গল্প

গল্প নববর্ষ সংখ্যা ✍

ভাইরাল

নববর্ষ সংখ্যা ✍

ভাইরাল

লেখক : অনীক মজুমদার

নিধিবাবুর বছর চল্লিশেক বয়স। সাধারন চেহারা,বেশ একটু মোটার দিকে,হাইটাও মাঝারি,দেখতেও সাধারন মধ্যবিত্ত বাঙালির মতোই।তিনি একটি বেসরকারী অফিসে চাকরি করেন আজ টানা পনের বছর,মাইনে যা পান তাতে স্ত্রী ও মেয়ের ছোট্ট সংসার দিব্বি চলে যায়।কিন্তু তার মনে সুখ নেই, তার কারন আর কিছুই না ছোট বেলা থেকে বিখ্যাত হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই তো হল না তার সাথে দরকার প্রতিভা এবং কপাল। প্রতিভা না থাকলেও তার নতুন কিছু শেখার ইচ্ছে ছিল,কিন্তু সেই প্রতিবার প্রতিভার অভাবে বাদ পরা। স্কুলে থাকতে খুব আগ্রহের সাথে তিনি নাটক করতেন এবং সেখানে তার সব থেকে বড় কাজ ছিল ‘মহেশ’ নাটকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়।তারপর এখন আর সাহস হয়না নতুন কিছুর করার, আর দশটা-পাঁচটা অফিস করে ফুরসত কোথায়।
জীবন হঠাৎ করেই অনেক পালটে গেল তার।আগে তার স্মার্ট ফোন- ফোন আসা ও যাওয়ার বেশি কোন কাজে ব্যবহার হত না,কিন্তু এই গেল বার তার আগের বার তার কম্পানি থেকে বড় বাবুর হুকুম এল এখন থেকে বাড়ি বসে কাজ করতে হবে। মেয়ের কাছ থেকে তালিম নিয়ে প্রথমে বেশ ভালো করে কম্পিউটার এরপরে ভিডিও কলিং ও সব শেষে ইন্টারনেটের ব্যবহার তিনি শিখে নিলেন। নিধিবাবু ভেবে ছিলেন এই বয়সে মানুষের আর নতুন কিছু শেখার আগ্রহ থাকেনা,কিন্তু পরিস্থিতি তার এই ধারনা মিথ্যে প্রমান করে দিল। প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধে ও সময় লাগলেও আস্তে আস্তে সে সব কিছু বুঝে গেল।এরপর কাজ শেষে হাতে প্রচুর সময় পেলেন তিনি। আগে অফিস থেকে বাড়ি যাতাযাত করতেই অনেক সময় চলে যেত এখন আর তো আর সেটা হচ্ছে না।
একদিন তিনি তার স্ত্রীকে একটা কথা বলতে গিয়ে দেখলেন তার স্ত্রী মোবাইলে কী এক ভিডিও দেখছেন। নিধিবাবুর কৌতুল হল,তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-“কী দেখছ ওতে?” তার স্ত্রী উতসুখ হয়ে বললেন-“আরে দেখ না মেয়ে বলল এটাকে ‘ইউটিউব’ বলে সবাই এতে ভিডিও দেয়,অনেক কিছু জানা ও শেখা যায় এ থেকে।” বিষয়টা সম্পূর্ন বোধগম্য না হওয়ায় তিনি মেয়ের কাছে গেলেন। ‘জি-মেল’টা জানাছিল তার মেয়ে এবার বাকি আরো অনেক কিছু বুঝিয়ে দিল তাকে- ‘ফেসবুক’,‘হোয়াটসঅ্যপ’, ‘ইউটিউব’ এগুলোতে কীভাবে একাউন্ট করতে হয়,কীভাবে চালাতে হয়,কীভাবে সবার সাথে কথা বলতে হয়।
ফেসবুকে নিধি বাবু দেখলেন তার অনেক পুরোন বন্ধু আগের থেকেই আছে,কিছু নতুন ও পুরোন বন্ধুর এর সাথে এবার ভার্চুয়াল জগতে তার বন্ধুত্ব স্থাপন হল; হোয়াটসঅ্যপেও তিনি একটি গ্রুপে জয়েন হলেন যেখানে তার বন্ধুদের সাথে কত গল্প করেন,ঠিক সেই কলেজের মতো আড্ডা চলে সর্বক্ষন। এরকম একটা জগতের কথা তিনি কল্পনাও করেননি।তিনি আধুনিকতাকে সমর্থন করেন কিন্তু একটা সময়ের পরে কাজের চাপে আর নতুন জগতটার দিকে তার মুখ তুলে দেখা হয়নি,পৃথিবী কতটা এগিয়েছিল এতদিন আর তিনি- তিনি পড়েছিলেন সেই দশ বছর পিছনে।
এরপর একদিন নিধি বাবুর বন্ধু সুদীপ্ত বিশ্বাস যাকে সবাই বিশ্বাস নামেই ডাকে তিনি গ্রুপে একটা ভিডিও দিয়ে ম্যাসেজ করলেন-“গান করে ভাইরাল হল এক সাধারন মজুর।” এরকম ঘটনা নাকি আকসার এখন ঘটে,সাধারন কোন মানুষ নতুন কিছু করে বা তার লুকোন প্রতিভাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রকাশ করে বিখ্যাত হয়। কিন্তু এই ‘ভাইরাল’ জিনিসটা কী!? মেয়ে ক্লাস করছে এখন তাকে ডাকা যাবে না,তাই বিশ্বাসের কাছেই জানতে চাইলেন ‘ভাইরাল’ ব্যাপারটা কী। বিশ্বাস তাকে বললেন-“দেখ এখন ভালো কিছু বা মন্দ কিছু কিম্বা হাস্যকর কিছু করে ইন্টারনেটে দিয়ে সেখানে বিখ্যাত হওয়া কে বলে ভাইরাল,কত মানুষ গান করে,নাচ করে,অভিনয় করে,একে অপরের সমালোচনা করে,মিমিক্রি করে আরো কত কিছু করে বিখ্যাত হয়,পয়সা কামায় তাদের কে বলে ‘ইন্টারনেট সেলিব্রটি’,তাদের যশ,খ্যাতি কোন ফিল্ম স্টার বা ভালো খেলোয়ারের চেয়ে কম নয়।” নিধিবাবু এরপর এক ছুটির দিনে ইউটিউবে অনেক রকম ভাইরাল ভিডিও দেখলেন। সত্যিই এখন কত সহজে বিখ্যাত হওয়া যায়। মানুষ সিরিয়াস কথা বলতে বলতে পড়ে গিয়েও সেটা হাস্য কর এক ভিডিও হয়ে ভাইরাল হচ্ছে, কেউ আবার খাবার ও জিনিস নষ্ট করা দেখিয়ে, কেউ হয়তো ভালো কিছু রান্না করে,কেউ নেচে আবার কেউ ভরা শীতে গায়ে বরফ ঢেলে, কেউ তার নিজের ঘোরার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে কেউ আবার সাধারন মানুষের সাথে মজা করে যাকে ‘প্রাঙ্ক’ বলে- কত কত কিছু করছে মানুষ,মানুষ দুকান কাটা হচ্ছে তার একটা ভিডিও ভাইরাল করার জন্যে।বন্ধু-বান্ধব ছাড়াও ভাই-বোন,স্বামী-স্ত্রী বাবা-ছেলে কিম্বা একাএকাই মানুষে ভিডিও করছে।একজন বৃদ্ধকে নিধিবাবু দেখলেন বয়স সত্তোর সেওনাকি ভাইরাল- তাও কিনা ভিডিওতে লিপরিডিং করে।
নিধিবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও কিছু একটা করে ভাইরাল হবেন। দুপুরে খেয়ে উঠে তিনি ছাদে গিয়ে ভাবতে বসলেন,কিছুই মাথায় আসছিল না তার। কিছুপরে তিনি দেখলেন পাশের বাড়ির ভুতো একাএকা ফুটবল খেলছে আর সামনে রাখা একটা ক্যমেরায় সেটা রেকড করছে। ধা করে মাথায় ঝিলিক খেলে গেল নিধিবাবুর।তাইতো ভুতো ফুটবল খেলে ভালো তাই সে তার স্কিলের ভিডিও করছে, সে যেটা ভালো পারে সেও সেটা করবে। সেটা কী অভিনয়! হ্যা, তিনি ওই অভিনয় করবেন। ছোটবেলার তার খুব সাধ ছিল অভিনেতা হওয়ার, এখনও তার সিনেমা দেখতে ভাল লাগে।এখন ইউটিউবে অনেকে একটা বিষয়ের বিভিন্ন অবস্থাকে তুলে ধরে ভীডিও করে হয় যাকে বলে ‘ভায়িন্স’, এই যেমন ‘বাঙালির দোল উৎসব’, এই উৎসব কে ঘিরে বাঙালি জীবনে যা যা হয় সেগুলো কে নিয়ে একটা ভিডিও।
দুদিনে ছোট একটা স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললেন তিনি,আর কী ভাবে ভিডিও করতে হবে সব কিছু ইউটিউব থেকে দেখে নিলেন। সমস্যা হচ্ছে ভিডিও এডিটিংটা নিয়ে,ফোনের ক্যামেরাই কাজ হবে বটে কিন্তু এডিটিং জিনিসটা তার দ্বারা সম্ভব না।এবার সম্পুর্ন বিষয়টা মেয়ে কে তিনি বললেন, মেয়ের উৎসাহ আছে এসবে,তাছাড়া এখনকার ছেলে মেয়েরা এসব ভালো বোঝে। মেয়েও রাজি দুজনে মিলে ঠিক করল মাকে এখন কিছু বলবেনা। আরো কিছুদিন পরে সুটিং শুরু হল, নিধিবাবুর মেয়ে একটা ইউটিউবে চ্যানেল খুলে ফেলল। ভিডিও এর নাম ঠিক হল- ‘লকডাউনে বাঙালি’।
ভিডিও প্রায় হয়ে এসেছে এমন এক সময় নিধিবাবুর মাথায় আরো একটা সিনের কথা আসল- এখন হঠাৎ করে কয়েকদিন বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বাঙালির লকডাউনে বৃষ্টিতে কী কী হয় তাই নিয়ে হবে সিনটা। মেয়েকে বলে ঠিক হল পরে যেদিন বৃষ্টি হবে সেদিনই এই সিনটার সুটিং করবেন। এই সিনটাই হবে সবচেয়ে মজার তার ভিডিওর।
কিছুদিন পরেই আকাশে মেঘ দেখে বাবা ও মেয়ে ছাদে চলে এল। নিধিবাবুর মেয়ে ইউটিউব থেকে দেখে রেখেছিল কী করে জল থেকে ক্যামেরা বাঁচিয়ে ভিডিও করতে হয়ত,এক টেকে নাও হতে পারে তাই তাদের এই ব্যবস্থা। এরপরে বৃষ্টিতে ভিজে নিধিবাবুর সুটিং শুরু হল। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা কাপুনি দিয়ে জ্বরে পরলেন নিধিবাবু। মেয়ের কাছ থেকে সবকথা শুনে প্রচন্ড রাগারাগি করলেন নিধিবাবুর স্ত্রী। ডাক্তার এসে ওষুধ লিখে দিয়ে যাবার সময় বললেন-“ভয় নেই সামান্য ভাইরাল ফিবার হয়েছে ঠিক হয়ে যাবেন।” ডাক্তারের কথা শুনে নিধিবাবু ভাবলেন-‘ভাইরাল হতে গিয়ে শেষে ভাইরাল ফিবার! নাহ,আর না,তিনি সাধারণ দর্শকই ভালো।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.