গল্প

গল্প নববর্ষ সংখ্যা

বার সিংগার

নববর্ষ সংখ্যা

বার সিংগার

লেখক : বন্দনা বিশ্বাস

অধীর বাবুর বাড়ি টাকি রোজিপুরে। অধীর বাবু ব্রাহ্মণ। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন মিনতিকে। অধীর বাবুর বাড়ির পাশেই মিনতিদের বাড়ি। অধীর বাবু পূজো করে যা পায় তাতে দুজনের সংসার চলে যায়। মিনতি সত্যি সুন্দরী। মাধ্যমিক পাস করার পর অধীর সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে। সনাতন ধর্ম, বৈদিক আচার-আচরণ তাকে যেন টেনে নিয়ে যায়। সাত্ত্বিকভাবে থাকতে সে খুব ভালোবাসে। তার বয়সের ছেলেরা যখন হিন্দি সিনেমা দেখে, রাস্তায় ক্রিকেট খেলে তখন অধীর গায়ত্রী মন্ত্র জপ, সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ ইত্যাদিতে মজে থাকে।
পাড়ার বয়স্করা অধীরকে খুব ভালবাসে। কিন্তু ওর সমবয়সী ছেলেরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তাতে অধীরের কিছু আসে যায় না। সে ধুতি পরে। ত্রি সন্ধ্যা গায়ত্রী জপ করে। সকালে সূর্য মন্ত্র পাঠ করে। মিনতি ছোটবেলা থেকেই খুব শান্ত ধীর। তার সৌন্দর্যের মধ্যেও একটা স্নিগ্ধতা আছে।
মিনতি স্কুলে যায় আসে। তার বাবা সবজি বিক্রি করে বাজারে, আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। বাবা-মায়ের এই আর্থিক পরিস্থিতিতে মেয়েটার মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা হয় না।মিনতির কোন বিষয়ে কোনো চাহিদা নেই। সে ঘর সংসারের কাজ করে হাসিমুখেই। মায়ের সাথে সাথে রান্না করে, মায়ের কাজে সাহায্য করে। অধীরের মিনতিকে খুব ভালো লাগে।
মিনতির বয়স দেখতে দেখতে ১৮ বছর পেরিয়ে গেল। মিনতির বাবা যখন মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলের খোঁজ করছিল তখন অধীর তার বন্ধুকে পাঠালো মিনতির বাবার কাছে। বন্ধুটি এসে মিনতির বাবাকে বলল," যদি আপনি পয়সা না দেখতে চান, চাকরি না দেখতে চান তাহলে আমি বলব অধীরের মত একটা ভালো ছেলের সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে দিন। মন্দিরে গিয়ে বৈদিক মতে শুধু শাখা সিঁদুর দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন। রাজ ঐশ্বর্য না পেলেও আপনার মেয়ে কিন্তু রানীর মতোই থাকবে, অধীরের ঘরে। এমন ছেলে এই সমাজে, এই যুগে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের কথা।"
মিনতির বাবা অধীরকে কে চেনে। যেহেতু একই পাড়ায় তাদের বাড়ি। এবং অধীরের কথা পাড়ার সবাই বলে সত্যিই ভালো ছেলে। মিনতির বাবা রাজি হয়ে যায়। মিনতির ও মনে মনে অধীরকে খুব ভালো লাগতো। হয়তো সম্পদের অভাব ছিল কিন্তু মানসিক শান্তিতে ওরা ছিল অত্যন্ত ধনী। সংসারে যেন দুঃখ প্রবেশই করতে পারত না।
কিছুদিন পরে ঘর আলো করে তাদের একটা মেয়ে হলো। মেয়ের নাম রাখল অপর্ণা। দেখতে শুনতে সত্যিই অপরুপা। লেখাপড়া তে মেয়েটি অত্যন্ত ভালো। সংস্কৃত অনার্স নিয়ে সে যখন কলেজে ভর্তি হল তখন পাশের গ্রামেরএক ভদ্রলোক তার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল অধীর বাবুর কাছে। ছেলেটি সৈনিক বিভাগে চাকরি করে, অত্যন্ত ভালো ছেলে। অধীর বাবু রাজি হয়ে গেলেন। বিয়ে হয়ে গেল অপর্না সাথে সুপর্ণর।

দেখতে দেখতে মিনতি অধীর বাবু বয়স হয়ে যায় মেয়ের ঘরে একটি ছেলে একটি মেয়ে। নাতি-নাতনী, মেয়ে জামাই নিয়ে ভালোই দিন কাটছিল অধীর বাবুর। কিন্তু হঠাৎ অধীর বাবু কাজ থেকে ফেরার পথে বুকে ব্যথা অনুভব করে। বাড়ি ফিরে মিনতির কাছে একটু জল চাইলেন। তারপর আর কোন সাড়া শব্দ নেই। কোন চিকিৎসাই করতে হলো না চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। একা হয়ে গেল মিনতি।
মেয়ের পাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছে। তাই অপর্না মাকে একা না রেখে তার মেয়ে সূচিকে রেখে দিল মায়ের কাছে। সুচি দিদার কাছেই থাকে। বাবা মা গ্রামের বাড়িতে যখন আসে তখন তাকে নিয়ে আসে, আবার কিছুদিন পরে বাবা মা ভাই চলে গেলে চলে আসে দিদার কাছে।

দিন চলে যায়, হঠাৎ খবর আসে সুপর্ণকে যেতে হবে কাশ্মীরে। তখন ভারত পাকিস্তানের ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে গেছে। জঙ্গি হামলা চলছে। অপর্ণা চোখের জলে বিদায় জানায়। অপর্ণা ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে উঠলো। এতদিন অপর্ণার ননদ তার ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামীকে নিয়ে বাপের বাড়িতে বাবা-মার কাছে থাকতো। এখন অপর্ণা ফিরে আশায় ননদ এমনকি অপর্ণার শ্বশুর শাশুড়ি ও ঠিক মেনে নিতে পারল না। ফলে কিছুদিন পরে সে মায়ের কাছে চলে গেল। সুপর্ণ এমন জায়গায় থাকে যেখান থেকে ফোনে কোন যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। দুই এক বার বাড়ির ল্যান্ডফোনে ফোন করে, বাবার সাথে কথা হয়। ফলে অপর্ণার সাথে তার আর কথাও হয় না। টাকা পয়সা যা পাঠায় তা শ্বশুরের হাতেই পৌঁছায়। সুপর্ণ জানতেও পারেনা অপর্ণার দিন কিভাবে কাটছে। অপর্ণা খুব কষ্টে মায়ের কাছে থাকে। সে তখন আস্তে আস্তে কোন একটা কাজের সন্ধান করে। যাতে মায়ের সাথে তার ছেলে-মেয়ে সংসারের কিছুটা সুরাহা হয়। পাশের বাড়ির কাজলবাবু কলকাতায় চাকরি করে। একদিন অপর্না গিয়ে বলল কাকু, আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন? কাজল বাবু বললেন, "দেখো মা, আমি তো হোটেলে চাকরি করি। যদি তুমি ওখানে কাজ করতে চাও তাহলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি।"
অপর্ণা বলল, "যদি ভদ্রস্থ কাজ হয় তাহলে আমি করতে পারি। আর আপনি তো ওখানে আছেন, তাই আপনি আমার গার্জেনের মতন থাকবেন। আমার মনে হয় না আমার কোন অসুবিধা হবে। " কাজল বাবু বললেন, " ঠিক আছে।" চাকরিটা হয়ে গেল অপর্ণার।
ছোটবেলা থেকে অপর্না গান শিখেছে তার চাকরিটা হল বারে গান করা। তার গলা শুনে হোটেলের মালিকের খুব ভালো লাগে। মেয়েটা দেখতেও সুন্দর, সুন্দর গান করে তাই তার মাইনেটাও ভালোই দিলেন। অসুবিধা হচ্ছিল না বেশ সুন্দর সংসার চলছিল ওদের। অপর্ণার শ্বশুরবাড়িতে খবরটা গেল। শ্বশুর মশাই খুব অসন্তুষ্ট হলেন। একদিন এসে বললেন, আমার বাড়ির বউ হোটেলে কাজ করে এই কথা শুনে আমাকে পাড়ার লোকেরা ছি ছি করছে। তখন মিনতি দেবী অপর্ণার মা বললেন, " আমার মেয়েটা যে এত কষ্ট করে এখানে পড়ে রয়েছে দুটো বাচ্চা নিয়ে, জামাই এবং আপনারা কেউ তো একটা পয়সাও দেন না। মেয়েটার চলবে কি করে? দুটো বাচ্চাকে কি খাওয়াবে? আর হোটেলে কাজ করে বলতে সে তো গান করে। এমন গান যারা আজ বড় বড় গায়ক গায়িকা তারাও তো এই হোটেল থেকেই বড় হয়েছে। সে তো কোন অন্যায় করেনি। তার উপরে আমার পাশের বাড়ির এক দাদা যিনি আমার খুব পরিচিত ওর বাবার মত ওকে ভালবাসে। তিনি আছেন বলে আমি অনেক নিশ্চিন্তে আছি। আপনারা এসব লোকের কথা কান দেবেন না।"
অপর্ণনার শ্বশুর রাগতভাবে বললেন --"আপনারা আমার অনুমতি ছাড়া কিভাবে মেয়েকে পাঠালেন?" অনেক বাজে বাজে কথা বলে কোন জলস্পর্শ না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিছুদিন পর জামাই সুপর্ণ ফিরে এলো বাড়ি। বাবা ,মা , বোন, বোনের বর নানাভাবে নানা কথা লাগলো অপর্ণার নামে। বাবা মা এর কথায় সুপর্ন একদিনের জন্যও অপর্ণার সাথে এমনকি ছেলে মেয়ে কেও দেখতে এলো না। কিছুদিন পরে অপর্ণার বাড়িতে একটি চিঠি এলো। চিঠি বলতে সুপর্ণ ডিভোর্স ফাইল করেছে সেই চিঠি। হ্যাঁ সুপর্ণ ডিভোর্স ফাইল করেছে। কারণ হিসেবে নানা কথা লিখেছে। চিঠিতে উকিলের বয়ান অনুযায়ী চরিত্র নিয়ে নানা কুৎসা, বাবা-মাকে বিভিন্নভাবে টর্চার করে এই সমস্ত কথা লেখা। অপর্ণার মনে হল যে মানুষটা তার কাছে এতদিন ছিল। সুখে দুঃখে দুজনে একসাথে থেকেছে। সেই মানুষটা তাকে চেনে না? কে কি বলল সেই কথাতেই ডিভোর্স ফাইল করলো।, একবারও কি অপর্ণার সাথে দেখা করতে পারল না। ছেলেমেয়েগুলো তো শুধু একা তার নয়? এই যার মানসিকতা সে ক্ষেত্রে ভালোই করেছে ডিভোর্স ফাইল করে। যে মানুষ বিচার করে না, যার বিশ্বাস নেই নিজের স্ত্রীর উপর। তার সাথে একসাথে না থাকাই ভালো। মা বললো,"-অপর্ণা, তুই ছেলেমেয়েদের খরচ দাবি কর।" অপর্ণা বলে," মা , যে নিজের ছেলে মেয়েকে একবার দেখতে আসে না, আমি কিভাবে আছি খোঁজ নেয় না, তার কাছে কিসের দাবি? আমার ছেলে মেয়ে আমি মানুষ করব, কারোর দয়া নিয়ে নয়।"
অপর্ণা মিউচুয়াল ডিভোর্স দিয়ে দিল। অবাক হয়ে গেল অপর্ণা। সে দাবি করেনি ঠিকই কিন্তু ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা বা খোরপোষ দেওয়ার দায় তার বাবার নেই?
মেদনীপুরের গোপগড় থেকে এসেছে তন্ময়। ক্লাস এইট পর্যন্ত তার পড়াশোনা। সে কলকাতা এসেছে ভাগ্যের অন্বেষনে। একদিন বাজারের মুরগি বিক্রেতার সাথে বন্ধুত্ব হয়। মুরগি বিক্রেতা শুকুর আলী তাকে বলে, "তুই আমার দোকানে বসতে পারিস প্রতিদিন ২৫ টাকা করে দেব।"
তাতেই রাজি হয়ে যায় তন্ময়। তন্ময়ের ব্যবহার খুব সুন্দর। আস্তে আস্তে সে টাকা জমিয়ে ছোট্ট একটা দোকান নেয় বাজারে। সেখানে সে নিজেই মুরগির ব্যবসা করে। এই সময় একজন ভদ্রলোকের সাথে তার আলাপ হয়। ভদ্রলোক জাহাজে চাকরি করতেন। একদিন তন্ময় কে তিনি বললেন," তুমি আমাদের জাহাজে মুরগি সাপ্লাই করতে পারবে? বারোমাস তো কাজ থাকবে না। যখন জাহাজ ঘাটে আসবে তখনই কাজ পাবে।" তন্ময় রাজি হয়ে যায়। নিয়মিত সে জাহাজে মুরগি সাপ্লাই করত। তার সততা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে তন্ময় আজকে জাহাজের সবচেয়ে বেশি ও বড় চিকেন সাপ্লায়ার। এই বয়সেই তার সততা ও ব্যবসায়ী বুদ্ধির জোরে বিশাল পয়সার মালিক হয়ে উঠল। অতিরিক্ত পয়সা মানুষকে কিছুটা বিপথে চালিত করে। তেমনি ভাবেই তন্ময় ও নিজেকে ধনী সমাজের প্রতিষ্ঠা করার জন্য মাঝে মাঝে ক্লাবে, বড় বড় হোটেলে, নাইট ক্লাবে যাতায়াত শুরু করলো । এভাবেই সে একদিন পৌঁছে গেল অপর্ণা যে নাইট ক্লাবে বার সিংগার ছিল সেখানে।
অপর্ণাকে দেখার পর থেকেই তন্ময় অপর্ণার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ল। অপর্ণা নিজের কাজ অর্থাৎ তার গান গাওয়া শেষ হলেই সে চলে যায়। কোন কাস্টমারের সাথে কখনো কথা বলা বা দেখা করেনা। তন্ময় বহু চেষ্টা করেও অপর্নার সাথে কোন রকম যোগাযোগ করতে পারল না। একদিন হোটেল মালিক কে সে তার মনের সব কথা জানালো। হোটেল মালিক বিভূতি বাবু তন্ময়ের মতো দামি কাস্টমারকে হাতছাড়া করতে চান না। তিনি বারবার বোঝান,-"দেখুন তন্ময় বাবু, আপনি চাইলে আমি অপর্ণার চাইতে সুন্দরী ভালো সিঙ্গারের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব, কিন্তু অপর্ণার সাথে পারবো না।" নাছোড়বান্দা তন্ময় বাবু। অপর্ণাকেই চাই তার। বিভূতি বাবু অনেক বুঝিয়ে অপর্ণা কে রাজি করালেন তন্ময় বাবুর সাথে দেখা করানোর। তন্ময় অদ্ভুতভাবে এত সুন্দর কথা বলল অপর্ণার সাথে অপর্ণার ও ভালো লাগলো তন্ময়কে। এভাবেই বেশ কিছুদিন চলতে থাকে। কারনে অকারণে তন্ময় অপর্ণার খবর নেয়। জানতে পারে তার ছেলে মেয়ের কথা, তাদের জন্য যতটা সম্ভব সাহায্য করে। অপর্ণার স্বামীর ব্যবহার কষ্ট দেয় তন্ময়কে। একদিন তন্ময় অপর্ণা কে বলে. "দেখো অপর্ণা আমি এখনো বিয়ে করিনি। যদিও আমি তোমার মত শিক্ষিত নই। আমি অশিক্ষিত বলতে পারো। আমার বিদ্যা ক্লাস এইট অব্দি। যদি তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো তাহলে আমি তোমার ছেলে মেয়ের সঙ্গে তোমাকে আমার জীবন সঙ্গী করতে চাই । "
অপর্ণা বলল," তুমি কি ভেবে বলছো কথাগুলো ? তোমার পরিবার আছে, বাবা-মা আছে, তারা কখনোই মেনে নেবে না আমাকে, আমার ছেলেমেয়েদের। তুমি ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও। আমি তোমার পাশেই আছি।" তন্ময় বলল," তুমি মনে হয় আমাকে এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছ না। আমার উপরে আমার পরিবারের কথা বলার ক্ষমতা নেই। আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছি যদি তুমি আমাকে গ্রহণ করো তাহলেই আমি বিয়ে করবো। তা না হলে সারা জীবন অবিবাহিত থেকে যাব।"
মুখে যাই বলুক অপর্ণার ও ভালো লাগে তন্ময় কে। আর একা একা নিজের জীবনটাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে আজ সেও বড় ক্লান্ত। বড় ইচ্ছে হয় কারোর কাঁধে মাথা রাখতে। সে ক্ষেত্রে তন্ময় ই একমাত্র-- যার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে থাকা যায়। এখন তার মা মারা গেছে বাচ্চা দুটোকে বাড়িতে রেখে তার এই কাজ করতেও ভালো লাগেনা। তবুও উপায় নেই তাই তাকে করে যেতে হয়। বেশ কিছুদিন সময় নিলো অপর্ণা, তারপর তন্ময় কে বলল আমি রাজি আছি। তন্ময়ের কাজ যেহেতু হলদিয়ার ডকে তাই সে জায়গা কিনেছে হলদিয়ার কাছে। বেশ কয়েক কাঠা জমির উপর বিশাল এক বাড়ি তৈরি করেছিল। সেখানেই নিয়ে গিয়ে উঠল অপর্ণা ও তার ছেলে মেয়ে কে। ছোট্ট ভাঙাচোরা বাড়ি থেকে এই বিশাল বাড়িতে এসে অপর্ণার ছেলেমেয়েগুলো হাফ ছেড়ে বাঁচল। তন্ময় এখানে রান্নার লোক, কাজের লোক রেখে দিয়েছে। বাড়ির সামনে বাগান পিছনে বিরাট সবজি ক্ষেত। অপর্ণার জীবন যেন আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগলো। তন্ময় যে এত ভালো সে কল্পনাও করতে পারেনি। আস্তে আস্তে ছেলেমেয়েরা বড় স্কুলে পড়া শেষ করে, কলেজ পাস করল। তন্ময় দুই ছেলে মেয়েকে বিদেশে পাঠালো উচ্চশিক্ষার জন্য। তাছাড়া ছেলেমেয়েরা যাতে তাদের পরিচয় নিয়ে কোনরকম অস্বস্তিতে না পড়ে তাই তন্ময়ের পিতৃপরিচয় নিয়ে তারা চলে গেল বিদেশ। অপর্না সমাজসেবায় নিজেকে নিযুক্ত করল। তন্ময় তার কোন ইচ্ছায় বাধা দেয় না। অপর্ণার ইচ্ছায় সে এক বিরাট আশ্রয় বানিয়ে দিল। যেখানে দুস্থ অসহায় মেয়েরা এসে থাকতে পারে। আর যারা বাড়ি থেকে আসতো তাদের বিভিন্ন রকম হাতের কাজ শিক্ষা, পড়াশুনো যে যেদিকে চায় সেদিকেই তাকে সুযোগ করে দিল। জেলা থেকে জেলান্তরে সে খবর রটে গেল। এখন সবাই তাকে 'অপর্না মা' বলে ডাকে। কলকাতা থেকে বড় বড় নামকরা শিক্ষকদের এনে গ্রামের ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিনা পয়সায় কোচিং এর ব্যবস্থা করলেন। বহু ছেলে-মেয়ে তার প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আজ সমাজের মুখ উজ্জ্বল করেছে।
তন্ময় অপর্ণার কাজে খুব খুশি। সমাজ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেকোনো কাজে অপর্ণা কে ডাকে। কখনো কখনো তন্ময় তার সঙ্গে যায়। যদিও তন্ময় লেখাপড়া কমতি আছে বলে কিছুটা হলেও সিটিয়ে থাকে। কিন্তু অপর্ণা সামাজিক যেকোনো কাজে তন্ময়কে সর্বত্র নিয়ে যায়। অপর্ণার এই খ্যাতি, তার তন্ময়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাকে সম্পূর্ণতা এনে দেয়। অপর্না তার পুরনো জীবন পুরোপুরি ভুলে গেছে। সে ডুবে গেছে তন্ময়ের আন্তরিকতায়, এখানকার ছেলেমেয়ে যারা তা কোচিং সেন্টারে পড়ে তাদের সাথে, দুস্থ মহিলাদের সাথে। নিজের ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকলেও তার মনে কোন ক্ষোভ নেই। কারণ সে দিন রাত্রি মানুষের সাথে থাকে।
সুপর্ণ ডিভোর্সের পর আবার বিয়ে করেছে বাবা-মার কথা মত। তার একটি ছেলে আছে। ছেলে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য ভালো কোচিং সেন্টার খোঁজ করছিল। একজন ভদ্রলোক তাকে বলল আপনি হলদিয়া য় 'অপর্ণা কোচিং সেন্টারে' যান সেখানে টাকা পয়সা তো নামমাত্র নেয়, কিন্তু ভীষণ ভালো গাইড দেয়। যারা যায় সব ছেলে মেয়েরাই মোটামুটি ভালো জায়গায় চান্স পায়। সুপর্ণ ছেলেকে নিয়ে পরদিন গোপগড় থেকে হলদিয়ার দিকে রওনা হল এগারোটা নাগাদ। হলদিয়া এসে অপর্না সেন্টারের ঠিকানায় ওরা পৌঁছে গেল। ঘন্টাখানেক বাস জার্নি করে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত এবং চিন্তান্বিত অবস্থায় অপর্ণা কোচিং সেন্টারে পৌঁছল।
রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করল এবং সমস্ত কিছু জেনে ছেলেকে ভর্তি করে দিল। এই কোচিং সেন্টারে যারা দূর থেকে আসে তাদের থাকার ব্যবস্থা আছে। সুপর্ণ ছেলেকে এখানকার হোস্টেলে রেখে দিল। তারপর ছেলেকে রেখে যখন ফিরে আসছে তখন অপর্ণা ঢুকছে কোচিং সেন্টারে।, সুপর্ণ কে দেখে অবাক হয়ে যায় অপর্ণা। অপর্ণার বয়স কিছুটা বেড়েছে, চেহারার মধ্যে অনেক বেশি পরিবর্তন এবং অনেক বেশি স্মার্ট তাই সুপর্ণ ঠিক বুঝতে পারিনি অপর্ণাকে। কিন্তু অপর্ণা বুঝতে পেরেছে সুপর্ণকে। সুপর্ণ হাতজোড় করে নমস্কার জানায় অপর্ণাকে। " ম্যাডাম, আমার ছেলেকে রেখে গেলাম একটু দেখবেন, যেন পড়াশোনা ফাঁকি না দেয়।" অপর্ণা অবাক হয়ে সুপর্নর দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল চিন্তা করবেন না। আমার লোকজন আছে এখানে সবাইকে সমান ভাবে দেখা হয়। আশা করি ছেলের কাছে সব জানতে পারবেন।
অপর্ণা গলার শব্দে সুপর্ণর একটু সন্দেহ হলো। খুব চেনা পরিচিত কণ্ঠস্বর। তারপর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অপর্ণার দিকে। অপর্ণা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি আসছি বলে ঢুকে গেল। দু একবার ছেলের কাছে আস্তে আস্তে সুপর্ণ চিনতে পারল। অপর্ণা কোনরকমেই তার কাছে পরিচয় দিল না। একদিন রিসেপশনে বসে আছে অপর্ণা, সুপর্ণ আসলো ছেলের সাথে দেখা করতে। সুপর্ণ অপর্ণাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার চেষ্টা করতেই, অপর্ণা কাজের কথা বলেই বলল ," কিছু মনে করবেন না, কাজের কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা বলা আমি পছন্দ করি না।" এমন সময় তন্ময় ঢুকলো। অপর্ণা অত্যধিক ব্যস্ততা দেখিয়ে উঠে পড়ল। তন্ময়ের সাথে কথা বলতে বলতে সুপর্ণা বুঝে গেল এই অপূর্ণাই তার প্রথম স্ত্রী। ছেলে মেয়েরা কত বড় হয়েছে সেটা তার দেখতে বড় ইচ্ছে হলো। তাই তন্ময়কে জিজ্ঞেস করল,"আপনাদের ছেলে মেয়ে? তন্ময় বলল তারা দুজনেই বিদেশে থাকে। আমাদের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে।" দূর থেকে অপর্ণা সবই খেয়াল করছিল। হঠাৎ নিজের টেবিল থেকে উঠে এসে বলল," সেই তো সিঙ্গারের কাছে আসতে হলো। সকল কাজকে সম্মান করতে শিখুন। আপনারা ভদ্রলোক, সমাজে প্রতিষ্ঠিত।" সুপর্ণ শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে রইল।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.