বিনোদন

বিনোদন

সুচিত্রা সেন

কলকাতা ৩ মে, ২০২৩

লেখক : পবিত্র সরকার

সুচিত্রা সেন

উপরের শিরোনামটি দিয়ে এই লেখকও ভাবছেন, এ কি সাহিত্যের অধ্যাপকের লেখার একটি বিষয় হতে পারে ? একটি পূর্ণ জীবন কাটিয়ে বছর সাতেক আগে প্রয়াত হয়েছেন সুচিত্রা, তাঁর তিরাশি বছর বয়সে। তাঁকে স্মরণ করা আর কোনও কারণে নয়। তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি ‘ঘটনা’ বা ‘ফেনোমেনন’, এবং আজকাল জনপ্রিয় সংস্কৃতির পাঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গুরুত্ব পেয়েছে, তাতে সুচিত্রা সেন বা উত্তমকুমারের সাংস্কৃতিক উপস্থিতির ইতিহাস গুরুত্বের সঙ্গে চর্চিত হওয়ার যোগ্য।

‘তিরাশি বছরের বৃদ্ধা’ কথাটা লিখেই মনে হল, মিথ্যে কথা লিখেছি। তাঁকে কি বৃদ্ধ অবস্থায় দেখেছি আমরা ? ক্বচিৎ-কখনও খবরের কাগজের চোরা ক্যামেরায় তাঁর ওই বয়সের অস্পষ্ট অকপট ছবি হয়তো উঠেছে, কিন্তু সে ছবি কি আমাদের মনে বিন্দুমাত্র দাগ কেটেছে ? সবাই জানে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে নিজের চারপাশে এক দুর্ভেদ্য আড়াল তৈরি করে রেখেছিলেন, হলিউডের আর-এক রহস্যময়ী দুর্ধর্ষ নায়িকা গ্রেটা গার্বোর মতো, হয়তো গার্বোর চেয়েও বেশি নিবিড় ছিল তাঁর পর্দানশিন জীবন, কিন্তু আমরা কেউ তাঁর যৌবনকে ডিঙিয়ে তাঁর প্রৌঢত্ব বা বার্ধক্য ছুঁতেই বা ধরতেই পারিনি। আমাদের কাছে ও সবের অস্তিত্বই দাঁড়ায়নি কখনও, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেতিহাস যে ভাবেই চলুক। আমাদের কাছে তাঁর ‘পূর্ণ জীবন’ মানেও তাই তাঁর যৌবনের অসামান্য সংক্ষিপ্ত পরিসরটুকু মাত্র, তার আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই। কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এ যে অলকাপুরীর কথা আছে, যেখানে গাছে ফুল ফোটার বিরাম নেই, রাত্রি সকল সময় জ্যোৎস্নাময়, এবং, আরও অনেক কিছুর সঙ্গে, ‘ন চ খলু বয়ো যৌবন্দান্যদস্তি’—যৌবন ছাড়া আর কোনো বয়স নেই।

সুচিত্রা সেন আমাদের কাছে ওই বয়সে অনন্ত যৌবনে, আবদ্ধ, প্রোথিত হয়ে রইলেন। আর-এক মহাকবির ভাষা ধার নিয়ে বলি, ‘এক রাত্রে ফুটে ওঠা অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল’এর মতো। তিনি কোথায় জন্মেছিলেন রমা সেন নামে, তাঁর শৈশব-কৈশোর কেমন ছিল, তাঁর মাতৃ-পিতৃ পরিচয়, বা তাঁর বিবাহিত ‘মিসেস সেন’ পরিচয় কী ছিল, কতটা ছিল, তাঁর মাতৃরূপ, কিংবা কেমন ছিল তাঁর চল্লিশ বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন ও নিঃসঙ্গতা, তা নিয়ে জীবনীকার, ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী গবেষণা করুন। আমরা শুধু তাঁর দ্যুতিময় যৌবনের ভিখারি দর্শক, আমরা তাঁর আর সব অস্তিত্ব অস্বীকার করেছি। হয়তো চলচ্চিত্রের সব রোমান্টিক নায়িকা সম্বন্ধেই আমাদের এ রকম ভাবতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কেউ কেউ তো যৌবন পেরিয়ে যাবার পরেও থেকে যান, বড়দি, পিসিমা বা মা-ঠাকুমার ভূমিকায় দাপটে অভিনয় করতে থাকেন—এই বাংলা টিভি সিরিয়াল আর সিনেমাতেই কত জন সেরকম আছেন। তাঁদের আমরা শ্রদ্ধা করি, তাঁদের অভিনয় আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে, বিনোদনকে ঐশ্বর্য দেয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের স্বপ্নে চিরস্থায়ী আবাস তৈরি করেন না, তাঁরা আমাদের হৃৎপিণ্ড মুঠোতে ধরে ছেলেখেলা করেন না আর।

এই যে ‘আমরা’, ‘আমাদের’ করে এত কথা বলছি, এই ‘আমরা’ কারা ? আমরা হলাম সেই প্রজন্ম, যারা ১৯৫০-এর গোড়ার বছরগুলি থেকে সিনেমা দেখা শুরু করেছি, যাদের ভালোমন্দ যৌবনস্বপ্ন গড়ে উঠেছিল অসাধারণ সব জুটির দুর্ধর্ষ অস্তিত্বে। হিন্দিতে রাজকাপুর-নারগিস, দিলীপকুমার-নারগিস-মধুবালা-বৈজয়ন্তীমালা, দেবানন্দ-সুরাইয়া, আর বাংলায় সুচিত্রা আর উত্তমকুমার। বলা বাহুল্য, প্রথম জনেরা তুলনায় একটু আগেকার, কিন্তু ‘বোম্বাই-কা বাবু’তে তো দেবানন্দ আর সুচিত্রার জুটি ছিল, যেমন ‘দেবদাস’-এ ছিল দিলীপকুমার সুচিত্রার জুটি। আমরা দাবি করি, আমরা উপমহাদেশের সিনেমার শ্রেষ্ঠ কিছু জুড়ির ছবির দাপটের সময় সমকালীন দৃশ্যে হাজির ছিলাম, এমনকি এমনও বলতে পারি যে, ছবিগুলি আমাদের জন্যেই তৈরি হয়েছিল। এ কথা যে বুড়ো লোকদের অতীতবিষয়ক আস্ফালন নয়, এমন চিৎকার নয় যে,’যত সব ভালো আমাদের সময়ে ছিল, এখন কিছুই হচ্ছে না’, তা আশা করি সকলে অনুগ্রহ করে স্বীকার করবেন। আমাদের মতে এই জুটিগুলি ভারতীয় সিনেমার ক্লাসিক যুগের অন্তর্গত, সেই যুগ এখন অন্তর্ধান করেছে। নিশ্চয়ই পরের প্রজন্মেও এসেছে নতুন নতুন জনপ্রিয় জুটি, কিন্তু শুধু গ্ল্যামার নয়, যাকে বলে ‘মহিমময় উপস্থিতি’, তার খবর আর পাই না। নতুন প্রজন্ম নিশ্চয় তাঁদের উপস্থিতিতে আমোদিত বা উন্মাদ হয়, কিন্তু আমরা তাঁদের যোগ্য দর্শক নই। আর সিনেমাও এখন নায়ক-নায়িকা-কেন্দ্রিক নয় আর ততটা, তার নানামুখী বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু যেগুলি নায়ক নায়িকা-কেন্দ্রিক, সেগুলিতে দেখি শুধু অভিনয় দিয়ে কাজ চলে না আর, নায়ক আর নায়িকাদের হাজারো কসরত করতে হয় জনমনোরঞ্জনের জন্য। প্রচণ্ড কোমর দুলিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ নাচ নাচতে হয়, এই পাহাড়ের চুড়োয়, এই সমুদ্রের ধারে, এই সর্ষের বা ইউরোপের টিউলিপের খেতের পাশে, এই রাজপ্রাসাদের সিঁড়িতে, নানা বর্ণে, নানা শৈলীতে। কখনও দু-জনে একা-একা, কখনও সখা-সখীদের নিয়ে। পোশাক-আশাকে একটু উদারতা দেখাতে হয়, বিশেষ করে নায়িকাদের। কখনও কখনো যাকে ‘বেডরুম সিন’ বলে তারও আয়োজন রাখতে হয়, তবে তরুণ প্রজন্মের দর্শকের মন ওঠে, মফস্‌সলে সামনের সিটগুলিতে ভল্লুকের চিৎকার ওঠে, ‘সিটি’ পড়ে, এবং কিছুদিন হাউসফুল নিয়ে আর প্রযোজকের চিন্তা থাকে না। আমাদের সময়ে তো স্ক্রিনের সামনে টাকা-সিকি-আধুলিও পড়ত ঝনাৎ ঝনাৎ আওয়াজ করে।

সুচিত্রা সেন বা উপরের নায়িকাদের এ সব কিছুই প্রায় করতে হয়নি। আমাদের মনে আছে, শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্রনাথ’-এ উত্তমের বুকের উপরে এলিয়ে ছিলেন সুচিত্রা, উত্তম ডায়ালগ্‌ বলছিলেন, ‘বুকের ওপর শুয়ে আছ সরযূ, বুকের কথাটা বুঝতে পারছ না’ বা এই জাতীয় কিছু, তাতে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রায় এক মাসের হুল্লোড়ের রসদ পেয়ে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, সুচিত্রাও শুনেছি ‘পথে হল দেরী’ ছবিটে আশিটি শাড়ি পরেছিলেন (কথাটা সম্ভবত অতিরঞ্জন), কিন্তু প্রথম দিককার বাংলা রঙিন ছবিতে এ রকম হতেই পারে। তবে পোশাক-আশাকের প্রাচুর্য বা অভাব সুচিত্রার মতো নায়িকাদের অস্ত্র ছিল না। তাঁদের একা বা সখীদের সঙ্গে হাত-পা ছুড়ে প্রাণপণ নাচতেও হয়নি। অসাধারণ অভিনয় ছাড়াও কী একটা ছিল তাঁদের শরীরে, তাঁদের চলাফেরায়, তাঁদের তাকানো এবং কথা বলায়, যাতে আজকের নায়ক-নায়িকাদের মতো দেহ এবং শক্তিমত্তাপ্রদর্শনের দরকারই হত না।

যৌন আবেদন ? অবশ্যই ছিল। যিনি রোমান্টিক নায়িকা হবেন সিনেমায়, তাঁর প্রসঙ্গে এ কথাটা আমি অস্পৃশ্য বলে মনে করি না। তাঁর ছিল দীর্ঘ সুঠাম দেহ, সাধারণ বাঙালি নায়িকাদের তুলনায় দীর্ঘ, ছিল বাঙালি মেয়ের স্নিগ্ধ শ্যামলতা। ছিল দুটি ভাষাময় ঠোঁট—চাপা নয়, কিন্তু প্রবল আবেদনময়, যেন সে দুটিতে কথার চেয়ে ব্যঞ্জনা বেশি ফুটে উঠত। কিন্তু এ সব যৌন আবেদন মেরিলিন মন্‌রোর মতো নয়, তা নিরাবরণ শরীর আর সচেতন come –hither ধরনের লাস্যভঙ্গির উপর নির্ভর করে না। ‘বেবি ডল্‌' গোছের ভাবমূর্তি আদৌ ছিল না তাঁর, আর সেটাই ছিল তাঁর অপ্রতিরোধ্য আবেদনের মূলে। অন্যান্য নায়িকারা যেখানে নায়কের তুলনায় একটু গৌণ ও পরাভূত থাকে সেখানে তাঁর মধ্যে কোথাও একটা ছিল পুরুষের সমকক্ষ, সতেজ ও সটান মাথা-উঁচু-করা এক সত্তা, যার জন্য পুরুষ মরিয়া হতে পারে। সুচিত্রার কমনীয় উপস্থিতি, বিশাল দুটি চোখ, সুঠাম ঠোঁট দুটির মধ্যে সজ্জিত সুগঠিত দাঁতের সারি, ডানদিকের থুতনিতে একটি তিল—এ সবই যথেষ্ট ছিল। তাঁর চোখদুটি যেন সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে কথা বলত। চোখের অভিনয়ই তো আসল অভিনয়, যা প্রত্যেক বড়ো অভিনেত্রীর অপরিহার্য সম্বল। আর কান্নার অভিনয়ে তাঁর সেই সুঠাম ঠোঁটদুটির কম্পন, তা আমাদের উন্মাদ করে দিত। কিন্তু তবু তাঁর ওই ঋজু সুরম্য দেহপ্রতিমার মধ্যে কোথাও একটা আভিজাত্য ছিল, ছিল সম্রাজ্ঞীর দৃপ্ত ভঙ্গিমা, যা আমাদের বলে দিত তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। তুলনা অন্যায় হবে, বাংলায় আমরা অভিজাত ব্যক্তিত্বের অভিনেত্রী অনেক পেয়েছি, যেমন আমাদের সময়েই ছিলেন চন্দ্রাবতী, সুনন্দা, পরে সুমিত্রা দেবী—কিন্তু তারাঁ কেউ যে ‘মহানায়িকা’ হয়ে উঠলেন না তার কারণ সুচিত্রার ব্যক্তিত্বের মধ্যে সেই আভিজাত্য ও যৌবনের (ইংরেজি ‘গ্ল্যামার’ কথাটায় যা ধরা পড়ে) এমন একটা চমৎকার আনুপাতিক মিশ্রণ ছিল, যা অন্যদের ক্ষেত্রে ঘটেনি।

আর ঘটেনি উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ ও ঐতিহাসিক অভিনয়বন্ধনের মতো অন্য কারও সঙ্গে সেই অবিশ্বাস্য রাসায়নিক সংযোগ। উত্তমকুমারো তাঁর দিক থেকে হয়ে উঠেছিলেন এক সম্পূর্ণ নায়ক। তিনি যে পাশ্চাত্য অর্থে খুব সুদর্শন ছিলেন তা নয়। গ্রেগরি পেক বা রবার্ট রেডফোর্ডের দীর্ঘতা তাঁর ছিল না, ছিল না কোনও পেশল দেহের সেই নিরাসক্ত বীরত্ব বা নির্লিপ্ততা। তাঁর অভিনয়সামর্থ্যের প্রমাণও আমরা পেয়েছি, ‘চাঁপাডাঙ্গার বৌ’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘অমানুষ’, ‘চৌরঙ্গী’ বা বিশেষ করে ‘নায়ক’-এ। কিন্তু বাঙালির কাছে অভিনেতা উত্তমকুমার গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না, বরং বাঙালি ভালোবেসেছিল, ‘গুরু’ বলে পূজা করেছে নায়ক উত্তম কুমারকে। তাঁর ওই আকাশ-আলো-করা অসাধারণ হাসি, তাঁর চুলের ছাঁট, তাঁর ঘাড় ঘুরিয়ে বিষণ্ণ পশ্চাদ্‌দৃষ্টি, তাঁর সিগারেট খেয়ে ধোঁয়ার আংটির ফুৎকার (‘চাওয়াপাওয়া’ ছবিতে যা দেখেছিলাম), এবং তাঁর সান্দ্র কণ্ঠস্বর, সবই সমসাময়িক নায়কদের থেকে তাঁকে অনেক উঁচুতে তুলে দিয়েছিল। বস্তুতপক্ষে শারীরিক অর্থে তাঁর চেয়ে সুন্দর হয়তো ছিলেন অসীমকুমার (সুচিত্রার ‘শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া’ ছবিতে যিনি চৈতন্যদেব সেজেছিলেন), কিংবা প্রদীপকুমার (হিন্দি ছবিতে যাঁর সার্থকতা উত্তমকুমারের চেয়ে বেশি), কিন্তু বাংলা ছবিতে তাঁদের সেই ব্যক্তিত্বের উত্তরণ ঘটেনি যা নায়ককে মহানায়কের পদবিতে উন্নীত করে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো দৃপ্ত পৌরুষ নিয়ে বাংলা ছবিতে খুব কম নায়ক এসেছে, কিন্তু সুচিত্রার সঙ্গে তাঁর ‘সাত পাকে বাঁধা’ নামক অসাধারণ ছবিটি সত্ত্বেও সেই জুটি সেই তীব্র আকর্ষণ তৈরি করল না। ‘দত্তা’তে আমাদের মনে হল সুচিত্রার বয়স হয়েছে, একটু বেশি মেক-আপ দিয়ে তাঁকে সৌমিত্রর নায়িকা সাজতে হচ্ছে, সৌমিত্রর সঙ্গে তাঁকে ঠিক মানাচ্ছে না। ফলে সৌমিত্রর সঙ্গে তাঁর কোনও রোমান্টিক ইন্দ্রজাল তৈরি হয়নি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে, যদিও অভিনয়ে দুজনেই দুজনের মর্যাদা রক্ষা করেছেন।

তাই উত্তম-সুচিত্রার জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অসাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনা। ওই মায়াজগতে ‘মেড ফর ঈচ আদার’ কথাটি কেবল এই যুগল সম্বন্ধেই সম্ভবত বলা চলে। চলচ্চিত্রে পরস্পরের ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিল এক অতিশয় কাম্য পুরুষ আর কাম্য নারীর দুই জীবন্ত চিহ্ন, তা মায়া হলেও এ মায়া কয়েক প্রজন্মের বাঙালি নারীপুরুষকে কী আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা কে না জানে। অপরিণত যৌবনে আমরা এ দুয়ের মিলনান্ত ছবিতে শেষে দুজনের একটি আলিঙ্গন- দৃশ্য (‘শিল্পী’তে যেমন ছিল) দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম বটে, কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে এসে বুঝতে পারি, তাঁরা সিনেমার মধ্য যতক্ষণ পরস্পরের সঙ্গে কথা বা আচরণের আদান-প্রদান করতেন ততক্ষণ একটা ইন্দ্রজাল তৈরি হত, তা যেন দর্শকদের প্রতি মুহূর্তের সম্মোহনের মতো কাজ করত।

যৌবনের নানা স্পর্ধা আর স্বপ্ন নিজেদের বিস্তার খোঁজে, বাস্তবে তা যত প্রতিহত হয়, তত সে কল্পনার অলীক জগতে নিজেকে নিক্ষেপ করতে চায়। চলচ্চিত্র এই একটি মায়ালোক, যা আমাদের দিবাস্বপ্নের দোসর হয়। আমাদের যৌবনে সুচিত্রা-উত্তমের ছবি এই এক অলীক আর ঐশ্বর্যময় ইচ্ছাপূরণের জগৎ নির্মাণ করেছিল। এ এক ভয়ংকর কুহক, এ কুহক কাউকে কাউকে উন্মত্ততার সীমানায় নিক্ষেপ করে তা আমরা জানি। তবু এই স্বপ্নের অনুধাবন হয়তো সকলের জন্যই জরুরি। তার জন্য আমরা কাকে ধন্যবাদ দেব ? ইতিহাসের এই সমাপতনকেই—যে আমাদের কৈশোর-যৌবনই উপহার পেয়েছিল উত্তম-সুচিত্রাকে, বাংলা ছবির জগতে। এরই জন্য আমরা, সেই দরিদ্র সাদা-কালো ছবির জগতের লোকেরা, পরের রঙিন ছবির সব প্রজন্মকে কিছুটা অনুকম্পাও করি। হায়, তাদের সমস্ত রঙ দিয়ে তারা সুচিত্রা-উত্তমের মতো কোনো অলোকিক জুটিকে উপার্জন করতে পারেনি।

আর এঁদের আবির্ভাব আর উপস্থিতির ইতিহাসলগ্নটির কথা যেন আমাদের মনে থাকে। স্বাধীনতা এসেছে কযেক বছর হল, কিন্তু নানা দফায় পূর্বপাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুর স্রোত আসছে পশ্চিমবঙ্গে, তাঁদের বিপর্যস্ত জীবনমৃত্যুসংগ্রামের চিহ্ন ছড়িয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবাংলা জুড়ে, খাদ্য আন্দোল তৈরি হচ্ছে একাধিকবার, দেশে বেকারি, অভাব বেড়েই চলেছে, কেন্দ্রে ও পশ্চিমবাংলায় রাজনৈতিক অস্তিরতা বাড়ছে, একচ্ছত্র জাতীয় কংগ্রে দল ভাঙছে—এই নানা দীনতা, সংকট ও গ্লানির মধ্যে বাঙালি যেন এক রূপকথার নিষ্কৃতি চাইছে উত্তম-সুচিত্রার ছবিগুলিতে, এক রোমাঞ্চকর পলায়ন-প্রস্থান। কে জানে এই পলায়ন, বাঙালির ফুটবল খেলার মতোই, বাঙালিকে কতটা স্বস্থানে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল ? ক্ষণকালের জন্যে হলেও ভুলিয়ে দিয়েছিল তার অস্বস্তিকর প্রতিবেশকে, বর্তমানকে !

সুচিত্রা সেনের কোন্‌ ছবি প্রথমে দেখেছিলাম ? সময়ক্রম ধরে বোধ হয় বলতে পারব না। ‘সবার উপরে’, না ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ? না কি ‘শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া’ ? না ‘সাড়ে চুয়াত্তর” ? যে যেটাই প্রথমে দেখু, সেই দেখা থেকে কোন্‌ বাঙালি তাঁর প্রেমে পড়েনি বলা শক্ত। বয়ঃসন্ধি উত্তীর্ণ কিশোর থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ পর্যন্ত এই জ্যোৎস্নাজোয়ারের টান এড়াতে পারেনি, এবং নিশ্চয়ই প্রচুর মেয়েও তাঁর প্রেমে পড়েছে। এই সব ছবি দেখতে দেখতে এক সময় তাঁকে বা উত্তম-সুচিত্রার ছবিকে ছেড়েও গেছি বুদ্ধিজীবী তকমা পাবার আকাঙ্ক্ষায়। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন বা বিদেশের আইজেনস্টাইন, বুনুয়েল, ভিত্তোরিয়ো দি সিকা, কুরোসোয়া, ওয়াইদা বা পরে তারকোভ্‌স্কি আমাদের মন জয় করেছেন। তখন এই ‘ছেলেমেয়েতে দেখা হল’, একটু খুনসুটির পর ভালোবাসা হল, ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি হল, তার পর সে সব চুকে গিয়ে আমরা সবাই যা চাইছিলাম সেই ইচ্ছাপূরক মিলন ও আলিঙ্গন হল--এই ফরমুলার ছবিকে এমনকি হাস্যকরও ভাবতে আরম্ভ করেছিলাম। তা ছাড়া এই তত্ত্বে পৌঁছেছিলাম যে, নরনারীর ব্যক্তিগত স্বপ্ন দেখানো এই সব ইচ্ছাপূরক ছবি এক হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীল, তা সমাজ ও ব্যবস্থার বর্তমান চেহারাকে ভালো বলে ভাবতে বাধ্য করে, সমাজ বদলের পথনির্দেশ বা ইঙ্গিত দেয় না। যাকে স্টেটাস কো বলে তা বজায় রাখতে উৎসাহ দেয়, পরিবর্তনের চেষ্টাকে নিরুৎসাহ করে। সে বিশ্বাস নানা ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও এখনও ছাড়িনি, কিন্তু পরে ভেবেছি, সমাজতত্ত্বের দিক থেকে তো ভাবা দরকার কেন এরকম একটি জুটি বাংলা চলচ্ছিত্রের ইতিহাসে এমন দুষ্প্রতিরোধ্য হয়ে উঠল, কেন অন্য জুটি তার ধারেকাছে পৌঁছোতে পারল না। বাংলা ছবির প্রযোজকরা উত্তম-সুচিত্রাকে বাজি রেখে যে জুয়া খেলতেন তাতে তাঁরা বিপুলভাবে জিতবেন এই স্বপ্ন দেখতেন। হিন্দি ছবিতে অবশ্য সুচিত্রার সাফল্য উত্তমের চেয়ে বেশি।

উত্তম চলে গেছেন দীর্ঘদিন, সুচিত্রা এই ক-বছর গেলেন। সুচিত্রাও কি চেয়েছিলেন বাঙালি তাঁর যৌবনকেই মনে রাখুক, সকলের কাছে তাঁর ওই যৌবনমায়াই সত্য হয়ে থাক, আর কিছু নয় ? ‘প্রণয়পাশা’ ছবির পর আর ছবি করলেন না তিনি, চল্লিশ বছরের মতো আত্মগুপ্তি আর আত্মনির্বাসন বরণ করে নিলেন, লোকচক্ষু থেকে নিজেকে আড়ালে সরিয়ে একেবারে একজন ‘প্রাইভেট সিটিজেন’ হয়ে গেলেন। কেন, সে প্রশ্নের স্পষ্ট আর সম্পূর্ণ উত্তর কবে পাওয়া যাবে কে জানে ?

ফলে তাঁর বয়স কত হয়েছিল, তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিবাহ, সন্তান-সন্ততি—এই সব প্রশ্ন তাঁর ওই চিরস্থায়ী মায়ামূর্তির কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। তিনি যা চেয়েছিলেন তাই হবে। আমরা তাঁর যৌবনপ্রতিমাকেই মনে রাখব। অন্তত আমাদের প্রজন্ম। হ্যাঁ, ইউটিউবের মাধ্যমে এখনকার প্রজন্মও নিশ্চয়ই তাঁর ছবিবুলি দেখে, কিন্তু জানি না তারা আমাদের সই শিহরন অনুভব করে কি না। জিজ্ঞেস করতে ভয় হয়। যদি তারা আমাদের আবেগ আর স্বপ্নকে ভেঙে দেয় ?



Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.