প্রবন্ধ

প্রবন্ধ বৈশাখী উপহার

চাঁদের পথে যানজট

বৈশাখী উপহার

চাঁদের পথে যানজট

লেখক : ডঃ তুষার রায়

আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অনেক দেশই সফল বা অসফল চন্দ্র-অভিযান করেছে। এদের মধ্যে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, জাপান , ইয়োরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি(ESA),ভারত,লুক্সেমবার্গ, ইসরায়েল, ইটালি,দক্ষিণ কোরিয়া আর সংযুক্ত আরব এমাইরাত(UAE)।এইসব সফল আর অসফল অভিযানের ফল হিসাবে চাঁদের সমতলের কিছু স্থান প্রায় মানুষের তৈরি রকেট আর যন্ত্রের কবরস্থান হয়ে উঠেছে।শুরুতে বেশ কয়েকটি অসফল অভিযানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা-৯ প্রথম সফলভাবে চাঁদে নেমেছিল ১৯৬৬ সালে।চার মাস পরেই নামল আমেরিকার রবোটিক যান “সার্ভেয়ার-১”।শুরু হয়ে গেল একের পর এক আমেরিকার এপোলো অভিযানগুলি।মনে থাকতে পারে ঐতিহাসিক ১৯৬৯ এর জুলাই থেকে শুরু করে আরও কত অ্যাপোলো মিশন চাঁদে পা রেখেছিল অথবা অথবা খুব কাছ দিয়ে উড়ে গেল। আজ পর্যন্ত বারো জন পৃথিবীর মানুষ ত চাঁদের উপর বেড়িয়েই এলো। এপোলো-১১’র কথা কে না জানে? একে ‘নীল আর্মস্ট্রং’ মিশন বললে বোধহয় আরও তাড়াতাড়ি মনে পড়ে যাবে। শেষ অ্যাপোলো মিশন (এপোলো-১৭) চাঁদে নেমেছিল ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭২এ। বারো দিন চাঁদের মাটিতে ৭.৬ কিলোমিটার (দীর্ঘতম) পাথুরে মাটিতে দাপাদাপি করে বেড়াল আর ১৯শে ডিসেম্বর ফেরার পথে নিয়ে এলেন ১১৫ কেজি চাঁদের ধুলো-মাটি আর পাথর।এত বেশি দিন আর কোন অ্যাপোলো মিশন চাঁদে কাটাই নি বা চাঁদের উপরে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়নি বা ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেনি। এই মিশনের তিন বীর সবচেয়ে বেশি মাত্রায় চাঁদের মাটি-পাথর নিয়ে এসেছিল।সম্ভবত পরবর্তী ৫০ বছরের চন্দ্র অভিযান বিরতির কথা মনে রেখেই তা করা হয়েছিল। এর পরই অ্যাপোলো মিশন বন্ধ হয়ে গেল নানা কারণে-বিশেষ করে অর্থাভাব আর অতিরিক্ত সাবধানতার মূল্য মাথায় রেখেই।

সেই কোন সুদূর অতীতে ১৪ই সেপ্টেম্বর,১৯৫৯ এ তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম চাঁদে পাঠিয়েছিল “লুনা-২” নামের মহাকাশ যান।চাঁদে নামেনি,কিন্তু খুব কাছ থেকে ছবি এনে আমাদের জ্ঞান বাড়িয়েছিল।এর আগের সব চন্দ্র গবেষণাই হয়েছিল পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ মারফত। তারপরের ইতিহাস ত আমারা জানি: অ্যাপোলো মিশনগুলি। অ্যাপোলো-১৭(১৯৭২)তেই শেষ হল চাঁদের মাটিতে নেমে তথ্য সংগ্রহের গৌরবময় অধ্যায়। অর্ধ-শতক পরে আবার গত ২০২২ সালের আগস্ট মাসে ‘নাসা’ নতুন উদ্যমে চন্দ্র অভিযানে নেমেছে একটি অতি শক্তিশালী ৩০-তলা উঁচু রকেটের সাহায্যে। এই নতুন মিশনের নাম দেওয়া হয়েছে-‘আর্টে-মিস’।গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর চাঁদের দেবী,‘আর্টে-মিস’ আবার ‘অ্যাপোলো’র যমজ বোন।তাঁর নাম অনুসারেই এই নতুন মিশনটির নামকরণ করা হয়েছে। মোট ৫টি আর্টে-মিস মিশন চলবে আগামী কয়েক বছর ধরে যেমন চলেছিল অ্যাপোলো মিশনগুলি।

এই আর্টে-মিস মিশনগুলির উদ্দেশ্য আর সামান্য বিবরণ জেনে নেওয়া আগামী দিনের খুব প্রয়োজনীয় ‘জানা-অজানা’ বলে প্রমাণিত হবে। প্রথম মিশন আর্টে-মিস-১ গত ২০২২ এর আগস্ট মাসেই চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে কিছু ইঞ্জিন সংক্রান্ত গণ্ডগোলের জন্য আবার সেই যাত্রা স্থগিত রাখতে হয়েছিল।শেষ পর্যন্ত গত ১৬ই নভেম্বর (২০২২)বুধবার আর্টেমিস-১ এর বিশাল,৩২ তলা উঁচু রকেটের মাথায় ‘ওরিয়ন’ নামের ক্যাপসুল চলে গেছে চাঁদের কক্ষপথে। দু-দু’বার কোন না কোন কারণে বন্ধ থাকার পর শেষ পর্যন্ত ওরিয়ন ঠিকঠাক উৎক্ষিপ্ত হল চাঁদের।

উদ্দেশ্যে।দীর্ঘ ২৫ দিন যাবত ওরিয়ন উড়েছে।চাঁদের মাটিতে নামার পরিকল্পনা ছিল না কিন্তু মাত্র ৯৭ কিলোমিটার উপর থেকে চাঁদকে পরিক্রমা করে,তথ্য সংগ্রহ করে চাঁদ থেকে ৬৪,৪০০ কিলোমিটার দূরে উড়ে গিয়ে মহাকাশে এক ‘চক্কর’ লাগিয়ে ফিরে এসেছে পৃথিবীতে। সম্ভবত আগামী মিশনের (আর্টেমিস-২) ‘মহড়া’ হিসাবে।
এর পরের মিশনগুলি ২০২৫ এঁর আগে পাঠানো হবে না বলে নাসা জানিয়েছে।কিন্তু তাদের মুখ্য বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যগুলির কথা মোটামুটিভাবে আমাদের জানা আছে। এর পরের আর্টে-মিস-২ মিশন যাবে চাঁদ ছাড়িয়ে মহাকাশের আরও অনেক গভীরে যেখানে কোন মানুষ আজ পর্যন্ত যায়নি। এটাই হবে আর্টে-মিস মিশনের অন্তর্গত প্রথম ‘মনুষ্য’ মিশন। আর্টেমিস-২ এর ‘ওরিয়ন’ নামক মহাকাশ যানে চারজন ‘নভচর’ থাকবেন। এই মিশনের সাহায্যে ‘নাসা’ আরও জানতে পারবে যে, মানুষের পক্ষে অসীম অন্তরিক্ষের কত গভীরে যাওয়া সম্ভব। আরও পরীক্ষা করতে চায়,আমাদের পৃথিবীতে চালু ‘জি পি এস’ সঞ্চার প্রণালীর বাইরে গিয়ে নাসার নিজস্ব ‘মহাকাশ সঞ্চার প্রণালী’র সাহায্যে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বানিয়ে রাখতে পারবে কিনা। আসলে এই মিশনটিকে মঙ্গল বা অন্য গ্রহে যাবার প্রস্তুতি বলে মনে করছেন বৈজ্ঞানিক মহল। মনে রাখতে হবে চাঁদ ত ঘরের কাছের গন্তব্য, কিন্তু মঙ্গল? সে যে অনেক দূরের গন্তব্যস্থলঃ গড়ে সাড়ে ৮ কোটি কিলোমিটার দূরে।

এরপরের অভিযান,‘আর্টেমিস-তিন’ এর লক্ষ মনুষ্য মহাকাশ-চারী যাত্রী নিয়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করা।মনে থাকতে পারে আমাদেরই আপন ‘চন্দ্রায়ন-২’ প্রথম পৃথিবীকে জানিয়েছিল যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছের খাঁড়িতে আছে অসীম ‘বরফ-জলের’ ভাণ্ডার।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চাঁদের ‘রোভার’ বিক্রমের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জানা গেছে যে ‘আর্টিমিস-৩’ যাত্রীদের মধ্যে থাকবেন একজন মহিলা আর একজন অ-শ্বেত মহাকাশচারী। বৈজ্ঞানিকদের বিশ্বাস এবং ‘চন্দ্রায়ন-২’ জানিয়েছে যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর চিরন্তন ছায়া-ঘেরা অঞ্চলে বিপুল এক ‘অনন্ত’ বরফ-জলের জগত আছে। এক সপ্তাহ-ব্যাপী ওই নভ-চরেরা ওই অঞ্চলে গবেষণা করবে আর তথ্য সংগ্রহ করবে।এই মিশনের সময় হবে এখন থেকে এক/দুই বছর পরে,সম্ভবত ২০২৫/২৬এ।

আর্টেমিস-৪ আর ৫ হবে এই শৃঙ্খলার চতুর্থ আর পঞ্চম মিশন।এদের কাজ হবে চন্দ্র পরিক্রমণকারী,সৌর-বিদ্যুৎ চালিত একটি মহাকাশ গবেষণাগার স্থাপন করা।এই গবেষণাগারে অতি উন্নত ধরণের যন্ত্রপাতি,একটি মহাকাশে সঞ্চার কেন্দ্র(Communication Hub) ছাড়াও থাকবে অল্প সংখ্যক মহাকাশচারীর কয়েক দিনের থাকা-খাওয়ার ‘পান্থশালা’। হয়ত বা এর একটা বাণিজ্যিক দিকও ‘নাসা’র মাথায় থাকতে পারে, কেননা সেই সময় নাগাদ ‘মহাকাশ-ভ্রমণ’ বাণিজ্যিকভাবেই শুরু হয়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে আর্টেমিস মিশনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞান কোন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে: চাঁদের গলি মহল্লায় ঘুরে বেড়িয়ে ‘মাটি আর নুড়ি’ সংগ্রহ করে ফিরে আসা আর নয়;এবারের অভিযান সত্যিকারের মহাকাশের গভীর প্রদেশে উঁকি মারা। অসীম মহাকাশে লম্বা পাড়ি দেবার জন্য শুধু প্রস্তুতি নয়,চাঁদ হবে হয়ত ‘ইন্টার-চেঞ্জ’ মধ্যবর্তী স্টেশন-যেমন আমরা দেশের বিভিন্ন কোণে পৌঁছাবার জন্য ‘ইন্টারচেঞ্জ’ মেট্রো স্টেশন বা রেলওয়ে জংশন স্টেশন ব্যবহার করে থাকি।
ওদিকে চীন দেশের “চাঙ্গে” নামের চন্দ্র অভিযান প্রকল্পের অন্তর্গত ৮টি অভিযানের কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।চার বছর আগেই চীন ঘোষণা করেছিল যুগান্তকারী ‘চাঙ্গে-৪’ চন্দ্রযান একটি সচল রোভার “ইউটু-২”,Yutu-2) নিয়ে ৮ ই ডিসেম্বর,২০১৮ তে এখন-পর্যন্ত-না-জানা চাঁদের ‘অদেখা-মুখে’র দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে নেমে পড়েছে। চাঁদের এই অঞ্চলটিতেই আছে এক বিশাল বরফ-জলের ভাণ্ডার। এই বরফের ভাণ্ডার গলালে চাঁদ আর জলহীন মরুভূমি থাকবে না।তাই এই ‘সুজলা’ অঞ্চলেই চীন নামিয়েছে ‘চাঙ্গে-৪’কে।এরপরে চাঙ্গে-৫,৬,৭ এবং ৮ নামবে চাঁদের মাটিতে যথাক্রমে এই বছর(২০২৪), ২০২৬ আর ২০২৮ এ। চাঙ্গে-৫ পার্থিব একদিন অর্থাৎ চান্দ্রিক ২ সপ্তাহব্যাপী অভিযান চালাবে।এই অভিযান শেষে দুই কে জি ধুলো-মাটি নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। চাঙ্গে-৭ বিশেষভাবে এই বিশাল বরফের ভাণ্ডার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করবে। এরপর চাঙ্গে-৮,২০২৬ এ চাঁদে একটি ভ্রাম্যমাণ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করবে বলে চীন জানিয়েছে। দেখতেই পাচ্ছেন কি বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে চাঁদের উপর। আর এই কর্মযজ্ঞে নেমে পড়েছে পৃথিবীর কয়েকটি বিত্তশালী দেশ।

বেসরকারি চন্দ্র অভিযান:

এ ত গেল সরকারি বৈজ্ঞানিক সংস্থা গুলির আগামী কয়েক বছরের চন্দ্র-প্রকল্পের ‘রোড-ম্যাপ’। কিন্তু আসল খেলা এবার শুরু হয়ে গেছে। বেসরকারি কিছু সংস্থাও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে চাঁদের পথে।এদের মধ্যে প্রথম হ’ল ইজরায়েলের ‘বেরেসিট’ (Beresheet)নামক চন্দ্র মিশন। স্পেস-আই এল (Space-IL) নামক বেসরকারি সংস্থা এর কর্ণধার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই মিশনটি সম্পূর্ণরূপে সফল হতে পারেনি: ২০১৯ এর ১১ই এপ্রিল চাঁদের মাটিতে নামার মুহূর্তেই চাঁদের মাটিতে ধাক্কা লেগে পৃথিবীর সঙ্গে এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।এরপর দ্বিতীয় বেসরকারি অভিযান হিসাবে এলো জাপানী মহাকাশ সংস্থা দ্বারা পরিচালিত সংযুক্ত আরব ইমাইরাতের (UAE) প্রথম চন্দ্র প্রকল্প ‘হাকুতা-আর’ (Hakuta R)। এক বিশাল-কায়( প্রায় ৪০-তলা বাড়ির সমান উঁচু) স্পেস-এক্স(Space X) রকেটে চড়ে দশ কিলোগ্রাম ওজনের চাঁদের রোভার “রসিদ”কে কোলে নিয়ে ‘হাকুতা আর’ যাত্রা করেছিল ২০২২ এর ১১ই ডিসেম্বর।এই প্রকল্পের বৈজ্ঞানিকরা আশা করেছিল,সব কিছু শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক চললে, ২৫শে এপ্রিল (২০২৩) মঙ্গলবার ভারতীয় সময় সকাল ১০:১০ থেকে ১১:১০ এর মধ্যে ‘হাকুতা আর’ সাধারণ হাওয়াই জাহাজের মত চাঁদের মাটিতে নেমে আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শেষ মুহূর্তে হাকুতা-আর চাঁদের মাটিয়ে নামতে সফল হতে পারেনি। চাঁদের মাটিতে ধাক্কা খেয়ে চন্দ্র-যানটি ধ্বংস হয়ে যায়।
এঁর পর আর একটি আমেরিকান প্রাইভেট কোম্পানি,“ইন্টুইটিভ মেসিনস” (Intuitive Machines)গত বৃহস্পতিবার,২৩শে ফেব্রুয়ারি(২০২৪) “নোভা-সি” অভিযানের “ওডিসিয়াস” বা ছোট করে “ওডি” নামের একটি চন্দ্রযান চাঁদের দক্ষিণমেরুর কাছে নামতে সক্ষম হয়েছে।চন্দ্রবানটি সামান্য ‘কাত’ হয়ে বসলেও,ঠিক ঠাক কাজ করতে সক্ষম বলে জানা গেছে। এই নিয়ে প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে আমেরিকার চন্দ্রযান আবার ফিরে এলো চাঁদের মাটিতে।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.