নববর্ষ সংখ্যা✍
আসার আশা
লেখক : কৃশানু মিত্র
অকালে মাত্র বাইশটা অক্লান্ত বসন্ত পার করে সে চলে গেল। রেখে গেল কৃতি ছাত্রের তকমাধারী কিছু শংসাপত্র। তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের টুকরো নিদর্শন কিছু জমা রয়ে গেল ইউটিউব ভান্ডারে। আর হাবা কালা পিতা এবং স্বর্গাদপি গরিয়সীর জন্য রইলো এক বুক হাহাকার। বছর খানেক গড়িয়ে গেছে। দেবেন আর তার স্ত্রী আজ পরিজনের বিড়ম্বনার বিষয়। কেউ দেবেন কে দেখে পালায়। কেউ ঈশ্বরের নামে প্রবোধ দেয়। পুত্রহারা সন্তানের যন্ত্রণা অন্যের বুকে তেমন করুণ সুরে বাজলো কই।
গৌরী, বাড়ির আনাচে কানাচে যেখানেই যায় অদৃশ্য অশরীরী ছায়া জাহির করে অভিষেকের উপস্থিতি। দুহাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়ে ক্লিষ্ট হয় গৌরী। শূন্য খাট, বইয়ের স্তূপ এক বছর ধরে যেখানে যেমন ছিল তেমনিই পড়ে আছে। টানটান গিটারের তারে জঙ্গ ধরেছে। মাকড়সার জালে গিটারের শব্দ গহ্বর ঢাকা পড়ে আছে। নিষ্প্রাণ স্বরযন্ত্রে কেবল কান্না বাজে। গৌরী দেবেন কে বলে, আমার কাটা ছেঁড়া করা শরীর নতুন প্রাণ জন্ম নিতে পারবে না? আমার সন্তান চাই প্রজাপতি কুমারী বলেছেন, আমি আসন্ন পুত্রসম্ভবা, উনি কৌতুক করতে পারেন না। হাবাগোবা হলেও দেবেন বুঝতে পারে গৌরী প্রজাপতি কুমারীর আশ্বাস বাণী মেনে নিয়েছে। দেবেন নিরন্তর ছোটাছুটি করছিল দত্তক নেওয়ার জন্য। পড়শীরা কানে ঢুকিয়েছে দেবেনের ভাই পরিজনেরা মেনে নেবে না দত্তক সন্তানকে। বড় হলে তার মন বিষিয়ে দেবে ওরা। ওরা তোমাদের সম্পত্তি চায়। এমত অবস্থায় প্রজাপতি কুমারীর আশ্বাসে দেবেনের মনে বল এসেছে। সেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে প্রজাপতি কুমারীর কথা। প্রজাপতি কুমারীর সব ভবিষ্যৎবাণী সত্য হয় আশ্রমে তেমনটাই শুনেছে সে। দেবেন ভাবে, নাঃ, এখনো আশা আছে বৃথা দত্তক নেওয়ার পেছনে আর দৌড়াবে না সে।
অভিষেক এক রাতে দেবেন কে স্বপ্ন দিয়ে বলে, এত তাড়াতাড়ি আমায় ভুলে গেলে বাবা? দেবেন ভয় পেয়ে যায় ধড়ফড়িয়ে উঠে সে বউকে সাপটে জড়িয়ে ধরে। গৌরী অসহায় স্বামীর কাছে জানতে চায় এমন আচরণের কারণ। দেবেন বলে,অভি আমায় অভিযুক্ত করল। গৌরী বলে, কি বলল অভি? দেবেন বলে, ও বলতে চায় আমরা ওকে কোনদিন তেমন ভালবাসিনি। নাহলে নাকি ওকে চলে যেতে হতো না। গৌরী বলে, তুমি ভুল শুনেছো ও জানে ওর চলে যাওয়া ভবিতব্য ছিল। আমার স্বপ্নে হানা দিয়ে অভি জেনে গেছে সে ফিরে জন্ম নেবে আমার কোলে। দুবছর তেরো দিন পর। প্রজাপতি কুমারি এমনটাই বলেছেন। অভি যদি স্বপ্নে ফিরে আসে ওকে মনে করিয়ে দিও এই কথা।
দেবেন অভির পুনর্জন্মের তোড়জোড় শুরু করে। ওরা দুজনে পরদিন আশা-আকাঙ্ক্ষা কেন্দ্রে হাজির হয়। ফিরে পেতেই হবে অভিকে এবং তা প্রজাপতি কুমারীর দেওয়া দিনক্ষণ মেনে। ডাক্তার চক্রবর্তী সব শুনে কাগজপত্র দেখে বলেন, গৌরী নিজের ভ্রূণে মা হতে পারবেনা কোনদিন। কারণ ওর ডিম্বাশয় বাদ গেছে। গৌরী ডাক্তারবাবুকে বলেন প্রজাপতি কুমারী বলেছেন, আমি অন্তস্বত্ত্বা হব। বয়স্ক ডাক্তারবাবু গৌরীর মানসিক অবস্থানের কথা বুঝতে পেরে বলেন, যারা লালন করে তারাই পিতা-মাতা। পৃথিবীর পিতা গোপাল তিনি গো অর্থাৎ পৃথিবীকে পালন করেন। সবাই তার সন্তান। জন্ম লগ্ন থেকে তোমরা যদি কাউকে বড় করো সে তোমাদের সন্তান। স্যারোগেট ফাদার হবে তোমার স্বামী। অন্যর গর্ভে তোমার সন্তান জন্ম নেবে। যেমন একজনের দান করা কিডনি নিয়ে অন্যে বেঁচে থাকে। তেমনি অন্যের ডিম্বানুকে নিষিক্ত করবে তোমার স্বামীর শুক্রাণু। জন্ম নেবে তোমাদের সন্তান। আইনি সাহায্যে তোমরা বাবা-মা হবে। চিন্তা কিসের? তারপর ডাক্তারবাবু গৌরীর চোখে চোখ রেখে বলেন,প্রজাপতি কুমারী এটাই বলতে চেয়েছেন। দেবেন আর গৌরীর মাথায় ঢোকে না এমন জটিল বিষয়। সে জিজ্ঞেস করে, দেবেনের কোন ক্ষতি হবে না তো? স্পার্ম ত্যাগ অতন্ত্য সাধারণ বিষয়। ডাক্তার চক্রবর্তী বুঝে উঠতে পারেন না অবোধ দম্পতির এই উদ্বেগ কি করে প্রশমিত করবেন। ডাক্তার কে চিন্তিত দেখে গৌরী ঘাবড়ে যায়। গৌরি বলে, স্যার যদি কিছু না মনে না করেন একটা কথা বলি। ডাক্তার বলে, বলুন। গৌরী বলে, আমি যতটুকু বুঝেছি কোন একজন মহিলার গর্ভে রাখা হবে আমার স্বামীর শুক্রাণু। ডাক্তার বলেন ঠিক বুঝেছ। গৌরী বলে, কিভাবে ডিম্বানুর সঙ্গে শুক্রাণুর মিলন হবে? ডাক্তার চক্রবর্তী বলেন, এ এক জটিল পদ্ধতি। আপনাদের তা বুঝে কাজ নেই। গৌরী বলে,না না, বিষয়টা যখন আমার আমাকেই তা বিশদে বুঝে নিতে হবে। কোনরকমে বাবা মানে আমার শ্বশুর মারা যাওয়ায় রেলের চাকরি পেয়ে ও সংসার পেতেছিল। পুত্র হারিয়ে ভেসে গেছে সেই সোনার সংসার। এখন ওর যদি কোন ক্ষতি হয়ে যায় আমি সইতে পারবো না। আত্মহত্যা ছাড়া আমার কোন গতি থাকবে না। খুব তাড়াহুড়ো করে গৌরী নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করার চেষ্টা করছিল। ডাক্তার কিছু বলতে উদ্দত হলে গৌরী
তাকে থামিয়ে দেয়। গৌরী বলে, এতশত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসায় কাজ নেই। যিনি ডিম্বাণু দেবেন সে নিশ্চয়ই সাধারণ ঘরের মেয়ে। টাকার জন্য বাধ্য হচ্ছেন এই কাজ করতে। আমাকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিন। ডাক্তার বলেন,এ অসম্ভব আইনি বাঁধা মানে জটিলতা আছে এতে।
গৌরী বলে, কিসের বাঁধা, আমি তাকে বলবো, বোন তুমি দিনক্ষণ দেখে অন্তত একবার আমার স্বামীর সঙ্গে সহবাস কর। অত ঝামেলা করে কাজ নেই। শুক্রাণু নাও ডিম্বাণুতে মেলাও। জঠরে প্রবেশ করাও। কালা দেবেন, গৌরীর কথার সারমর্ম বুঝতে না পেরে দ্রুত ঘাড় নাড়ে।
শিক্ষিত সংস্কৃতিমান ডাঃ চক্রবর্তী ফ্যালফ্যাল করে গৌরীর দিকে চেয়ে আছে। সহস্র চিন্তা স্রোত গঙ্গার মত শিবের জটাজাল ছিঁড়ে ডাক্তারবাবুর মাথা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একটু গলা নামিয়ে ডক্টর চক্রবর্তী বলেন, আপনার স্বামী যদি ঐ মহিলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। গৌরী মৃদু হেসে বলে, তাহলে দুজনের মধ্যে অন্তত একজন বেঁচে গেল। আশা করি আমার স্বামী ওদের সন্তানকে আমার কাছে রাখতে দেবে। গৌরী আর ডাক্তারবাবুর অশ্রুত বাক্যালাপ বুঝতে না পেরে দেবেন ফের ঘাড় নাড়তে থাকে।