ভ্রমণ

ভ্রমণ

খাজুরাহো ভ্রমণ (এক)

লেখক : দেবাশিস দেব

খাজুরাহো ভ্রমণ (এক) শীত পড়লেই বেড়িয়ে পড়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে। মার্চ থেকে অক্টোবর কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবা যায় না। যেখানেই যাও চাঁদিফাটা রোদ। তাই শীত পড়লেই চার বন্ধু মিলে বেড়িয়ে পড়ি যদিও প্রচুর পারিবারিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়! এবারের গন্তব্য মধ্যপ্রদেশের ছতরপুর জেলার ছোট একটি শহর খাজুরাহো যেখানকার মন্দিরগুলোর মধ্যযুগীয় ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য খাজুরাহোকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি দিয়েছে। যেহেতু গমন ও গন্তব্যস্থল দুটোই আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং এই কোভিড অতিমারীতে সর্বজনীন যানবাহন বর্জনীয় তাই হণ্ডা কোম্পানির একটি চারচাকা গাড়ি আমাদের ভ্রমণের সাধন হিসেবে আমরা বেছে নিয়েছি। বলাবাহুল্য এই গাড়িটি অনেক রোডট্রিপে আমাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়েছে। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যেতেই আমাদের দলের ন্যাভিগেশন বিশেষজ্ঞ শক্তিপ্রসন্ন রুট ম্যাপের দায়িত্ব সাগ্রহে নিলেন। দুদিনে রাঁচি, ডাল্টনগঞ্জ, সাতনা হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম খাজুরাহো। যাত্রাপথের বিবরণ দিলে লম্বা হয়ে যাবে লেখাটি তাই দেওয়া গেল না যদিও দারুণ উপভোগ্য ছিল এই ৪৮ ঘণ্টা।

খাজুরাহো মধ্যপ্রদেশের ছোট একটি শহর। আমরা একটি বাংলাভাষী গাইডের খবর পেয়েছিলাম কলকাতা থেকেই। খাজুরাহো পৌঁছে রাতেই গাইড রাজু, ওরফে প্রণয় কর্মকারের সঙ্গে ফোনে কথা হল। সবকটা মন্দির ঘুরে দেখতে সারাদিন লেগে যাবে তাই সকালে নটায় বেরোতে হবে বলে রাজু আমাদের জানিয়ে রাখল। কথায় কথায় রাজু আমাদের জানাল ওরাই খাজুরাহোর একমাত্র স্থায়ী বাঙালি পরিবার। মাত্র ৩০০০০ মানুষের বাস এই শহরে।

সকালে উঠে আমি গাড়ি ধোয়ানোর লোক খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। দরজা খুলতেই মুখে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটায় থমকে গেলাম। ধূসর আকাশ, ঘন কুয়াশায় মোড়া ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট। হোটেলের উলটো দিকের ফুটপাথে একটি ছোট দোকান চোখে পড়ল; নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, সিগারেট, ইত্যাদি উপলব্ধ। বাইরে গ্যাসের উনুনে চা হচ্ছে। পাশে একটি আঙ্গোঠী মানে লোহার কড়াইতে আগুন জ্বলছে আর সেটির চারপাশে উবু হয়ে বসে জনাতিনেক মজদুর গোত্রীয় লোক বিড়ি টানতে টানতে হাত সেঁকছে। মাথায় উলের টুপি ও মোটা জ্যাকেট পরে বেরিয়েছি তাই ঠাণ্ডা সয়ে এসেছে, কিন্তু ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা – থুড়ি কাগজের কাপ দেখে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম চায়ের লাইনে। চায়ে চুমুক দিয়ে আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ করতেই দোকানদার মুঠোফোনে কাউকে ডেকে পাঠাল। খানিকবাদেই রোগাপটকা একটি কিশোর প্লাস্টিকের বালতি নিয়ে হাজির। দোকানের পাশের টিউব ওয়েল টিপে জল তুলে আমাদের ধুলাময় শকটটিকে অতি যত্নসহকারে পরিষ্কার করে দিল। আমি একশো টাকার একটি নোট দিতেই সলজ্জ চোখে কিশোরটি নোটটি পকেটে পুরতে গেল, কিন্তু তার আগেই দোকানদার উচ্চৈঃস্বরে বুন্দেলখন্ডী ভাষায় কিছু বলল। কিশোরটির ম্লান মুখমণ্ডল দেখে বুঝতে পারলাম এই নবীন কিশোর সাংসারিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ; ও বুঝতে পারেনি এই একশো টাকার সবটা ওর প্রাপ্য নয়। হয়ত পঞ্চাশ টাকাই ওর ভাগ্যে জুটবে, বাকিটা দোকানদার দালালি নেবে। সারা পৃথিবীই এই মাঝখানের মানুষগুলো চালাচ্ছে; এখানেও যে তাই হবে সেই রূঢ় সত্যটা মেনে নিতে কষ্ট হল, বিশেষত কিশোরটির আহত সারল্যের দিকে তাকিয়ে।

সকাল সকাল হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে জামাকাপড় পরে তৈরি হওয়ার আগেই রাজু বাইক নিয়ে হাজির। সময়নিষ্ঠ মানুষ দেখলেই আমার মন খুশি হয়ে যায়। আমাকে তৈরি দেখে জিজ্ঞেস করল সবাই রেডি কিনা।
‘দশ মিনিটে হয়ে যাবে,’ আমি জানালাম। আমি ভাবছিলাম রাজু কে সামনের সিটে বসতে বলব যাতে ওর রাস্তা দেখাতে সুবিধে হয় যদিও হণ্ডার পেছনের সিট তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু রাজু নিজেই মুস্কিলআসান করে দিল।
‘কাকা, আমি বাইকে আগে আগে যাবো, আপনারা আমাকে ফলো করবেন,’ হিন্দি উচ্চারণে বাংলা শুনতে বেশ ভালই লাগছিল আমার। রাজু বয়স তিরিশেকের যুবক। স্মার্ট, সপ্রতিভ রাজু পেশাদার গাইড; ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফরাসি ছাড়াও অনেকগুলো বিদেশি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। অতিমারীর প্রকোপে কাজকর্ম বছর দেড়েক বন্ধ হয়েছিল, এখন ধীরেধীরে আবার টুরিস্ট আসা শুরু হয়েছে, রাজু ক্ষোভ সহকারে জানাল।
‘আমি ইংরেজিতেই বলব, কাকা,’ রাজু আমাদের অনুমোদন চাইল। ‘বাংলা পারি বলতে কিন্তু মাঝে মাঝে আটকে যেতে পারি।’

আমরা সবাই সমস্বরে অনুমোদন দিলাম।
আমি স্টিয়ারিং এ, শক্তিপ্রসন্ন ন্যাভিগেশন সিটে – যদিও এখন তার দরকার নেই কেননা রাস্তা দেখানোর জন্য রাজু গাইড আছে। অম্লান আর সুশান্ত পেছনের সিটে। সকাল নটা, কিন্তু ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে রাস্তাঘাট। আমি গাড়ির স্ক্রিনে দেখলাম তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি দেখাচ্ছে।

আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা খাজুরাহোর পশ্চিম পরিসরের কাছে পৌঁছে গেলাম। আগেই বলে নেওয়া দরকার খাজুরাহোতে বর্তমানে ২০-২৫টি মন্দির রয়েছে এবং এগুলো মোটামুটি তিনটি ভৌগলিক পরিসরে, যথাক্রমে পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণে প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ১৮৫০ সালে ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক অ্যালেকজান্ডার কানিংহামের করা এই শ্রেণীবিন্যাস এখন সর্বজনগ্রাহ্য। এই মন্দিরগুলি হিন্দু ও জৈন দেবদেবীদের নামে উৎসর্গিত। ইতিহাস বলে দশম শতাব্দীতে এই মন্দির গুলির নির্মাণ শুরু হয়। চান্দেলা বংশের রাজা যশোবর্মণ এই মন্দির তৈরি শুরু করেন বলে জানা যায়। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কালিঞ্জরের চান্দেলা বংশদ্ভুত রাজারা বেশ প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিলেন এবং মধ্যভারতের পুরো বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে ওদের রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল। মধ্যযুগীয় শহর মাহোবা, যা চান্দেলা রাজাদের রাজধানী ছিল বলে জানা যায় তার থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে খাজুরাহো। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে রাজা চন্দ্রবর্মণ চান্দেলা বংশের প্রতিষ্ঠাতা। কথিত আছে একদা স্নানরতা রূপসী হেমবতীর রূপে মোহিত হয়ে স্বয়ং চন্দ্রদেব হেমবতীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হন এবং তারপর হেমবতীর একটি পুত্রসন্তান জন্মায়। কিন্তু হেমবতী তার বিবাহবহির্ভূত অবৈধসম্পর্কজাত পুত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে চন্দ্রদেবকে অভিশাপ দিলে চন্দ্রদেব হেমবতীকে আশ্বাস দেন যে এই পুত্র পরে স্বনামধন্য রাজা হবে। চন্দ্রবর্মণই সেই পুত্র। মৃত্যুর পর স্বপ্নে মা হেমবতী পুত্র চন্দ্রবর্মণকে আদেশ করেন মন্দির তৈরি করতে যেখানে সমস্ত মানবিক আবেগগুলি প্রতিফলিত হবে। যদিও এই কাহিনী নিয়ে দ্বিমত রয়েছে; অনেকেই এটা মনগড়া আষাঢ়ে গল্প বলে মনে করেন, তবে খাজুরাহোর মন্দির গুলির দেওয়ালের অতুলনীয় ভাস্কর্য দেখতে দেখতে এই কাহিনী যথার্থ বলেই মনে হয়। যশোবর্মণের পর রাজা ধঙ্গ ও রাজা বিদ্যাধরের নাম পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে মন্দিরের সংখ্যা আনুমানিক ৮৫টি ছিল বলে জানা যায়। তিনশো বছর ধরে তিলে তিলে তৈরি হয়ে আসা এই বিশাল কর্মযজ্ঞ যে কোন একজন রাজার জীবদ্দশায় সম্ভব নয় সেটা সহজেই বোঝা যায়। পশ্চিম পরিসরের মন্দিরগুলির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের কাছেই ছোটখাট একটি মার্কেট কমপ্লেক্স। ছড়িয়ে ছিটিয়ে জামা কাপড়, স্যুভেনির ও চা কফি ইত্যাদির দোকান। মাঝখানে ফাঁকা জায়গা গাড়ি রাখার জন্য নির্দিষ্ট করা। কিন্তু তিনটে বিশালবপু গোমাতা সেখানে শুয়ে আছেন। আমি কানফাটা হর্ন বাজালাম কিন্তু তিন গোমাতা অনড় অবিচল। শক্তি ও সুশান্ত গাড়ি থেকে নেমে হুসহাস করাতে অনিচ্ছা স্বত্তে ওঁরা গাত্রোত্থান করলেন বটে, কিন্তু উঠেই ক্রোধপ্রকাশের অভূতপূর্ব নমুনা রেখে গেলেন পশ্চাৎদেশ নির্গত কিলো তিনেক ধূমায়িত গোবরে। কি আর করা? কায়দা করে এদিক ওদিক করে গাড়ি পার্ক করলাম। ইতিমধ্যে রাজু গাইড জানাল টিকিট দেওয়া এখনও শুরু হয়নি। বলে রাখা আছে, শুরু হলে আমরাই প্রথম পাবো। বলা বাহুল্য আমরা সবাই বদখত মাস্ক পরে আছি, কেননা ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে কোভিড নিয়ম অনুযায়ী মুখোস পরে থাকা বাধ্যতামূলক। পানের দোকান দেখে আমি একটি বেনারসি পান খাব বলে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু দোকানদার বিরসমুখে জানাল, নেই। অগত্যা পানমশলা।

কোভিড নিয়ে সাধারণ মানুষের ভীতি তখনও কাটেনি তাই হয়ত গুটিকয়েক দর্শনার্থী গেটে দাঁড়িয়েছিল। চেহারাছবি দেখে বোঝা যাচ্ছিল এরা কেউই বঙ্গসন্তান নয়। সাধারণত ভারতবর্ষে যেখানেই বেড়াতে গেছি, বিশেষত শীতের দিনে, বাঁদর টুপি পরিহিত বাঙালি টুরিস্টের দেখা অব্যর্থভাবে পেয়েছি। যাইহোক টিকিট ইন্টারনেটে কাটতে হল। মোবাইলের স্ক্রিন দেখিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম।

এ এস আই – অর্থাৎ আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে খাজুরাহো মন্দিরের পরিসরটি পরিচ্ছন্ন ও সুবিন্যস্ত। বিশাল একটি পার্ক বলা যেতে পারে। সবুজ গালিচার মত ছেঁটে রাখা ঘাস, মাঝখান দিয়ে শানবাঁধানো হেঁটে যাওয়ার পথ। বাগানে সুদৃশ্য গাছগাছালি। মধ্য জানুয়ারির শীতের সকালের গাঢ় নীল আকাশ আর আরামদায়ক সোনালি রোদ আমাদের আমন্ত্রণ জানাল।

আগেই বলে নেওয়া ভালো আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই মন্দিরগুলো দেখতে আসিনি। সাধারণ দর্শকের ভূমিকায় আমরা কিছুটা ইতিহাস ও কিছুটা ভাস্কর্য – মধ্যযুগের ভারতবর্ষের কারিগরি কৌশল ও স্থাপত্যের নিদর্শন দেখার জন্যই এসেছি। যখন ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়গুলি রাজু আমাদের শোনাচ্ছিল, তখন হঠাৎ আমার মনে হল মন্দিরের সংখ্যা ৮৫ থেকে ২৫ হয়ে যাওয়ার কারণ কি? উত্তরে রাজু বলল, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক চান্দেলা রাজ্য দখল করে নেন। চৌদ্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর পরিব্রাজক ইবন বতুতার আরবি ভাষায় লেখা ভ্রমণকাহিনী ‘রিহ্লাহ’ তে খাজুরাহোর উল্লেখ আছে। তবে এর আগেও একাদশ শতাব্দীতে, যখন চান্দেলা রাজাদের স্বর্ণযুগ চলছিল তখন গজনীর সুলতান মামুদ চান্দেলাদের রাজ্য কালিঞ্জর আক্রমণ করেছিলেন। পারস্যের ঐতিহাসিক আল-বেরুনির উপাখ্যানে খাজুরাহোর বর্ণনা আছে। ইবন বতুতা লিখে গিয়েছেন কুতুবউদ্দিনের সময় থেকেই হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা শুরু হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সিকন্দর লোদীর রাজত্বকালেও প্রচুর মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। হিন্দু ধর্মাচরণের ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারী হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ মন্দিরে যাতায়াত বন্ধ করে দেন। ঘন বিন্ধ্যাচলের মধ্যে থাকা বর্তমানের এই মন্দিরগুলোর চারপাশে ততদিনে জঙ্গল গজিয়ে গেছে। ফলে এগুলো ধর্মোন্মাদনার বিধ্বংসী হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। অনেক শতাব্দী পরে, ১৮৩০ সালে ইংরেজ সারভেয়ার টী এস বারট ঘন জঙ্গলের মধ্যে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া খাজুরাহোর মন্দিরগুলি পুনরাবিষ্কার করেন।

এই পশ্চিমের মন্দিরগুলির মধ্যে বিখ্যাত দুটি মন্দির, লক্ষণ মন্দির ও কান্দারিয়া মহাদেব মন্দির ছাড়াও দেবী মণ্ডপ, বরাহ মণ্ডপ, দেবী জগদম্বা মন্দির ও মহাদেব মণ্ডপ এই চত্বরে রয়েছে। তবে সর্বোত্তম ও বৃহত্তম কান্দারিয়া মহাদেব মন্দির দেখার পর অন্যগুলো তেমন আকর্ষণীয় বলে মনে হয় না কেননা এই মন্দিরের গায়ের ভাস্কর্যগুলি নিখুঁত, অনবদ্য ও অতুলনীয়। রাজু বলল, যদিও অনেকগুলো মন্দির এই পরিসরে আছে কিন্তু এগুলোতে কোন পূজা হয়না। লক্ষণ মন্দিরের পাশে- আলাদা প্রবেশদ্বার সহ একটি ছোটখাট মন্দির আছে যেখানে নিত্যপূজা হয়। গুটিকয়েক ধর্মার্থীকে ঘণ্টা বাজিয়ে পূজা করতে দেখলাম। কিছু বিশালাকার বেলেপাথরের চাঁই, কিছু অর্ধসম্পন্ন মূর্তি, স্তম্ভ ইত্যাদি লক্ষণ মন্দিরের পেছনে ছড়িয়ে আছে। রাজু জানাল মন্দির তৈরির সময় এগুলো হয়ত বেশি হয়ে গিয়েছিল। মধ্যপ্রদেশ সরকার চত্বরের ভেতরে পরিচ্ছন্ন বাথরুমের বন্দোবস্ত করে রেখেছেন তবে রেস্টুরেন্টটি অতিমারীর প্রকোপে আপাতত বন্ধ আছে।

রাজু জানাল মন্দিরগুলি স্যান্ডস্টোন অর্থাৎ বেলেপাথর দিয়ে তৈরী। বিন্ধ্যপর্বতের পান্না জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া কেন নদীর গিরিখাদের আশেপাশে হলদে বেলেপাথরের অনেকগুলো পাহাড় আছে। বলা হয়ে থাকে ওই পাথর দিয়েই মন্দিরগুলি তৈরী করা হয়েছিল। তবে নবম শতাব্দীর স্থপতি ও বাস্তুকারদের অসাধারণ প্রকৌশল ও জ্যামিতিক জ্ঞান দেখে বিস্ময় জাগে যে মাপজোখ কতখানি নির্ভুল হলে কুড়ি টনেরও বেশি ওজনের মেগালিথ – বৃহদাকার প্রস্তরখণ্ড, শুধুমাত্র মরটীস ও টেনন জোড়ার সাহায্যে এবং কেবলমাত্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্যবহার করে হাজার বছর ধরে অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে! সর্ববৃহৎ কান্দারিয়া মহাদেব মন্দিরের উচ্চতা ১০৯ ফিট। শুধু এই মন্দিরটিতে প্রায় ৯০০ ভাস্কর্য রয়েছে। সব কটি মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্য অনবদ্য ও অতুলনীয়। এতে মধ্যযুগের সাধারণ মানুষের দিনযাপন ও ধার্মিক ধ্যানধারনার প্রকাশ দেখা যায়। রাজু জানাল হিন্দুধর্মে জীবনের চারটি পর্যায়ের চারটি আকর্ষণ যথাক্রমে ধর্ম, মোক্ষ, অর্থ ও কাম এই ভাস্কর্যগুলিতে দেখা যায়। যদিও মাত্র শতকরা ১০ ভাগ ভাস্কর্যে কামকলার বিবরণ আছে কিন্তু খাজুরাহোর মন্দিরগুলির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ বোধহয় এই রতিক্রিয়ার দৃশ্যগুলিই। তবে লক্ষ্যনীয় এই যে মধ্যযুগের ভারতবর্ষের মানুষেরা নারীপুরুষের শারীরিক মিলনকে অশ্লীল বলে মনে করতেন না। রাজু জানাল এক ঐতিহাসিকের মতে এই সঙ্গম দৃশ্যগুলি পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন, যা সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি না কেন ভাস্কর্যগুলির দৃষ্টিনন্দন আবেদন অনস্বীকার্য। রাজু ঠিকই বলেছিলঃ ইতিহাস ও ভাস্কর্যে মুগ্ধ হয়ে কতটা সময় কেটে গেছে আমাদের খেয়াল নেই। খিদে লাগতেই ঘড়ি দেখলাম। একটা বাজতে চলেছে।

পশ্চিমের পরিসর শেষ করে লাঞ্চ সেরে আমরা আবার গাড়ি করে বেরিয়ে পড়ি অন্য দুই পরিসরের মন্দির গুলো দেখার উদ্দেশ্যে। পূর্ব এবং দক্ষিণ পরিসরে মন্দিরের সংখ্যা কম এবং তুলনামূলক ভাবে নিম্নমানের। প্রথমেই পশ্চিম পরিসর দেখে নিলে পূর্ব বা দক্ষিণ পরিসর না দেখলেও চলে। আমরা যখন দক্ষিণ পরিসরের দুলহাদেব মন্দিরটিতে ঢুকলাম তখন লোহার মই বেঁধে মন্দির পরিষ্কার করার কাজ চলছে। কথা বলে জানলাম দুতিন বছর পর পর এই ধোয়ামোছা করা হয়। এই মন্দিরগুলোতে উল্লেখযোগ্য কোন বৈশিষ্ট্য দেখা গেল না। চৌষট্টি যোগিনী মন্দির একটু তফাতে। গাড়ি পার্ক করে এবড়ো খেবড়ো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হল। কিন্তু নিরাশ হলাম দেখে। মন্দির এখন নিতান্তই ধ্বংসস্তূপ। আজকের জন্য মন্দির দর্শন এখানেই শেষ।

বিকেল হয়ে এসেছে। শিবসাগর দিঘির জলে আকাশের রক্তিমাভা। গাড়ি রেখে আমরা খাজুরাহোর শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ঢুকলাম। রাজু আমাদের জন্য পছন্দ করে অর্ডার করল। মিষ্টি ও নমকিন সহযোগে দুকাপ করে চা খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরব। কিন্তু রাজু জানাল সন্ধ্যেবেলা আরেকবার পশ্চিম পরিসরে আসতে হবে। ৬টা থেকে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোয়ের টিকিট বলে রাখা আছে।। আমরা যখন আবার পার্কে টিকিট দেখিয়ে ঢুকলাম তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। রোদ পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে পড়তে শুরু করেছে। কানমাথা ঢেকে বসে পরলাম সার করে রাখা চেয়ারে। খানিক বাদেই অমিতাভ বচ্চনের ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরে চান্দেলা বংশের জয়গাথা শোনা গেল। সকাল থেকে রাজু আমাদের এসব নিয়েই বলেছে। যাইহোক, অন্ধকারের মধ্যে নিক্ষেপিত রঙিন আলোয় মন্দিরগুলি মাঝে মাঝে দৃশ্যমান হচ্ছিল। এক ঘণ্টার প্রোগ্রাম। শেষ হতেই আমরা উঠে পড়লাম। একদফা চা খেয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কাল সকালে পান্না চলে যাব, সঙ্গে নিয়ে যাব একরাশ স্মৃতি আর কিছু ছবি।


Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.