গল্প

গল্প দীপাবলি সংখ্যা

পরিশোধ

দীপাবলি সংখ্যা

পরিশোধ

লেখক : শক্তিপদ রাজগুরু



প্রভাত তার বন্ধু দেবেশকে নিয়ে কলেজে আসছে, নির্জন পথ। একটা চায়ের দোকানে কয়েকজন ছেলে আড্ডা মারছে, কলেজের মেয়েরা এসময় এপথে যায়। এই ছেলের দলের পাণ্ডা বুলেট। হঠাৎ কলেজের একটি মেয়ে দেবী এই পথে যাচ্ছে। বুলেটের দল তাকে লক্ষ্য করে টিটকারী মারতে দেবী চটে ওঠে। একটি ছেলেকে চড় মারতে এবার বুলেটের দল দেবীর উপর চড়াও হয় তাকে বেইজ্জত করার চেষ্টা করে।
এমন সময় সাইকেল করে প্রভাত-দেবেশ এসে পড়ে। প্রভাত দেবীকে চেনে---সে দেবীকে বাঁচাবার জন্য এই ছেলেদের সঙ্গে লড়াই করে তাদের মারধোর করে তাড়ায়।
এমন সময় একটা দামী গাড়ি এসে থামে। গাড়িতে কলেজ যাচ্ছে শহরের বড়ো ব্যাবসাদার দুনিচাঁদ মল্লিকের মেয়ে শিখা।
সে গোলমাল, লোকজন আর প্রভাত দেবেশকে দেবীর সঙ্গে দেখে গাড়ি থামায়।
শিখা চেনে এই প্রভাতকে। কলেজের ছাত্র সমিতির পাণ্ডা। দুর্দান্ত ছেলে।
শিখা বলে---উঠে আয় দেবী।
ভীত দেবী ওর ডাকে গাড়িতে ওঠে। শিখা ধরে নিয়েছে যে প্রভাতই একা পেয়ে অপমান করেছে। তাই শিখা বলে প্রভাতকে খুব বেড়েছ দেখছি। মেয়েদের মান ইজ্জত জ্ঞানও তোমার নেই?
গাড়িটা বের হয়ে যায় ওদের জ্ঞান দিয়ে। প্রভাত অবাক। দেবেশ বলে---দেখলি তো বড়ো লোকের মেয়ের মেজাজ। প্রভাত বলে উলটে গালাগাল দিয়ে বসল ধনীর দুলালী। গাড়িতে যেতে যেতে বলে দেবী---না রে শিখা। পথে কটা ছেলে আমাকে অপমান করেছিল, ওই প্রভাতই এসে বাঁচালো---
শিখা বলে ওকে চিনিস না। ওসব ওর সাজানো নাটক---তোর কাছে হিরো সাজতে চায়। ওদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। কলেজে ক্লাশ চলছে। দেবী-প্রভাত-শিখারা নোট নিচ্ছে। প্রফেসরের লেকচার চলছে।
শিখা ধনীর মেয়ে। পড়ায় মন নেই। ছোটো আয়না বের করে ক্লাশে ঠোঁটে লিপস্টিক মাখছে।
দেবী বলে---নোট নিবি না?
শিখা শোনায়---বাড়িতে বাবা চারজন প্রফেসর রেখেছেন আমার জন্য। তারাই ভালো নোট দেন।
কলেজের ছুটির পর মাঠে খেলা চলছে। সোমনাথ ফুটবলের ক্যাপটেন। ইনটার কলেজ ম্যাচে এবার ফাইনালে উঠেছে কলেজ তাই প্র্যাকটিস করাচ্ছে সোমনাথ।
খেলার শেষে আসছে প্রভাত। দেবীকে দেখে চাইল। দেবী বলে---আজ গাড়িতে শিখা যা বলেছে সেটার প্রতিবাদ করেছি। ও ভুল বুঝেছে তোমায়। আমি দুঃখিত প্রভাত।
প্রভাত বলে---এই কথাটা বলার জন্য এখনও রয়েছ?
না বললে নিজেকে দোষী ভাবতাম।
প্রভাত বলে---বড়ো লোকের আদুরে মেয়ে কী বলল, তার জন্য আমার মাথাব্যথা নেই। একলা যেও না---চলো পৌঁছে দিই তোমাকে। গাড়িতো নেই। এই সাইকেল বাহন। ওঠো---
কেরিয়ারে তুলে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেয় প্রভাত। দেবীর বাবা সাধারণ এক কেরানি। কোন সওদাগরি ফার্মে চাকরি করে হরিশবাবু। মা কোনোমতে ওই টাকায় সংসার চালায়। মেয়েকে কলেজে পড়ায়। দেবী ভালো গান গাইতে পারে। নিজের দু-একটা গানের টুইশানি করে নিজের হাতখরচটা তোলে।
দেবীর মা প্রভাতকে চেনে। আজ মেয়েকে পথে কারা অপমান করার চেষ্টা করছিল সে খবরও রটে যেতে মা সরলা দেবী ভাবনায় পড়ে। এখনও ফেরেনি মেয়ে। হরিশবাবুও বাড়ি ফিরে ভাবছে মেয়ের জন্য। এমন সময় দেবীকে প্রভাতের সঙ্গে ফিরতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়। বলে---পথে ওই ছেলেগুলো কী করেছে?
প্রভাত বলে---কোনো ভয় নেই মাসীমা। এইসা ওষুধ দিয়েছি ওরা আর ট্যাঁ ফুঁ করতে সাহস করবে না।
দেবী বলে---ও এসে পড়লো।
হরিশবাবু বলে---কি যে দিনকাল পড়লো, শুনি ছেলেগুলোকে কোনো মাতব্বর পোষে, ওরা ভালো ছেলে নয়।
প্রভাত বলে---ওদের শিক্ষা দেবার মতো শক্তি আমার আছে। চলি।
---চা! সরলা এগিয়ে আসে।
প্রভাত বলে---না। আজ থাক---দেরী হয়ে গেছে। বাড়িতে মা ভাববে। একবার পাঠশালা ঘুরে যেতে হবে।
সাবিত্রী দেবী ছেলের পথ চেয়ে আছে। রাত্রিহয়ে গেছে। একটা আধাবস্তির মতো বাড়ি। ঠাকুর এর সামনে সাবিত্রী দেবী পূজা করছে।
বস্তির ওদিকে একটা চালা ঘরে বস্তির ছেলে মেয়েরাও দু-একজন বয়স্কও পড়ছে। দুটি ছেলে তাদের পড়াচ্ছে। ঢোকে প্রভাত। সকলে তাকে সমীহ করে।
---পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে তো রে। সকলে মাথা নাড়ে।
বলে প্রভাত---ফটিক এদের বইপত্তর কিছু কিনতে হবে। টাকাটা রাখ। কাল কিনে দিবি। বের হয়ে আসে প্রভাত। বস্তির ওদিকে মদের ঠেক। দু-একজন মদ্যপান করছে। হঠাৎ সাইকেলের বেল শুনে তারা বোতল আড়াল করে।
প্রভাতদা আসছে। দেখলে গোলমাল করবে। হঠা এবার। ওরা ভালোমানুষ সেজে যায়। ওদের খবরও নেয় প্রভাত। একজনকে বলে---হর, তোর চাকরির জন্য বলেছি। কাল চিঠি নিয়ে যাবি। দ্যাখ কাজটা যদি হয়।
হর---তোমার দয়ার কথা ভুলব না।
অন্যজন বলল---বস্তির মানুষদের জন্য তুমিই করো প্রভাত।
প্রভাত হাসে---ছাড়োতো ওসব কথা। চলি। মা সাবিত্রী দেবী ছেলের পথ চেয়ে রয়েছে। রাতে প্রভাতকে ফিরতে দেখে বলে---এই পরোপকার করলেই চলবে? নিজের পড়াশোনা কি করিস? সামনে পরীক্ষা।
বলে প্রভাত---তোমার আশীর্বাদ থাকলে এবারও দারুণ রেজাল্ট হবে মা। আর নিজের জন্য তো সবাই করে, করছিও। অবসর সময়ে যাদের জন্য কেউ ভাবে না---সেই গরিব মানুষদের জন্য কিছু করা কি অন্যায় মা। তুমি মা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের পুজো কর। তাঁরা কি বলেছেন জানো না?
সাবিত্রী দেবী বলে---সব জানিরে। কিন্তুù আমার উপর-তোর উপর যে এত বড়ো অবিচার করে গেল---কই তার তো কিছুই হল না। সেই দিনগুলোর কথা আমি আজও ভুলতে পারি না। তখন তুই ছোট্ট---
সাবিত্রীর মনে পড়ে দূরগ্রামের সেই দিনগুলোর কথা। তার তরুণ স্বামী আর সাবিত্রী তখন তরুণী। একটিমাত্র ছেলে তাদের ছোট্ট শিশু। সাবিত্রীর স্বামী বলে---এখানে ভালো চাকরি পাবো না। তোমাকে-আমাদের সন্তানকে বাঁচাতে হবে। এভাবে এখান থেকে তা হবে না। তাই শহরেই যাব।
আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? সাবিত্রী বলে। তার কথায় তার স্বামী জানায়।
---এছাড়া আমার আর কোনো পথই নেই। তাই যেতেই হবে। চলে আসে সেই তরুণ স্ত্রী সন্তনকে ফেলে।
সাবিত্রী স্বামীর পথ চেয়ে থাকে। দিন চলে না---এর তার বাড়িতে কাজ করে সন্তùানকে মানুষ করতে চেষ্টা করে। গ্রামের বড়ো লোক কনকবাবুর কুনজরে পড়েû অসহায় সাবিত্রী। স্বামীরও কোনো খোঁজ নেই। কনকবাবু ওকে প্রলোভন দেখায়, তাতে রাজি হয় না সাবিত্রী। জোর করে কনক ওর উপর অত্যাচার করতে চেষ্টা করে। কোনোমতে পালিয়ে আসে। গ্রামের লোকদের জানায়। তবু কোনো প্রতিকার হয় না। পুলিশে যাবে---সেই রাতে কনকবাবুর লোক ওর ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, ওদের পুড়িয়ে শেষ করবে। কিন্তু কোনোমতে বের হয়ে পালায় সাবিত্রী সন্তনকে নিয়ে। ট্রেনে ওঠে---কলকাতায় আসে। সে আজ অনেক দিনের কথা। এখানে কোনোমতে এই বস্তিতে আনে তাকে এক বৃদ্ধ---নরেন দাদু, তার আশ্রয়ে বড়ো হয়ে ওঠে প্রভাত। সাবিত্রী আজও সেই সংগ্রামের কথা ভোলেনি। আর স্বামীও কোনো খবর নেয়নি। তবু স্বামীর সেই তরুণ বয়সের বিবর্ণ ফটো তার ঠাকুর ঘরে। এখনও প্রণাম করে। বলে প্রভাত---যে লোকটা তার স্ত্রী-একমাত্র সন্তùানকে ফেলে পালিয়ে গেল তাকে আর মানো কেন মা!
সাবিত্রী বল---যেখানেই থাকুন---যাই-ই করুন তবু তিনি আমার স্বামী, তোর বাবা।
---ছাই। একদিন যদি তার দেখা পাই তাকে এর জবাবদিহি করতেই হবে মা। কি অপরাধ করেছিলে তুমি যার জন্য এই শাস্তি।
মা বলে---নে, খেয়েনে।
প্রভাত বলে---পড়তে বসেছি মা। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো আমার খাবার চাপা দিয়ে রাখো। প্রভাত পড়ছে রাত হয়েছে।

ধনীদের ক্লাব তখন সরগরম হয়ে উঠেছে। ব্যান্ড বাজছে---দামী পোশাক পরা পুরুষ নারীর দল নাচে ব্যস্ত। শিখাকে দেখা যায় সেখানে। বহু ছেলে তার সঙ্গ পাবার জন্য উদগ্রীব। বিরাট বিজনেস ম্যাগসেট মি. দুনীচাঁদ মল্লিকের একমাত্র মেয়ে। তার সুনজরে পড়ার জন্য অনেকেই ব্যস্ত। এখানে শিখা ঘুরছে, মক্ষীরানির মতো। ওদিকে তার মা মিসেস প্রতিমা মল্লিক বয়স হলেও এখন কড়া মেকআপ আর উৎকট সাজে সে যৌবনকে ধরে রাখতে চায়। ক্লাবের একদিকে সে কয়েকজনকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।
আর দুনীচাঁদবাবু চেনে টাকা---প্রতিষ্ঠা। সে ঘরের ওদিকে বসে ক্লাবেই বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে নতুন একটা প্রজেক্টের কথা আলোচনা করছে। তার মেলামেশা ওপরতলার মানুষদের সঙ্গে। কোনো মন্ত্রীকে আজ বিশেষ অতিথি করে এনে তার সম্মানেই পার্টি দিচ্ছে। মন্ত্রীমশায়ও জানে এই কারখানায় লাইসেন্স দিলে তার পকেটেও কয়েক লাখ টাকা এসে যাবে। মন্ত্রী-নেতাদের অনেকেই এই দুনী মল্লিকের হাতের পুতুল। ভোটের সময় দুনী মল্লিকই তাদের ভরসা। দুনী মল্লিকও ওদের ভোটে জিতিয়ে দেয়। আর তার বিনিময়ে দুনী মল্লিকও নানা পথে প্রভূত রোজগার করে। অবশ্য কিছু ছিটেফোঁটা ওই প্রভুদেরও দেয়।
আজ দুনী মল্লিক তেমনি এক কারখানা গড়তে চায়। শহরের ওদিকে বিরাট একটা বস্তি, ওই বস্তি দখল করে দুনীচাঁদ সেখানে কারখানা গড়তে চায়। তার জন্য সে নেতাদের মদত পাবার আশায় এখানে পার্টি দিয়েছে টাকাও দেয় প্রভুদের।
ব্যাঙ্ক টাকা দেবে---ব্যাঙ্কারও এসেছে। জমি দেবে মি. সেন। কারখানা বানিয়ে ফয়দা তুলবে দুনী মল্লিক। মি. সেনকেই পার্টনার করবে সে---সেন তার অনেক দিনের বন্ধু।
রাতে ওদের ষড়যন্ত্র হয়, আর সেই বস্তির ঘরে পড়ছে প্রভাত। এদের ক্লাবে দামী খাবার ছড়াছড়ি যাবে। প্রভাতের জোটে কয়েকখানা রুটি, সামান্য সবজি মাত্র।

সরোজ সেন কৌশলী চতুর। তার ছেলে প্রকাশই ওই দুনী মল্লিকের ফার্মের ম্যানেজার। দুনী মল্লিক অতীতে পরিশ্রম করে এই ব্যাবসা গড়েছে। অবশ্য দুনী মল্লিক সেই কথাগুলো ভোলেনি। আজ ক্লাবে এই প্রাচুর্যের মধ্যে বেশি মদ্যপান করে নিজের অতীতকে মনে করতে পারে। সামান্য একটা তরুণ পরমেশ কলকাতা শহরে আসে ভাগ্যকে গড়তে। হাওড়া স্টেশনে ফেরি করেছে, শহরের ফুটপাথে বাস করেছে-কলের জল খেয়ে দিন কেটেছে। গ্রামে স্ত্রী-সন্তùানকে ছেড়ে এসেছে তাদের অন্ন জোগাতে পারেনি। এখানে নিজেও বেকার, সেদিন গঙ্গার ধারে বসে আছে---হঠাৎ গেল গেল রব শুনে চাইল। বাবুঘাটের জোয়ার ভরা গঙ্গার স্রোতে একটি মেয়ে ভেসে চলেছে-ডুবছে। সকলেই হাহাকার করে কিন্তুù কেউ নিজের প্রাণ বিপন্ন করে বাঁচাতে যায় না। ডুবছে সে। সেই তরুণ ওই স্রোতে লাফ দিয়ে পড়ে আর স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে সেই মেয়েটিকে বাঁচায়।
মেয়েটি ধনী লোক দেবেন রায়-র একমাত্র মেয়ে। বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল নদীর ধারে পা পিছলে পড়ে গেছে, তারপর এই বিপদ। দেবেন রায় ওই তুরুণটিকে বাড়িতে নিয়ে আসে। আর তার স্ত্রীও সব শুনে তরুণটিকে তারও খুব ভালো লাগে। যখন জানতে পারে যে ছেলেটির চাকরিও নেই থাকার জায়গাও নেই, এখানেই রেখে দেয়। তরুণটিও কাজে খুবই পটু, ক্রমশ সেই দেবেনবাবুর মেয়ে প্রতিমাকে তার ভালো লাগে। প্রতিমাই এগিয়ে আসে। দেবেনবাবুও এমন বিশ্বাসী ছেলে পেয়ে তাকেই জামাই করতে চায়। তরুণটির সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ---তবু মনে পড়ে তার ফেলে আসা গ্রামের কথা। সেখানে রয়েছে তার স্ত্রী একমাত্র সন্তùান। কিন্তুù এদিকে তার স্বপ্ন---ভবিষ্যৎ অন্যদিকে ওই স্ত্রী পুত্র অভাব অনাহার।
দুনো পরিশ্রম করতে পারে ছেলেটি তাই দেবেনবাবু তার আসল নামের বদলে দুনী বলেই ডাকতেন---পরমেশের বদলে এখন সে দুনী মল্লিক বলেই পরিচিত। আর সেই দেবেনবাবুর ছোট্ট কারখানা থেকে আজ দুনীবাবু কোটিপতি হয়েছে। রাত হয়েছে। স্ত্রী প্রতিমা এসে স্বামীকে ডাকতে দুনী মল্লিকের হুঁশ হয়। পার্টি তখন ভেঙেছ ওরা ঘরে ফেরে মেয়ে শিখাকে নিয়ে।
সরোজ সেন চতুর ধুরন্ধর লোক। তার ছেলে প্রকাশù ম্যানেজমেন্ট কোর্স শেষ করে এখন দুনী মল্লিকের ফার্মের ম্যানেজার। সেন চায় ছেলে দুনী মল্লিকের মেয়েকে হাতে এনে বিয়ে করুক আর সেনও পার্টনার সেজে দুনী মল্লিকের সর্বস্ব দখল করবে। তাই এই প্রজেক্টে সেও এগিয়ে এসেছে। তার ছেলে প্রকাশ বাপের চেয়েও এক কাঠি উপরে।
তার কাছে রেস-জুয়া-মদ্যপান-মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই টাকার দরকার। দুনী মল্লিকের ব্যাবসাতে তাই সেও আড়ালে সাপ্লাইয়ারদের কাছে মদ-কমিশন হোটেলবাজীর খরচাও নেয়।

দুনীবাবুর নতুন প্রজেক্টের জন্য লোকের দরকার। প্রভাত অনার্স নিয়ে বি এস সি পাস করেছে। সাবিত্রীও খুশী। বলে তোর বাবা শুনলে কত খুশী হতো। গর্জে ওঠে প্রভাত। ওই লোকটার নাম করো না মা। একদিন ঠিক খুঁজে পাব তাকে। সেদিন এর জবাবও চাইব। কলেজে পরীক্ষার ফল বের হয়। দেবীও এসেছে। দেবীও খুশী হয় প্রভাতের কৃতিত্বে। দুজনে এখন বেশ ঘনিষ্ঠ। শিখাও শোনে প্রভাত কলেজের মুখ রেখেছে। শিখা বলে---টুকে না হয় মস্তানি করে এই রেজাল্ট করেছে।
প্রভাত বলে---হ্যাঁ। তোমার বাবার মতো। দুনম্বরি করেই এত টাকা কামিয়েছেন তো---তাই সব তাতে দুনম্বরির কথাই ভাব ম্যাডাম। শিখা বলে---তাদের দরজাতেই আসতে হয় তোমাদের অন্নের জন্য।
প্রভাত হাসে---না। যদি যাই জানবে ওই দুনম্বরি ঠেকাবার জন্যই যাব। আর অন্ন---সেটাও রোজকার করবো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের রোজগারে। তোমাদের মতো সমাজের পরগাছাদের মতো নয়।
ধমকায় শিখা। দেবী বলে---চলো।
কলেজের প্রিন্সিপাল বলেন---পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করো প্রভাত।

প্রভাত জানে না কী করবে। তবে জানে রোজগার তাকে করতেই হবে। কথাটা দেবীকেও বলে সে। দেবী জানে মধ্যবিত্তদের অবস্থা। তার বাবারও শরীর ভেঙে পড়েছে। চাকরিতে আর যেতে পারছেন না, তবু যেতে হয়। বলে দেবী।
---আমাকেও পাস করে চাকরির সন্ধানই করতে হবে প্রভাত। সংসারের বোঝা না হলে কে টানবে? বাবার শরীরও ভেঙে পড়ছে। প্রভাত বলে--- মা যে কী ভাবে কত কষ্টে আমাকে মানুষ করেছেন। নরেন দাদুও বুড়ো হয়েছেন। এদের এবার নিশ্চিত করতে হবে। তাই চাকরিই করবো।
দেবেশ বড়ো লোকের ছেলে, প্রভাতের খুবই বন্ধু। হাসি খুশী ছিল দরিয়া ছেলে দেবেশ। সেই-ই বলে---আমাদের ফার্মে আয়। বাবাকে বলে রেখেছি তুই চাকরি পাবি। তারপর বিয়ে কর। জোর ভোজ হবে।
হাসে প্রভাত, ওসবে কাজ নেইরে। বিয়ে করে ঘর বাঁধার সময় এখন নেই আমার, দেবীরও। দুজনের কাঁধে দুটো সংসার। ওদের দেখবে কে? স্বার্থপরের মতো বিয়ে করে দুজনে সরে পড়বো? এ হতে পারে না।
---তাহলে চাকরিটা তো কর।
প্রভাত বলে---বন্ধুত্ব আছে থাক। সেটাতে মনিব চাকর এর সম্পর্কে নামাতে চাই না।
চায়েরদোকানে চা খেতে খেতে কাগজটা দেখছে প্রভাত। চোখে পড়ে মল্লিক এনটারপ্রাইজের ওই চাকরীর বিজ্ঞাপনটা। ভাবছে প্রভাত। মা সাবিত্রী দেবী এখানে আশ্রয় পেয়েছিল নরেনবাবুর দয়ায়। লোকটা এককালে বড়ো গাইয়ে ছিল। তখন গানের জগতেই ডুবে থাকতো---রোজগার নেই। স্ত্রীও রোগে ভুগে মারা যায়। একটি সন্তানাও।
তারপর একাই থাকে নরেন---বহু বছর কেটে গেছে ওই অসহায় মেয়ে আর প্রভাতকে এনেছিস এখানে। এখন বৃদ্ধ নরেনবাবু থাকে ওদিকে। প্রভাত এসে নরেনকে প্রণাম করে, মাকেও। নরেনবাবু ওই সাবিত্রীকে নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছে। প্রভাত বলে চাকরি পেয়েছি দাদু। সাবিত্রী বলে---পড়বি না আর?
প্রভাত বলে---এতদিন ধরে আমার বোঝা বয়েছ। এবার আমাকে তোমাদের জন্য কিছু করতে দাও মা।
বৃদ্ধ নরেন বলে---এম.এ. অবধি পড়াবার সাধ্যি আমার আছে। প্রভাত বলে---আমার সে সাধ নেই দাদু। এত পড়ে কী হবে? দেখি যদি রোজগারের কোনো পথ পাই---তাই চাকরি নিলাম।
প্রভাত চাকরি করতে এসেছে আরচাকরি পেয়েছে সে ওই মল্লিক এনটারপ্রাইজের অফিসে। সেখানে চাকরি করছে প্রভাত।
সারা অফিসে একজনকে সবাই সমীহ করে। সে যেন অফিসের আতঙ্ক সে ওই মি.প্রকাশ সেন। যাকে তাকে যা তা বলে, এই অফিসের মালিক যেন সেইই। বড়োসাহেব দুনী মল্লিকের কাছে এগোনো যায় না। তিনতলায় তার নিজস্ব বিশাল অফিস, ওদিকে চেম্বার। সেক্রেটারিরা সহজে কাউকে সেখানে যেতে দেয় না।
প্রকাশ সেন অফিস চালায়।
প্রভাত দেখে বয়স্ক এক ভদ্রলোক বসন্তবাবুকে। পারচেজ সেকশনের বড়বাবু, খুবই সৎ। সাপ্লায়াররা তাকে কোনোরকম ঘুষই দিতে পারে না। প্রভাত ওই বিভাগের কর্মী। দেখেছে ওই বসন্তবাবুকে।
ওদিকে প্রকাশ সেন সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে নানাভাবে টাকা নেয়, আর মাল ঠিক মতো সাপ্লাই না দিয়েই হাজার হাজার টাকার বিল দেয়, সেগুলোকে আসল বলে সই করতে বলে প্রকাশ বসন্তবাবুকে।
কিন্তুù বসন্তùবাবু তা করতে চান না।
প্রকাশ শাসায়---মাই অর্ডার। সই করে দেবেন বিলে।
বসন্তù বের হয়ে আসে। বিপদে পড়েছে সে। প্রকাশ বুঝেছে লোকটা গোলমাল করবে তাই তার পেছনে লাগে। সেকশনের মধ্যে তুচ্ছ কারণেই সেদিন যা তা ভাবে অপমান করে বসন্তবাবুকে। বলে---এরপর কোনো ভুল দেখলে চার্জশিট করবো আপনাকে। ইউ আর গুড ফর নাথিং। বসন্তবাবুর চোখে জল আসে।
ব্যাপারটা দেখেছে প্রভাত। বসন্তবাবু ওই ছেলেটিকে বিশ্বাস করেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে প্রভাত। স্টাফদের বিপদে আপদে সে বুক দিয়ে পড়ে।
তাই বসন্তবাবুও প্রভাতকে প্রকাশ সেনের ওই গোপন খবরগুলো দেয়। অন্যায়ভাবে টাকা নেয়। সাপ্লায়ারদের কাছে ফলস বিল করে।
কনট্রাকটারদের পয়সায় হোটেলে, বারে যায়। অফিসের মেয়েদেরও বাধ্য করায় তার সঙ্গে হোটেলে যেতে।
প্রভাত কখনো নিজে ছদ্মবেশে-কখনো তার দলের কেউ বেয়ারা সেজেও হোটেলের ওপর নজর রাখে প্রকাশ সেনের উপর।

দেবী দেখেছে বাড়িতে তার হাসিখুশী বাবা ওই বসন্তবাবু দিন দিন কেমন বিমর্ষ চিন্তিত হয়ে পড়ে। স্ত্রী-মেয়েকে বলে আর চাকরি করা যাবে না বোধ হয়। অফিসের বস যা অত্যাচার-অন্যায় শুরু করেছে কোনো দিন ফেঁসে না যাই।
দেবী বলে ও চাকরি ছেড়ে দাও বাবা।
বসন্তবাবু বলে---দিন চলবে কী করে? সেটা জানে না দেবীও।
তার মনেও নামে ভাবনারছোঁয়া।
দেবীর একমাত্র নির্ভরওই প্রভাত। রবিবার প্রভাত সময় করে বাগানে অপেক্ষা করে, দেবী আসে। দুজনে প্রভাতের মোটর বাইক নিয়ে বের হয়। ওই মুহূর্তগুলো ওদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত। আজ দেবীও চিন্তিত। সেই গান হাসি নেই।
দেবী বলে---বাবার অফিসে কি সব গোলমাল চলছে। কে একজন বস নাকি ওর পিছনে লেগেছে। বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। জানি না হার্টের রুগি যদি কিছু হয়ে যায়।
প্রভাত বলে বড়লোকদের ওইটাই জন্মগত অধিকার। অন্যায়-অত্যাচার করার দাবি তাদের জন্মগত। গরীবরা কি চিরকাল ওদের অন্যায় অত্যাচার সয়েই থাকবে। আমাদেরও অফিসেও দেখি এক ব্যাটাকে---দেব এবার ব্যাটাকে টাইট করে।
দেবী বলে আমার বাবার অফিসে যদি তোমার মতো কেউ থাকতো নিশ্চিন্তù হতাম। একদিন চল না বাবার সঙ্গে দেখা হবে। তোমার কথায় যদি বাবা ভরসা পান।
প্রভাত বলে---দেখি! যাবো এবার।
---কতদিন ধরে বলছি যাবার সময় তোমার হয় না। অথচ আমি তো মাসীমার কাছে যাই। গরীবের বাড়ি যেতে মন চায় না?
কাছে টেনে নেয় প্রভাত দেবীকে।
আমিও গরীব কিনা। গরীবদের জন্য তাই কিছু করতে চেষ্টা করি মাত্র। চাকরিটা পাকা হলে তোমার বাবা মাকে যেদিন তোমার দায় থেকে নিশ্চিন্তù করতে পারবো, সেদিন যাব।
দেবী খুশীতে উপচে ওঠে। দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন সে দেখে। বলে---কবে সেই সুসময় হবে স্যারের। প্রভাত গেয়ে ওঠে---দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে তাদের গানে গানে।

মি. সেন এবার ওই দুনী মল্লিককে পার্টনার করেছে---তার, টাকা সব কায়দা করে বের করতে চায়। দুনী মল্লিককেই বলে---আপনার ওই বস্তিটা সাফ করে ওখানেই কারখানা হবে, শহরের কাছেই।
মি. সেন এবার ওই দলিলের সই জাল করে ওই বস্তির সেল ডিডও করে নেয়। আর প্রকাশও কৌশলে ব্যাঙ্কের চেক বই-এ দুনী মল্লিকের কিছু সই করিয়ে রাখে---কি সব পেমেন্ট করতে হবে। দুনী মল্লিক এতো লেখাপড়া জানে না---তাতে ধাপ্পা দেয় প্রকাশ নানাভাবে।
সেদিন প্রকাশ বসন্তùবাবুকে কতকগুলো বিলে সই করতে বলে। প্রভাত স্টোর থেকে রিপোর্ট এনেছে কতবার বিলের মাল সাপ্লাই হয় নি। সব জেনে বসন্তবাবু সই করতে চান না। প্রকাশ ওকে চার্জশিট করে---সাসপেন্ড করেছে। এবারপ্রভাত সব কাগজ নিয়ে সটান এম ডি দুনী মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে যাবে, বাধা দেয় সেক্রেটারিরা। প্রভাত ছাড়বে না। তারা বলে ডেপুটি ডিরেক্টারের সঙ্গে দেখা করুন।
প্রভাত ওদিকে ডেপুটি ডিরেক্টারের ঘরে ঢুকে দেখে এয়ার কনডিশনড চেম্বারে বসে কাজ করছে শিখা।
---তুমি! অবাক হয় প্রভাত।
শিখা বলে---তুমি নয় আপনি। এটা কলেজ নয় অফিস। আর আমিই ডেপুটি ডিরেক্টার। কী চাই?
---যা চাইতে এখানে এসেছি তা পাব না। ঢুকছে প্রকাশ। নিজেই চেয়ার টেনে বসে প্রভাতকে দেখে চাইল।
বলে প্রভাত---যারাই রক্ষক তারাই এখানে দেখছি ভক্ষক।
শিখা চটে ওঠে---হোয়াট ডু ইট মিন? এখানে কেন এসেছো?
বললাম তো সুবিচারের জন্য। যা এখানে পাব না। গরীবের উপর নিরীহ সৎ মানুষদের উপর অত্যাচার করেই আপনারা ক্ষমতার আস্ফালন দেখাতে চান। চলি।
বের হয়ে যায় প্রভাত। বেশ বুঝেছে প্রকাশের কথামতোই চলবে শিখা।
অবশ্য প্রকাশ এর মধ্যে শিখার কাছে কিছুটা এসেছে।
শিখাকে সেইই ডেপুটি ডিরেক্টর হবার সাহস জুগিয়েছে। দুনী মল্লিকও বলে আমার ছেলে তো নেই। সে থাকলে এ ব্যাবসা-সেইই সামলাতো। এখন তুইই আমার ভরসা শিখা।
প্রকাশ জানে শিখা অফিসে একটা পজিশনে থাকলে তার ওই অন্ধকার পথের রোজগারটা বাড়বে। তাকে দিয়েই সে এখন দু-একটা বড়ো কনট্রাক্ট তার পেটোয়া কনট্রাক্টটার দেওয়ায় নিজে মোটা টাকা কমিশন খায়।
আজও এসেছে তেমনি মতলবেই। প্রভাতকে দেখে মেজাজটা তাই বিগড়ে যায়। শিখা বলে ও কোন সেকশনে কাজ করে?
প্রকাশ বলে পার্চেজে, তবে কাজের থেকে অকাজই বেশি করে। অফিসের স্টাফরা ওকে নেতা মনে করে। সব অযোগ্য লোকদের জন্য আন্দোলন করে।
---ওকে তাড়ান। শোনায় শিখা।
প্রকাশ বলে---আস্তে। ইউনিয়ন এখনই ঘেরাও করবে। ওর উপর নজর রেখেছি। ওকে কায়দায় পেলেই ব্যবস্থা করবো। যেমন ওই বসন্তবাবুকে সাসপেন্ড করেছি ওকেও করবো। এত বড়ো সাহস তোমাকে ইনসাল্ট করে!
প্রভাত বসন্তবাবুর উপর অন্যায়ের প্রতিবাদই করবে।
সেদিন সকালে দুনী মল্লিক বাড়ির বাগানে বেড়াচ্ছে। সকালে বেড়ানো তার অভ্যাস। হঠাৎ প্রভাতকে বসন্তùবাবুর সঙ্গে দেখে চাইল। দুনী মল্লিক দেখছে প্রভাতকে---ওর মুখটা যেন খুব চেনা। এ যেন অতীতের সাবিত্রীর মতোই। ওই মুখটা ওর মনে ঝড় তোলে নিমেষের জন্য, তার গ্রামের সেই স্মৃতি-সাবিত্রীর কথা- অতীতের কথা মনে ভিড় করে আসে। শুধায় দুনী মল্লিক---কে? কে তুমি?
প্রভাত বলে আপনার অফিসেই কাজ করি স্যার।
---এখানে?
---বিচার, ন্যায় বিচারের আশাতে এসেছি স্যার।
---কেন? ম্যানেজার, ডেপুটি ডিরেক্টার এরা তো রয়েছেন।
প্রভাত বলে---যারাই রক্ষক তারাই যদি ভক্ষক হন আমরা বিচার তো পাবো না। এই প্রকাশবাবুই এখানে জড়িত। ---মানে?
বসন্তùবাবু এবার বলে সব কাহিনী। মিথ্যা বিলের খবর লাখ লাখ টাকা বাজে কনট্রাক্ট দেওয়া হয়, কাজও তেমন হয়। নতুন ফ্যাক্টরির জন্যও বহু টাকা জলে যাচ্ছে। প্রকাশবাবু-মি. সেন এর মতলব ঠিক ভালো দেখছি না। মিস মল্লিকও এসব কাজ বোঝেন না, ওরাই তাঁকে দিয়েও কিছু ভুল কাজ করাচ্ছে। ওই ভুয়ো বিলে সই করিনি তাই সাসপেন্ড করেছে স্যার, বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে।
দুনী মল্লিক চমকে ওঠে।
তার এত কষ্টে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যে এই সর্বনাশ ঘটতে চলেছে তা জানতেন না।
প্রভাত সেই সাসপেনসন অর্ডার, বসন্তবাবুর দরখাস্ত আর অনেক টাকার ভুয়া বিলের জেরক্স কপি সব তুলে দেয় দুনী মল্লিকের হাতে। দুনী মল্লিক বলে।
---তুমি এসেছিলে, এসব দিয়ে গেছ তা কাউকে বলবে না। এসব খবর অফিসে যেন কেউ জানতে না পারে। যা করার আমিই করব।
প্রকাশ এখন দাপিয়ে বেড়ায় অফিসে নানাভাবে রোজকারও করে। কনট্রাক্টরা তাকে হোটেলে আপ্যায়ন করে, মেয়েছেলেও ভেট দেয়।
প্রকাশ সেদিন অফিসে এসে দেখে বড়সাহেব বসন্তùবাবুর সাসপেনশন অর্ডার ক্যানসেল করেছেন। কারণ বসন্তùবাবু পুরানো কর্মচারী, তাকে প্রথম অপরাধের জন্য মাপ করা হল। আয় দুনী মল্লিক অন্য সেকশনের অফিসারদের ডেকে স্টোর, স্টক সাপ্লায়ারদের বিল সব ভেরিফাই করে রিপোর্ট দিতে বলেন গোপনে। নতুন কারখানার সব ফাইল, স্টক ও হিসাবও চেয়ে পাঠান। এবার নিজেই তদন্তù করবেন। ওই ছেলেটির সম্বন্ধেও গোপনে খবর নেন। জানতে পারেন সেই গোবি¨বাবুর কাছে প্রভাতের সৎ সাহসের খবর। তার লোক মারফত শোনেন প্রভাত ওই মহল্লায় খুবই জনপ্রিয়।
বসন্তবাবু আজ খুব খুশী। প্রভাতের জন্যই চাকরি ফিরে পেয়েছে। আজ তাকে ছাড়েন না। বাড়িতে নিয়ে গেছে বসন্তবাবু---স্ত্রীকে বলে।
---এই প্রভাতের জন্যই আবার বাঁচার পথ পেয়েছি। এই আমাকে বাঁচিয়েছে, আমাদের বাঁচিয়েছে।
বসন্তùবাবুর স্ত্রী বলে---মেয়েটা এখনও ফিরল না। টুইশানির চেষ্টায় গেছে। প্রভাতের সঙ্গে দেখা হলে কত খুশী হতো। বসো বাবা--- মিষ্টি মুখ না করে যেতে পারবে না।
বসন্তবাবু দোকানে যায়---ওর স্ত্রী ভিতরে, বাইরের ঘরে প্রভাত বসে আছে। ঘরে ফিরে ওকে দেখে অবাক হয় দেবী। ---তুমি।
বসন্তùবাবু ঢোকে---ওরে ওই আমাকে শয়তানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। আমাদের মুখের গ্রাস ফিরিয়ে দিয়েছে।
দেবী বলে---তুমিই সেই মহাবীর।
প্রভাত বলে---যাক অজান্তেই তোমার কাছে একটা দাবি জন্মে গেছে। বাবা মায়ের অমত নিশ্চয়ই হবে না।
দেবী হাসে---কিন্তু মাসীমা!
প্রভাত বলে---আমি তোমার বাবা মাকে ম্যানেজ করেছি। ওটা এবার তুমি করে নিতে পারবে।

সাবিত্রী দেবী ছেলের পথ চেয়ে থাকে। প্রভাত চাকরির পর সেবাদলের অফিস, নাইট স্কুল এসবের কাজ দেখে যে সে। নরেনবাবু, সাবিত্রী পথ চেয়ে থাকে। কদিন ধরে বস্তির মানুষকে কারা নাকি শাসাচ্ছে উঠে যেতে হবে। তাদের সেবা সদনকে তুলে দেবার জন্য শাসিয়ে গেছে বস্তি ভেঙে নাকি বড়ো কারখানা হবে কোন কোম্পানির।
দুনী মল্লিক এবার নিজেই তার বিশেষ বাহিনী দিয়ে সব খবর নিচ্ছে। আর স্টোর থেকে রিপোর্ট পেয়ে সে চমকে উঠেছে। প্রচুর টাকার ভুয়ো বিল পেমেন্ট হয়েছে। স্টোর থেকে মাল চলে যাচ্ছে বাইরে ফলস্ চালানে। এইভাবেও কোম্পানির প্রচুর টাকা ক্ষতি হয়েছে, ফলে আয়ও অনেক কমে গেছে।
আর নতুন কারখানার নামে সেন টাকা নিয়েছে কিন্তুù জমিই দখল করা হয়নি। এবার দুনী মল্লিক সেনকে বলে---এবছরের মধ্যে কারখানা করতেই হবে অনেক টাকা নিয়েছেন আর দেব না। কাজ দেখাতে হবে।
তাই সেন তার গুণ্ডাবাহিনীকে বলে---যে ভাবে হোক ওই বস্তির দখল নিয়ে মাঠ করতে হবে। পুলিশকেও হাতে এনেছে। তাদেরও সাহায্য চাই ওই বস্তি ভাঙতে, লোকদের উৎখাত করতে। দুনী মল্লিক, প্রকাশ অন্যান্য ম্যানেজারদের ডেকে বলে সাবধান, নাহলে কোম্পানী তুলে দিতে বাধ্য হব।
প্রকাশ এবার বিপদে পড়েছে। তাকে চেক সই করার পাওয়ার কেড়ে নিয়ে পার্চেজ থেকে অন্য বিভাগে বদলী করা হয়েছে। প্রকাশ দেখেছে দুনীবাবু তার পিতৃদেব সেনকেও এবার চাপ দিচ্ছে কারখানা তৈরির জন্য। প্রকাশ রেগেই উঠেছে। দুনী মল্লিক জেনেছে কারখানায় একজন রয়েছে যাকে বিশ্বাস করা যায়। সে ওই প্রভাত। তাকে বাড়িতেই ডাকিয়ে আনেন, জানান, কারখানার বিপদের কথা। এ ভাবে চললে কারখানা তুলে দিতে হবে। মাত্র কয়েকজন চোরের জন্য এত লোকের অন্ন চলে যাবে এটা মানতে পারে না প্রভাত। বলে সে, আসলে চোরদের হাতে হাতেই ধরবো স্যার। এই কারখানা বাঁচাতেই হবে।
এবার শিখাও বুঝেছে তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। কারখানার দেনা বেড়েছে---ট্যাক্স দিতে পারেনি, ব্যাঙ্কাররাও টাকার তাগাদা দিচ্ছে। তাদের টাকা ফেরত না পেলে তারা আদালতে গিয়ে কারখানা ক্রোক করিয়ে নেবে। প্রকাশ সেন এখনও শিখার সামনে মুখোশ পরেই চলেছে। প্রকাশ বলে, চোরদের ধরবোই। আর ইউনিয়ন করে ফাঁকিবাজী বন্ধ করবো। ওই প্রভাতের মতো ছেলেদের তাড়াতেই হবে। নাহলে কারখানার উন্নতি হবে না।
প্রভাত খবর পেয়েছে যে সন্ধ্যার পর ট্রাক বোঝাই মাল যায় গেট দিয়ে, সেদিন প্রভাত দুটো ট্রাককে ধরে। ফলস্ চালান করে মালপাচার করা হচ্ছে। হাতে নাতে ধরে ফেলে ঘটনাটা---কিন্তুù সঙ্গের আসল অপরাধী অন্ধকারে কেটে পড়ে।
সেই অপরাধী প্রকাশেরই লোক। তাকে দিয়েই এসব কাজ করার প্রকাশ সামান্য টাকার বিনিময়ে, সে এসে বলে প্রকাশকে আর একাজ করা যাবে না। ওই প্রভাত আজ ধরেই ফেলেছিল। কোনোমতে বেঁচে এসেছি।
প্রকাশও বুঝেছে ওই প্রভাত তার সর্বনাশই করবে। তাই প্রকাশ বলে---ওর ব্যবস্থা করছি আজই। প্রভাত ওই চুরি ধরার পর এসেছে পাঁচতলায় দুনী মল্লিকের চেম্বারে, শিখাও রয়েছে। প্রভাত দেখায় সেরই ফলস্ চালান। লাখ লাখ টাকার মাল এভাবে একটা চক্র পাচার করছে। আজ ওদের একজন হাত ফসকে পালিয়েছে তাকে ধরবেই প্রভাত।
প্রকাশ সেনও আসে। সেও সমর্থন করে প্রভাতকে এখানে। প্রভাত নেমে যাবে লিফট দিয়ে। প্রকাশ তার আগে ওই লিফটের সেফটি ফিউজ খুলে দেয়। আর স্বপ্ন দেখে যে প্রভাত ওই লিফট দিয়ে নামবে আর মাঝপথে লিফট কন্ট্রোল হারিয়ে পাঁচতলার নীচে গিয়ে আছড়ে পড়ে চুরমার হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে প্রকাশ সেনের শত্রু ওই প্রভাত। প্রভাত বের হয়ে নামতে যাবে লিফটে, প্রকাশ খুশী।
হঠাৎ দুনীবাবু কী জরুরি কাজে প্রভাতকে ডাক দেন, লিফটে নেমে যেতে বলেন প্রকাশকে। চমকে ওঠে প্রকাশ, অন্য একজন কর্মী লিফটে ওঠে। লিফটা সশধে আছড়ে পড়ে নামার মুখেই চুরমার হয়ে যায়।
চমকে ওঠে সবাই। প্রভাতকে যেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে নিয়তিই বাঁচিয়েছে। ওই দুনীবাবু তাকে ডাকতে নির্দেশ দিয়ে। শিখাও চমকে ওঠে। দেখে যে প্রকাশ ইচ্ছা করেই লিফটে ওঠেনি। পুলিশ জানায়---এটা স্যাবোতেজই। কেউ প্ল্যান করে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। ---সেকি? দুনীবাবু চমকে ওঠে।
প্রভাত এবার প্রকাশের চেম্বার থেকেই ওই সব ফলùস চালান বই, প্যাড, স্ট্যাম্প সব বের করে আনে। প্রকাশ যে এ কাজ করেছে তা জেনেছে সবাই। প্রকাশ কদিন অফিস আসে না। সে সব খবর পায় গোপনে। ওদিকে সেন সাহেব অর্থাৎ প্রকাশের পিতৃদেব এবার সেই জাল কাগজপত্র দেখিয়ে ওই বস্তির মালিকানা দাবি করে আর প্রকাশও চায় এবার বস্তি উচ্ছেদ করে নিজেরাই সেখানে কারখানা গড়বে পিতাপুত্রে।
তাই খুবই উৎসাহী হয়ে উঠেছে প্রকাশ বস্তি দখলের ব্যাপারে। আর দেখে এখানেও বাধা হয়ে উঠেছে ওই প্রভাতই। সেও এবার রুখে দাঁড়ায় তার দলবল নিয়ে। প্রকাশও তার শত্রুকে নিপাত করতে চায়। ওই প্রভাতের জন্য ওই দুনী মল্লিকের কারখানা গ্রাস করতে পারেনি। এমনকি শিখার মনেও প্রভাতই প্রকাশের সম্বন্ধে ধারণা বদলে দিয়েছে। প্রকাশ এর লোকজন বস্তিতে বোমাবাজী করেছে। সাবিত্রী দেবীও ভয় পায়।
বুড়ো নরেনবাবু বলে---এসবে কাজ নেই। আমরা চলে যাব। প্রভাত বলে না। ওই লোভী শয়তানদের কালো হাত ভেঙে দেব। নরেন বলে---দুনী মল্লিক সাংঘাতিক লোক। এ তার বস্তি।
সাবিত্রী দেবী ও অন্য মেয়েরা সেদিন ঠিক করে সবাই দুনী মল্লিকের কাছে যাবে আবেদন নিয়ে। তার অনেক আছে---এটুকুকে যেন ছেড়ে দেন। দেবীও এই বস্তিতে আসে। সেও দেখেছে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ---আর প্রভাতদের লড়াই। সে ভীত হয়।
প্রভাতের সঙ্গে আজ যেন তার জীবনও জড়াতে চলেছে। দেবী তাই বলে---এ বস্তি ছেড়ে অন্যত্র চলো।
প্রভাত বলে---ওই প্রকাশদের কারখানা গড়তে দেব না এখানে। চোরের দল ওরা। কারখানা করবো বলে জায়গা নিয়ে বেচে দেবে।
নরেনবাবু বলে---এ দুনীবাবুর জায়গা।
তবে?
জাগে নরেন---বাইরে ওদের ঝগড়া, ভিতরে এক। ওই সেনরা আর দুনীবাবু একত্রেই এসব করছে। অবাক হয় প্রভাত।
নরেন বলে---ওই বড়োলোকদের বিশ্বাস করি না।
দুনীবাবু চাপ দিচ্ছে সেনকে কারখানা না করলে তহবিল তছরুপের দায়ে কোর্টে যাবে। তাই সেন প্রকাশ পিতাপুত্রে এবার বস্তি দখলের লড়াইয়ে নেমেছে। আজ ওরা দখল নেবেই। তৈরি প্রভাতরাও।

দুনীবাবু বাড়ির ফটকে ওই মহিলা বাহিনীর ভিড় দেখে অবাক হয়। গেটে দারোয়ান আটকেছে তাদের। দুনীবাবুর স্ত্রীও দেখছে ওপর থেকে। সেইই বলে---মেয়েদের উপর দারোয়ান লাঠি চালাবে নাকি! কী ব্যাপার?
দুনীচাঁদবাবু গেটে এসেছে। তার বস্তির ওপর হামলা বন্ধ করতে হবে। ওখানে তাদের ওপর বোমবাজী চলবে না। অবাক হয় দুনীচাঁদ---এসব বাজে কথা। ওবস্তি ভাঙতে বলিনি।
সাবিত্রী এগিয়ে আসে। দেখছে সে দুনী মল্লিককে। ওর দারোয়ান তখন ভিড় হঠাবার জন্য মেয়েদের ওপর লাঠি চালাচ্ছে। সাবিত্রী এগিয়ে আসে---
তার সামনে সেই অতীতের ছবি---তার তরুণ স্বামী পরমেশ---পরমেশ আজকের দুনী মল্লিক দেখছে সাবিত্রীকে। তাদের হারানো অতীত। সাবিত্রী ছুটে আসে---তুমি! এতদিন পর। দারোয়ান ভেবেছে মহিলা তার মালিককেই আক্রমণ করবে, লাঠি চালিয়েছে সে।
---না!
দুনীবাবু আটকাবার আগেই দারোয়ানের লাঠির আঘাতে ছিটকে পড়ে সাবিত্রী।

বোম পড়ছে বস্তিতে। প্রকাশ তার লোকজন নিয়ে এসেছে আক্রমণের জন্য। প্রভাত ও দলবল নিয়ে বাধা দিচ্ছে।
লড়াই চলে---প্রভাতের আক্রমণে ওরা পালায়। প্রভাত সেন ও প্রকাশকে হাতে নাতে ধরে ফেলে। এসময় এসে পড়ে দুনীচাঁদ। তিনি বলেন---প্রভাত। এরা? এখানে?
মি. সেন ও প্রকাশ বলে---আমরাই বস্তির মালিক, দখল নিচ্ছি। এ বস্তি আপনি আমাদের বিক্রী করেছেন।
প্রভাত বলে---সত্যি! বলুন।
দুনীচাঁদ আজ সব জেনেছে। বলে সে।
না। ওসব দলিল মিথ্যা। এ বস্তি আমার- কাউকে বলিনি, কাউকে এদের তুলতেও বলিনি।
---কারখানা করতে হবে?
সেনের কথায় দুনীচাঁদ বলে---ওই তো দশ বিঘে জায়গা পড়ে আছে। কারখানা ওখানে হবে। এরা যেমন আছে থাকবে। আর এই দাঙ্গা বাধানোর জন্য আপনাদের পুলিশেই দেব।
এগিয়ে আসে প্রভাত।
দুনীবাবু বলে---এসব গড়বে এবার আপনারা নন, গড়বে এই প্রভাত মল্লিকই।
---স্যার। অবাক হয় প্রভাত। বলে দুনীবাবু এখনই চল প্রভাত। জরুরি দরকার আছে।
---কোথায়?
হাসপাতালে এসেছে প্রভাত। সাবিত্রী দেবীর আঘাত গুরুতর। ছেলেকে দেখে বলে--- এই তোর বাবা প্রভাত!
---বাবা!
চাইল প্রভাত। দুনীবাবু বলে।
---আমার অপরাধের সীমা নেই প্রভাত। তারপর নিজে দাঁড়িয়ে কত খুঁজেছি তোদের। আর দেখা পাইনি। দেখা পেলাম এক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে---আমার জন্যই আজ তোর মা---
সাবিত্রী আহত। হাঁপাচ্ছে। ---আমাকে দোষী করো না ওগো। তোমার সন্তানকে তোমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে এবার আমার কাজ---শেষ। সাবিত্রী মারা যায়।
দুনীচাঁদ---শিখার চোখে জল, প্রভাত মায়ের প্রাণহীন দেহের ওপর কান্নায় ভেঙে পড়ে। শিখা ডাক দেয়---দাদা! দাদা---
নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে---মেশিন চলছে। সেই বস্তির ছেলেরা কাজে ব্যস্ত। শিখাদেবী ওরাও কাজ দেখছে। প্রভাতও।
সবুজ বাগান---প্রভাত-দেবী সেখানে তাদের জীবনের মিলনের সার্থকতার সুরে গায় গান, আবার সুর ফিরে এসেছে জীবনে।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.