিধবা হওয়ার পর কারো গলগ্রহ হয়ে থাকেননি। বাপের বাড়ির কাছে নিজের জন্য ছোট হলেও আলাদা আস্তানা গড়ে তোলেন। সেখানে থেকেই মনের ছোট ছোট আশা পূরণ করতে থাকেন। অন্যেরা বিপদে পড়লে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিবেশিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তমলুকের এক সাধারণ কৃষক ঠাকুরদাস মাইতির কন্যা ইনি। লোকে তাকে 'গান্ধীবুড়ি' বলে ডাকে। প্রকৃত নাম মাতঙ্গিনী হাজরা। কাজে-কর্মে-কথায় মহাত্মা গান্ধীকে সর্বান্তকরণে অনুসরণ করায় তাঁর নাম 'গান্ধীবুড়ি। বিপ্লবের আতুরঘর মেদিনীপুরের মেয়ে মাতঙ্গিনীর চোখে তখন ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করার স্বপ্ন। অনুপ্রেরণার উৎস মহাত্মা গান্ধী। বিদেশী পণ্য প্রত্যাখান থেকে শুরু করে, নিজের হাতে চরকা কেটে খাদির কাপড় বানাতেন। ১৯০৫ সাল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। তখন থেকেই মাতঙ্গিনীর লড়াই শুরু। বাকিটা ইতিহাস। ১৯৩২ সাল। দেশজুড়ে লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের ঢেউ সজোরে আছড়ে পড়ল মেদিনীপুরে। মাতঙ্গিনী হলেন এই আন্দোলনের অন্যতম কান্ডারী। এরজন্য কারাগারে রইলেন। লোকেরা একটি ভঙ্গুর বৃদ্ধ মহিলাকে ভ্রুকুটি ছাড়াই কয়েক মাইল হাঁটতে দেখেছিল। দ্রুত মুক্তি পেলেন তিনি। একের পর এক অভিযান। এবারে চৌকিদারি ট্যাক্সের বিলুপ্তি চাই। ফলশ্রুতিতে কয়েকমাস সশ্রম কারাদন্ড। যখন মুক্তি পেলেন, দৃষ্টিশক্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মনের জোর ও সাহসিকতায় শারীরিক পঙ্গুত্ব হার মেনেছে।১৯৩৩ সালে বাংলার গভর্ণর স্যার জন অ্যান্ডারসনকে কালো পতাকা দেখান। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। তমলুক থানা দখল চাই। প্রায় ৬০০০ বিক্ষোভকারীর একটি বিশাল মিছিল। নেতৃত্বে ৭২ বছরের মাতঙ্গিনী। মিছিলের উপর পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলি চলতে থাকে। মাতঙ্গিনী অটল। সকলকে অনুসরণ করতে অনুরোধ করে মাতঙ্গিনী সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। হাতে তেরঙ্গা উঁচু করে ধরা আছে। চারিদিকে বুলেটের ঝাঁ ঝাঁ শব্দ। মাতঙ্গিনীর মুখে মন্ত্র জপের মত 'বন্দে মাতরম স্লোগান'। পরপর, পরপর, পরপর বুলেটের আঘাতে মাতঙ্গিনীর দেহ ক্রমশ রক্তের নদীতে ভাসতে থাকে। হাতে তখনো শক্ত ভাবে ধরা আছে স্বাধীনতার প্রতীক তেরঙ্গা পতাকা।
শিক্ষায়, রূপে, গুণে তেজস্বিনী এক নক্ষত্রের গল্প। মাত্র উনিশ বছর বয়সে এই নক্ষত্রের আলো নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, যখন তাঁকে জীবিত অবস্থায় তাঁর নিজের কাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ে মীরাদেবীর স্বামী, আত্মীয় স্বজনের কাছে মৃত ঘোষণা করার পরে, তাঁর কুশ-পুত্তলিকা দাহ ক'রে ব্রাহ্মণ ডেকে শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন। কে এই তেজস্বিনী? কি ছিল তাঁর দোষ? ইনি হ'লেন পূর্ব বাংলার বরিশাল জেলার অভিজাত ব্রাহ্ম পরিবারের উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং অম্বালিকা দেবীর কন্যা অরুণা গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর দোষ এটাই যে তিনি ভালোবাসায় বয়স-ধর্ম-জাতপাত না মেনে, অচলায়তন ভাঙার বাণী নিয়ে এগিয়ে এসে বিয়ে করলেন তাঁর থেকে বাইশ বছরের বড় মুসলিম কংগ্রেস নেতা ও খ্যাতনামা ব্যারিস্টার আসফ আলিকে। বিয়ের পরে এই বাঙালি কন্যা হ'লেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তী নায়িকা, অরুণা আসফ আলী (১৯০৯ -১৯৯৬) যাঁকে 'জোয়ান অফ আর্ক', 'গ্রান্ড ওল্ড লেডি অফ দ্য ইন্ডিপেনডেন্স মুভমেন্ট' এবং 'হিরোইন অফ ১৯৪২' -- এই নামেও ভূষিত করা হয়। কনভেন্ট শিক্ষিতা এবং নৈনিতালের অল সেন্টস কলেজের স্নাতক, কলকাতার গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলের শিক্ষিকা অরুণার রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে, বিয়ের পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে।তখন থেকেই জীবনকে বাজি রেখে তিনি ব্রিটিশ শাসনকে প্রতিটি পদক্ষেপে চ্যালেঞ্জ জানান। লবণ-সত্যাগ্রহে (১৯৩০) নেতৃত্ব দেওয়ায় এল ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ এবং একবছরের কারাদন্ড। গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি হলেও অরুণা কারারুদ্ধ-ই রইলেন। তাঁর ভয়ে ব্রিটিশ-রাজের হৃদয় কম্পিত। অবশেষে সহবন্দীরা জনবিক্ষোভে ফেটে পড়লে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। এক বছর পর। তিহার জেলে কারারুদ্ধ অরুণা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন বন্দীদের সাথে আচরণের বিরুদ্ধে । এই প্রতিবাদে স্তব্ধ ব্রিটিশেরা তখনি তাঁকে আম্বালার নির্জন কারাগারে পাঠালেন; তবে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলে তিহার জেলের উন্নতি হয়। গান্ধীর চাপের কারণে অবশেষে তাঁর মুক্তি ঘটে। ১৯৪২ সালের আগস্টে ভারত-ছাড়ো প্রস্তাবের দমনমূলক প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের নেতাদের গ্রেপ্তার করে। অরুণা আসফ আলি ৯ই আগস্টের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ও গোয়ালিয়র ট্যাঙ্ক ময়দানে কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন করেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁর জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে, তিনি আত্মগোপনে চলে যান ও একটি আন্ডারগ্রাউন্ড আন্দোলন শুরু করেন। কংগ্রেসের মাসিক ম্যাগাজিন ইনকিলাব সম্পাদনা করেন। ১৯৪৬ সালে ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার হলে তিনি আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন। স্বাধীনতার পরে তিনি দিল্লীর প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালে অরুণা আন্তর্জাতিক লেনিন শান্তি পুরস্কার, ১৯৯১ সালে জওহরলাল নেহরু পুরস্কার, ১৯৯২ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ১৯৯৭ সালে মরণোত্তর ভারতরত্ন পুরস্কার পান।
দেশকালের বর্তমান পটভূমিতে, সভ্যতার সংকটে যখন আমাদের অতীত গৌরব ধূলিসাৎ হতে চলেছে এই অগ্নিকন্যার সংস্পর্শে আমরা নতুন করে জেগে ওঠার মন্ত্র খুঁজে পাই। তাঁদের মূল্যবান স্মৃতি আমাদের ঐশ্বর্যবান করে, বেগবান করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে অলোকসামান্য অগ্নিকন্যাদের শক্তি ও সাহসের স্মৃতিযাপন, আমাদের কাছে উত্তরণের প্রেরণা এবং আধুনিক পৃথিবীর প্রকৃত মুক্তিবেদ।