ভ্রমণ

ভ্রমণ

অচেনা নর্থ বেঙ্গলের পথে

লেখক : অন্তরা বিশ্বাস

অচেনা নর্থ বেঙ্গলের পথে

“এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বল তো?”
মনে পড়ে সেই বিখ্যাত গান সপ্তপদী সিনেমার! ঠিক সেই ভাবনা নিয়েই  গত গরমের ছুটিতে বেরিয়ে পড়েছিলাম কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ধরে নর্থবেঙ্গল। নর্থবেঙ্গল বলতে শুধু ওই দার্জিলিং আর পার্শ্ববর্তী ডুয়ার্স   বক্সার , জলদাপাড়া, খাসি, জয়ন্তী নয়, তার বাইরেও এমন কিছু জায়গা আছে। যে জায়গা গুলোয় জন সমাগম কিছুটা কম হয়।যেই দিন রাতে ট্রেনে উঠলাম। তার পরের দিন পৌঁছে গেলাম শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে নিউমাল নামে ছোট্ট এক স্টেশনে। ছোট্ট। কিন্তু সাজানো । ছিমছাম। মাল বাজারে এক পরিচিত দিদির বাড়িতে খানিক সময় কাটিয়ে ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়ে পড়লাম টাটাসুমোতে। পথের ধারে ধারে গাছের শোভায় প্রকৃতি যেন বার বার কাছে ডাকছে। বেশ কয়েকটা টি এস্টেট পড়ল। বিশেষত রেলিচেলা টি এস্টেটটি চোখ জুড়ানো।প্রতিটি চা গাছ আলাদা করে ভাগ করে সাজানো। মূলত চা পাতার কুঁড়ি তোলার ভিত্তিতে সেই বিভাজন।

আমরা দলে আটজন মতো ছিলাম। সকলেই মনের আনন্দে প্রকৃতির শোভা দেখতে এগিয়ে চলেছি। গাড়ি ধীরে ধীরে পাহাড়ের পাকদন্ডী ঘুরে ঘুরে উপরে উঠছে। গাড়ির ভিতর থেকে বাইরে নজর গেলে ততই পাহাড়ের গায়ে বাড়ি গুলো যেন ধাপে ধাপে সাজানো মনে হচ্ছে।মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি পড়ছে। পাহাড়ের গায়ে রাস্তা মাঝে মাঝেই এবড়ো খেবড়ো। কোথাও আবার পাহাড়ের গা বেয়ে ধস নেমেছে। এক সময় রাস্তার ধারে বড় বড় পাথরের চাঁই। তার পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে রাস্তা গেছে। আমরা বিকেলে পৌঁছে গেলাম পাবোং হোম স্টেতে। পাহাড়ের গায়ে সাজানো কটেজ। চারা পাশে গাছেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষেরা হোম স্টে টা চালায়। তারা তাদের সাধ্য মতো আথিতেয়তা করল। রাতের বেলা পাহাড়ের উপত্যকা ঘন অন্ধকারের মধ্যেও দূরে ছোট ছোট আলোতে শাণিত হয়েছিল। দূরের বাড়ি গুলোর আলো যেন জোনাকি! রাতের দিকে ঠান্ডা সামান্য বাড়তে থাকে।

পরের দিন ভোরের দৃশ্য আরও অপরূপ। ভোরের আলোয় মেঘেরা যেন হাতের কাছে নেমে আসছে। তাদের যেন মুঠো বন্ধি করে হৃদয়ের কোণে সাজানো যাবে।তার পর আমাদের গাড়ি ছুটে চলল পাহাড়ের পথ ধরে। পথে যেতে যেতে পড়ল রামধুরা ভিউ পয়েন্ট। সেখানে তিস্তা নদীর মোহনার একটা অপূর্ব দৃশ্য নজরে এল। ধীরে ধীরে রাস্তা ঘিরে পাইন গাছের সারি। কত বিচিত্র সব অর্কিড।

আমরা দুটো গাঁও ঘুরে দেখে নিলাম। ইচ্ছে গাঁও আর সেলেরি গাঁও।
ইচ্ছে  গাঁওটা সাজানো বাড়ি । এখানে সম্পত্তি লিজে নেওয়া যায়। ক্রয় করা যায় না। তারপর সেঁলেরি গাঁওতে যখন পৌঁছানো গেল তখন পাহাড়ে নেমেছে বৃষ্টি। বৃষ্টির জল আপন ছন্দে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে চলেছে। সেখানে জোঁকের কিছু উপদ্রব আছে। সারি সারি পাইন গাছ বৃষ্টির জলে স্নান করে মুগ্ধতায় দাঁড়িয়ে আছে।আমরা বাগরাকোট হয়ে সেখানে দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ সারলাম। ধামসা ভ্যালি ফোর্ট নজরে এল। সেখানে বহু পূর্ববর্তী সময়ের যুদ্ধ সামগ্রী কামান রয়েছে। বিট্রিশ শাসন কালে যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে।

পাহাড়ের কোল বেয়ে যত এগোনো যায় ততই মনোরম চিত্তাকর্ষক দৃশ্য হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। আমরা এগোতে এগোতে পাহাড়ের পাকদন্ডী বরাবর নামতে নামতে পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিম সীমান্তে এসে পৌঁছালাম। তখন বিকেল হয়েছে। রাস্তার এক ধারে পাহাড়ের পাথর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথাও ধস নেমেছে। রাস্তার উপর ধসের পাথর সব ক্রেনে করে সরানোর কাজ চলছে। চেক পোস্টে আমাদের পরিচয় পত্র নিরীক্ষণ করা হল। তার পর চেক পোস্ট পার করেই এখটা ব্রিজ পার হতেই শুরু হল সিকিম। সিকিম বর্ডারেও চেক পোস্ট রয়েছে। সেখানে চেকিং পর্ব মেটার পর খানিক এগিয়ে পাহাড়ের ঢালু রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি নীচের দিকে নামতে যাবে। এমন সময় এখন বিপত্তি এসে হাজির। রাস্তা মেরামতির জন্য যাতায়াত দুই ঘন্টার জন্য বন্ধ! কাজেই আমাদের সকলকে গাড়িতেই অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের ডেসটিনেশন ছিল সেবাস্টিয়ান হোম স্টে।যেটা ঋষিখোলা নদীর ধারে।পথ মাত্র দেড় কিলোমিটার। কিন্তু পাহাড়ি পথ। উঁচু নীচু। এবড়ো খেবড়ো।

আমার সহ যাত্রীরা তেমন কেউই গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে নারাজ। তারা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আমি আর একজন সহযাত্রী গাড়িতে বসে পথ খোলার অপেক্ষায় রইলাম।ঈশ্বরের অসীম কৃপায় পথ খুলে গেল কুড়ি মিনিট পর। তারপর গাড়ি পাহাড়ের সরু রাস্তার পাকদন্ডী ঘুরে ঘুরে ধীরে ধীরে এসে নামল এক নদীর তীরে। নদীটি স্বল্প খর স্রোতা। নদীর বুকে মাঝে মাঝেই ছোট বড় নানা আকারের পাথর পড়ে আছে। নদীকে ঘিরে পাহাড়। আর পাহাড়ের  ধাপে ধাপে শ্যামল উদ্ভিদের শোভা। সে এক মনোমুগ্ধকর অপরূপ সৌন্দর্য। যে সৌন্দর্যের বর্ণনা কলমে করা অসাধ্য। চাক্ষুস করার স্বার্থকতাই আলাদা।নদীর বুকে পাথরে অনেক ট্যুরিস্ট বসে আছে। তারা প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করছে। ঋষিখোলা নদী সিকিম আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবর্তী প্রান্তে অবস্থিত। নদীর একদিকে পশ্চিমবঙ্গ। আরেকদিকে সিকিম। দুই প্রতিবেশী রাজ্যের ঐক্যের পূণ্যভূমি। নদীর মাঝ বরাবর বাঁশ আর কাঠের গুঁড়ি দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। এক জায়গায় নদীর বুকে জলের স্রোত বেশ কিছুটা কম। তার উপর দিয়েই আমাদের টাটাসুমো নদীর বুক পার করে অপর তীরে পৌঁছাল। সন্ধ্যা নেমেছে। কালো কালি কে যেন লেপে দিয়েছে প্রকৃতির কোলে। পাহাড়ের বুকে গাছেরা নীরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সন্ধ্যা বেলা নদীর ধারে খানিক সময় কাটানোর পর আমরা সেই রাতে যে যার মতো কটেজে বিশ্রাম করলাম।

পরের দিন ভোর বেলা এক ছুটে নদীর ধারে চলে গেলাম। কী অপরূপ শোভা। দুই পাহাড়ের মাঝে মেঘেরা নেমে এসেছে। সূর্যের আলোয় পাহাড়ের মাথায় গাছের রঙে তিনটে স্তর দেখা যাচ্ছে। একদম উপরে সোনালি ,তারপর সাদা সবশেষে সবুজ। এই দৃশ্যের মোহনীয় আবেশ চাক্ষুস না দেখলে বোঝা যাবে না। নদীর জলের রঙ থেকে থেকে পরিবর্তন হয়ে  যায়। কারণ রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি। তবে জল অসম্ভব রকমের ঠান্ডা। হোম স্টের ব্যবস্থা পনায় যারা রয়েছেন, তারা শহর থেকে অনেক কষ্ট করে খাবার সহ অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে আসে। একটা বিষয় খুব ভালো লাগার মতো । সেটা হল এখানে মানুষ একে অপরকে সাহায্য করে। ধরুন রাস্তা সরু। দুই দিক থেকে মুখোমুখি যানবাহন চলে এলে তখন একদিকের যানবাহন পিছনে সরে জায়গা করে দেয় অপর যানবাহনকে চলে যাওয়ার জন্য। শহরের মতো তারা বিবাদে লিপ্ত হয় না। সকালে সূর্যের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বেরিয়ে পড়লাম লাভা গাঁওর উদ্দেশ্যে। ছোট্ট সাজানো শহর মুখী গাঁও। দিনের বেলাতেও বেশ ঠান্ডা। এখানে বাজার  বেশ জমজমাট। রয়েছে লাভা মনেস্ট্রি। গৌতম বুদ্ধ রয়েছেন মানুষকে আর্শীবাদ দেওয়ার জন্য। খুব সুন্দর ভাবে তিনটি তলায় আলাদা করে ভাগ করে রয়েছে লাভা মনেস্ট্রি। সৌন্দর্য আর ঐশ্বরিক শান্তি মিলে মিশে এক হয়ে রয়েছে। এরপর আমাদের ফেরার পালা। দিনের শেষে সময় যেন হাতের নাগালের বাইরে মুহূর্তে বেরিয়ে গেল। আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। পথে পড়ল রেলিচেলা নদী। নদী প্রায় মজেই গেছে। তার উপর সুবিস্তৃত বড় ব্রিজ। সেখানে খানিক প্রকৃতির নির্যাসকে নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম শহরের দিকে। পথে  পড়ল গরুবাথান টি এস্টেটটি। সেখানে চা বাগানের শোভা আমাদের মুগ্ধ করল। গাড়ির ড্রাইভার জানাল মাঝে মধ্যে এখানে ছোট চিতা বাঘের বাচ্চাও আসে। চা গাছ গুলো এক ভাবে পর পর সুন্দর করে ঋজুভাবে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেন বাক্যালাপে ব্যস্ত!

আমাদের আগরতলা এক্সপ্রেস সন্ধ্যা ছটায় ছিল। এখানে রাশ মুগ্ধতা নিয়ে দ্রুত নিউ মাল স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। আমাদের চার দিনের ছোট্ট ট্রিপ কখন যেন ফুরিয়ে গেল। সময়কে ধরা যায় না। কিন্তু মুহূর্তকে মনের কোণে ধরে রাখা যায়। যা সারা বছর বেঁচে থাকার জন্য প্রাণ চঞ্চল করে রাখে। আপনিও বেরিয়ে পড়তেই পারেন নর্থবেঙ্গলের এই অফ রুটে। শুধু ভালো গাড়ি আর ড্রাইভার পেলেই হল। সঙ্গে ঠিক ঠাক থাকার মতো হোম স্টে। সেগুলো আগের থেকেই বুকিং করে নেবেন।

তারপরেই “থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে , দেখব এবার জগৎটাকে, ” এই বলে বেরিয়ে পড়ুন।



Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.