প্রবন্ধ

প্রবন্ধ দীপাবলী সংখ্যা

আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে

দীপাবলী সংখ্যা

আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে

লেখক : অমিতাভ মাইতি


দিনটা ছিল ১৯৪১ সালের ২৫শে জুলাই। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের রূপকার সাহিত‍্যে নোবেল লরিয়েট(১৯১৩-১৯৪১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবারের মতো তাঁর কর্মযজ্ঞের পীঠস্থান, সাধের শিক্ষাকেন্দ্র বিশ্বভারতী (শান্তিনিকেতন) ছেড়ে চলেছেন জন্মভূমি কলকাতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ সময়কালটা গুরুদেবের স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভালো ছিল না। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী গুরুদেব জীবনের শেষ চার বছর দীর্ঘস্থায়ী রোগে বেশ কাবু হয়ে পড়েছিলেন। রোগের নাম অর্শ (Piles)। এই চার বছরে দুবার দীর্ঘসময় অসুস্থ অবস্থায় শয‍্যাশায়ী ছিলেন। ১৯৩৭ সালে একবার জ্ঞান হারিয়ে প্রায় কোমায় চলে গিয়েছিলেন। সেই সময় কবি মৃত্যুকে যে খুব কাছ থেকে প্রত‍্যক্ষ করেছিলেন তা তাঁর সেই সময়কালের লেখা থেকে স্পষ্ট জানা যায়। ১৯৪০ সালের শেষদিকে আবার একই ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এবার আর সেরে উঠা হয়নি।

১৯৪০ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর কবি শান্তিনিকেতন থেকে পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর কাছে দার্জিলিং থেকে ৫০ কিমি পূর্বে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৭১০০ ফুট উচ্চতায় পাইন আর ওক গাছের সারি ঘেরা ছোট্ট শৈলশহর কালিম্পং গিয়ে উঠলেন। প্রসঙ্গক্রমে জানাই কবি প্রথম কালিম্পং এসে উঠেছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর শৈলনিবাস 'গৌরীপুর হাউসে' ১৯৩৮ সালের ২৫শে এপ্রিল। এই বাড়িতে থাকাকালীন কবি লিখেছেন 'জন্মদিন' সহ 'সেঁজুতি'র একাধিক কবিতা, কিছু পত্র ও প্রবন্ধ। হিংসায় উন্মত্ত বিশ্বব‍্যাপী যুদ্ধকামীদের প্রতি মৈত্রীর বার্তা দিয়েছেন এই 'গৌড়ীপুর হাউসে' বসেই। তবে এই বাড়ি তথা কালিম্পং শহর ইতিহাসের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে বাংলা ১৩৪৫ (ইং১৯৩৮) সালের ২৫শে বৈশাখ তারিখটির জন‍্য। এইদিনই কালিম্পং-এ প্রথম টেলিফোন সংযোগ হয় আর সেই টেলিফোন উদ্বোধনের মধ‍্য দিয়ে জন্মদিন উপলক্ষে লেখা স্বরচিত কবিতা জনগণের উদ্দেশ্যে আবৃত্তি করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতাটি ছিল

"আজ মম জন্মদিন। সদ‍্যই প্রাণের প্রান্তপথে
ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে
মরণের ছাড়পত্র নিয়ে..."
(কবিতা : জন্মদিন, কাব‍্যগ্রন্থ : সেঁজুতি)



সেদিন কবিকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাতে মংপু থেকে এসেছিলেন ড. মনোমোহন সেন, মৈত্রেয়ী দেবী ও চিত্রিতা দেবী। কলকাতা থেকে এসেছিলেন প্রবোধকুমার সান‍্যাল, সঙ্গে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা আর কবির প্রিয় অমল হোমের পাঠানো একটি সুদৃশ‍্য কলম। এসেছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা শাখার অধ‍্যক্ষ নিরঞ্জন মজুমদার। সেদিন কবি "গৌড়ীপুর হাউসের" একটি দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে বসে টেলিফোনে 'জন্মদিন' কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন আর কলকাতার আকাশবাণী ভবন থেকে সেই ফোন রিসিভ করে সারা ভারতবর্ষে সম্প্রচার করা হয়। কবি মোট চারবার কালিম্পং-এ এসে 'গৌড়ীপুর হাউসে' উঠেছিলেন। শেষবারের আসা এই ১৯৪০ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর। কবির মৃত্যুর পর অবশ‍্য পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর নামে কবিরই কেনা 'গৌড়ীপুর হাউসে'র ঢিলছোড়া দূরত্বে জমিতে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ি তৈরি করেছিলেন। বাড়িটির নাম কবিরই ঠিক করা রথীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের স্টুডিয়ো 'চিত্রভানু'র নামাঙ্কিত।


কালিম্পঙে ১৯৪০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর রাতে কবি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দার্জিলিং থেকে ছুটে আসেন সিভিল সার্জন। কবির রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল প্রস্টেট গ্ল‍্যান্ডের সমস‍্যা। তখনই অপারেশন না করলে জীবন সঙ্কটের রায় দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতিমা দেবী ও মৈত্রেয়ী দেবী এই অপারেশন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগের অধ‍্যক্ষ ও সাহিত‍্যিক রামকুমার মুখোপ‍্যাধায়ের লেখা থেকে একথা জানা যায়। টেলিফোনে জরুরী খবর পেয়ে কলকাতা থেকে সেদিন রাতের দার্জিলিং মেলেই ডা. সত‍্যসখা মৈত্র, ডা. অমিয়নাথ বসু ও কবিবন্ধু ডা. নীলরতন সরকারের ভ্রাতুষ্পুত্র ডা. জ‍্যোতিপ্রকাশ সরকারকে সঙ্গে নিয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ রওনা হন। কালিম্পং পৌঁছে কবিকে পরীক্ষা করা পর চিকিৎসক টিম তৎক্ষণাৎ কবিকে কলকাতা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। কালিম্পং থেকে প্রায় অচৈতন‍্য অবস্থায় গুরুদেবকে নিচে নামিয়ে আনা হয়। একটা স্টেশন ওয়াগনের সিট খুলে ফেলে কবির জন‍্য বিছানা করা হয়। ড্রাইভারের পাশে পালা করে বসে পরামর্শ দিচ্ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও সুরেন কর। কবির পাশে ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। পথের মাঝে বাগানের মজুরের দল নিয়ে ডা. মনোমোহন সেন জল-কাদার মধ্যে রাস্তা ঠিক করাচ্ছিলেন যাতে ঝাঁকুনি কম হয়। রাত্রি ন'টা নাগাদ পাঁচ ছ'খানা গাড়ির কনভয় শিলিগুড়ি পৌঁছে অচৈতন‍্য রবীন্দ্রনাথকে কলকাতাগামী ট্রেনে তোলা হয়। এটাই ছিল কবির পাহাড় তথা উত্তরবঙ্গের শেষ যাত্রা। রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার খবর পেয়ে শিলিগুড়ি রেলওয়ে স্টেশন লোকে লোকারণ‍্য। মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা থেকে জানা যায় যে, দু'টি কামরা বুক করা হয়েছিল। একটিতে কবির সঙ্গে ডাক্তারদের মেডিক্যাল টিম, সুরেন কর ও মৈত্রেয়ী দেবী আর অন‍্যটিতে প্রশান্তচন্দ্র বাকীদের নিয়ে। যে স্টেশনেই ট্রেন দাঁড়ায় উৎকন্ঠিত মানুষের ভিড়। গভীর রাত পযর্ন্ত স্টেশনে স্টেশনে স্নেহব‍্যাকুল জনতার উচ্ছ্বাস ছিল। নিশিথ রাতে উড়োখবর ছিল রবীন্দ্রনাথের চিরবিদায়ের। তাই তাদের পরমাত্মীয়ের শেষ মুহূর্তের স্পর্শটুকু পাবার আকুল আর্তিটুকু পৌঁছে দেওয়ার উন্মাদনা।

কলকাতায় ফিরে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রায় একমাস শয‍্যাশায়ী থাকার পর শান্তিনিকেতন ফিরে যেতে ব‍্যাকুল হওয়া কবিকে ১৮ই নভেম্বর, ১৯৪০ তাঁর আত্মার শান্তিস্থল শান্তিনিকেতনে ফিরিয়ে আনা হল। 'উদয়ন' বাড়িতে কবিকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নার্সসহ রাখা হল। তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। নিজহাতে লিখতে পারতেন না বলে শ্রুতিলিখনের জন‍্য ব‍্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী ও স্নেহধন‍্যা বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও সুলেখিকা রানী চন্দকে দ্বায়িত্ব দেওয়া হল। শান্তিনিকেতন ফিরে কবি সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। এরমধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রস্টেট গ্ল‍্যান্ডের সমস্যা আরো বেড়ে গেল। অ‍্যালোপ‍্যাথি, হোমিওপ্যাথি ও কবিরাজি কোন ওষুধেই তেমন কাজ হচ্ছে না।



প্রাবন্ধিক ও শান্তিনিকেতনের ডাক্তার শ‍্যামল চক্রবর্তীর লেখা থেকে জানা যায় যে, ১৯১৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন পারিবারিক বন্ধু ও কিংবদন্তি ডাক্তার নীলরতন সরকার (যাঁর নামে কলকাতার শিয়ালদহ অঞ্চলে অবস্থিত বিখ্যাত নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হসপিটাল)। ডা. সরকার কখনও কবির অর্শ অপারেশন করার পক্ষপাতী ছিলেন না। অস্ত্রোপচারের কথা উঠলেই তিনি অন‍্য ডাক্তারদের বলতেন যে, "যাঁর অস্ত্রোপচারের কথা হচ্ছে তিনি মানুষটা কিন্তু সাধারণ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর ওঁনার শরীর এই অস্ত্রোপচারের ধকল নিতে পারবে বলে মনে হয় না। তার থেকে ঔষধে থাকলে ওঁনার জীবনটা আরো কিছুদিন থাকবে।" আর কবি নিজেও অস্ত্রোপচারে আগ্রহী ছিলেন না। কবি প্রায়ই বলতেন, "মানুষকে তো মরতেই হবে একদিন। একভাবে না একভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ। মিথ‍্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কি প্রয়োজন?"



এদিকে কবির শারীরিক অবস্থা ক্রমশ নিম্নগামী এবং যন্ত্রণায় যথেষ্ট কষ্ট পাচ্ছিলেন। আবার ১৯৩৯ সালে হঠাৎ পত্নী বিয়োগে ডাক্তার নীলরতন সরকার পাকাপাকিভাবে গিরিডিতে বসবাস করতে শুরু করেন। অগত‍্যা সেইসময় আর এক নামকরা চিকিৎসক ও ডা. সরকারের পুত্রসম ছাত্র ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের শরণাপন্ন হতে হল। ডা. বিধানচন্দ্র রায়, ডা. ললিতমোহন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ও ডা. ইন্দুভূষণ বসু শান্তিনিকেতনে এসে কবিকে পরীক্ষা করে দ্রুত অর্শ অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও অনান‍্য কবির সুহৃদ আশ্রমিকরা শলাপরামর্শ করে অস্ত্রোপচারের সপক্ষে মত দেন। কবি অস্ত্রোপচারে প্রথম থেকেই নিমরাজী ছিলেন। তাই অস্ত্রোপচার চূড়ান্ত হলে সকলকে আবারও অনুরোধ করেন ড. নীলরতন সরকারের সঙ্গে গিরিডিতে যোগাযোগ করতে। দুঃখের কথা সেই সময় সকলেই একপ্রকার মিথ‍্যের আশ্রয় নিয়ে কবিকে জানিয়েছিলেন যে গিরিডিতে ডা. সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সেই অস্ত্রোপচারের সুবাদেই কবি আজ প্রাণের শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলেছেন কলকাতায় জোড়াসাঁকোর পূর্ণ জন্মভূমিতে।

অপারেশন করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শান্তিনিকেতন থেকে কলিকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা পাকা হ'ল। ঠিক হ'ল সকাল সাড়ে ন'টার (09.30 hrs.) ট্রেনে (বিশেষভাবে তৈরি সেলুন কার) গুরুদেবকে কলিকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। কবির শারীরিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ। হয়তো এটাই তাঁর প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তিস্থল স্বপ্নের শান্তিনিকেতনের পাঠ চুকিয়ে শেষ বিদায়ের পালা। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও কবির বিশেষ স্নেহভাজন শৈলজারঞ্জন মজুমদার ঠিক করলেন কলিকাতায় রওনা হওয়ার আগে কবিকে গান গেয়ে বৈতালিক করে ঘুম ভাঙাবেন। আগের দিন শৈলজারঞ্জন গানের দলের ছেলেমেয়েদের ডেকে তাঁর মনের ইচ্ছা জানালেন এবং ছাত্রছাত্রীরা রাজী কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। ওরা সবাই সাগ্রহে রাজী হলেন। যেহেতু রিহার্সাল করার সময় ছিল না, তাই extempore গান হবে ঠিক হ'ল। গানের শিক্ষক শৈলজারঞ্জন গানটা ঠিক করে দিলেন এবং রাত্রে রান্নাঘরে ঘোষণা (announce) করলেন যে, আগামীকাল ভোরে লাইব্রেরীর বারান্দার সামনে সকলে জড়ো হবে বৈতালিকের জন্য এবং যে যেমন পারবে গানটা করবে।



গুরুদেব উদয়নের দোতলায় থাকতেন। তাই নিদিষ্ট দিনে উত্তরায়নের গেটের ভিতর দিয়ে গিয়ে উদয়নের কবির ঘরের জানালার নীচে দাঁড়িয়ে ভোরের আধো-অন্ধকারে সকলে সমবেত কন্ঠে গানটা গেয়ে বৈতালিক ক'রে গুরুদেবের ঘুম ভাঙালেন। গুরুদেব বহু কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সকলকে দর্শন দিলেন এবং বৈতালিকের গানটা সাদরে গ্রহণ করলেন, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সকলে ধন্য হয়ে ফিরে গেলেন। সেইদিনের 'গীতালি'র গানটা ছিল



"এ দিন আজি কোন্ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার? আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার?
কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে,
উষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার..."



(রাগ : বাউল, তাল : দাদরা, পর্যায় : পূজা-আনন্দ, রচনাকাল : ২৪শে আশ্বিন, ১৩২১/১১ই অক্টোবর, ১৯১৪) প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধগয়া ভ্রমণে গিয়ে সেখানে একদিন (১১ই অক্টোবর, ১৯১৪) প্রাতঃকালে উপরের গানটা লিখেছিলেন ভগবান বুদ্ধকে স্মরণ করে।

শরীর যে আর টানছে না। অসম্ভব দুর্বল তার ওপর থেকে থেকে প্রস্টেট গ্লান্ডের ব‍্যথা। যে রবীন্দ্রনাথ পরিচিত মহলে প্রায়ই বলতেন, "আর সবার শরীর আর রবীন্দ্রনাথের শরীর এক নয়।"



কারণ একটাই অটুট সুস্বাস্থের অধিকারী ছিলেন তিনি। 'মহেন্দ্রনিন্দিতকান্তি উন্নতদর্শন' শ‍্যামা নৃত‍্যনাট‍্যের বজ্রসেনের অলক্ষ‍্যে যেন তিনি নিজের সৌম‍্য মূর্তির কথা বলতে চেয়েছেন। ছ'ফুট দু'ইঞ্চি দীর্ঘ দেহ, চওড়া বুক, সবল পেশীশক্তি, আজানুলম্বিত মহাভূজ, চওড়া স্কন্ধ, সিংহের মত গ্রীবা। বিধাতা যেন উজাড় করে দিয়েছেন। এমন রূপ-স্বাস্থ‍্য, মেধা-ব‍্যক্তিত্ব যা কোটিতে একটা মেলে। ছেলেবেলা থেকে কুস্তি, সাঁতার, এমনকি টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়েছেন, সেই মজবুত শরীরের মধ্যে কখন যে এসে বাসা বেঁধেছে অসুখ তিনি নিজেই আঁচ করতে পারেননি। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "ক্লান্তি শব্দটা বাবামশাইয়ের অভিধানে ছিল না। তাঁর ঘুম ছিল খুব কম, কখন যে তিনি ঘুমোতেন, কেউ জানতে পারতাম না।" সেই রবি আজ ক্লান্তিতে অবসন্ন, ব‍্যথা-যন্ত্রণায় জর্জরিত। গত চার বছর যাবৎ শরীর যেন আর চলতে চায় না।



প্রসঙ্গক্রমে জানাই কবি অর্শর (piles) সঙ্গে প্রস্টেট গ্লান্ডেরও সমস‍্যা ছিল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ‍্যাপক সব‍‍্যসাচী বসুরায়চৌধুরী বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথের শেষ সময়টা কীভাবে কেটেছিল, গবেষকদের কাছে তা হয়তো নতুন নয় কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এই তথ‍্যের অনেকটাই প্রায় অজানা। কবির প্রকৃতপক্ষে কী রোগ ছিল, তা নিয়েও এখনও উঠে নানা মত। আমাদের কাছে প্রস্টেট ক‍্যান্সার ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকরা সম্প্রতি প্রমাণ পেশ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষদিকে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রস্টেট ক‍্যান্সারে। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ‍্যটা সাধারণ মানুষের কাছে জানানো জরুরী ছিল। তবে এ নিয়ে বিতর্ক বা গবেষণা চলতেই পারে।"



রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ অবস্থায় কালিম্পং থেকে কলকাতা হয়ে শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে সেই আগের মতো আর প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি অনুভব করতে পারছেন না। যিনি কিনা কারও সেবা নিতে চাইতেন না, তিনি আজ বড় অসহায়। বাধ‍্য হয়েই সেবক-সেবিকার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। এমনকি ডিকটেশন দিয়ে যিনি কোনদিন লিখতে হবে ভাবেননি, আজ তাও করতে হচ্ছে। মানসিক দিক থেকে কবি যেন আরো ভেঙে পড়েছেন। একটা অস্থিরতা শরীরের ভেতর কাজ করছে। কখনও চেয়ারে একটু বসছেন তো পরক্ষণেই বিছানায় শুয়ে পড়ছেন। আবার কখনও জানালার ধারে আরামকেদারায় বসে প্রতিমা দেবীর সাজানো বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখেন সৃষ্টির বিচিত্র লীলা। অনুভব করেন জীবন যেমন আছে, মৃত্যুও তেমন আছে। অস্বীকার করলে চলবে না যে মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোন মূল‍্যই থাকে না। তবুও জীবনের তরী যে এত তাড়াতাড়ি ডুবতে চায়! কবি যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। এ যেন নিজের মনের সঙ্গে আত্মার লড়াই।

মৃত্যু! মানব জীবনে বারবার আসে না, আসে একবারই। মানব জীবনের অত‍্যন্ত মৌলিক তথা গুরুত্বপূর্ণ প্রত‍্যয় হল 'মৃত্যু'। এই সত‍্য হতে কবি কখনও বিচ‍্যুত হতে চাননি। কিন্তু মৃত্যুকে কবি এইভাবে গ্রহন করতে রাজি নন। এতো পরাজয়, ভীরুতার পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব‍্যে মৃত্যু চেতনা সম্পর্কে বিভিন্ন আঙ্গিকে ব‍্যাখ‍্যা ও বর্ণনা করেছেন। উপনিষদ ছিল কবির আমৃত্যু সখা -- "সত‍্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম আনন্দ রূপম মৃতম যদ্বিভাতি।" অর্থাৎ "তিনি সত‍্য, তিনি জ্ঞান, তিনি অনন্ত। এই অনন্ত সত‍্যে, অনন্ত জ্ঞানে তিনি আপনাতে আপনি বিরাজিত। তিনি যে আনন্দিত, তিনি যে রসস্বরূপ, ইহাই আমাদের নিকট প্রকাশমান।" এই ছিল তাঁর প্রতিদিনের ধ‍্যান মন্ত্র, তাঁর সমস্ত জীবন ও অসংখ্য সৃষ্টিধারা এই উপনিষদীয় ভাবনার ফলশ্রুতি। তাইতো তিনি উপনিষদীয় ভাবনার বরপুত্র। কবির সব চিন্তার মাঝে লুকিয়ে আছে এই উপনিষদের দর্শনের মর্মবাণী -- "ইশা বাস‍্য মিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগতাং জগত" অর্থাৎ
"এই গতিশীল জগতে যা কিছু চলমান বস্তু আছে ঈশ্বর বাসের নিমিত্ত মনে করিবে।" রবীন্দ্রনাথের গদ‍্য-পদ‍্য, নিবন্ধ-প্রবন্ধ, গল্প-উপন‍্যাস এবং গানের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে দর্শনে এই নিগূঢ় রহস‍্য। চিন্তার সব অংশের মাঝে তিনি ছিলেন ঋজু, যার মর্মার্থ গিয়ে পৌঁছেছে বেদান্ত দর্শনের অন্তমূলে। তাইতো কবি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন একান্তে, গ্রহণ করেছেন মিত্ররূপে, কল্পনা করেছেন একান্ত সখা ও প্রেয়সী রূপে। মৃত্যুকে দূর থেকে যতটা নিষ্ঠুর ও নির্দয় মনে হয় -- কাছে আসার পর সে অহেতুক ভয় ভেঙে যায়। আসলে কবি বলতে চেয়েছেন, মৃত্যু কখনই কবির থেকে বড় নয়, বরং কবিই মৃত্যুর থেকে বড় এই উপলব্ধি কবিকে সান্তনা দেয়। কাজেই জন্ম-মৃত‍্যু যেন এক সূত্রে গাঁথা এক অভিন্ন চেতনার নাম। তাইতো 'মৃত্যুঞ্জয়' কবিতায় কবি বলেছেন --

"... যত বড়ো হও, তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও। আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে।"

আবার কখনও মৃত্যুকে কবি বলতে চেয়েছেন -- অতি নিচ, অনুদার, সর্বগ্রাসী এবং সার্থপর। তাকে ভয় হয় তবুও এই মৃত্যু সত‍্য যাকে কখনই অস্বীকার করা যায় না, এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মৃত্যু অমোঘ। তাইতো কবি বলেছেন -- "মৃত‍্যু অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে... এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত‍্যয়, মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়..."

রবীন্দ্রনাথ বয়সের ভারে ন‍‍্যুব্জ হয়েছেন, কিন্তু মনের গহীনে তিনি আজও চির নবীন, চির সবুজ। কবি এখনও কাঙাল প্রেমের, ভালোবাসার। তাইতো মৃত্যুকে তিনি ভেবেছেন পরম প্রণয়ী আত্মার -- "মরণ রে, তুঁহু মম শ‍্যামসমান"। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু নিয়ে অনেক ভেবেছেন। কবির অধিকাংশ কবিতা ও গানে পরমাত্মায় নিবিষ্ট হওয়ার গভীর আকুতি প্রতিভাত। পরমপুরুষের সান্নিধ‍্য লাভের মধ্য দিয়েই কবি যে পরম সুখের সন্ধান করেছেন তা অনন্ত জীবনেরই ইঙ্গিতবাহী। কবি বিশ্বতানকে জীবন তরঙ্গের সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করেছেন তাঁর সৃষ্টির মধ‍্য দিয়ে। জীবনের শত ধারার স্নানে সকল অপূর্ণতা, নির্দিষ্টের সীমানা পার করে অসীমের অমরত্ব লাভ। কবির অনুভবে মৃত্যু জীবনের অপর নাম। জন্মজন্মান্তর সে অনন্ত যাত্রাপথের পথপ্রদর্শক, কখনো সে মহাকালের মহামিলনদূত, কখনো সে রহস‍্যময়তায় ঘেরা, তবুও সে সর্বতাপ বিমোচনকারী অনিন্দসুন্দর! তাইতো কবির কন্ঠে শোনা যায় -
-
"জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতাসুধারসে এসো।
...বাসনা যখন বিপুল ধুলায়
অন্ধ করিয়া অবোধ ভুলায়

ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।"
(রাগ : দেশ, তাল : একতাল, পর্যায় : পূজা, রচনাকাল : ১৩১৬ বঙ্গাব্দ/১৯১০ খৃষ্টাব্দ)
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় মৃত্যু আদতে জীবনেরই এক অধ‍্যায়। তাইতো মরণের স্রোতে বারবার সিক্ত হয়ে জীবনের অসম্পূর্ণতাকে পরিপূর্ণতায় দিকে নিয়ে গেছেন শত দুঃখ বেদনার মধ‍্য দিয়ে। সারাজীবন প্রিয়জনের বিয়োগ ব‍্যথায় কাতর হয়েছেন। ব‍্যথাতুর হৃদয়ে কলম ধরেছেন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে কিন্তু কখনো কর্তব্যে খামতি ছিল না। কোন মৃত্যুই তাঁকে থামাতে পারেনি। তাইতো কবি লিখছেন
--
"নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা।
মন রে মোর, পাথারে হোস নে দিশেহারা।
বিষাদে হয়ে ম্রিয়মাণ বন্ধ না করিয়ো গান,
সফল করি তোলো প্রাণ টুটিয়া মোহকারা..."

(রাগ : সাহানা, তাল : নবতাল, পর্যায় : পূজা, রচনাকাল : ১৩০৯ খৃষ্টাব্দ/ ১৯০৩ বঙ্গাব্দ)

রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তিগত জীবনে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে একের পর এক নিকট পরমআত্মীয়কে চির বিদায় জানাতে হয়েছে শত ইচ্ছার বিরুদ্ধে। কবি এক সময় ভেবেছিলেন 'শেষ' করে দেবেন নিজেকে! কারণ, তাঁর জীবনে মরণের কী নিরবচ্ছিন্ন বিধ্বংসী খেলা!

১১ই মার্চ, ১৮৭৫ সাল। কবি তখন মাত্র ১৪ বছরের কিশোর। মৃত্যু কি তা প্রথম উপলব্ধি করলেন জন্মদাত্রী মা, সারদা সুন্দরী দেবীকে {১৮২৭(?) - ১৮৭৫} হারিয়ে। মধ্যরাত্রে দাসী যখন চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল তখন তাকে কিশোর রবির কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যান নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, পাছে কিশোর রবির মনে আঘাত লাগে। রবি ঠাকুরের কথায় --
"প্রভাতে উঠিয়া যখন মা'র মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপর শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ঙ্কর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না। কেবল মনে হ'ল এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।"

২১শে এপ্রিল, ১৮৮৪। একদিন চতুর্দোলায় চড়ে মাত্র ন'বছর বয়সে যে ছোট্ট লাজুক শ্যামলা মেয়ে গোধূলি লগ্নে সিঁদুর রঙের লাল রাঙা চেলি পড়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের হাত ধরে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ছোট্ট রবির খেলার সাথী, নতুন বৌঠান হয়ে এসেছিলেন। যাকে দেখে ভৃত‍্যমহলে দমবন্ধ করা পরিবেশে ছোট্ট রবির মনে হয়েছিল, এতদিন যে রাজার বাড়ি খুঁজে পায়নি, সেই বাড়িটার খবর নিয়ে এল এই রূপকথার রাজকন্যা যে তাকে ডানা মেলে দিগন্তে উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাবে। যে কিনা তাঁর বাল্য থেকে কৈশোরের মুক্তির আলোর দিশারী। যাঁর প্রেরণায় বালক রবি একদিন কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে শুধু রবীন্দ্রনাথ থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন। স্নেহের ঠাকুরপো যাকে কল্পনা করে বলেছিলেন, নারী অর্ধেক মানবী, অর্ধেক কল্পনা। রোমান্টিক স্বপ্ন-সঞ্চারিণী সেই নতুন বৌঠান ওরফে কাদম্বরী দেবী (জুলাই ৫, ১৮৫৯- এপ্রিল ২১, ১৮৮৪) আজ লাল রঙের বেনারসি পড়ে সিঁথিতে রক্তরাঙা লাল সিঁদুর মেখে পালঙ্কে শুয়ে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে নশ্বর দেহে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে এক অব্যক্ত বেদনা নিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন। তাই তো রবীন্দ্রনাথ নতুন বৌঠান চলে যাওয়ার পর বলেছিলেন -
-
"ভাগ্যিস নতুন বৌঠান মারা গিয়েছিলেন, তাই আজও তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখছি -- বেঁচে থাকলে হয়তো বিষয় নিয়ে মামলা হত।" ২৩শে নভেম্বর, ১৯০২। আবার সেই দোলাচলের ছোঁয়া! 'ছিন্নপত্রাবলী'-তে কবি লিখেছিলেন, "ব্যক্তি হিসাবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা কত উৎকট, যার মধ্যে কোনও সান্তনা নেই। কিন্তু বিশ্বজগতের হিসাবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা অতি সুন্দর ও মানবাত্মার সান্ত্বনাস্থল।"

শান্তিনিকেতন থেকে অসুস্থ কবি জায়াকে আনা হ'ল জোড়াসাঁকোয়। মায়ের সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ থেকে গেলেন। এর পর একদিন, কবি জায়া মৃণালিনী দেবীর (১৮৭৩- সেপ্টেম্বর ২৩, ১৯০২) তখন বাকরোধ হয়েছে। রথীন্দ্রনাথকে ডেকে মায়ের বিছানার পাশে বসালেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনীর দু'চোখ দিয়ে তখন শুধুই অঝোর জলের ধারা। কোন এক অনির্দিষ্ট আশঙ্কায় কবি শান্তিনিকেতন থেকে বাকী ছেলেমেয়েদের জোড়াসাঁকোয় আনালেন। এক অনির্দিষ্ট আশঙ্কায় তাঁদের সারারাত কাটল নির্ঘুম। অবশেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সেই রাত্রে চলে গেলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী। সারাটা রাত ছাদে একা পায়চারি করে কাটালেন রবীন্দ্রনাথ। বলে গেলেন কাউকে তাঁর কাছে না যেতে। "আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে/ বসন্তের বাতাসটুকুর মতো...।" নিভে গেল জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে মৃণালিনীর ঘরের সব আলো। রইলেন এক আকুল কবি আর মা-হারা তাঁর পাঁচটা ছেলেমেয়ে। ভিড়ে, আদরের আড়ালে আর রইল নিজের অনুবাদের খাতার শেষ মলাটে দেবনাগরী অক্ষরে মৃণালিনীর নিজের হাতে লিখে রাখা, অনিঃশেষ ভালোবাসা আর বেদনায় ভেজা এক যন্ত্রণাকাতর কবির সংসারের সাতটা তারার নাম।

১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯০৩। পরের পর মৃত্যুশোক। কবির সবচেয়ে আদরের দুরন্তপনা মেজমেয়ে রেণুকা ওরফে রানী (১৮৯০-১৯০৩) কখন যেন বুকে বাঁধিয়ে বসেছে মারণরোগ যক্ষ্মা। তখন যক্ষ্মা হলে ফিরে আসত না প্রায় কেউই। কবি তখন অসুস্থ রানীকে নিয়ে ছুটলেন আলমোড়ায়। পাইন গাছের শান্ত-স্নিগ্ধ, নিবিড় ছায়ায় যক্ষ্মাক্রান্ত রানীকে সুস্থ করার চেষ্টায়। সেখানেই লিখে ফেললেন 'শিশু' কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা। তারপর স্নেহের রানীকে সেই সব কবিতা পড়ে শোনাতেন, যাতে রানী রোগযন্ত্রণা ভুলে কিছু সময়ের জন্য ভাল থাকে। কিন্তু মৃত্যু যে অতীব ভয়ঙ্কর। তাই তো মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে এই অসহায় মেয়েটার আর্তনাদ অসহায় পিতৃহৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। আলমোড়া থেকে রানীকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসার পর এমনি একদিন বন্ধুপ্রতিম রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে জানতে চাইলেন, "রেণুকার শরীর কেমন আছে।"

প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "আজ সকালে সে মারা গিয়েছে।" সেদিন রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে রামেন্দ্রসুন্দর স্থির হয়ে গিয়েছিলেন। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, কতটা মানসিক যন্ত্রণাবিদ্ধ হলে একজন মানুষ এই সহজ সরল উত্তর দিতে পারেন। রানীর মৃত্যু এই সমস্ত প্রশ্নকে নিস্তব্ধ, নিথর করে দিয়েছিল।
স্বজনহারার মৃত্যু মিছিল দেখতে দেখতে রবীন্দ্রনাথ মংপুতে একবার মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন, আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনও আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি -- "তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নিদিষ্ট পথে।"
যতদূর জানা যায় প্রাণাধিক প্রিয় পত্নী ও স্নেহের মেজকন্যা রানীর মৃত্যুর পর কবি বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নিচের এই গানটা লিখেছিলেন --
"আছে দুঃখ,আছে মৃত্যু,
বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ,
তবু অনন্ত জাগে..
." (রাগ : মিশ্র, তাল : একতাল, পর্যায় : পূজা, রচনাকাল : ১৩০৯ বঙ্গাব্দ (১৯০৩ খৃষ্টাব্দ)। পরবর্তীতে ১৯০৭ সালে কবি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (১৮৯৫-১৯০৭) মাত্র ১২ বছর বয়সে হারিয়েছিলেন।

১৯২৩ সালে মৃত্যু পথযাত্রী শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়কে (স্বনামধন্য শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র এবং বিশ্বখ্যাত চিত্রপরিচালক ও স্বনামধন্য সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের পিতা) রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো দেখে এসে বলেছিলেন -- পূর্ণস্বরূপের বিশ্বে আমরা ফাঁক মানতে পারব না। এই কথাটি আজ এত জোরের সঙ্গে আমার মনে বেজে উঠেছে তার কারণ সেদিন সেই যুবকের মৃত্যু শয্যায় দেখলুম সুদীর্ঘকাল দুঃখভোগের পরে জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মত অত বড় বিচ্ছেদকে, প্রাণ যাকে পরম শত্রু বলে জানে, তাকেও তিনি পরিপূর্ণ করে দেখতে পেয়েছেন। তাই আমাকে গাইতে অনুরোধ করেছিলেন --

"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে...।"

আসলে সৃষ্টিশীল রবীন্দ্রনাথের জীবনে অর্ধসময়ের বেশি ছিল এক আত্মপ্রত‍্যয়ের অধ‍্যায়। এই বিশেষ পর্বে আমরা কবিকে বারংবার পাই নবরূপে নব কলেবরে। চির অতৃপ্ত এ মানবাত্মাটি এই সময়ে নিজেকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন সাহিত‍্য সৃষ্টির নব নব অধ‍্যায় রচনার মধ‍্য দিয়ে। সাধারণ মানুষ হয়েও তিনি যে ব‍্যতিক্রমী আত্মা, তার পরিচয় পাই যখন স্বল্প সময়ের ব‍্যবধানে একের পর এক পরমাত্মীয়কে অকালে হারিয়েও তিনি নতুন সৃষ্টির খেলায় মেতে ওঠেন।

২৫শে জুলাই ১৯৪১, 'উদয়ন' থেকে আশ্রমের মোটরগাড়ি বেরিয়ে গোটা আশ্রম ঘুরে চলল বোলপুর-শান্তিনিকেতন রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। কবি আধশোয়া অবস্থায় বসে আছেন, পাশে বসে নাতনি নন্দিতা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছে। উত্তরায়ন প্রাঙ্গণের দু'পাশে সারিবদ্ধ ছাত্রছাত্রীরা গাইছেন --

"আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন। তার আকাশ-ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে, মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত‍্যই নূতন..."

(রাগ : ইমন, তাল : দাদরা, পর্যায় : বিচিত্র, রচনাকাল : ১৩১৮ বঙ্গাব্দ/১৯১১ খৃষ্টাব্দ)

সাধের রবীন্দ্রভবন, ছাতিমতলা ঘুরে রান্নাঘর আর গৌর প্রাঙ্গণের কাছে চৌমাথায় গাড়ী যখন পৌঁছল। সামনে কতগুলো নতুন আলোকস্তম্ভ লাগানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। কবি নাতনিকে জিজ্ঞেস করলেন -- "হ্যাঁরে এগুলো কি হচ্ছে?" নাতনি নন্দিতা উত্তর দিল -
- "আমাদের নতুন আলো আসছে।" তখন কবি ম্লান হেসে বললেন -- "ও তোদের পুরানো আলো চলল বুঝি?" নির্বাক নন্দিতা ছলোছলো আঁখিতে কবিরই একটা গান গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন --
"দীপ নিবে গেছে মম নিশীথসমীরে,
ধীরে ধীরে এসে তুমি যেয়ো না গো ফিরে।
এ পথে যখন যাবে
আঁধারে চিনিতে পাবে --
রজনীগন্ধার গন্ধ ভরেছে মন্দিরে...।"

(রাগ : বেহাগ, তাল : অর্ধঝাঁপ, পর্যায় : প্রেম, রচনাকাল : ১৩২৮ বঙ্গাব্দ/১৯২১ খৃষ্টাব্দ)

এটাই ছিল গুরুদেবের শান্তিনিকেতন থেকে শেষযাত্রা। তাইতো আশ্রম চিকিৎসক শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ‍্যায়কে ডেকে বলেছিলেন, "শচী, আমার আশ্রম রইল, আশ্রমবাসীরাও রইলেন। তুমি দেখে রেখো।" সেদিন পুরো আশ্রমবাসী দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল চোখে কবিকে বিদায় জানিয়েছিল।
১৯৪১ সালের ২৫শে জুলাই বেলা তিনটে পনের মিনিটে রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে পৌঁছোলেন। খবরটি গোপন থাকায় হাওড়া স্টেশন বা পথে তেমন ভিড় ছিল না। কেবল হাওড়া স্টেশনে দেবকী বসুর উদ‍্যোগে নিউ থিয়েটার্সের বাস কবিকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আনার জন‍্য অপেক্ষা করছিল। জোড়াসাঁকোয় পৌঁছে মহর্ষি ভবনের দোতলায় 'পাথরের ঘর'-এ গুরুদেবকে রাখা হল। সারাদিনের ট্রেন ভ্রমণ, তার উপর গরমে কবি বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হল পাথরের ঘরে। ভীষণ ক্লান্তিতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। বললেন, "আমাকে এখন নাড়াচাড়া করো না, এইভাবেই থাকতে দাও।" তাই আর খাটে তোলা হল না। অল্প সময় বাদে স্ট্রেচারে ঘুমিয়ে পড়লেন। এই পাথরের ঘরের পূর্বদিকের বারান্দায় রবীন্দ্রনাথের অস্ত্রোপচারের জন‍্য রীতিমতো একটা অপারেশন থিয়েটার বানানো হয়েছিল। সময়কালের কথা চিন্তা করলে বাড়িতে জীবানুমুক্ত করে এরকম একটি অপারেশন থিয়েটার সত‍্যিই বিস্ময়কর। জোড়াসাঁকোয় শেষের দিনগুলি অসুস্থ কবিকে সারাক্ষণ দেখাশোনা করতেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের স্ত্রী নির্মলকুমারী (রানী) মহলানবিশ। অত কষ্টের মধ্যেও কবি তাঁকে মজা করে বলতেন 'হেডনার্স'। প্রয়োজনে নির্মলকুমারী দেবী কবির কাছ থেকে উঠলেই রীতিমতো হুমকি দিয়ে কবি ভয় দেখাতেন, "শেষ পর্যন্ত এমন একটা অসুখ বাঁধাবো তখন দেখি আমার হেডনার্স কি করে যায়।" নির্মলকুমারী মহলানবিশের "বাইশে-শ্রাবণ" বই থেকে জানা যায় যে মৃত্যু সম্পর্কে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই বলতেন, "মৃত‍্যু না থাকলে জীবনের কোন মানে নেই। আর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে জীবনকে না দেখলে অমৃতের সন্ধান মেলে না। এ জীবন মরণের খেলা দিয়েই জগৎ সত্য হয়ে উঠেছে।"
মৃত্যু সম্পর্কে কবির ধারণা নিয়ে তাঁরই খাস মুন্সী ও লিপিকার সুধীরচন্দ্র করের প্রবাসী পত্রিকায় ১৩৪৮ -এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় লেখা "অস্তগামী রবির দিনলিপি" থেকে জানা যায় যে, কোনদিনও কবি মৃত্যু পথের বীভৎস‍্যতাকে কিংবা তার অনিশ্চয় ভয়কে মনে আমল দেননি। বরং জীবনের প্রথম থেকেই মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি তাঁর লেখনিতে প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম জীবনে "মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে" বলে শুরু করলেও মধ‍্য জীবনে লিখলেন, "বৈরাগ‍্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়" আর শেষ জীবনে রোগশয‍্যায় ৩০শে জুলাই সকাল সাড়ে ন'টায় স্নেহধন‍্যা বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও সুলেখিকা রানী চন্দকে (রবীন্দ্রনাথের ব‍্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী) ডেকে বললেন কবিতা লিখতে হবে --

"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী..."

(কবিতাটি পরে শেষ লেখা কাব‍্যগ্রন্থে স্থান পায়, কবিতার নাম 'সৃষ্টির পথ')।

গোটা জীবনে তিনি বহু আপনজনের মৃত্যুর সারি দেখেছেন। মৃত্যুলোক বারবার তাঁকে বিধ্বস্ত করতে চেয়েছে কিন্তু সাময়িক মুষড়ে পড়লেও কখনো পরাভূত হননি। ১৯০০ সালের নভেম্বরে কলকাতা থেকে স্ত্রী মৃণালিনীকে লিখেছিলেন, "বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে... মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনাতো নেই -- শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত‍্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখো তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।" তাই তো মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কন্ঠে কবি বলতে পেরেছিলেন, "করি না ভয়, তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া, / দাঁড়াব আমি তব অমৃত-দুয়ারে।"
২৫শে জুলাই জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ পৌঁছোনোর পর বিকেলের দিকে কিছু স্বজন দেখা করতে এলেও তিনি কারোর সঙ্গে সেভাবে কথা বলতে পারলেন না। সন্ধ্যার দিকে খানিকটা দুর্বলতা অনুভব করলেও সারারাত বেশ স্বস্তিতেই ঘুমিয়েছেন। ২৬শে জুলাই সকালটা কবি বেশ ফুরফুরে ছিলেন। এরপর আশি বছরের ছোটকাকা রবীন্দ্রনাথ আর সত্তর বছরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ অতীতের নানা কথা স্মরণ করে প্রাণখুলে হাসিঠাট্টা করলেন। বিকেল সাড়ে চারটার সময় ডাক্তার সত‍্যেন্দ্রনাথ রায় গ্লুকোজ ইনজেকশন দেওয়ায় ব‍্যথা অনুভব করে কবি বললেন, "দ্বিতীয়া, গেল সব জ্বলিয়া।" এরপর কবির কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। পরেরদিন ২৭শে জুলাই, সকালে ইনজেকশনের প্রভাব কেটে গেলে ঝকঝকে কবি হাসিমুখে রানী মহলানবিশকে বললেন, "জানো আজও আর একটা কবিতা হয়েছে সকালে। এ কী পাগলামি বল তো? প্রত‍্যেকবার ভাবি এই বুঝি শেষ, কিন্তু তারপরেই দেখি আবার একটা বেরোয়। এ লোকটাকে নিয়ে কি করা যাবে?" কবিতাটি ছিল 'শেষ লেখা' কাব‍্যগ্রন্থের 'প্রথম দিনের সূর্য' --

"প্রথম দিনের সূর্য / প্রশ্ন করেছিল / সত্তার নূতন আবির্ভাবে, / কে তুমি -- / মেলে নি উত্তর...।"
ওইদিন বিকেলে তাঁকে দেখতে আসা আত্মীয়স্বজন ও অন‍্যান‍্য সুহৃদদের রসিকতা করে বললেন, "ডাক্তাররা বড় বিপদে পড়েছে। কতভাবে রক্ত নিচ্ছে, পরীক্ষা করছে কিন্তু কোন রোগই পাচ্ছে না তাতে। এ তো বড় বিপদ ডাক্তারদের। রোগী আছে, রোগ নেই।"
২৯শে জুলাই বিকেলে (মতান্তরে ৩০শে জুলাই সকালে) রানী চন্দকে ডেকে লেখালেন, "দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে / এসেছে আমার দ্বারে; / ...ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি -- / মৃত‍্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।"
এ কোন রবীন্দ্রনাথ। সারাজীবন যিনি মৃত্যুকে সাদরে আলিঙ্গন করেছেন বেঁচে থাকার অঙ্গ হিসাবে। তবে কেন আজ এই অনর্থ পরাজয় তাঁকে গ্রাস করছে।
৩০শে জুলাই ঠিক হয়েছিল কবির শরীরে অস্ত্রোপচার হবে কিন্তু একথা কবিকে জানতে দেওয়া হয়নি। সকালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, "কবে অপারেশন হবে।" প্রত‍্যুত্তরে রথীন্দ্রনাথ জানালেন, "কাল-পরশু হতে পারে।" এমন সময় ডাক্তার ললিতমোহন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় এলেন। কবি তাকেও অপারেশনের কথা জিজ্ঞাসা করায় ডাক্তার ললিত বললেন, "আজকের দিনটা ভালো আছে। তাহলে আজই অপারেশন সেরে ফেলি কি বলেন? রবীন্দ্রনাথ একটু হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, 'আজই?' এরপর রানী চন্দের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তা ভালো। এরকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো।" তারপর রানীকে বললেন লিখে নে তো -- "অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে / সে পায় তোমার হাতে / শান্তির অক্ষয় অধিকার।" একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কবি রানীকে বললেন 'সৃষ্টির পথ' কবিতার সঙ্গে এই তিন লাইন জুড়ে দিস। এটাই কবির শেষ লেখা কবিতা। এরপর আচ্ছন্ন অবস্থায় কবির কন্ঠে শোনা গেল, 'মা-মণি!'
গুরুদেবের মুখে 'মা-মণি' ডাক শুনে রানী চন্দ তৎপর হলেন। 'মা-মণি' অর্থাৎ পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী নিজের অসুস্থতার জন‍্য 'বাবামশায়'কে ছেড়ে শান্তিনিকেতনে পড়ে আছেন। সেই জন‍্য দুঃখ করে বাবামশায়কে চিঠিও লিখেছেন। সেই চিঠি কবিকে পড়ে শোনানো হয়েছে। কি মনে হল রানী চন্দ আচ্ছন্ন কবির কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে বললেন, "শুনছেন গুরুদেব?" বার কয়েক ডাকার পর কবি মৃদু সারা দিলেন। রানী বললেন, "বৌঠান বড় ভাবনায় আছেন আপনার জন‍্য। একটা চিঠি লিখবেন বৌঠানকে?" রবীন্দ্রনাথ আচ্ছন্ন অবস্থায় বলতে থাকলেন আর রানী লিখে নিলেন। শেষে কলম নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে নিচে লিখলেন 'বাবামশায়'। এটাই রবীন্দ্রনাথের শেষ হস্তাক্ষর।
আগেই পাথরের ঘরের বাইরে পূর্বদিকের বড় বারান্দায় অপারেশন থিয়েটার তৈরি করা ছিল। বেলা এগারটায় রবীন্দ্রনাথকে স্ট্রেচারে করে অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে আনা হল। চারিদিকে সাদা কাপড়ে ঘিরে দেওয়া হল। এই অপারেশনে ডা. ললিতের সঙ্গে ছিলেন ডা. অমিয় সেন, ডা. সত‍্যসখা মৈত্র ও মেডিক্যাল টিমের অন‍্যান‍্যরা। পুরো অ‍্যানেসথেসিয়া ব‍্যবস্থা থাকলেও লোকাল অ‍্যানেসথেসিয়া করা হয়। প্রস্টেট কাটা নয়, তলপেটে একটা ফুটো করে ইউরিন বের করে দেওয়ার রাস্তা করে দেওয়া হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় একে "সুপ্রা পিউবিক সিস্তোস্কোপি" বলা হয়। অপারেশন চলাকালীন কবি সমস্তটাই টের পেয়েছেন এবং ভালই যন্ত্রণা উপভোগ করেছেন। প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট অপারেশন হয়। বেলা বারটা নাগাদ কবিকে বেডে দেওয়া হয়। বিকেলের দিকে বেশ ব‍্যথা অনুভব করেছিলেন। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ডা. ললিতমোহন কবিকে দেখতে এসে জিজ্ঞাসা করেন, "অপারেশন চলাকালীন আপনার ব‍্যথা লেগেছিল?" শত কষ্টের মধ্যেও স্বভাবসুলভ রসিকথায় জবাব দিলেন, "কেন মিছে মিথ‍্যে কথাটা বলাবে আমাকে দিয়ে।" তবে সেদিন রাত্রে কবির ভালই ঘুম হয়েছিল। কিন্তু ১লা আগস্ট থেকে কবির শরীরে অবনতি শুরু হয়। প্রবল হিক্কা উঠতে থাকল। ২রা আগস্ট কিছুই খেতে চাইলেন না। শুধু বললেন, "আহ! আমাকে জ্বালাসনে তোরা।"
৩রা আগস্ট থেকে কিডনির স্বাভাবিক কাজ প্রায় বন্ধ বলা যেতে পারে। টেলিগ্রাম পেয়ে সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেনে স্নেহের অসুস্থ 'মা-মণি' অর্থাৎ পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এলেন। সঙ্গে কৃষ্ণ কৃপালিনি ও বাসন্তী। ৪ঠা আগস্ট সকালে চার আউন্সের মতো কফি খেলেন। জ্বর আগের থেকে বেড়ে গেছে। ৫ই আগস্ট প্রায় কোমায় চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। শেষ চেষ্টা হিসাবে অপারেশনের একটি সেলাই খুলে ফেললেন ডা. ললিতমোহন। সন্ধ্যার দিকে ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে কবিকে দেখতে এলেন বন্ধুবর ডা. নীলরতন সরকার। অভ‍্যাসবশে নাড়ি দেখলেন ডা. সরকার। কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না। বার বার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝলেন আর কিছু করার নেই। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে চরম অসহায়তা। ধ্বন্বন্তরি ডাক্তার তিনি, কিন্তু এ যেন অর্জুনের হাত থেকে গাণ্ডিব খসে পড়েছে। উঠে যাবার আগে পরম মমতায় বন্ধুর কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপর উঠে দাঁড়ালেন। হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার কাছ থেকে বার কয়েক ফিরে চাইলেন। বুঝতে পারলেন এই শেষ দেখা। দু'চোখে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। হয়তো নীরবে বলে গেলেন, 'হে বন্ধু, বিদায়'। এদিন রাতেই ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের আদেশে স‍্যালাইন দেওয়া হল। মজুত রাখা হল অক্সিজেন। নাকটা বাঁদিকে হেলে গেছে, আর বাঁ চোখটাও লাল হয়ে ক্ষুদ্রাকৃতি হয়েছে। ৬ই আগস্ট শেষ আশা হিসাবে কবির ব‍্যক্তিগত কবিরাজ বিমলানন্দকে ডাকার কথা বললেন মীরা দেবী কিন্তু রুগী তখন হাতের বাইরে তাই ডা. রায়ের আপত্তিতে কবিরাজের মত নেওয়া হল না। স্নেহের 'মা-মণি' প্রতিমা দেবী কানের কাছে মুখ এনে ডাকলেন, 'বাবামশায়!' এ ডাক উপেক্ষা করার নয়। তাইতো মনে হল ধ‍্যানমগ্ন ঋষি একবার তাকিয়ে দেখলেন। নির্মোহ নির্লিপ্ত দৃষ্টি। হয়তো বা সীমা নয়, অসীমের উদ্দেশ্যে মেলে ধরা। রূপ নয় অরূপকে দেখার আকুতি। একটু নড়ে উঠলেন 'বাবামশায়'। রাত বারটার পর শরীরের আরো অবনতি হল।

এদিকে আকাশবাণী থেকে অবিরত কবির আগাম মৃত্যুর অমৃতলোকে পথযাত্রার ধারাভাষ‍্য শুরু হয়ে গেছে। শেষ দেখার জন‍্য অগনিত মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে। প্রাণের মানুষকে দেখার জন‍্য মানুষ আজ উন্নাদ হয়ে উঠেছে। সকলের গন্তব্য মহর্ষি ভবনের দোতলার 'পাথরের ঘর'। জনতার চাপে কোলাপসিবল গেট ভেঙে পড়ল। অতি উৎসাহী কেউ কেউ জল নিকাশি পাইপ বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে থাকা শ‍্যামাপ্রসাদের তখন কিংকর্তব‍্যবিমূঢ় অবস্থা।

৭ই আগস্ট ১৯৪১(২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮)। ভোর থেকে মোটরগাড়ির আনাগোনা শুরু হল জোড়াসাঁকোর সরু গলিতে। ক্রমে রাতের আঁধার সরে ভোরের আকাশ ফর্সা হল। পূবের দিগন্তে রোজকার মতো লাল গোলাকার সূর্য উদিত হল বটে কিন্তু এই সিঁদুরভাঙা ভোরে ত্রিভুবনের কোথাও যেন আনন্দধারা বইছে না, সবাই আজ এক মোহন মৃত্যুর মুখোমুখি -- মনে ভাবনা, আর কতক্ষণই বা এই অনিন্দ‍্যনিন্দিতকান্তি নশ্বরলোকে দৃষ্টির মধ্যে আবদ্ধ থাকবেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় গুরুদেবের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে উপাসনা করলেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে সংস্কৃত মন্ত্র পড়লেন, "ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি / নমস্তেহস্তু মা মা হিংসীঃ...।" বাইরের বারান্দায় কেউ যেন গুণগুনিয়ে গেয়ে উঠলেন, 'কে যায় অমৃতধামযাত্রী।'
সকালে শেষবেলায় কবিকে দেখতে এলেন ডা. বিধান রায় ও ডা. ললিতমোহন। সকাল ন'টায় দেওয়া হল অক্সিজেন। ক্ষীণ শব্দে নিঃশ্বাস পড়ছে। সেই নিঃশ্বাস ক্রমশ ক্ষীণতর হয়ে গেল বাইরের সংযোগ সত্ত্বেও। পায়ের উষ্ণতা ধীরে ধীরে কমে গেল। পায়ের কাছে অবিরাম পড়া হচ্ছিল তাঁর জীবনের বীজমন্ত্র, 'শান্তম, শিবম্, অদ্বৈত‍্যম'। ১লা আগস্ট থেকে প্রায় নির্বাক আচ্ছন্ন কবি হয়তো বা যোগনিদ্রায় মগ্ন। ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হল অক্সিজেনের নল। বেলা বারটা দশ নাগাদ কবির ডান হাতটা একটু উঠেই নেমে গেল। একটা তীব্র আর্তস্বর ভেসে এল ঘর থেকে, "গুরুদেব আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।"
কবির প্রাণহীন নশ্বরদেহ পড়ে রইল ঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ যাত্রার জন‍্য ঘরের দরজা বন্ধ করে কবিকে তৈরি করা হচ্ছিল। এমন সময় উন্মত্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার বাঁধভাঙা ঢেউ আছড়ে পড়ল বন্ধ দরজায়। দরজার ছিটকানি ভেঙে গেল। তখন কবির নিরাভরণ, প্রাণহীন দেহটিকে স্নান করানো হচ্ছিল। কি লজ্জা! হোক না শবদেহ, তবুও কৌতূহলী মানুষের অপমানের হাত থেকে নিস্তার পেলেন না। রানী মহলানবিশের লেখনি, "যে মানুষের মন এত স্পর্শকাতর ছিল, যে মানুষ বাইরের লোকের সামনে নিজের ব‍্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা কখনও প্রকাশ করতে পারতেন না, সেই মানুষটার আত্মাহীন দেহখানা অসহায়ভাবে জনতার কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে পড়ে রইল।"
মনে পড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। রক্ত ফাটা মাটিতে দাঁড়িয়ে সেদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভেবেছিলেন এই ধ্বংসের ভেতর দিয়েই আত্মপ্রকাশ ঘটবে সৃষ্টির। কিন্তু কবি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন জীবন আর খুব বেশি দিন দেবে না তাঁকে। এমনই এক আসন্ন নববর্ষের প্রভাতে বৈতালিকের জন‍্য শান্তিদেব ঘোষ ও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবদারে রচনা করলেন মানবের জয়গান। সুরারোপ করলেন স্বয়ং কবি। কিন্তু একদিনে ধকল নিতে না পারার জন‍্য সুরারোপ হল দু'দিনে। স্বরলিপি করে দিলেন শান্তিদেব ঘোষ। কবির প্রিয় ভৈরবী আঙ্গিকের গান। সকালের প্রথম প্রহরের, যে ভোর নবজীবনের বোধন গাইছে ---
"ওই মহামানব আসে।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক --
এল মহাজন্মের লগ্ন...।"
(রাগ : ভৈরবী, তাল : কাহারবা, পর্যায় : আনুষ্ঠানিক সংগীত, রচনাকাল : ১লা বৈশাখ ১৩৪৮(১৪-০৪-১৯৪১)।
এরপর ভরা গ্রীষ্মে, নিজের শেষ জন্মদিনের দু'দিন আগে কবি আরো একটা গানের জন্ম দিয়েছিলেন। তথ‍্যগতভাবে এটাই রবীন্দ্রনাথের লেখা শেষ গান। কিন্তু গানটি কবিতা হিসাবে ১৩২৯ বঙ্গাব্দে কবিরই লেখা 'পূরবী' কাব‍্যগ্রন্থের 'পঁচিশে বৈশাখ' কবিতার অংশ বিশেষকে সামান‍্য বদল করে সুরারোপ করেছিলেন স্বয়ং গুরুদেব নিজেই। এটিও ভৈরবী আঙ্গিকের গান -
- "হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার
জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।
তোমার প্রকাশ হোক
কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন...।"
(রাগ : ভৈরবী, তাল : কাহারবা, পর্যায় : আনুষ্ঠানিক সংগীত, রচনাকাল : ২৩শে বৈশাখ ১৩৪৮ (০৬-০৫-১৯৪১)।
রবীন্দ্রনাথের শেষ ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতনের উদার উন্মুক্ত নীলাকাশের তলায়, তাঁর সৃষ্টির মাঝখানে প্রকৃতির কোলে শান্ত স্তব্ধ কোলাহল মুক্ত পরিবেশে বিলীন হতে যেখানে থাকবে না কলকাতার উন্মাদনা কিংবা জনতার জয়ধ্বনি। ১৯৩০ সালের ২৫শে অক্টোবর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে আগাম এক চিঠিতে লিখেছিলেন, "আমার শ্রাদ্ধ যেন ছাতিম গাছের তলায় বিনা আঢ়ম্বরে বিনা জনতায় হয় -- শান্তিনিকেতনের শালবনের মধ্যে আমার স্মরণের সভা মর্ম্মরিত হবে, মঞ্জরিত হবে, যেখানে যেখানে আমার ভালোবাসা আছে, সেই সেইখানেই আমার নাম থাকবে।" কিন্তু সেদিন তাঁর অন্তিম ইচ্ছাকে সম্মান জানানোর কেউ ছিলেন না। যদিও কবিরই দেওয়া নাম 'আকাশবাণী' রেডিও মারফত শান্তিনিকেতন প্রথম গুরুদেবের অনন্তলোকে যাত্রার খবর পায়। সেদিন আশ্রমবাসী তাদের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কবির প্রাণহীন দেহ হয়তো তারা শান্তিনিকেতনের মাটিতে আনাতে পারেননি কিন্তু তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী কণিকা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, শান্তিদেব ঘোষ সহ আরো অনেকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পাঠভবন গ্রন্থাগার থেকে উপাসনালয় পযর্ন্ত "সম্মুখে শান্তি পারাপার -- / ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।" গানটি সমবেত কন্ঠে গেয়ে গুরুদেবকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।
গ্রীষ্মপোড়া দেশে চৈত্র-বৈশাখ এমনিতেই খুব নিষ্ঠুর দু'টি মাস। সামনে অনন্ত দহন। গ্রীষ্মের দারুণ অগ্নিবাণে যখন ধরিত্রী ফেটে চৌচির, শুষ্ক কাননশাখে ক্লান্ত কপোত ডাকে করুণ স্বরে, জীবজগৎ দগ্ধপ্রায়, চাতক এক ফোঁটা জলের জন‍্য আকাশের পানে তাকিয়ে হাহাকার করে ঠিক তখনই শ্রাবণের অঝোর ধারার বারি সমস্ত দহন মিটিয়ে কবিকে ছাড়পত্র ধরিয়ে দেয় বৈতরণী পারের মুক্তির স্বাদ পেতে। আজ সেদিন সমাগত। তাই কবির শেষ গানের পাশাপাশি আড়ালে বেজে চলবে তাঁরই শেষ ইচ্ছানুযায়ী আর এক গান --
"সম্মুখে শান্তিপারাপার --
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার...।"
প্রসঙ্গক্রমে জানাই, ১৩৪৬ -এর এক ভরা শীতে রবীন্দ্রনাথ এই গান লিখেছিলেন 'ডাকঘর' নাটকে অভিনয়ে ব‍্যবহারের জন‍্য। সেই অভিনয় আর হয়নি। স্নানের পর সাদা বেনারসির জোড় পরানো হল। পরনে কোঁচানো ধুতি, গরদের পাজ্ঞাবী, পাট কড়া চাদর গলার নিচ থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো। কপালে চন্দন টিকা, গলায় গোড়ের রজনীগন্ধার মালা, দু'পাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল রজনীগন্ধা। রানী চন্দ কবির বুকের উপরে রাখা হাতে ধরিয়ে দিলেন পদ্মকোরক। যেন রাজবেশে রাজা ঘুমোচ্ছেন রাজশয‍্যায়। শান্তকন্ঠে ধীরে লয়ে ব্রহ্মসংগীত বাজছিল। বাড়ির ভেতর উঠোনে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু নকশা এঁকে মিস্ত্রিদের দিয়ে গুরুদেবের শেষ যাত্রার পালঙ্ক প্রস্তুত করলেন। ঠাকুরবাড়ির নিয়মে মধ‍্যাহ্নে প্রয়াণ হলে বিকেলের মধ্যে তাঁর শেষকৃত‍্য সম্পন্ন করতে হবে। বাঙালির মনের আকাশ জুড়ে আজ নেমেছে অঝোরে বৃষ্টি। অপরাহ্ন তিনটের দিকে লাখো জনতার ভিড়ের মধ‍্য দিয়ে কবির শবদেহবাহী শকট বেরলো জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে চিরবিদায়ের পথে। ধরিত্রীর ক্ষুদ্রতা ছাড়িয়ে অনন্তলোকে যাত্রা শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ।
"বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়,
পায় অন্তরের নির্ভয় পরিচয়
মহা-অজানার...।"
হয়তো মৃত্যুর শেষ ছাপিয়ে তিনি খুঁজে নিতে চাইছেন মহা-অজানার অন‍্য নক্ষত্রলোক। আকাশবাণী থেকে ভরাট গলায় কবির শেষযাত্রার ধারাভাষ‍্য দিচ্ছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। হঠাৎ ইথার তরঙ্গে ভেসে এল স্বরচিত কন্ঠে কাজী নজরুলের কবিতার লাইন, 'ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে।'
শবদেহ শ্লথ গতিতে চলেছে নিমতলা মহা শ্মশানের দিকে। যতদূর জানা যায়, একসময় ঠাকুরবাড়ির স্বজনদের হাত থেকে বাঁধভাঙা লাখো মানুষের ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ একদল উন্মত্ত জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে গেল কবির শবদেহ। শোকে মূহ‍্যবান জনতা নিজ সংগ্রহে রাখার জন‍্য কেউ কেউ চুল দাড়ি পযর্ন্ত ছিঁড়ে নিয়েছে কবির নিঃপ্রাণ দেহ থেকে। এমনকি জেনে অবাক হতে হয় যে সেদিন নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথের হাতে এই মহামানবের শেষকৃত‍্য সম্পন্ন হয়নি। কারণ উন্মত্ত জনতার ভিড়ে রথীন্দ্রনাথ শ্মশানে পৌঁছতেই পারেননি। অবশেষে শেতকৃত‍্য সম্পন্ন করেন কবির ভ্রাতুষ্পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে ঈশ্বরপ্রতিম মানুষটি চিরকাল শান্তির মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন, যার নিজের ভাষ‍্য ছিল, "আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক।" সেই সুন্দর ও শান্তির উপাসকের চিরবিদায় হল অসুন্দরের হাতে।
পড়ন্ত বেলায় গঙ্গার ওপারে পশ্চিমের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা আর এপারে ওই ধরিত্রীর বুক‍ে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহাপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে...।
তথ‍্যসূত্র : -
১) Rabindranath Tagore : The Myriad-minded Man - by Krishna Dutta, Andrew Robinson -- Bloomsbury, 1997
(This is a biography of Rabindranath Tagore).
২) গীতবিতান -- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা,
৩) গুরুদেব -- রানী চন্দ, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা,
৪) রবি জীবনী - প্রশান্ত কুমার পাল,
৫) রবীন্দ্র জীবনীকথা -- প্রভাতকুমার মুখোপাধ‍্যায়,
৬) বাইশে শ্রাবণ -- নির্মল কুমারী মহলানবিশ,
৭) বাইশে শ্রাবণ -- অনুত্তম ভট্টাচার্য,
৮) রবীন্দ্রনাথ ও অন‍্যান‍্য -- প্রতিমা দেবী,
৯) পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ -- অমল হোম
১০) জীবনস্মৃতি -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ,
১১) রবি-রশ্মি -- চারুচন্দ্র বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়,
১২) রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহ -- ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী,
১৩) রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথঃ -- পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়,
১৪) আনন্দবাজার পত্রিকার চিঠিপত্র ও আর্কাইভ,
১৫) গুগল উইকিপিডিয়া।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.