প্রবন্ধ

প্রবন্ধ নববর্ষ সংখ্যা ✍

জীবন ও আনন্দের কবি : জীবনানন্দ

নববর্ষ সংখ্যা ✍

জীবন ও আনন্দের কবি : জীবনানন্দ

লেখক : সুস্মিতা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে সফল হয়েছিলেন তাঁর নিজস্বতার এক কাব্যবলয় সৃষ্টিতে। এর পেছনে ছিল তাঁর কবি-ভাবনা তথা দার্শনিকতার মৌলিকতা, ইতিহাস ও সময়চেতনাসঞ্জাত এক বিপন্নতা। কবি তাঁর তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে যে জগৎ ও জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁর চিত্ররূপ, তাঁর অলোকসামান্য প্রতিভার তুলিকার স্পর্শে, তাঁর কবিতা সৃষ্টির মাধ্যমে তা যেন প্রাণবন্ত হয়েছে। জীবনানন্দের সার্থক নাম, তাঁর এই প্রাণবন্ত সৃষ্টির মধ্যেই সার্থকতা লাভ করেছে। তাঁর কবিতা একাধারে জীবনমুখী এবং তা পাঠকের মনে লোকোত্তর আনন্দরস সৃষ্টি করে। এই রস সৃষ্টিতেই কবির সার্থকতা। প্রচলিত ধারা ভেঙে,নতুন বোধের ইশারা দিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন এক একটি চিত্রকল্পের সাহায্যে বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ সার্বিক এক মহাচেতনার সৃষ্টি করেছিলেন। জীবনকে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অনুভব করে মৃত্যুকে সংক্রামিত জীবনচর্যার মাধ্যমে আবিষ্কারের অন্তহীন গভীর প্রবণতার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। প্রকৃতিকে নিবিড়তম উপলব্ধি ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে কবি জীবনানন্দ যেন অলোকসামান্য প্রতিভধর। তিনি যেন প্রাচীন ভারতের কবিরত্ন বানভট্টের উত্তরসূরী। কল্পনালোক ও স্বপ্নলোকের সঙ্গে গদ্যময় বাস্তব পৃথিবীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জীবনানন্দের সৃষ্টিতে রয়েছে কবির মনের মাধুরীর অসামান্য ছোঁয়া। কাছের জিনিসকে অবহেলা করে আমরা দূরে অনেক দূরে অসামান্যকে খুঁজি। কিন্তু আমাদের চারপাশের যে সব জিনিসকে আমরা তুচ্ছ বলে অবহেলা করি, সে সব বিষয়ও জীবনানন্দের রচনায় অসামান্য হয়ে উঠেছে। তাই তো তিনি লিখেছেন....... "চালতার পাতা থেকে টুপ টুপ জ্যোৎস্নায় ঝরেছে শিশির;/কুয়াশায় স্থির হয়েছিল ম্লান‌ ধানসিড়ি নদীটির তীর। ধানসিড়ি কখনো কবির কাছে বাংলার শ্মশানভূমি, যেন পুরোনো ঐতিহ্যের, রূপকথার স্বপ্নমেদুর দিনরাত্রির স্মৃতিবাহী।"
"হায় চিল,সোনালি ডানার চিল,এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে।"
কবি পৌষের রাতে অনন্ত নিদ্রায় অভিভূত হতে চেয়েছেন ধানসিড়িটির তীরেই। আবার বাংলার নদী-মাঠ-ঘাট ভালোবেসে পৃথিবীর রূপ অস্বীকার করে সেখানে কবি শুধু এই বাংলার সবুজ করুণ ডাঙায় ফিরে আসতে চেয়েছেন জন্ম জন্ম ধরে-- সেও এই ধানসিড়ির বাংলায়। ধানসিড়ি যেন আবহমান বাংলার রূপকথার প্রতীক। ধানসিড়ি কবির চিরনিদ্রায় শান্তির সোপান, আবার রূপসী বাংলার রূপপ্রেমিক কবির পুনর্জন্মেরও স্বপ্ননীড় এই ধানসিড়ি। তাই সমগ্র পৃথিবীকে এমনকি সমগ্র বাংলাকেও সরিয়ে রেখে কবি ফিরে আসতে চান এই ধানসিড়িটির তীরেই---- "আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে..... আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে............ বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙায়।" জীবনানন্দের কবিতায় নিটোল, উজ্জ্বল, নির্লিপ্ত,ভারহীন শব্দরাজি নিঃশব্দে অসাধ্য সাধন করে কল্পনার জাদুবলে। 'পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়', 'আকাশের ওপারে আকাশ', 'বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝড়ে পড়ে ইস্পাতের কলে', 'মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়', 'পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন', 'কোথাও সময় নেই আমাদের ঘড়ির আধারে', 'অন্তহীন হরিতের মর্মরিত লাবণ্য সাগর', 'কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে','এরকম হিরণ্ময় রাত্রি ছাড়া ইতিহাস আর কিছু রেখেছি কি মনে'। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জীবনানন্দ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, "জীবনানন্দ ছিলেন ষোল-আনা শুদ্ধ একজন কবি। তাঁর মানসিক গঠনের যে যৎসামান্য পরিচয় আমরা পেয়েছিলাম, তাতে মনে হয় তিনি যে কবিতা লেখেন, এটাই ছিল তাঁর একমাত্র পরিচয়। বস্তুত, কবিতা ছাড়া জাগতিক অন্য কোনো ভাবনার ধারই সম্ভবত তিনি ধারতেন না।" একদিকে ধূসর অতীত,অপরদিকে বর্তমান,...দুইয়ের মাঝে যেন এক দিগভ্রষ্ট নাবিক তিনি। সুখ-দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য, ভালোবাসা-ঘৃণা, প্রেম-অপ্রেম এর আঁধার হিসেবে জীবনানন্দের দ্বান্দ্বিক অবস্থান। ক্ষয়ে যাওয়ার অনুভূতি, নির্জনতা, ক্ষণস্থায়ী জীবনে নারী, প্রকৃতি ও মৃত্যুচেতনা....এই নিয়েই আমাদের নির্জনতার কবি জীবনানন্দ। এক বিপন্ন অস্তিত্ব-চেতনা যে কলাকুশলতায় ছবিতে, ছন্দে, প্রতীকে, রূপকল্পে,শব্দে ধরা পড়বে সেই রহস্যপুরীর দরজা তিনি নিজেই শেষ পর্যন্ত খুলতে সক্ষম হন।বিস্ময়করভাবে বাংলা কবিতার এতদিনকার কাঠামো আর সংস্কারে ছেদ ঘটিয়ে উড়ে গেলেন কবিতার নিজস্ব আকাশে। জীবনানন্দ আমাদের কাছে কি এবং কতখানি,তাই বলে বোঝানো প্রায় অসম্ভব।ইতিহাস ও সমকালীনের তিনি সেই আশ্চর্য মোহনা, যার চড়ায় এসে আমাদের নৌকা থেমে যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন,"প্রত্যেক বড় মাপের কবিই ভাষাকে কিছু না কিছু সমৃদ্ধ করে যান। জীবনানন্দকে শুধু কৃতিত্ব দিয়েই থেমে থাকা যায় না, তিনি বাংলা কবিতার আকৃতিটাই বদলে দিলেন। এমন শব্দের পাশে শব্দ বসাতে লাগলেন, যা উপমা বা রূপক নয়,যা আমাদের অবচেতন মনের বহিঃপ্রকাশ। অনেক পঙক্তি পারম্পর্যহীন, যেন কোনো অর্থের সংযুক্তি নেই। অথচ তা বিনি সুতোর মালাও মনে হয় না। সুতোটি অদৃশ্য কিন্তু অনুভব করা যায়।"
"চারিদিকে শান্ত রাতি---ভিজে গন্ধ---মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকাগুলো লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র'বে চিরকাল; --
এশিরিয়া ধুলো আজ--বেবিলন ছাই হয়ে আছে।"
কবির এই কবিতাংশ পাঠ মনকে শান্ত ও সমাহিত করে দেয়।মনকে যেন দেশ ও কালের অতীত এক সত্তায় পৌঁছে দেয়। মনকে ক্ষুদ্রতার গন্ডি থেকে অনন্ত অসীমে প্রসারিত করে দেয়। মনের এই প্রসারতার ছোঁয়া এবং রেশ সহজে হারিয়ে যায় না। বরং নিয়ে যায় কোনো শুভ্রতর সমাজের অন্বেষায়। নতুন শব্দকে নতুন করে সৃষ্টি করার পরমাশ্চর্য জাদুমন্ত্র জীবনানন্দের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র। শব্দের সৌরভ,সম্মোহনগুণ, আলোছায়ার সময়টাতে রহস্যময়তা, শুধু দৃশ্য নয়,গন্ধ ও স্পর্শও আনে তাঁর শব্দ। শুধু শব্দকে ব্যবহার করা নয়,শব্দের অবস্থান,প্রয়োগেও তিনি সমস্ত লক্ষ্মণরেখা ভেঙে মৌলিক সৃষ্টিশীলতায় পৌঁছে যান। নীল জ্যোৎস্না, রুপালি আগুন ভরা রাত, কুয়াশায় মেঠো চাঁদ, শিশিরের জল,শীতের হিম,হেমন্তের ধানখেত,হলুদ ঠ্যাং-তোলা শালিখ,পচা চালকুমড়োর ছাঁচ, রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ, প্রেমিক ছিল পুরুষের শিশির ভেজা চোখ, কিন্নরকন্ঠ দেবদারু গাছ, সিংহের ছালের ধূসর পান্ডুলিপি, সবুজ বাতাস ইত্যাদি শব্দরাশিকে তিনি নতুন অর্থবহ করে তুলেছেন। নির্জন মাছের চোখ, কড়ির মতন সাদা মুখ,বেতের ফলের মতো ম্লান চোখ তাঁর একেবারেই নিজস্ব অপরূপ ও অভূতপূর্ব সৃষ্টি। কবিতার সহজাত পরিবেশের সাথে মিল ঘটিয়ে তিনি শব্দ ব্যবহার করেছেন। বাংলা কবিতায় এ যাবৎকাল যা অনাঘ্রাত, যে গন্ধ কবিতায় পাওয়া যায়নি, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রথম সেইসব রহস্যময় গন্ধ ভরপুর। লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ, বাতাসে ঝিঁঝিঁর গন্ধ,চালের ধূসর গন্ধ,চিলের বানায় রৌদ্রের গন্ধ, চন্দন কাঠের চিতার গন্ধ, পুরনো পেঁচার ঘ্রাণ, ঘুমের ঘ্রাণ ইত্যাদি। চিরকালের কবিতার অনুষঙ্গ, উপাদান তাঁর কবিতায় নেই। নিজস্ব কাব্যভাবনা ও দার্শনিকতায় তিনি কবিতার স্বতন্ত্র সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। আবেগ ও মনন এক শান্ত শীতলতার জন্ম দেয় এক ধরনের বিশেষ প্রতীক যা একান্তই নিজের বিপন্ন আত্ম অনুভূতির ছাঁচে গড়া। জীবনানন্দের কবিতায় এমন একটা জগৎ তৈরি হয় যেখানে জীবনের মধ্যে মৃত্যু, মৃত্যুর মধ্যে জীবন, কোলাহলের ভেতর স্তব্ধতা....সব একসাথে থাকে।তাই তো তিনি লেখেন, 'অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ।' জীবনানন্দের কবিতার দুর্বোধ্য সংকেত অনেকটা নেশার মত।তাঁর কবিতায় বুনো হাঁস, মৃগ-মৃগী, ধানসিড়ি নদী, ইঁদুর, পেঁচারা এসেছে প্রতীক হিসেবে। এই প্রতীকী কল্পনা কখনও চেতন বা অবচেতনায় সাংকেতিকতার রহস্য সৃষ্টি করেছে। কবিতার শব্দরাশি পাঠককে নিয়ে গেছে অন্য এক জটিল ইঙ্গিতে। রবীন্দ্রনাথ সাংকেতিকতায় নন্দিনীকে পরিয়েছিলেন রক্তকরবী, লোরকার ছিল ম্যাগনোলিয়া ফুল, মেটারলিংক এঁকেছিলেন নীল পাখি। ডি.এইচ. লরেন্সের সাপ আর জীবনানন্দের বিপন্নতার অব্যক্ত গাঢ় জানিয়েছে থুরথুরে অন্ধ পেঁচা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে লিখেছেন, "এই সঙ্গীত মুখরিত গগনে তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।" উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষার হাত ধরে জীবনানন্দের কবিতায় একদিকে যেমন এতদিনকার প্রথা, সংস্কার, গতানুগতিকতাকে ভেঙেছেন, অন্যদিকে গড়েছেনও নিজের মতো করে। তাঁর কবিতার ভেতরে লক্ষ্য করা যায় বহুমুখী ব্যঞ্জনার দ্যুতি।বেতের ফলের মতো ম্লান চোখ, কমলা রঙের রোদ,উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা, বাতাবি লেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস, রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ, কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলো......সবেতেই চিত্ততন্ত্রী রূপদ্রষ্টা কবির মগ্নতা, ধ্বনিসুষমা, ঐন্দ্রজালিকের মতো সম্মোহন ক্ষমতাসম্পন্ন যা একদিকে স্বপ্নচারী, অপরদিকে দৃশ্যবিলাসী ও স্পর্শপিপাসু। তিনি জানতেন কবিতায় ব্যবহৃত হতে হতে অনেক শব্দ, অনেক রং, অনেক উপমা, সাজসজ্জা মলিন হয়ে গেছে, তাই তিনি নতুন শব্দে নতুন রঙে,নতুন ছবি আঁকতে শুরু করেন। " নক্ষত্রের রাতের আঁধারে বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে/চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দুবেলা নির্জন মাছের চোখে।" অথবা "নীলাভ নোনার বুকে ঘনরস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে?" জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই শরীরের রূপ ও মৃত্যুর সহাবস্থানের রূপকল্প, বাংলা কবিতায় অতুলনীয় শ্রেষ্ঠত্বের স্থায়ী আসন পেয়েছে। শব্দের সুচারু নির্বাচন, নিটোল, উজ্জ্বল, নির্লিপ্ত, ভারহীন শব্দরাজি নিঃশব্দে অসাধ্য সাধন করে। কবিতাকে জীবনানন্দ দাশ বলতে চেয়েছেন অনির্বচনীয় বাণী। 'ঝরা পালক'-এ সার্বিক প্রেমচেতনা ধরা না পড়লেও 'ধূসর পান্ডুলিপি' ও 'বনলতা সেন'-এ সেই প্রেমচেতনা ইতিহাসচেনার সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত সঙ্কেত নিয়ে আসে পাঠকের মনে। একান্ত ব্যক্তিগত প্রেমচেতনা যা ধূসর-পান্ডুলিপির কবিতার শরীরে দেখা গিয়েছিল, সেই প্রেমচেতনা 'বনলতা সেন'-এ জায়গা ও সময়ের নিরিখে পরিব্যপ্ত হয়ে পড়ল যেন। এই প্রেমচেতনা বিশ্বচেতনার অন্যতম ইঙ্গিত দেয় 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থের 'শঙ্খমালা' কবিতাটির মতো। এই কবিতা যেন এক রূপকথার মোড়কে ইতিহাসচেতনার দরজার দিকে নির্দেশ করে। যে নারী কবিকে বলে তোমাকে চাই, জীবনানন্দ তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে ----
"কড়ির মতন শাদা মুখ তার, দুইখানা হাত তার হীম ;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে': দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার !
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো--দুধে আর্দ্র--কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পা নাকো আর।"
কি আশ্চর্য চিত্রকল্প বয়ন রহস্য তাঁর কবিতায় মেলে।কী আশ্চর্য বহুস্তরে নিমগ্ন হওয়ার ইঙ্গিত চিত্রকল্প, কল্পনামায়ায় এমন এক তীব্র গভীরতা যে কবি খুব সহজেই তাড়াতাড়ি প্রবেশ করেন সৃজনশীল অস্তিত্বের সামগ্রিক দ্বন্দ্ববিন্যাসের ভিতরে। এ যেন এক স্বপ্নের মধ্যে আরও এক স্বপ্নের আবহ তৈরি। মানুষের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে সময়চেতনাকে প্রবেশ করিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ইতিহাসচেতনায়। শব্দ এখানে শুধুই শব্দ নয়, শব্দ এখানে প্রতীক,সেই প্রতীকের সঙ্কেতে ভাষা নতুন মাত্রা পেয়ে কবিতাকে পৌঁছে দিচ্ছে অন্য ভুবনে। জীবনানন্দের পূর্ববর্তী কারো কবিতায় এই 'রূপ' একেবারেই অনুপস্থিত। বাংলা কবিতার গভীরতম ব্যঞ্জনআময় প্রতীকের নাম 'বনলতা সেন'। প্রাপ্য ও অপ্রাপনীয়ের মধ্যে যে দুঃসহময় বিচ্ছেদ তার সন্ধিস্থলে যাবতীয় রহস্যময়তা নিয়ে অবস্থান এ নামটির। 'এতদিন কোথায় ছিলেন'..... কথার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে কাল থেকে কালান্তরে,লোক থেকে লোকান্তরে অগ্রগমনের প্রচেষ্টা। এই নিরুপম মাত্রার প্রবাহই যেন জীবনানন্দের সমগ্র কবিতা। যে কোনো প্রধান কবি চলমান জগৎ থেকে সংগ্রহ করেন তাঁর নিজস্ব চিত্রসম্পদ। কিন্তু সেই চিত্রসম্পদ আপন সঙ্কেত রচনায় যখন ভাষা-সৌন্দর্য রচনা করেন তখন এক বৈপরীত্যময় ভাবনা জগতের সৃষ্টি হয়। এরই সাহায্যে কবি প্রচলিত ধ্যানধারণাকে ভেঙেচুরে পাঠককে নিয়ে যায় গহন দীপ্ত অন্য এক দ্বীপে। যেখানে প্রেম,স্বপ্ন, আনন্দ, বিরহ, বর্তমান, ভবিষ্যৎ মহাকালকে যেন স্পর্শ করে। মৃত্যু সেখানে কখনও ভালোবাসার পূর্ণচ্ছেদ ঘটায় না। বনলতা সেন, সুরঞ্জনা, সচেতনা তাই শুধু নামবিশেষ নয়, তারা হয়ে উঠেছে কবিতার চিহ্নমালা। চৈতন্যের এক অন্য জাগরণ।যে জাগরণ 'ধূসর পান্ডুলিপি'-তে শুরু তাই ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে ব্যপ্ত ইশারায় ধীরে ধীরে 'বনলতা সেন', 'মহাপৃথিবী', 'সাতটি তারার তিমির', 'রূপসী বাংলা', 'বেলা অবেলা কালবেলা'-য়। ক্লান্তি, বিষন্নতা, মৃত্যুচেতনা জীবনানন্দের ভাবনাকে পরিব্যপ্ত করে থাকলেও তিনি শুধু নৈরাশ্যবাদী কবি নন, সার্বিক বিনাশকেই তিনি একমাত্র সত্য বলে মনে করেন না। ইতিহাস সচেতন কবি দাঙ্গা যুদ্ধ মানব জীবনের দুর্গতির কথা বলেও গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করেন ---'সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে-এপথেই পৃথিবী কর্মমুক্তি হবে।' ইতিহাস-সচেতন প্রজ্ঞআবআন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি যথআর্থই অনুভব করেছেন --'শ্বাশত রাত্রির বুকে সকলই অনন্ত সূর্যোদয়।' মৃত্যু, প্রকৃতি, অশ্রু, প্রেম ও মায়া--এ সব নিয়েই জীবনানন্দের কবিতা। তাঁর কবিতা যেন এক আঁধার সঙ্গীত। দুই যুদ্ধের মধ্যকালের হতাশা ও বেদনাকে রহস্যময় সঙ্গীতে উত্তীর্ণ করেছেন জীবনানন্দ। যে কোনো কবির কাছেই প্রথম ও শেষ প্রয়োজন তাঁর কবিতাভাষা আয়ত্ত করা। কবিতা চর্চা ও চর্যার মাঝে হঠাৎই কী করে এই পথের সন্ধান কবি আবিষ্কার করেন। সত্য ও জিজ্ঞাসার স্তর পেরতে পেরতে একটি বাঁক থেকে অন্য বাঁকে তাঁর যাত্রা। প্রচলিত ধারার ভেঙে, নতুন বোধের ইশারা দিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন এক একটি চিত্রকল্পের সাহায্যে বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ এক সার্বিক মহাচেতনার সৃষ্টি করেছিলেন। জীবনকে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অনুভব করে মৃত্যুকে সংক্রামিত জীবনচর্যার মাধ্যমে আবিষ্কারের অন্তহীন গভীর প্রবণতার জন্ম দিয়েছিলেন ।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.